হৃদমাঝারে পর্ব -১৪

#হৃদমাঝারে – [১৪]

নিজের প্রিয়জনদের কথা ভাবতেই মেহরিমার বুকটা হা হা করে উঠলো। একদিকে এতগুলা মানুষের জিবন আর অপর দিকে নিজের প্রিয়জনদের জিবন। কোন ছেড়ে কোনটা বেছে নিবে মেহরিমা তা ঠাউর করতে পারছে না সে। ফ্লোরে বসে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে কাঁদছে মেহরিমা। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ফারাহানের মুখটা।

– আর কত সময় নিবে মুন। ভিডিওটা দিয়ে দাও।

মুখ থেকে হাত সড়িয়ে সামনে তাকায় মেহরিমা। ডক্টর ইমরান খানের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলে,

– আপনি কি করে পারেন এতগুলা মানুষের জিবন নিয়ে খেলতে।

মেহরিমার কথার কোন জবাব না দিয়ে ব্যাঙ্গাত্বক হসি হাসে সে। তারপর বলে,

– তুমি ভিডিওটা দিবে নাকি এখনি ওদের কল করবো। শুধু একটা কলের অপেক্ষা। আমি একটা কে করবো আর সাথে সাথে তিনটা লাশ পরে যাবে।

– না। চিৎকার করে মেহরিমা। তারপর নিজের মোবাইলটা তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলে, এই নিন এটাতে আছে আর অপকর্ম। ডক্টর ইমরান তড়িৎগতিতে মোবাইলটা হাতে নেয়। যেন ওনি ওনার প্রান ফিরে পেল। ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে তার দুজন সহচারীকে ডেকে বলল, এই মেয়েকে তোরা আমার সামনে থেকে নিয়ে যা। আর হ্যাঁ এর সাথেও তোরা যা খুশি করতে পারিস। ডক্টর ইমরান খানের কথা শুনে লোক দিকে ললাসু দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকাতেই মেহরিমা কেপে উঠে। তার চোখে বিরাজ করছে ভয় আতঙ্ক। অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ডক্টর ইমরান খানের দিকে কিন্তু সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সে তো এখন মেহরিমার মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত। ডক্টর ইমরান খান রুম থেকে বেড়িয়ে যেতেই লোকদুটো হাতের তালু ঘসে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে মেহরিমার দিকে এগিয়ে আসে। ভয়ে মেহরিমার কুকড়িয়ে উঠে। না, না আমার কাছে আসবে না বলছি। কাছে আসবে না। না হলে আমি তোমাদের মেরে দিবো। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলে মেহরিমা। যদি ও হাতের কাছে কিছু পেয়ে যায়। যে করেই হোক ওকে তো বাচতে হবে। কিন্তু লোকদুটো ওর দুকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। মেহরিমা এবার চোখ গেলে টেবিলের উপর থাকা ছুড়িটার দিকে। দ্রুত উঠে গিয়ে ছুড়িটা হাতে তুলে নেয়। আর তাদের দিকে তাকা করে বলে, আমার কাছে আসবে না বললাম। মেরে দিবো। তোমাদের দুজনকেই মেরে দিবো। কিন্তু কে শুনে কার কথা। একটা লোক পিছন থেকে মেহরিমার হাত ধরলো অপর জন ওর হাত থেকে ছুড়িটা নিয়ে নিলো তারপর ওকে নিয়ে চলল বাড়ির বাহিরে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে ছটফট করতে থাকে মেহরিমার। ততক্ষণে লোকদুটো ওকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মুখের উপর শীতল কিছু পড়তেই চোখ বন্ধকরে নেয় মেহরিমার। তবে কি শেষ হয়ে যাবে ও।

চোখ খুলে নিজেকে একটা অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করে মেহরিমা। ধপ করে উঠে চারিদিকে চোখ বুলায়। বুঝতে বাকি রইলো না এটা ওদের-ই খামার বাড়ি। তখনি দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেলো। মেহরিমার বুঝতে বাকি রইলো না কেউ ভিতরে আসছে। মেহরিমা আবার আগের ন্যায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। একটা লোক ভিতরে এসে দেখলো মেহরিমা এখনো অঞ্জান হয়ে আছে সে বলে উঠলো,

– এই মেয়েটার কখন যে ঞ্জান ফিরবে। আমার তো আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না। এই শরীরের উপর আমার নেশা লেগে গেছে। উহ্ মেয়েটার ঞ্জান কেন ফিরছে না।

লোকটার কথাগুলো জড়ানো ছিলো। মেহরিমার বুঝতে অসুবিধা হলো না লোকটা নেশাক্ত। নেশার ঘোরে বলছে কথগুলো। মেহরিমা যতটা সম্ভব নিজেকে শক্ত করে নিলো। যে করেই হোক এই বিপদ থেকে তাকে বের হতেই হবে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন দেখলো মেহরিমা সাড়া দিচ্ছে না তখন লোকটা ফিরে যায়। আর যাওয়ার আগে নেশালো কন্ঠে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে গেলো।

লোকটা চলে যেতেই মেহরিমা উঠে বসে। নিঃশব্দ চরণে সামনে পা ফেলে এগোতে থাকে। বাড়ির পিছনে এগোতেই দেখলো কয়েকজন লোক মিলে গরুর ঘর পরিষ্কার করছে। মেহরিমা ঘরের পিছনের দিক দিয়ে নিঃশব্দে চলে আসে খামার বাড়ির বাহিরে। সরু চিকন রাস্তা ধরে সামনে দিকে দৌড়ে আসছে মেহরিমা। মাথাটা ভিষন ব্যাথা করছে তার। মাঝে মাঝে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে দৌড়াচ্ছে। কিছুসময় পর মেইন রাস্তায় এসে পৌছায় সে। মেইন রাস্তায় এসে এদিক ওদিকে তাকাতেই পিছনে হট্টগোলের শব্দ শুনতে পেলো। পিছনের দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল কয়েকজন লোক দৌড়ে ওর দিকেই আসছে। মেহরিমার আর বুঝতে বাকি রইলো না লোকগুলো কারা? কোন কিছু না ভেবে সামনের দিকে দৌড়াতে লাগলো। এদিকে মাথা ব্যাথাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছ যে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ দেখতে পেলো সামনের দিকে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে ওর দিকে। একবার মাথা ঘুড়িয়ে পিছনের দিকে তাকালো মেহরিমা। পিছনে লোকগুলো এখনো আসছে। মেহরিমার একবার মনে হলো এই লোকগুলোর হাতে পরার চেয়ে গাড়ির নিচে চাপা পরাটা ওর জন্যে ভালো হবে। তাই আর কোন কিছু চিন্তা না করে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর তখনি গাড়িটা দ্রুত ব্রেক করলো। ঘটনাক্রমে গাড়ির ভিতরের সবাই সামনের দিলে ঝুকে পরে। আর মেহরিমা এখনো চোখ বন্ধ করে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে দুজন লোক এসে মেহরিমার সামনে এসে দাঁড়াতেই তারা অবাক চোখে মেহরিমাকে দেখে বলে,

– মুন। এই মুন কি হয়েছে তোর?

চোখ খুলে সামনে তাকায় মেহরিমা। চোখের সামনে আকাশ ও তার বাবাকে দেখে মেহরিমার মুখে হাসির ঝলক দেখা যায়। মুখে হাসি ফুটলেও চোখে তার আতঙ্ক। তড়িৎগতিতে আকাশের বুকে ঝাপিয়ে পরে মেহরিমা। আর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আকাশ মেহরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আকাশের বাবা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওদের দুজনের দিকে।

সুফার চুপচাপ বসে আছে মেহরিমা। মেহরিমার পাশে বসে ওর এক হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে আকাশের মা। ওর সামনে বসে আছে আকাশ ও তার বাবা। মেহরিমা মাথা নিচু বসে আছে। আকাশে বাবা ওকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে উঠলো,

– কি হয়েছে মুন? এভাবে হই রোডে দৌড়াচ্ছিলে কেন?

মেহরিমা মাথা তুলে আকাশের বাবার দিকে তাকায়। মেহরিমার চোখ-মুখে আতঙ্ক। এটা দেখে আকাশের বাবা আবারও বলে উঠলো,

– কিসের এত ভয় পাচ্ছো মুন। ভুলে যেওনা আমি একজন সিনিয়র কমিশনড অফিসার। আমাকে তুমি সবটা বলতে পারো।

মেহরিমা বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে। মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বলতে শুরু করলো। ওর বাবা ও তার করা কাজের ব্যাপার এমনকি সেই ভিডিওটার ব্যপারে সবটা বলল। সব শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আকাশ ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– হ্যাঁ বাবা মুন ঠিক বলেছে। শিশু পাচার ওরগান বিক্রি স্মগলিং এমনি ড্রাগস সহ আরো অনেক অপকর্মের সাথে যুক্ত ইমরান আংকেল। আমি আর মুন মিলে থানায় একটা ডাইরি করে এসেছি।

– কিন্তু ওই পুলিশ ও বাবার টাকার কেনা গোলাম। মুন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল।

আকাশের বাবা মুনের মাথায় হাত রেখে বলল, আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি মা। আমি দেখছি ব্যাপারটা। আমার একটা বন্ধু আছে। সে সিনিয়র পুলিশ কমিশনার। ওর সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা করবো আর যত দ্রুত সম্ভব ইমরানকে ওর করা পাপের শাস্তি দিবো। তবে মুন আকাশ আমি চাইনা তোমরা এই বিষয়ে বাহিরে আলোচনা করো। তাতে তোমাদের বিপদ-ই বাড়বে বৈ কমবে না। নিজের খেয়াল রেখো মুন।

আকাশের বাবার কথা শুনে মুন এক টুকরো আশার আলো খুজে পেলো। এত চিন্তার মাঝেও তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো হাসি। অতঃপর বলল,

– আমরা কাউকে কিছু বলবো না আংকেল। তুমি তোমার বন্ধুর সাথে এই বিষয়ে কথা বল। আর যত দ্রুত সম্ভব ইমরান খানকে শাস্তুি দাও।

১১,
আজ দুদিন হলো মেহরিমার সাথে কোন যোগাযোগ নেই ফারহানের। মেহরিমা কলেজে আসছে না। কল করলে ফোন সুইচ অফ বলছে। ফারাহান মেহরিমার বাড়ির ঠিকানাটাও জানে না আর না আছে ওর বাড়ির কারো নাম্বার। মেহরিমাকে দেখতে না পেয়ে প্রায় পাগল হয়ে গেছে সে। সারাক্ষণ মেহরিমার চিন্তায় মগ্ন সে। পার্কিং লটে গাড়ির উপর চিৎ হয়ে শুয়ে মুখের উপর ক্যাপ দিয়ে রেখেছে ফারহান। মেহরিমার কথাই ভাবছে সে এখন। কি হয়েছে মেহরিমার? ওর নাম্বারটা বন্ধ কেন? আচ্ছা মেহরিমা ঠিক আছে তো! এরকম আকাশ পাতাল চিন্তা করছে সে। তখন ওর এক বন্ধ সুজন বলে উঠলো, ওই তো মেহরিমা আসছে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here