হৃদমাঝারে পর্ব -১৬

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১৬)

বিদায়ের বেলা সবসময়ই কষ্টকর। একটা মেয়ে যখন নিজের চিরচেনা বাড়ি থেকে অন্য অচেনা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয় তখন তার মনের অবস্থা কেমন হয়,সেটা শুধু একটা মেয়েই জানে। এর পর থেকে নিজের বাবার বাসায় আসলেও দু’দিনের অতিথি ছাড়া আর কিছুই নয়। সবাই গাড়িতে উঠে পড়েছে। কেউ কেউ ফিরেও গিয়েছে। কাজিন মহল,মেঘ,শুভ্রতা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আভিয়ানের বউয়ের বিদায় শেষ হলে রওনা দিবে। শুভ্রতা এককোণায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে,এখন আবার প্রিয়া (আভিয়ানের বউ) এর কান্না দেখে নিজের হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ব্যাপারটা কি অদ্ভুত না? সে নিজের বিয়েতে কাঁদে নি, এখন অন্যের বিয়েতে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! মেঘ এসে শুভ্রতার পাশে দাঁড়ালে শুভ্রতা কিচ্ছু বলে না, মেঘের থেকে সরে গিয়ে মাহির পাশে দাঁড়ায়। মাহি শুভ্রতাকে দেখে মুচকি হাসে। মেয়েটার চোখেও পানি চিকচিক করছে,হয়তো প্রিয়ার কান্না দেখে!
শুভ্রতা কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতে লাগলো।
মেঘের পাশে একটা মেয়েকে দেখে শুভ্রতা সেদিকে এগিয়ে যায়। শুভ্রতাকে দেখে মেঘ ছিটকে দূরে সরে যায়। শুভ্রতা তা দেখে তীক্ষ্ম চোখে তাকায় মেঘের দিকে। যেনো চোখ দিয়েই মেঘকে ভষ্ম করে দিবে। মেঘ দু’টো ঢোক গিলে বলে,,’আরে শুভ্র! আসো। ও হলো আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড। প্রিয়ার কাজিন!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা জোরপূর্বক হেসে বলে,,’ওহ!’

‘হেই মেঘ। এটা কে?’ সুমাইয়ার কথায় মেঘ মুচকি হেসে বলে,,’মিসেস আবরার আওসিফ!’
মেঘের কথা হয়তো মেয়েটার পছন্দ হয় নি। মুখটা হাওয়া ছাড়া বেলুনের মতো চুপসে গেলো। শুভ্রতা তা দেখে পৈচাশিক আনন্দ পেলো।
‘দেখ শাঁকচুন্নি। এবার কেমন লাগে। আমার বরের সাথে নিকনিক করতে এসেছিস তাই না? তোর চিপকে থাকা আমি বের করছি!’ শুভ্রতা মনে মনে কথাগুলো বলে।
এর মাঝে আভিয়ান কোনো একটা প্রয়োজনে মেঘকে ডাক দিলে মেঘ “আসছি।’ বলে সেখান থেকে সটকে পড়ে। শুভ্রতা মেকি হাসি দিয়ে সুমাইয়ার দিকে তাকায়। সুমাইয়া ‘আচ্ছা আসছি।” বলে যেতে নিলে শুভ্রতা আটকে দেয়।

‘সে কি আপু,আপনি আমার স্বামীর বান্ধুবি একটু গল্প করবো না?’ শুভ্রতার কথায় সুমাইয়া ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রয়।
‘আপনারা একসাথে পড়ালেখা করেছেন?’
‘হ্যাঁ আমি আর মেঘ তো বেস্টফ্রেন্ডের মতো ছিলাম। মেঘ আমায় কতো হেল্প করেছে!’ সুমাইয়া আরো কিছু বলতে নেবে এর আগেই শুভ্রতা থামিয়ে দিয়ে বলে,,’আরে আপু। আপনার মেকাপ অনেকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে তো! এই দেখুন কাজলটা (কথাটা বলে শুভ্রতা হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে মুছে দেয়)।
‘ওহ থ্যাংস। আসলে তাড়াহুড়োতে ঠিকমতো সবটা হয় নি।’
দু’জনের কথা বলার মাঝেই একটা বাচ্চা হাতে দই নিয়ে হেটে আসছিলো। শুভ্রতাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় শুভ্রতা আরে পিচ্চি বলে বাচ্চাটাকে ধরতে নেয়,তখন সুযোগ বুঝে পুরো কাপটা সুমাইয়ার জামায় ঢেলে দেয়। সুমাইয়া ছিটকে সরে যায়।

‘এই এটা তুমি কি করলে? দেখে চলতে পারো না? আমার পুরো জামাটাই নষ্ট করে দিলে!’ সুমাইয়ার চিল্লানীতে ভয় পেয়ে বাচ্চাটা দৌড়ে পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে,,’ও মা ভূত!’
বাচ্চাটার কথায় শুভ্রতা আস্তে করে কেটে পড়ে। সুমাইয়া নিজের জামার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়। সেখানে নিজের অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠে। তার মুখের অনেক জায়গায় কালো কালো কাজল লেপ্টে আছে, মুখের মেকাপ খানিকটা উঠে গেছে,কিছুটা আছে। নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যায়। তার মানে এসব শুভ্রতার কাজ।
‘দেখ শাঁকচুন্নি কেমন লাগে এবার! অন্যের বরের সাথে নিকনিক? নেহাত বিয়ে বাড়ি বলে আর কিছু করলাম না। নইলে তোর একদিন কি আমার একদিন। এবার আমার বরটা কই? ওটাকে ধরতে হবে। কি সাহস,বলে কিনা ভার্সিটি ফ্রেন্ড!’ রাগে গজগজ করতে করতে শুভ্রতা চলে যায়!

‘ভাবী কি ভাবছো?’ মাহির কথায় শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে। মাথা নেড়ে বলে,,’কিছু নাহ। চলো যাবার সময় হয়ে গিয়েছে!’ কথাটা বলে শুভ্রতা আগে আগেই গাড়িতে উঠে পড়ে। সে কিছুতেই মেঘের সাথে যাবে না। মেঘের পাশে বসবেও না। থাকুক অন্য মেয়েকে নিয়ে,সেল্ফি তুলুক। কই তার সাথে তো কোনো সেল্ফি তুলে নাই। তাহলে সে কেনো কথা বলবে? বলবে না কথা। কিছুতেই না। শুভ্রতার পাশে সিট খালি না পেয়ে মেঘ অন্য জায়গায় বসলো। ম্যাডাম যে ক্ষেপে গেছে সেটা ভালো ভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছে।
________________
‘মেঘ বাবা কিছু জিনিস একটু আনা লাগবে। তুই প্লিজ গিয়ে নিয়ে আসতে পারবি?’ মেঘের খালার কথায় মেঘ সম্মতি দিয়ে বলে,,’আচ্ছা। আমায় লিস্ট দাও। আমি নিয়ে আসছি!’ মেঘ নিজের খালার থেকে লিস্ট নিয়ে মার্কেটে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। বাসার সামনে শুভ্রতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাক ছাড়ে,,’শুভ্র!’ শুভ্রতা পেছন ফিরে মেঘকে দেখে ভেংচি কাটে। মেঘ দ্রুত পা চালিয়ে শুভ্রতার কাছে আসে।
‘শুভ্র। মার্কেটে যাচ্ছি। তুমি যাবে?’
শুভ্রতা কিছু না বলে চুপ করে আছে।
‘চুপ থাকা কি সম্মতির লক্ষণ?’
শুভ্রতা এবারও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ তা দেখে হাত ধরে বেরিয়ে যায়।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। কিন্ত একটাও খালি সিএনজি পাচ্ছে না। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। লিস্টে রুম সাজানোর জিনিসও আছে। ঠিক সময় না নিলে সাজানো কমপ্লিট হবে না।
‘উফফ। সিএনজি ছাড়ুন। বাসে চলুন!’ শুভ্রতা বিরক্ত হয়ে বলে।
‘কিন্ত বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে?’ মেঘ শুভ্রতার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে। শুভ্রতা রাগি দৃষ্টিতে তাকাতে মেঘ একটা অটো নিয়ে বাসস্টপে যায়। এখান থেকে আভিয়ানদের বাসা অনেকটাই দূর। সব জিনিস এক জায়গা থেকে নেবে বলেই মূলত মার্কেটে এসেছে।
‘আপনার কাছে বেলুন আছে না?’
‘হ্যাঁ আছে। কেনো?’
‘দিন।’ মেঘ শুভ্রতার দিকে একটা বেলুন এগিয়ে দিতে শুভ্রতা তা ফুলিয়ে নিজের থ্রি-পিছের সাথে পিট করে নেয়। তারপর বড় করে পেটের উপর ওড়না দিয়ে দেয়। দেখে একজন প্রেগন্যান্ট মহিলার থেকে কম লাগছে না। শুভ্রতার কান্ডে মেঘ হা হয়ে যায়। অটো থেকে নেমে দু’জনে বাসে উঠে পড়ে। পুরো বাসে মানুষে ভর্তি। শুভ্রতাকে প্রেগন্যান্ট ভেবে একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বসতে দেয়। পাশে হয়তো ছেলেটির বন্ধু। মেঘ তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,’ভাইয়া আমার বউ প্রেগন্যান্ট তো। যদি কোনো সমস্যা হয়। আমি ওর পাশে বসি?’
মেঘের কথায় ছেলেটিও উঠে যায়। শুভ্রতা তা দেখে মেঘের কানে ফিসফিস করে বলে,,”আমাকে দিয়ে নিজের জায়গাটাও করিয়ে নিলেন?’
আসলে কি বলো তো,তোমাকে আমি যতোটা গবেট ভেবেছি,তুমি তার থেকে অনেক চতুর। কার বউ দেখতে হবে না?’ মেঘের কথায় শুভ্রতা ভেংচি কেটে ঠিক ভাবে বসে। কিন্ত বেলুন জিনিস কি স্থির থাকে? তাও শুভ্রতা যতোটা সম্ভব ঠিকভাবে রাখার চেষ্টা করে।
________________
“কি গো বউ। বাচ্চা-কাচ্ছা কিছু নিবা না? বিয়ে হইছে কয়েকমাস তো হই গেলো। কোনো খবর আছে নাকি?’
বয়স্ক একজন মহিলা কথাটা বলে। শুভ্রতার তার দিকে তাকিয়ে মহিলাকে চেনার চেষ্টা করে,মনে পড়েছে এটা আভিয়ানের ফুফি। শুভ্রতা কিছু না বলে সৌজন্যমূলক হাসি হাসলো। বিয়ে বাড়িতে আসবে এসব শুনবে না তা কি হয়! শুভ্রতা কিছু বললো না। পাশেই মেঘ বসে চা খাচ্ছিলো। বিয়ে বাড়িতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেঘ চা খাওয়া বন্ধ করে আভিয়ানের ফুফিকে বলে,,’ফুফি,তোমার ছেলের বিয়ে হয়েছে কয়দিন হয়েছে?’
‘এই দু’বছর হবে কেনো?’
‘কয়টা ছেলে-মেয়ে?’
‘আরে এখনও একটাও হয় নি রে। কতো বলি তাও কানে নেয় না! বলে সবকিছুর একটা সময় আছে,প্ল্যানিং আছে!’

মেঘ এবার মুচকি হেসে বলে,,’তোমাএ ছেলের যদি সময়,প্ল্যানিং থাকে,তবে আমাদের থাকবে না কেনো? আমার বাচ্চা বউয়ের মাথায় এসব ডুকিও না এখন! সময় আসলে সবাই সু’খবর শুনবা!’
মেঘের শান্ত স্বরের উত্তর উনার পছন্দ হয় নি। জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,’আজ কালকার ছেলে পুলেদের কিছু বলা যায় না, যদি বলি একটা কথা শুনিয়ে দেয় তিন কথা। যা ইচ্ছে কর। আমাদের কি?’ কথাটা হলে মহিলাটি ওখান থেকে চলে যায়। শুভ্রতা মুচকি হাসে।

‘এই আপনি আমাকে বাচ্চা বউ বললেন কেনো? আমি বাচ্চা?’
‘নাহ তুমি বাচ্চা বউ।’ কথাটা বলে মেঘ শুভ্রতার নাক টেনে দেয়।
‘আচ্ছা উনি তো ঠিকই বলেছে,আমার বিয়ের কয়েক মাস হয়েছে। বাবু..’ আর কিছু বলার আগেই মেঘ থামিয়ে বলে,,’একটা বাচ্চাকে নিয়েই আমার অবস্থা কাহিল,আরেকটা পারবো না!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,,’এতোই যখন বাচ্চা তবে রাতে বাচ্চার কাছে আসেন কেনো?’
‘আমার বউ আমি আসি কার কি?’ মেঘ শুভ্রতার কাছে এসে বলে।
‘এরপর থেকে কাছে আসলে,শিশু নির্যাতনের মামলা করবো!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ হেসে দিলো। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কাউকে দেখতে না পেরে টুক করে শুভ্রতার গালে ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে গটগট করে হেটে চলে গেলো। মেঘের কান্ডে শুভ্রতা ফিক করে হেসে দিলো।

চলবে..?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here