#হৃদমাঝারে
#নাইমা_জান্নাত
১৫)
দীর্ঘ রজনী। আকাশ জুড়ে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা ছড়ানো ছিটানো তারা! একটা তারা একটু বেশীই জ্বলজ্বল করছে হয়তো শুক’তারা! ছাদে রাখা বেলী ফুল গাছ থেকে মোহনীয় ঘ্রাণ বের হচ্ছে। এই মুগ্ধকর পরিবেশে ছাদের রেলিং এর পাশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ,শুভ্রতা। দুজনেই মুখেই কোনো কথা নেই,কিন্ত এই নিরবতা যেনো অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে। ছাদ থেকে সবাই নিচে নেমে শুতে চলে গেছে। সময় তো কম হলো না! ছেলে মেয়েদের আলাদা ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছে। মেঘ সেটা মানতে নারাজ! তার বিয়ে করা বউ অন্যরুমে ঘুমাবে কেনো? ফলস্বরুপ সে শুভ্রতাকে আটকে রেখেছে নিজের কাছে। তার ভাষ্যমতে আজ তারা রাত জাগবে।
আজ মেঘের কথা,আচরণ গুলো অন্যরকম ঠেকছে শুভ্রতার কাছে। এতোদিনের মেপে মেপে কথা বলা মানুষটার মুখে এইরকম কথা যতোটা না অবাক করে ততোটাই খুশি হয় শুভ্রতা। মানুষটাকে আজ একজন প্রেমিক পুরুষের থেকে কম লাগছে না। নাই’বা হলো সে আর পাঁচটা তথাকথিত নায়কদের মতো রোমান্টিক, নাই বা দিলো মিনিটে মিনিটে সারপ্রাইজ কিন্ত তার ছোট ছোট কেয়ার গুলোই শুভ্রতার কাছে যথেষ্ট ভালোবাসার জন্য!
ধমকা বাতাসে শুভ্রতার বিণুনী করা কিছু চুল সামনে বেরিয়ে আসে। শাড়ি চেঞ্জ করা থ্রি-পিছ পরে নিয়েছে আগেই! হলুদ মাখানো শাড়িতে তো থাকা যায় না। শুভ্রতা কিছু করার আগেই মেঘ আলতো হাতে শুভ্রতার চুল’গুলো কানের পিছে গুঁজে দিলো।
‘এই সময়টা না হয় এখানেই থেমে যাক!’ মনে মনে প্রার্থনা করে শুভ্রতা। কিন্ত সময়কি কারো জন্য অপেক্ষা করে? উঁহু। মেঘ দু’হাতে আলতোভাবে শুভ্রতার মুখটা উঁচু করে ধরে, শুভ্রতা মেঘের হাত ধরে ইশারায় ‘কি?’ জিজ্ঞাস করে। মেঘ কিছু না বলে শুভ্রতার কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দেয়। এটা নতুন না হলেও শুভ্রতার কাছে অনুভূতিটা সেই প্রথম দিনের মতোই। চোখ দু’টো বন্ধ করে নিঃশব্দে হাসলো। এই মানুষটাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এতোদিন ধরে হারানো সবকিছুর ক্ষতিপূরণ স্বরুপ এই মানুষটাকে যেনো পেয়েছে!
মেঘ আর শুভ্রতা দু’জনেই রেলিং এর উপর উঠে বসে। আভিয়ানদের বাসার ছাদের রেলিংটা বেশ মোটা,যার কারণে সহজেই উঠে বসে যায়। শুভ্রতা মেঘের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে। মেঘ নিজের প্রেয়সীকে আগলে রেখেছে।
‘শুভ্র! গান শুনবে?’ নিরবতা ভেঙ্গে মেঘ বলে। শুভ্রতার বুকে মাথা রেখেই মুখটা খানিক উঁচিয়ে বলে,,’আপনি শুনাবেন?’
মেঘ কিছু বললো না। শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে সময়টা উপভোগ করার চেষ্টা করে।
‘কিছু কিছু কথা বসে আছে ভিজে
মিছি মিছি ব্যাথা হয়নি যে নিজে
ঝরে যাওয়া পাতা জুড়ে বসে ডালে
মেঘে মেঘে কথা শুনে সে আড়ালে।
আকাশ যখন গাইবে বলে
আকাশ যখন গাইবে বলে বাদলেরই গান..
বাতাস তখন বইতে গিয়েও দেখায় অভিমান
অভিমান…
আকাশ যখন ফিরতি পথে মন খারাপের সুর
বাতাস তখন নিরব চিঠি পাঠায় বহুদূর
বহুদূর…
কিছু কিছু ধুলো জমে আছে কাঁচে
ডাকনামগুলো ভীষণ ছোঁয়াচে
মরে যাওয়া জমি ভীজে গেলো জলে
চারাগাছ’গুলো কতো কি যে বলে…
তোমার এমনি আসা,এমনি যাওয়া
এমনি হাজার ছল,সাজিয়েছ যেন
তোমার এমনি খেলা খেয়াল খুশি
করছে কোলাহল,থামেনি এখনও
চুপিচুপি দেয়াল জুড়ে আঁকছি কতো
মন কেমনের পাতা
চুপিচুপি জানতে পেলাম নিরুদ্দেশে
মায়ার চাদর পাতা..
কিছু কিছু কথা বসে আছে ভিজে
মিছি মিছি ব্যাথা হয় নি যে নিজে
ঝরে যাওয়া পাতা জুড়ে বসে ডালে
মেঘে মেঘে কথা শুনে সে আড়ালে..
আকাশ যখন গাইবে বলে বাদলেরই গানে
বাতাস তখন বইতে গিয়েও দেখায় অভিমান
অভিমান…..
গান শেষ করে চোখ খুলে শুভ্রতার দিকে তাকায় মেঘ। এতোক্ষণ গানটা সে চোখ বন্ধ করে গাইছিলো। আর শুভ্রতা মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মেঘ যে এতোভালো গান গাইতে পারে তার জানা ছিলো না। ইশ যদি জানতো তাহলে প্রতিদিন একটা করে গাইয়ে ছাড়তো। মেঘ তাকাতে দু’জনের চোখাচোখি হয়ে যায়।
মেঘ ইশারায় ‘কেমন হয়েছে?’ জিজ্ঞাস করলে শুভ্রতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,’খুব সুন্দর। আপনি এতো ভালো গান আমি জানতামই না!’
মেঘ মুচকি হেসে শুভ্রতাকে নিজের দিকে টেনে দু’হাতে শুভ্রতার কোমড় আঁকড়ে বলে,,’ম্যাডামের তাহলে ভালো লেগেছে বলুন!’
‘হুম অনেক!’ শুভ্রতার মেঘের কাঁধে দু’হাত দিয়ে বলে।
‘তাহলে আমার গিফট পাওয়ার অধিকার আছে! আমার গিফট?’
‘এ ্যাহ আমি কি আপনার জন্য গিফট নিয়ে ঘুরি নাকি? নাকি আমি জানতাম আপনি গান গাইবেন আমাকে গিফট দিতে হবে!’ শুভ্রতা ভেংচি কেটে বলে।
‘কিন্ত আমার যে গিফট চাই!’
‘আমার কাছে কিছু নেই। আপনি নিতে পারলে নিয়ে নিন কিছু!’
শুভ্রতার এই কথার অপেক্ষায় হয়তো ছিলো মেঘ। শুভ্রতার কথা শেষ হতেই মেঘ অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। শুভ্রতার ওষ্ঠের সাথে নিজের ওষ্ঠ মিলিয়ে দেয়। মেঘ আকস্মিক কাজ হতবম্ভ হয়ে যায় শুভ্রতা! কিছুক্ষণ পর মেঘ শুভ্রতাকে ছেড়ে দেয়। শুভ্রতা ছাড়া পেতে নাক মুখ কুঁচকে বলে,,
‘এই আপনি সত্যি আমার বর তো? এখানে আসার পর মাঝখানে আমার বর হাওয়া হয়ে গেছিলো। তখন নিশ্চয়ই আপনি আমার বরকে আটকে ওর জায়গায় নিজে চলে এসেছে! আমার ওই রস কষহীন বর এই সব কোনোদিন করতো না। আল্লাহ এখন তো মাঝরাত,এইসময় উনারা বের হন। তবে কি আপনি! থু থু। এই আমার বর কই? আমার ওই রস কষহীন বরই ভালো। ওইডা কই?’
শুভ্রতার মেঘ মেঘ খানিক জোরেই হেসে দেয়। শুভ্রতার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,’তোমার বরকে আমি ভ্যানিস করে দিয়েছি।’
কথাটা বলে দু’জনেই হেসে উঠে। শুভ্রতাকে হাই তুলতে দেখে মেঘ বলে,,’ঘুম পাচ্ছে?’
‘হুম।’
‘আচ্ছা চলো। এখন গিয়ে শুয়ে পড়। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তো!’
‘আচ্ছা চলুন।’ তারপর দু’জন মিলে নিচে নেমে গেলো।
_________________
‘মেঘ এটা কোনো কথা হলো? এভাবে কেউ বিয়ে বাড়ি থেকে চলে আসে?’ শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে। মেঘ শুভ্রতার শাড়ি ঠিক করতে করতে বলে,,’আমি কি বলেছিলাম? কিছু জিনিসের অধিকার ব্যক্তিগত ভাবে শুধুই আমার। এখন নড়াচড়া বাদ দিয়ে ঠিক ভাবে দাঁড়াও। আবার ফিরে যেতে হবে!’
শুভ্রতা ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়ে। আসলে মেঘের মা ঠিকই বলেছে তার ছেলে একটা ঘাড়ত্যাড়া!
শুভ্রতা বিয়ে বাড়ির ঘটনা ভাবতে লাগে। বিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য সবাই তৈরি হওয়ার জন্য উঠলে মেঘ এসে শুভ্রতাকে নিয়ে খালার কাছে যায়।
‘খালামণি,আমি আর ও একটু বাসায় যাবো। বরযাত্রী বের হওয়ার আগে আগেই চলে আসবো!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা কিছু বুঝতে পারলো না। তাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
‘কেনো রে মেঘ। কোনো সমস্যা হয়েছে এখানে? আসলে এতো কাজের মধ্যে আমি ঠিকমতো তোদের খেয়াল রাখতে পারছি না। শুভ্রতা মা, তোমার কোনো অসুবিধে হয়েছে?’
মেঘের খালার কথায় শুভ্রতা বলে,,’না না খালামণি আমার কোনো অসুবিধে হয় নি।’
‘কি হয়েছে সেটা আমি বুঝলে তো আপনাকে বলবো’ মনে মনে কথাগুলো বলে শুভ্রতা।
‘আসলে খালামণি,ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য যে জামা নিয়েছিলাম,ভূল করে ওই ব্যাগটা রেখে এসেছি। এখন রেডি হওয়া লাগবে তো। আর এখানে অনেক ভীড়ও বাসা থেকে এনে আবার এখানে রেডি হওয়া সম্ভব নয়। তাই ভাবলাম ওখান থেকে একেবারে রেডি হয়ে যোগ দিবো। তুমি চিন্তা করো না এখন মাত্র সাড়ে দশ’টা আমরা সাড়ে বারোটার মধ্যে চলে আসবো। তারপর আমি এসে আভিয়ানকে রেডি করে আমরা সোয়া একটার মধ্যে রওনা দেবো!’
‘আচ্ছা বাবা। তুই যা ভালো বুঝিস। তুই তো ছেলের মাঝে বড়। তোর উপরই সব দায়িত্ব। আমি ভরসা করি তোকে। সাবধানে যাবি,আসবি।’ তারপর মেঘ,শুভ্রতা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে।
‘আপনি খালামণিকে মিথ্যে বললেন কেনো?’
‘কই মিথ্যে বললাম। যে শাড়ি এনেছো সেটা আমার পছন্দ নয়,তাই বাসায় যাচ্ছি.’
‘আমি তো আপনাকে জিজ্ঞাস করেই এনেছিলাম!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ হাটা থামিয়ে সিএনজি ডাকে। তারপর উঠতে উঠতে বলে,,’শোন শুভ্র! তুমি যদি ওই বাসায় এখন রেডি হতে,আমি তোমাকে সাজাতাম কি করে? তাই আমরা বাসায় যাচ্ছি। আর কোনো কথা বলবা না। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে!’
মেঘের কথায় শুভ্রতার মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়! এই কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছে!
________________________
‘হয়ে গেছে!” মেঘের কথায় শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে। তারপর আবার দু’জনে ওই বাসার জন্য বেরিয়ে যায়।
‘আপনি একেকটা কান্ড এরকম করেন না? একদিন না হলে কি খুব বেশী ক্ষতি হতো?’ শুভ্রতার কথায় মেঘ সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,,’আমি যদি একদিন তোমার সাথে না থাকি, তবে কি ক্ষতি হবে?’
মেঘের কথায় শুভ্রতা তড়িৎ গতিতে মেঘের দিকে তাকায়। মেঘের মুখ দেখে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে। মেঘ কথাটা বেশ গভীর ভাবেই বলেছে। শুভ্রতা মেঘের হাত ধরে বলে,,’সেটা আমি মানতে পারবো না!’
‘তাহলে আমিও মানতে পারবো না!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা মুচকি হাসে। উঁহু মানুষটা ভূল নয়।
বিয়ে বাড়িতে এসে শুভ্রতা মাহিদের কাছে চলে যায়। মেঘ আভিয়ানের কাছে যায়। এরপর সবাই মিলে কনের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
পুরো বিয়েটা শুভ্রতা খুব সূক্ষ্ম ভাবে দেখেছে। পুরোটা সময় মেঘ শুভ্রতার পাশেই ছিলো। শুভ্রতার আজ নিজের বিয়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে।
________________
সবাই ফটো তুলতে ব্যস্ত। যে যা পারে শুধু ক্লিক করতে থাকে। পরে দেখে দেখে ভালো খারাপ নির্বাচন করবে। শুভ্রতার কোনো কালেই ফটোশুটে আগ্রহ ছিলো না। তাই চুপচাপ বসে আছে। মেঘ রাস্তার দিকে গিয়েছে,তাদের ফেরার সময় হয়ে এসেছ। গাড়ি এসেছে কিনা এইসব তদারকি করতে গিয়েছে। শুভ্রতার একা একা ভালো লাগছে না দেখে সেও উঠে সেদিকে যায়।
খানিকটা আগানোর পর মেঘের সাথে একটা মেয়েকে চিপকে থাকতে দেখে শুভ্রতা থম মেরে দাঁড়িয়ে যায়। মেঘের প্রায় গা ঘেঁষে ছবি তুলছে একটা মেয়ে। শুভ্রতা তা দেখে পা চালিয়ে সেদিকে যায়। আজ মেঘের খবরই আছে।
চলবে..?
(ভূল