হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -১৫ ও শেষ

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#আনিশা_নিঝুম
#উপসংহার

(শেষাংশ)

২০.
রাফাত ভয়ে ভয়ে বসে আছে তার অপরপ্রান্তে আফশান বসে আছে। আফশানের হাতে কাঠের শক্ত লাঠি। বিগত বিশ মিনিট ধরে রাফাতকে বেধড়ক পিটিয়ে ক্লান্ত দেহ নিয়ে সবে চেয়ারে বসেছে। রাফাতকে আফশান বলল,’মরার আগে তোর শেষ ইচ্ছা পূরণ করবো আমি। বল তুই কিভাবে তোর মৃত্যু চাস? তুই যেভাবি চাইবি আমি ঠিক সেভাবেই তোর মৃত্যু দিবো।’

‘কসম, আর কোনোদিন আমি স্নিগ্ধতার দিকে হাত বাড়াবো না। এবারের মতো মাফ করে দেন।’

‘উহু! গতবারও এই একই বলে পাড় পেয়ে গিয়েছিলি এইবার তোকে আর হাত বাড়ানোর সুযোগ দিলেই না তুই বাড়াবি।’

বলে ঝট করে টেবিল থেকে দা নিয়ে রাফাতের দুহাতে কোপ দিলো। রক্তে ভরে গেলো মেঝে। রাফাত ব্যথায় গ লা কা টা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলো। পৈশাচিক ভঙ্গী হাসলো আফশান। দেহরক্ষীরা ভয়ে তাকালো! আফশান এতোটা হিংস্র দেখেনি কখনো তারা কেউই! যাকে সব সময়ই শান্ত, চুপচাপ থেকে কাজ করতে দেখা গিয়েছে তবে ভালোবাসার এতোই শক্তি যে একটা শান্ত, চুপচাপ মানুষটা মূহুর্তেই ভয়ংকর,হিংস্র প্রাণীতে পরিণত করতে পারে?

টেবিলে সুন্দর করে সাজোয়া তিনটি অস্ত্র। আফশান লাঠি আর দা জায়গামত রেখে দিলো। তৃতীয় অস্ত্র নিয়ে নিলো তা দেখে রাফাত থমকে গেলো। তার ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলো। আফশান ছুড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,’এই ছুড়ি তোর কোথায় লাগাতে পারি? ওহ হ্যাঁ! তোর তো আবার পুরুষত্ব ফলাতে খুব ভালো লাগে! আমি বরং তোর পুরুষাঙ্গটাই কেটে ফেলি? কি বলিস?’

রাফাত আফশানের চেহেরা দেখে ভয়ে চুপসে গেলো। এতোটা হিংস্র এর আগে কখনো দেখেনি সে। নিজের কাজে আফসোস হচ্ছে! রাফাত ভীতু চোখে তাকিয়ে বলল,’আমি সব স্বীকার করছি। আড়ালে আড়ালে আমি আর মেজর মঈনুল রশীদ অনেক অন্যায় করেছি, দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নিজের সত্যতা লুকানোর জন্য অনেক নিরীহ মানুষ মেরেছি। আমাদের সত্যতা যখন মেজর সায়েদ আনাস জানলেন তখন তাকে আর তার স্ত্রীকে আমার মৃত মা মোহনা রশীদ আর আমার মরহুম পিতা মঈনুল রশীদ মেরে ফেলেছেন। মরহুম ক্যাপ্টেন নয়ন আলম, আমার বোনের মৃত স্বামী। তিনি যখন আমাদের ব্যাপারে জানতে পেরেছিলেন তখনই আমি আর আমার মরহুম পিতা মেজর মঈনুল রশীদ পরিকল্পনা করে তাকেও বাকিদের মতো মেরে ফেলি। নয়ন সাহেবের স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তানটাও আমরা পরিকল্পনা করে মেরে ফেলি৷ আমাদের পরিকল্পনা ছিলো আমরা মেজর সায়েদ আনাসের একমাত্র মেয়ের সব সম্পত্তি নিজের নামে করে তাকেও মেরে ফেলবো।’

রাফাতের এযাবৎ বলা কথাগুলো নিজের ফোনে রেকর্ড করে নিলো মুমিন। আফশানকে চোখে ইশারায় তা বুঝিয়ে বলল। আফশান বক্র হেসে বলল,’আমি তাই চেয়েছিলাম তুই আত্মসমর্পণ করিস। এটা এখন টিভিতে প্রচার হবে! সারা বাংলাদেশ জানবে তোর আর তোর বাবার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে। তখন তোদের ছবি কেউ মাথায় তুলে রাখবে না! আছাড় দিয়ে তা ভেঙ্গে থু থু ফেলবে হয়তো তা দেখার জন্য তুই ততক্ষণ পৃথিবীতে থাকবি না।’

রাফাত ভয় পেয়ে গেলো, ভীতু স্বরে বলল,’আমি তো স্বীকার করেছিই তবুও কেনো আমাকে মারবেন? আপনি আমার হাত কে টে দিয়েছেন এখন আমি চাইলেও কিছু করতে পারবো না।’

আফশান হাসলো রাফাতের কথায়! দীর্ঘক্ষণ হেসে বলল,’একবার ঠকেছি ঠকবাজকে বিশ্বাস করে তাই বলে দিত্বীয়বার বিশ্বাস করার মতো ভুল করবো না।’

আফশান যা বললো তা করলো ধারালো ছুড়ি দিয়ে রাফাতের পুরুষাঙ্গটি কে টে ফেললো। রাফাত ছটফটাতে ছটফটাতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেলো। রক্তে স্নান হয়ে গেছে সে। হাত কা টার সময় রক্ত ছিটে আফশানের শার্টে লেগেছিলো। আফশান নিজের শার্ট খুলে মাটিতে ফেললো। উন্মুক্ত শরীরে আরেকটি নতুন শার্ট জড়িয়ে মুমিনকে ডেকে বলল,’এই স্বীকারক্তি আজ সাংবাদিকদের দিয়ে প্রচার করিয়ে দিস। এতো বছর পর এই রহস্য উন্মোচন হলো! সকলেই জানুক আসল মাস্টারমাইন্ড কে ছিলো! সবার জানার অধিকার আছে। আমি ধ্বংস করে দিয়েছি সব! এতো বছর পূর্বে হওয়া অন্যায় গুলোর সব শোধ নিয়েছি! সেই মিষ্টি মেয়ে পলাশীর শরীরে বিধবা তকমা আর স্নিগ্ধতার শরীরে এতিম তকবা যারা লাগিয়েছিলো তাদের সবাইকে জা নে মেরেছি!’

আফশানের চোখ থেকে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। রাগে সে থরথর কাঁপছে। মুমিন আফশানের কাঁধে হাত রাখলো,’সব ঠিক হয়ে যাবে ইয়ার! আজ থেকে তোর আর ভাবীর জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। অতীত মনে রাখিস না!’

‘পলাশীর কি হবে? মুমিন! মেয়েটা সন্তান, স্বামী হারিয়ে একদম নিঃস্ব! মেয়েটার কষ্ট দেখলে অনেক কষ্ট হয় জানিস! ছোট বয়সেই বিধবা হয়েছে।’

মুমিন মুচকি হাসলো, জবাবে কিছু বলল না।

টিভিতে সদ্য খবর দেখে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলো। পলাশী নিঃশব্দে বসে বসে কাঁদছে। নিজের আপন ভাই ও পিতার জন্য স্বামী, সন্তান সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে সে। আমি তখনো স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। মানুষ এতোটাও নিকৃষ্ট হতে পারে আমার জানা ছিলো না! তখনই টিভিতে রাফাতের লাশটির দৃশ্য ভেসে উঠলো। পলাশী আপু কান্না থামিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর থমকে তাকালো টিভির দিকে! এতোটাই নৃশংস ভাবে মারা হয়েছে রাফাতকে যে তার লাশের দিকে তাকানোর মতো অবস্থা নেই। আমি ঠায় হয়ে বসে রইলাম। আমার নজর এড়ালো না ত্রিধার আর মুমিন ভাইয়ের বক্রহাসির রেখা।

২১.

ফায়াজ ম্যানশন আজ উৎসবে মেতে উঠেছে! বহুদিন পর খুশির আমেজ নিয়ে এসেছে আরশাদ ফায়াজ! পূর্ণা আর আশফির চোখ খুশিতে ভরে গিয়েছে। সারাদিন বংশের প্রথম নাতীকে নিয়ে থাকেন তারা। থাকবেনই বা কেনো? এই নাতীটাই যে তাদের সব! নিজেদের সন্তান হারিয়ে এখন নাতীটারই ভালোবাসা পেতে চান তারা। আশফি আরশাদকে কোলে নিয়ে বলল,’আমার নাতীটা আজ পুরো একবছরের হয়ে গিয়েছে!’

পূর্ণা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’নাতী কি শুধু তোমার? আমার একমাত্র ছেলের ছেলে এটা। আমার কলিজার দিত্বীয় অংশ।’

‘প্রথম অংশ কে?’ ভ্রুকুঁচকে প্রশ্ন করলেন আশফি। পূর্ণা বক্র হেসে নাতীকে নিজের কোলে নিয়ে বললেন,’আফশান।’

‘ওহ আমি তো কিছুই না।’

‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি তোমার? দাদা হয়ে গিয়েছো এখনো ভালোবাসা ভালোবাসা করো শুধু!’

‘কম বয়সে বিয়ে করে এই এক জ্বালা! স্ত্রীর থেকে ভালবাসাই সরতে চায়না।’

আশফি আর পূর্ণা হাসলো। অতঃপর নিজের নাতীকে নিয়ে খুশিতে মেতে উঠলেন।

আফশান আজ এক সপ্তাহ পর কাজ শেষ করে সবে ফিরেছে। এযাবৎকাল ফায়াজ ম্যানশনে এসে থাকছে তার পুরো পরিবার। অবশ্য তা স্নিগ্ধতার ইচ্ছাতেই হয়েছে। এ বাড়িতে আসার ইচ্ছে ছিলো না তার! কেনো যেনো এই বাড়ির সব মায়া ত্যাগ করে দিয়েছিলো তাই বাবা মা এই খু নে জড়িত নয় জেনেও এই সংসারে আবার আসার ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু নিজের হৃদয়েশ্বরী আবদার ফেলতে পারেনি সে। যে মেয়ে সারাজীবন মা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হলো তাকে কিভাবে সে শশুড় শাশুড়ি নামক দিত্বীয় বাবা মার ভালোবাসা,আদর থেকে বঞ্চিত করতে পারে সে? তাই স্নিগ্ধতা যখন আটমাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো তখনই নিয়ে আসে এখানে। আরেকটি কারণও আছে বটে! স্নিগ্ধতার গর্ভবতী অবস্থায় আপন কাউকে তার প্রয়োজন ছিলো সেই দিক চিন্তা করেও এখানে এসেছে।

আমি গোসল সেরে বের হলাম সবে। আফশানকে ক্লান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে তার কাছে গেলাম, হাসি মুখে বললাম,’আজ ফিরবে যে জানালে না?’

আফশান চোখ বন্ধ থেকে বললো,’জানানোর সুযোগ পাইনি।’

‘পলাশী আপু আজ আসবে?’
কয়েকমাস হয়েছে পলাশী আপু চাকরী করে আমাদের আগের ফ্ল্যাটে থাকছে। আফশান অবশ্য এখানে থাকার অনুরোধ করেছিলো কিন্তু পলাশী আপু তাতে রাজী হয়নি। না হওয়াটাই স্বাভাবিক! নিজের ছোট বোনের শশুড় বাড়িতে কিভাবে থাকবে সে?এই নিয়ে আমি বুঝালেও পলাশী আপু বুঝতে নারাজ।

‘হয়তো।’ ক্লান্তিমাখা কণ্ঠে জবাব দিলো আফশান।
আমি বুঝলাম সে ভীষণ ক্লান্ত তাই আর প্রশ্ন না করে নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে যেতে নিলাম তখনই আফশান আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো। নিজের কাছে এনে ক্লান্তিমাখা কণ্ঠে বলল,’স্নিগ্ধতা! আমি অনেক ক্লান্ত।’

‘তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার লাগাচ্ছি।’

আফশান চোখ বন্ধ করে বলল,’উম! আরশাদ কোথায়?’

‘মা বাবার কাছে আছে। এখন যেও না ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও তারপর যেও।’

‘আরশাদকে আজ মা বাবার কাছেই থাকতে দাও। কাবাবের হাড্ডি বানানোর কি দরকার?’

আফশানের কথায় আমি তাজ্জব বনে তাকালাম! আফশানের হাতে চাপড় মেরে বললাম,’ত্রিধার,ছাড়ো বলছি।’

‘ধরেছি কি ছাড়তে?’

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,’আমার কাজ আছে! অনেক ব্যস্ত আমি।’

‘একটু থাকো।’
বলেই একটা বক্স এগিয়ে দিলো আমার দিকে৷ আমি বললাম,’কি আছে এতে?’

ত্রিধার বক্স খুলে বলল,’হ্যাপি অ্যানিভার্সারি’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম ত্রিধারের দিকে। ব্যস্ততার মাঝে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম আজ আমাদের একসাথে থাকার দুবছর পূর্ণ হয়েছে! এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ভুলে যাওয়ার জন্য কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলাম আমি৷ ত্রিধার আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাত চেপে কেক কাটালেন। নিজ হাতে আমাকে খাওয়ালেন কেক,আমি খাওয়াতে যাব তার আগেই পেটে হাত চেপে দ্রুত গতিতে বাথরুমে গেলাম। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আমাকে ত্রিধার প্রশ্ন করলেন,’কি হয়েছে? অসুস্থ তুমি?’

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করলাম। ত্রিধার হয়তো বুঝলেন,ভ্রু নাড়িয়ে হেসে বললেন,’দিত্বীয়বারের মতো আমাকে বাবা ডাক শোনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!’

সমাপ্ত

|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here