হৃদয়ঙ্গম পর্ব -০৩ ও শেষ

#হৃদয়ঙ্গম
#পর্ব_৩(অন্তিম পর্ব)
#তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী

“নীলা তু,তু,তুমি এখানে কীভাবে?” কয়েক পা পিছিয়ে গেল পাবেল। ব্রিজের রেলিং শক্ত করে ধরে রাখল যাতে নিচে পড়ে না যায় কোনোভাবে। নিজের উপর যেন নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রায় হারিয়ে ফেলছে পাবেল।

নীলা হাসছে। মুখে একটা হাত আলতো করে চাপা দিয়ে হাসছে। কিন্তু কিছু বলল না নীলা।

নীলা দাঁড়িয়ে আছে পাবেলের সামনে এটা পুরো অবিশ্বাস্য! কপাল বেয়ে ঘামের আস্তরণ তৈরি হলো ওর। কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। নিজের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারাবে এবার পাবেল।

“ভয় পাচ্ছো কেন?” হাসি থামিয়ে নীলা বলল।

“এ হতে পারে না,” মনে মনে বলল পাবেল। চোখ বন্ধ করে আস্তে করে একবার বড়ো শ্বাস নিল। আবার শ্বার বের করে আবার শ্বাস নিল। এভাবে কয়েকবার করার পর। আস্তেধীরে চোখ খুলল। এবার নীলা নেই ওর সামনে। যাক! এতক্ষণ ও স্বপ্ন বা হ্যালুসিনেশনের স্বীকার হয়েছিল হয়ত। মনের ভুল এসব। আরেকবার ঘুরে নদীর দিকে তাকালে পাবেল। নদীর স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ওর নীলার ছবিটা৷ ওর নিজেরি ভুল ছিল। ভালো করে ছবিটা ধরে রাখতে পারেনি। স্মৃতির গহীনে হারিয়ে গিয়েছিল। যাক, ওর অনেক ছবি আছে পাবেলের কাছে।

ভাবনায় আবার ব্যঘাত ঘটালো ওর চলমান ঘটনাগুলো। আবার চিন্তার বিষয় তৈরি করল ওর মনে। কেন? শালিকেই কেন বিয়ে করতে হবে? শালি ছাড়া কী আর কোনো মেয়ে ছিল না? একটা সম্পর্কে ভেঙে নতুন সম্পর্ক গড়া কী মুখের কথা৷ ভালোবাসা যায় একজনকে। সেই জনকে ও পেয়েছে তাহলে সমস্যাটা কোথায়! হ্যাঁ নীলা চলে গেছে। ও তো আর ইচ্ছে করে যায়নি।

“কী এমন ভাবছো?” আবারও চিরচেনা পরিচিত কন্ঠে ভেসে উঠল কথাটা৷ “এত ভেবে কী হবে বলো?”

এবার যেন ভয় কাজ করছে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল নীলা দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় ওর সৌন্দর্য যেন আরো ফুটে উঠেছে।

“আমি কী সত্যি তোমায় দেখছি নাকি মনের ভুল?” পাবেল নরম ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নীলার দিকে তাকিয়ে থেকে।

“তুমি সত্যিও ভাবতে পারো আবার মিথ্যেও। আমি দুটোর মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি।” বলেই হাসতে শুরু করল নীলা।

“ওহহ,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পাবেল। “কেন এসেছো আবার আমাকে একা করে দিয়ে চলে যাবার পর?”

“আমি তো যাইনি। তোমার মাঝেই বেঁচে আছি। শারিরীক ভাবে না। তবে স্মৃতিতে গেঁথে আছি। কখনো তোমার ভালোবাসা দূরে যেতে দেয়নি আমায়।” নীলার স্বরটা কিছুটা গম্ভীর হয়ে আছে।

“তুমি চলে যাবার পর আজ প্রথম অনুধাবন করতে পারলাম আমি কতটা বাজে,” ঘুরে দাঁড়াল আবার পাবেল। নদীর স্রোতে চোখ চলে গেছে।

নীলা পাশে এসে দাঁড়াল ওর। কাঁধে এক হাত রেখে বলল, “আমি জানি কী হচ্ছে তোমার সাথে। আমার বোনের সাথে তোমার বিয়ের কথা বলছে আজ।”

“তুমি জানলে কী করে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল পাবেল।

“আমি যে তোমারি মনের সৃষ্টি,” মুচকি হাসল নীলা।

“দেখো আর যাই হোক নীলা। আমি কাউকে মেনে নিতে পারব না জীবনে। সম্ভব না। একদম সম্ভব না। তাও আমার শালিকে তো আরো না। কী করব আমি?”

“শক্ত করো নিজেকে। তুমি ভেঙ্গে পড়লে হবে? তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। নিজের জীবনকে গোছাতে হবে। তুমি এভাবে আবেগি হয়ো না। হয়ত আমিও মানতে পারব না আমার বোনের সাথে তোমার বিয়ে। আমি এটা চাইও না।”

“সত্যি তুমি চাও না এমন টা?”

“সত্যি চাই না। তোমার জীবনে অন্য কেউ আসুক। তবুও আমার বোন না।”

“হাসালে নীলা।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল পাবেল। “আমি কাউকে গ্রহণ করতে পারব না। তুমিই আমার প্রথম ও শেষ।”

“আমি জানি তুমি কতটা ভালোবাসো আমায়। মনের উপর কারো হাত নেই, পাবেল। দেখবে একদিন কেউ আসবে যে তোমায় আমার থেকে বেশি ভালোবাসবে।”

“এসব কথা বলো না নীলা। এমনটা হবে না ভালো করেই জানো।”

“যাই হোক, তুমি স্ট্রং হও। লড়াই করো এই সমস্যার সাথে। পরিবর্তন হও। এভাবে নরম থাকলে সবাই প্রভাব বিস্তার করবে তোমার উপর। একের পর এক অন্যায় হবে। সহজ সরল মানুষ ঠকে বেশি।”

“বলছো তুমি পরিবর্তন হতে! আমি পারব এমন?” পাবেল পাশে ঘুরে নীলার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল।

নীলা ডান হাত পাবেলের বুকের বা পাশে রেখে বলল, “হ্যাঁ, তোমাকে পারতেই হবে। আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে তুমি পারবে।”

চোখ বন্ধ করে পাবেল অনুভব করল নীলার ভালোবাসা আর ভরসাকে। চোখ খুলতেই দেখল নীলা নেই ওর সামনে। মনে মনে বলল, “তুমি এসেছিলে আবার চলেও গেলে। স্মৃতিতে একটা ধাক্কা দিয়ে গেলে। পরিবর্তনের হাওয়া লাগিয়ে দিয়ে গেলে। ওপারে তুমি ভালো থাকে নীলা ভালো থাকো।”

পাবেল নিজেকে শক্ত করল। নীলা আর ওর একমাত্র সম্পদ ওর ২বছর বয়সের ছোট্ট মেয়েটা। যে যাই বলুক, আর শুনবে না কারো কথা। এবার নিজের মতো সব করবে ও। সিদ্ধান্ত এবার একটাই চলে যাবে এ শহর ছেড়ে, এ জীবন থেকে ভিন্ন কোনো জীবনে।

বাড়িতে গিয়ে নিজের জামা কাপড় পরিবর্তন করল পাবেল। কিছু টাকা সঙ্গে নিল আর কিছু না। বোনের সাথে দেখা হয়ে গেল বেরোনোর সময়। ও চাইছিল কারো সাথে দেখা না হোক। কিন্তু হয়ে গেল। যেভাবেই হোক কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।

“কীরে ভাই কই যাচ্ছিস এত রাতে?”

“ও বাড়িতে যাচ্ছি।” তড়িঘড়ি করে বলল পাবেল।

“এত রাতে ও বাড়িতে কেন যাবি। বলতো কিছু?”

“দরকার আছে জরুরী এই বিষয়টার একটা ইতি আজ টানব দেখে নিস বোন।”

“কালকে যা। আজকেই যেতে হবে কোনো মানে আছে?” চিন্তিত স্বরে বলল নন্দিনী।

“হ্যাঁরে আজকেই এর শেষ করব। থাক আমি বেরুচ্ছি।” বলেই সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল পাবেল।

***

শ্বশুর বাড়িতে এসে সদর দরজায় কলিং বেল চাপল। দরজা খুলে দিল মায়া। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেসই করে বসল, “এত রাতে আপনি এখানে। কোনো সমস্যা হয়ছে নাকি?”

“হ্যাঁ, বিশাল সমস্যা হয়েছে। আর সমস্যা বাঁধিয়েছো তোমরা।” বলেই ঘরে ঢুকল পাবেল। ড্রয়িং রুমে এসে মায়াকে বলল, “যাও আমার মেয়েকে নিয়ে আসো।” কন্ঠে রাগান্বিত ভাব।

“মানে, ও এখন ঘুমোচ্ছে। ওকে দিয়ে কী করবেন। আগে আমার সাথে কথা বলুন,” মায়া উঁচু গলায় বলল।

পাবেলের শ্বশুর শ্বাশুড়িও বেরিয়ে আসল তাদের রুম থেকে তাদের আওয়াজ শুনে।

পাবেলের শ্বশুর পাবেলকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা নাকি। তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”

“আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না কারো। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার মেয়েকে দিয়ে দিন।”

“মেয়ে তো তোমারি। ওর উপর তোমারি হক। আমরা তো না করিনি কখনো। সব তো ভালোই চলছে। ও ছোটো বাচ্চা, ওকে নিয়ে রাখবে বা যত্ম করবে কীভাবে?” পাবেলের শ্বাশুড়ি বলল।

“আমার মেয়েকে নিয়ে আসুন। ওগুলো আমি বুঝে নিতে পারব। আমার মেয়ে আমার সব সিদ্ধান্ত খাটবে ওর উপর৷ আর কারো প্রভাব থাকুক সেটা চাই না। আমার আর আমার মেয়ের জীবনে আর কাউকে টানছি না। কথা গুলো মাথায় রাখবেন দয়াকরে,” কথা গুলো কাটার মতো বিদল যেন মায়ার শরীরে।

কেউ আনছে না দেখে পাবেল নিজে গিয়ে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসল। তারপর বলল, “আপনারা ভালো থাকুন।” বলেই বেরিয়ে গেল সদর দরজা দিয়ে পাবেল।

মায়া বসে পড়ল সোফায়। চোখ দিয়ে অশ্রু টলমল করছে। বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা। মায়া বুঝে নিয়েছি ওর আশা আর পূরণ হবে না৷ মায়ার বাবা মাও বড়ো মেয়ের জামাইয়ের থেকে এমন কিছু আশা করেনি। কখনো এমন রাগান্বিত রূপও দেখেননি। সবাই হতবাক হয়ে স্তম্ভিত মূর্তির মতো রয়ে গেল।

***

পাবেল ওর মেয়েকে নিয়ে একদম নিখোঁজ হয়ে যায়। দু বাড়ির মানুষ চিন্তায় পড়ে যায়। ওদের দু’জনের খোঁজ করেও পায়নি আর কখনো। এমনটা হবে একদিনের মাঝে কেউ ভাবতেও পারেনি। পাবেলও যোগাযোগ করেনি আর কখনো। করেই বা কী লাভ। ও এসবের মাঝে আর থাকতে চায় না। মেয়ে নিয়ে দূরে কোথাও থাকবে। এ চিন্তায় চলে গেছে কোথায় কেউ বলতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে ওদের খোঁজাও বন্ধ হয়ে যায়।

***

আট বছর পর,

পাবেল নিজের মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। মেয়ের নাম কনিকা। কনিকার চুলে তেল দিয়ে ভালো করে আঁচড়ে ফিতা বেঁধে দিল। সিঙ্গেল বাবার জীবন কাটাচ্ছে পাবেল। এতে অবশ্য ওর কষ্ট নেই। একটা ৭ তলার একটা ভবনে তিনতলার একটা ফ্লাট জুরে ওদের বসবাস। বাপ মেয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছে একসঙ্গে। পাবেল যেমনটা চেয়েছিল, হয়তো তার থেকেও বেশি।

“বাবা আমাকে আজকে ঘুরতে নিয়ে যাবে না?” কনিকা মায়বী কন্ঠে বলে উঠল।

“হ্যাঁ, যাব আজকে। একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাব তোমায় দুষ্টু মেয়ে। তবুও তো দুষ্টামি কমাচ্ছো না,” হাসি মুখে বলল পাবেল।

“আচ্ছা বাবা,” বলেই পাবেলের গালে চুমু একে দিল কনিকা। “আমি দুষ্টুমি না করলে কে করবে বলোতো।” হাসতে শুরু করল কনিকা।

কলিং বেল বেজে উঠল তৎক্ষনাৎ। কনিকা দৌড়ে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল। একজন মাঝবয়সী মেয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ছোট্ট গোল একটা বাটি।

মাঝ বয়সী মেয়েটা কনিকাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী মামনী?”

“আমার নাম কনিকা।” সহজ সরল ভাষায় জবাব দিল ও। “আপনাকে দেখে তো নতুন মনে হচ্ছে এখানে। আগে তো দেখেছি বলে মনে হয় না।”

“বাহ্, তুমি তো বুদ্ধিমতি মেয়ে। ধরে ফেললে কেমন,” হেসে উঠল মাঝ বয়সী মেয়েটা। “আমি আর আমার স্বামী এ বিল্ডিংয়ে উঠেছি ৫ তলায় ডান পাশের ফ্লাটে। আসছিলাম চিনি নিতে। তোমার আঙ্কেল চা খাবেন তো। আমাকে চিনি ধার দেয়া যাবে কী?” বাটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল।

“আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি,” বলে কনিকা বাটিটা নিতে যাবে তখন পাবেল এসে মেয়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “কে এসেছে, মা?” বলেই দরজার অপাশে থাকা মেয়েটার দিকে চোখ পড়ল পাবেলের। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। চেনা পরিচিত সেই মাঝ বয়সী মেয়েটা। নিজের অজান্তে পাবেল বলে উঠল, “মায়া!”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here