১.
পাত্রেরবেশে নিজের ভালোবাসার মানুষের পরিবর্তে অন্য কাউকে দেখে থমকে গেলাম আমি। বিষ্ময়, বিমূঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে নিঃশব্দে বসে রইলাম। সামনে বসে থাকা রাশভারী, দাম্ভিক মুখশ্রীর অধিকারী লোকটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম! কিয়ৎক্ষণের জন্য মনে হলো আমার সাথে কেউ ভীষণ ভাবে দুষ্টুমি করছে, আমাকে ভয় দেখানোর ছল এটা। কিন্তু নাহ! হুজুর যখন অপরপাশের লোকটির নাম উচ্চারণ করলো তখন বুঝতে পারলাম, এইমূহুর্তে যা হচ্ছে সবই বাস্তব, এখানে না বিয়েটা আমার ভ্রম আর না সামনে বসে থাকা মানুষটা। আমার মুখ থেকে টু শব্দ বেরিয়ে এলো না। থম মেরে বসে আছি। আমাকে পলাশী আপু আলতো হাতে ধাক্কা দিয়ে বললেন,’কবুল বল স্নিগ্ধ!’
পলাশী আপুর কথায় টনক নড়লো আমার৷ নড়েচড়ে তাকালাম লোকটির দিকে৷ তিনি কবুল বলে নিঃশব্দে নতজানু হয়ে বসে আছেন আপাতত তার কবুল বলার দায়িত্ব শেষ! আমি একবার চারদিকে চোখ মেলে তাকালাম। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। পলাশী আপুর দিকে তাকাতেই তিনি দিত্বীয়দফা আমাকে কবুল বলতে বললেন তবে সেটা বললেন চোখের ইশারায়। আমি থেমে থেমে তিনবার কবুল বলে ফেললাম।
মাত্র তিনটি শব্দ বলেই আমার গলা শুকিয়ে এলো। তৃষ্ণায় আমি পানির খোঁজে এদিক ওদিক তাকালাম কিন্তু কারোর ধ্যান আমার দিকে নেই। সবাই একে অপরকে কোলাকুলি করতে ব্যস্ত। পলাশী আপুও হাতের নাগাল ছেড়ে চলে গিয়েছেন তার কোনো কাজে। পানি না পেয়ে মূর্ছে যাওয়া ফুলের মতো চুপসে গেলাম আমি।
‘এই পানিটা খেয়ে নাও।’
রাশভারী কণ্ঠস্বর শুনে চোখ মেলে তাকালাম, পুরোপুরি ভাবে মাথাটা তুললাম না। তবে বুঝতে বাকি নেই আমাকে কে পানি দিয়েছে। আমি মুখে কোনো জবাব না দিয়ে পানিটা নিয়ে অপরপাশে মুখ ফিরিয়ে ঢক ঢক করে গ্লাসের পানিটা খেয়ে নিলাম। টেবিলে গ্লাসটি রেখে নিচু স্বরে বললাম,’ধন্যবাদ।’
অপরপাশ থেকে কোনো জবাব শুনলাম না। হয়তো কর্ণগোচর হয়েছে নয়তো শুনেও না শোনার ভাণ করেছেন। তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না! আপাতত পলাশী আপুকে একা পেলে আমার বহু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি আছে!
আচমকা পলাশী আপু আমার কাছে এসে আমার সদ্য হওয়া স্বামীকে মিষ্টি স্বরে বললেন,’ত্রিধার, তোমার মিষ্টি বউটাকে কিছুক্ষণ আমার কাছে রাখি।’
পলাশী আপুর কথায় জানতে পারলাম আমার সদ্য হওয়া স্বামীর নাম ত্রিধার। তবে অবাক হলাম কাজী যখন বরের নাম নিলেন তখন তিনি ত্রিধারের পরিবর্তে অন্য নামে বরকে পরিচয় দিয়েছেন। এই নিয়ে তেমন মাথা ঘামালাম না কারণ একজনের অনেকগুলো নাম থাকতেই পারে, অস্বাভাবিকের কিছু না। পলাশী আপু আমার হাত ধরে আমাকে উঠালেন। ত্রিধারই হয়তো সম্মতি জানিয়েছে তাই পলাশী আপু আমাকে নিয়ে আমার ঘরে এলেন। বাড়ির সবচেয়ে কোণায় ঘরটা আমার। আকারে ভীষণ ছোট হলেও পরিপাটি,গোছালো দেখলেই প্রাণটা জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।
পলাশী আপুকে একা পেয়েই আমি মাথায় ঘোমটা এক টানে খুলে ছলছল দৃষ্টিতে পলাশী আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,’প্রতারণা করেছো তোমরা আমার সাথে! খুব খারাপ তোমরা।’
পলাশী আপুর হাসিখুশি মুখটা মূহুর্তেই চুপসে গেলো। তিনি তেমন প্রতিক্রিয়া না হয়তো এমন প্রশ্নেরই দৃঢ় অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। এই প্রশ্নটা করার চেয়ে না করলেই হয়তো তিনি অনেক অবাক হতেন। পলাশী আপু আমাকে মৃদু স্বরে বলল,’স্নিগ্ধ, অনেক জটপাকানো কাহিনি। এখন বলতে গেলে দিন পেরিয়ে রাত হয়ে যাবে।’
‘এখন এমনিতেও রাতই!’ গম্ভীর কণ্ঠে বললাম আমি। পলাশী আপু মৃদু হেসে বললেন,’কথার কথা বলেছি আমি। স্নিগ্ধ! ত্রিধার ছেলেটা খুব ভালো, বিয়েটা মানিয়ে নিস।’
আমি পলাশী আপুর দিকে মুখ ফিরিয়ে অভিমানী স্বরে বললাম,’আজ আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করো আপু। আমরা তোমাকে নয়ন ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিবো বলে প্রতিশ্রুতি দিলে পরে বিয়ের দিন যদি তার পরিবর্তে অন্যকে এনে বসিয়ে দেই তবে মেনে নিবে?’
আমার কথায় পলাশী আপুর মুখটা গম্ভীর হলো, তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,’নাহ মেনে নিবো না। কিন্তু তোর আর আমার পরিস্থিতি এক নয় স্নিগ্ধ। তোর এই এলোমেলো জীবনে সেই সো কল্ড প্রেমিক রাফাত যখন স্বেচ্ছায় এই বিয়েটা করবে না বলে জানায় তখন কার কি করার থাকবে? আমরা রাফাতকে রিপ্লেস করতে বাধ্য হয়েছি, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। জীবন যতটা সহজ ভাবিস, ততটাও সহজ না।’
পলাশী আপুর কথার আংশ্যিকও আমার কানে গেলো না। রাফাত বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে? কথাটা একদমই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না আমার। আমি ফুঁপিয়ে বলে উঠলাম,’তোমরা মিথ্যা বলছো, রাফাত কখনো এমন করবে না।’
পলাশী আপু জবাব না দিলেও তার দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দটা আমার কর্ণকুহরে পৌঁছালো। আমি ধপ করে মাটিতে বসে কাঁদতে লাগলাম তা দেখে পলাশী আপু ঘাবড়ে গেলেন। তিনি মেঝেতে বসে আমাকে ধরলেন, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’স্নিগ্ধ, কাঁদে না, সবাইই জীবনে একবার না একবার এইরকম পরিস্থিতির শিকার হয় খালি কনসেপ্টটা ভিন্ন থাকে। দয়া করে কাঁদিস না সোনা। তুই না ব্রেভ গার্ল?’
আমি লেহেঙ্গার আংশিক আঙ্গুলে চেপে ধরে বললাম,’পলাশী আপু, আমি রাফাতকে ভীষণ ভালোবাসি, তবে আমার সাথেই কেনো এমন হলো? আমার জীবনটা এতো এলোমেলো কেনো?’
পলাশী আপু আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললেন,’তোর এই এলোমেলো জীবন গুছিয়ে দিতেই তো এসেছে ত্রিধার দেবদূত হয়ে! ত্রিধার তোর এই আগোছালো জীবন ঠিক করে তোকে নতুন এক জীবন দিবে!’
আপু কোনোকথায় আমার কর্ণকুহরে পৌঁছালো না আফসোস! তার আগেই আমি আমার চোখ বন্ধ করে ঢোলে পরলাম আপুর কোলে। চোখ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পূর্বে খালি আপুর ঠোঁটে লেগে থাকা মৃদু হাসিটাই নজরে পড়লো।
২.
চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। যেনো কেউ শক্ত করে চেপে আছে, এতোটাই শক্ত করে ধরে আছে যে আরেকটু এমন থাকলে আমার হাতটাই ভেঙ্গে যাবে। আমি ব্যাথাতুর শব্দ করার পূর্বেই কেউ বলে উঠলো,’আফশান! তুই যেইভাবে যেইভাবে বলেছিস আমি ঠিক সেইভাবেই সব করেছি। অনেক তথ্যও পেয়েছি আমি।’
শব্দ করতে চেয়েও মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না আমার। একরাশ কৌতুহল এসে ভর করেছে আমার উপর। ত্রিধারকে কেউ আফশান ডাকবে কেনো? ত্রিধারের জবাব শোনার জন্য আমি অজ্ঞানের ভান ধরে শুয়ে রইলাম। তবে ত্রিধারের কোনো জবাবই শুনতে পেলাম না দেখে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম। দেখতে পেলাম ত্রিধার একা আমার পাশে বসে আছে। আশেপাশে চোখ বুলালাম। কাউকেই দেখতে পেলাম না কিন্তু আমি শতভাগ নিশ্চিত এখানে কেউ এসেছিলো কিন্তু মূহুর্তেই গায়েব হলো কি করে? চিন্তা হলো আমার।
হতাশ হয়ে ত্রিধারের দিকে তাকালাম, ত্রিধার আমাকে এতোক্ষণ পরখ করছিলেন আমি তাকাতেই ভ্রুকুঁচকে বলেন,’এতো ডেসপারেট লাগছে কেনো তোমাকে? কিছু নিয়ে কি হতাশ?’
‘জ্বী?’ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ত্রিধারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম আমি। ত্রিধার আমার দিকে বেশ কিছু সেকেন্ড তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললেন,’কিছু না।’
আমি কিছু বললাম না। এইভাবেই কিছু সময় চুপ থাকলে হুট করে আমার পেট থেকে অদ্ভুত আওয়াজ আসা শুরু করলো আমি লজ্জা পেলাম। নিভু নিভু চোখে ত্রিধারের দিকে একবার তাকিয়ে নতজানু হলাম। ত্রিধার তা দেখে বললেন,’ক্ষিদে পেয়েছে তোমার স্নিগ্ধতা? খাবার এনে দিবো?’
‘সারাদিন না খেয়ে থাকার পরও যে ক্ষিদে পায়নি তা ভেবেও অবাক লাগছে আমার।’
আমার মুখে এই কথা শুনে ত্রিধার কিছু না বলেই উঠে চলে গেলেন। উনার যেতেই আমার মনে পড়লো এই ঘরটা আমার! এতোক্ষণ আমি এটাও খেয়াল করি নি তারমানে কি ওই পুরুষের কণ্ঠটাও আমার ভ্রম ছিলো? কিন্তু আপাতত আমাকে এইটাই ভাবাচ্ছে যে ত্রিধার আমাকে তার বাড়ি না নিয়ে যেয়ে এখানে রাখলো কেনো? আমি ঘড়ির দিকে তাকাতেই দিত্বীয়দফায় চমকালাম! রাত তিনটা বেজে ত্রিশ ছুঁই ছুঁই! এতো রাত হয়েছে বলেই কি ত্রিধার এই বাসায় থেকে গিয়েছে?
আমার ভাবনার মাঝে দরজা খুলে প্রবেশ করলো ত্রিধার। দরজাটা নিঃশব্দে ভীড়িয়ে আমার পাশে এসে বসলেন। তার হাতে বাঙ্গালীর খাবার মাছ, ভাত! ত্রিধার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,’বাসায় এইগুলো ছাড়া কোনো খাবার পেলাম না। পলাশীকেও ডাকতে ইতস্তত হচ্ছিলো তাই এটাই নিয়ে এসেছি। দোকান খোলা থাকলে হয়তো বিরিয়ানী আনতে পারতাম।’
‘অসুবিধা নেই,আমার ভাগ্যে যে এটা জুটেছে তাও অনেক বড় ব্যাপার।’
ত্রিধার আমার দিকে ভ্রুকুঁচকে চাইলেন। আমি তার হাত থেকে প্লেট নিবো তার আগেই তিনি আমার হাত সরিয়ে বললেন,’ত্রিধার এতোটাও কৃপণ না যে সে তার স্ত্রীকে খাইয়ে দিতে পারবে না।’
আমি আড়চোখে ত্রিধারের দিকে তাকিয়ে বললাম,’আমি কি বলেছি সেটা?’
‘না বললেও চোখের এক্সপ্রেশন দেখে বুঝে গিয়েছি।’
জবাব দিলাম না আমি। ত্রিধার আমাকে মাছ দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,’তোমার মাথায় অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি কিন্তু রহস্যকে রহস্যই থাকতে দাও উন্মোচন করতে গেলে ধোঁয়াশায় হারিয়ে যাবে।’
ত্রিধারের শেষ কথাটি থ্রেট হিসেবে মনে হলো আমার, ভয়ে কিঞ্চিৎ শরীর কেঁপে উঠলো! তার কথাটির মধ্যে যেনো লুকিয়ে আছে কত রহস্য!
চলবে?
#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০১
#আনিশা_নিঝুম
| আমার লেখা প্রথম ধারাবাহিক গল্প এটা! অনেক ভেবেচিন্তে এই একটা গল্পের থিম সাজাতেই আমার দেড়মাস লেগেছে। তাই আশা করি কেউ রেসপন্স না করে যাবেন না। আপনাদের রেসপন্সের উপরেও কিন্তু পরবর্তী পর্ব নির্ভরশীল! |
| প্রথম পর্বটিতে কোনো ভুল হলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন, আমি তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। |