#হৃদয়জুড়ে_তুমি
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
সিমা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার পর ইহান কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ব্যাপারটা বুঝতে পারা মাত্রাই চিৎকার করে এগিয়ে আসে সিমার দিকে। ইতিমধ্যেই রাস্তায় অনেকে জমা হয়ে গেছে। ইনায়াও সিমার এই অবস্থা দেখে ভীত হয়ে গেছে। ইহান আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত সিমাকে কোলে তুলে নেয়। নিজের গাড়িতে করে সিমাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। ইনায়াও যায় তার সাথে।
হাসপাতালে পৌছে গাড়ি থামিয়ে ইহান হন্তদন্ত হয়ে সিমাকে নিয়ে ছুটে ভেতরে যায়। সিমাকে জরুরি বিভাগে করানো হয়। সিমার অবস্থার কথা ইনায়া ফোন করে বাড়িতে জানায়।
মান্নাত বেগম, রায়হান খান কিছু সময়ের ব্যবধানে হাসপাতালে চলে আসে। মান্নাত বেগম এসে ইনায়াকে জিজ্ঞেস করে,
‘সিমা কোথায়? ওর অবস্থা এখন কেমন?’
ইনায়া বলে,
‘অবস্থা বেশি ভালো না। ভাবির অনেক ব্লাড লস হয়েছে। ডক্টর বলেছে লাইফ রিস্ক আছে।’
রায়হান খান তখন জিজ্ঞেস করে,
‘এক্সিডেন্টটা হলো কিভাবে?’
‘ভাইয়া পার্কিং লট থেকে গাড়ি আনার জন্য যাচ্ছিল। এমন সময় একটা গাড়ি ভাইয়ার দিকেই এগিয়ে আসছিল। আর কেউ না দেখলেও ভাবির নজরে আসে ব্যাপারটা। ভাবি ভাইয়াকে বাচানোর জন্য এগিয়ে যায় এবং ভাইয়াকে বাচাতে গিয়ে নিজে আহত হয়।’
ইতিমধ্যে সিমার বাবা সাজ্জাদ চৌধুরী হাসপাতালে এসে উপস্থিত হন। নিজের মেয়ের এই অবস্থার কথা শুনে তিনি অনেক জরুরি একটা মিটিং ফেলে চলে এসেছেন। হাসপাতালে এসে সাজ্জাদ চৌধুরী রায়হান খানের কাছে জানতে চান,
‘আমার সিমা কোথায়? ও কেমন আছে?’
‘তুই শান্ত হ। সিমার চিকিৎসা চলছে। ও সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
‘তুই আমাকে শান্ত হতে বলছিস রায়হান। আমার মেয়ের এই অবস্থা আর আমি শান্ত থাকব। শুনে রাখ আমার মেয়ের যদি কিছু হয় তাহলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়ব না। তোদের জন্য আমার মেয়েটার জীবন শেষ হয়ে যেতে বসেছে।’
রায়হান খান আর বলার মতো কিছু খুজে পাননা। কারণ এখন সাজ্জাদ চৌধুরী রেগে আছেন৷ তাই তাকে কোন বুঝিয়ে লাভ নেই৷ এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
এরমধ্যে ডাক্তার এসে বলেন,
‘পেশেন্টের বাড়ির লোক কে আছেন?’
ইহান সবেমাত্র কিছু দরকারি ওষুধ কিনে নিয়ে এসেছিল। সেই ওষুধগুলো ডাক্তারের হাতে দিয়ে বলে,
‘ডক্টর আমি এই ওষুধগুলো এনেছি। আমার ওয়াইফ ঠিক আছে তো?’
‘ওনার অবস্থার অবনতি ঘটেছে৷ অনেক বেশি ব্লাড লস হয়েছে। তাই ইমিডিয়েটলি রক্ত লাগবে। ওনার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তের ব্যবস্থা করুন।’
ইহান ব্ল্যাড ব্যাংকে যোগাযোগ করে, নিজের অনেক বন্ধুর সাথেও যোগাযোগ করে। কিন্তু কারো রক্ত ও নেগেটিভ নয়। এই রক্ত সহজে পাওয়া যায়না। সাজ্জাদ চৌধুরী বলেন,
‘আমার স্ত্রীর রক্তও ও নেগেটিভ ছিল। কিন্তু আমার রক্তের গ্রুপ আলাদা।’
সবাই এই নিয়ে খুব টেনশনে ছিল।
২৩.
ইহান অনেক কষ্টে যখন ও নেগেটিভ রক্তের সন্ধান পায় তখন ডক্টর বলে,
‘আমরা ইতিমধ্যেই রক্ত পেয়ে গেছি।’
ইহান জানতে চায়,
‘কোথা থেকে রক্ত পেলেন আপনি? আমাদের মধ্যে কেউ তো রক্ত এখনো জোগাড় করতে পারিনি।’
‘একটি মেয়ে রক্ত দিয়েছে।’
সাজ্জাদ চৌধুরী তখন বলেন,
‘কে সেই মেয়ে যে আমাদের এত বড় উপকার করল? তাকে আমার সামনে নিয়ে আসুন। আমার মেয়ের জীবন বাচিয়েছে সে। তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
ডাক্তার হতাশ হয়ে বলেন,
‘মেয়েটি তার পরিচয় জানায় নি। তবে সে একটি মাস্ক পরিহিত ছিল।’
‘মেয়েটি কোথায় এখন?’
‘সেটা তো আমি বলতে পারছি না।
কারণ ব্লাড দিয়েই মেয়েটি চলে গেছে।’
সাজ্জাদ চৌধুরী তখন বলেন,
‘মেয়েটি যেই হোক আমি নিজের অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাই।’
‘হুম ধন্যবাদ তো জানানোই উচিৎ। আজ যদি মেয়েটা সঠিক সময়ে এসে রক্ত না দিত তাহলে তো আপনাদের পেশেন্টকে কোনভাবে বাচানোই যেত না।’
‘আমি আল্লাহর কাছে মেয়েটির জন্য দোয়া করব। সে যেন অনেক সুখী হয়।’
একটু দূরে দাড়িয়ে মাস্ক পরিহিত সামিহা কথাগুলো শুনে নিজের চোখের জল মুছছিল। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে এসেছে সে। গোপন থেকেই নিজের পরিবারের খোজ নিয়েছে। সে জানতে পেরেছে যে তার বাবা এবং একটি যমজ বোনও আছে। কাকতালীয় ভাবে সামিহা যেই প্রজেক্টের জন্য বাংলাদেশে এসেছিল সিমাও সেখানে কাজ করে। সেখানে সিমাকে প্রথমবার দেখেই চিনতে পারর সামিহা। কারণ তাদের গায়ের রং ভিন্ন হলেও চেহারা একই। আজ যখন সিমার এক্সিডেন্টের খবর তার কানে আসে তখনই সে ছুটে আসে। অতঃপর সামিহা নিজের রক্ত দিয়ে সিমার জীবন বাচায়। সামিহা দূর থেকেই সাজ্জাদ চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তুমি আমার জন্য দোয়া করবে বলছ। অথচ আমাকেই নিজের থেকে দূরে করে দিয়েছিলে। নিজের আসল পরিবার থেকে দূরে থেকেছি এতদিন। ভেবেছিলাম তোমাদের কাছে থাকব। কিন্তু পরে যখন জানলাম তুমি আমাকে আমাদের মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করো তখন আমি সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। আমি থাকব না তোমাদের সাথে। দূরে থেকেই তোমাদের দেখব।’
সামিহা চলে যায় সেখান থেকে নিজের গন্তব্যের দিকে।
২৪.
দীর্ঘ এক দিন পর সিমার জ্ঞান ফেরে। তবে সে অনেক বেশি দূর্বল ছিল। ডাক্তার বলে দিয়েছে আশংকামুক্ত হলেও সিমার সুস্থ হতে অনেক বেশি সময় লাগবে। সিমার সুস্থ হওয়ার কথা শুনে এক এক করে সবাই এসে তার সাথে দেখা করে গেছে। আসে নি শুধু ইহান। সিমা ভেবে পায়না ইহানের না আসার কারণ কি। এসব ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সিমা।
অন্যদিকে ইহানের ভাবনা ভিন্ন। সে লজ্জায় সিমার সামনে যেতে পারছিল না। মেয়েটাকে তো কম অপমান করে নি ইহান। অথচ সেই সিমা ইহানের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিল।
মান্নাত বেগম ইহানের কাছে এসে তাকে সিমার কাছে যেতে বলে। ইহান তখন বলে,
‘আমি পারবো না। সিমার সামনে যেতে পারবোনা আমি। আমার গিলটি ফিল হচ্ছে।’
মান্নাত বেগম ইহানের কোন কথা শুনলেন না। তিনি এক প্রকার জোর করে ইহানকে সিমার কেবিনে পাঠিয়ে দেন। অবশেষে ইহানকে নিজের কেবিনে আসতে দেখে সিমার সকল ভাবনার ইতি ঘটে।
ইহান সিমার কাছে জানতে চায়,
‘ঠিক আছ তো তুমি?’
‘হুম আলহামদুলিল্লাহ বেচে আছি।’
ইহান সংকোচ বোধ করছিল আর কিছু বলতে। অনেক ভেবে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
‘তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো সেটা আমার জানা নেই। শুধুমাত্র আমাকে বাচানোর জন্য তুমি নিজের লাইফ রিস্কে ফেলেছিলে। তোমার কাছে আমি চিরকাল গ্রেটফুল থাকব।’
সিমা মলিন হেসে বলে,
‘এই উপকারের বিনিময়ে কিন্তু আপনাকে জোরপূর্বক নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় মেনে নিতে হবে না। আমি জানি আপনি কখনো মন থেকে আমায় মানবেন না। সত্যি বলতে আমি কখনো সেটা আশাও করিনি। বাই দা ওয়ে, অনেক রাত হয়েছে। আপনি আপনার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যান। আজ থেকে আমি চিরকালের মতো আপনাকে মুক্তি দিলাম। আমি আর আপনাদের বাড়িতে ফিরব না। এখান থেকে সরাসরি আব্বুর সাথে আমাদের বাড়িতে ফিরব।’
ইহানের বুকটা কেন জানিনা ছ্যাৎ করে ওঠে সিমার কথা শুনে। এতদিন তো সে এটাই চাইছিল। কিন্তু এখন সিমা তার থেকে দূরে যাবে এই কথাটা শুনেই তার কেন জানি কষ্ট হচ্ছে। হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাচ্ছে কথাটা।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨