হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -১২

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_১২
#আনিশা_নিঝুম

শব্দ নেই দেখে রাফাত নিজের চোখ খুললো পিটপিট করে। চোখ খুলতেই অবাক হলো রাফাত। ভয়ে থরথর কাঁপতে লাগলো শরীর। বিস্মিতপূর্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো আফশানের দিকে। আফশানের মুখজুড়ে গম্ভির! রাফাত শুকনো ঢোক গিললো। একবার আফশান আর আরেকবার মঈনুলের দিকে তাকালো। মঈনুলের মুখ বেয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে।

‘এতক্ষন তো চোখ বুজে ছিলি, কিছুই দেখিস নি, এখন জানতে চাস কিভাবে মেরেছি?’

রাফাত ভয়ে ভয়ে তাকালো। আফশান বলল,’একটা সিরিঞ্জ পুশ করেছি! যে সিরিঞ্জ পুশ করার পর মঈনুলের বুক জ্বলা শুরু করেছিলো, কিভাবে তরপাচ্ছিলো! তুই দেখিস নি। আমার অনেক শান্তি লেগেছে।’

এই মূহুর্তে আফশানকে রাফাতের কাছের ভীষণ ভয়ংকর, আর হিংস্র লাগছে! যার মনে এক ফোটাও দয়ামায়া নেই! কিন্তু মানুষটাই এই মূহুর্তে যতটা হিংস্র আছে স্নিগ্ধতার কাছে যেয়ে ততটাই নম্র হয়ে যায়! তারমানে আফশানের মনেও স্নিগ্ধতার জন্য ভালোবাসা আছে? সে কিছুতেই ওই দুইজনকে এক হতে দিবে না, সে স্নিগ্ধতা আর আফশানকে পুরোপুরি ভাবে ধ্বংস করে দিবে!

আফশান হেলেদুলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে দরজা খোলা রেখেই ঘর ত্যাগ করলো। চট করে বুদ্ধি খেলে গেলো রাফাতের মাথায়। সে টেবিলে পরে থাকা ছুড়ি কৌশলে হাতে নিলো, ছুড়ি নেওয়াটা তার জন্য খুব কঠিন কাজ ছিলো না, ছুড়ি দিয়ে সাবধানভাবে দড়ি খুললো। আস্তে করে উঠে দরজার সামনে গেলো আশপাশ দেখলো কেউ আছে নাকি! কাউকে না দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাহিরে বের হলো।

মনে মনে হেসে রাফাত বলল,’আফশান ফায়াজ! তুই যেতেও এখন হেরে যাবি! আমি শারীরিক ভাবে তোর কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও আমি মানসিক ভাবে তোকে শেষ করে দিবো! আর স্নিগ্ধতাকে পুরোপুরি জা নে মেরে দিবো!’

১৫.

রাফাতের অসহায় মুখ থেকে সব শুনে খারাপ লাগলো আমার। না চাইতেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম যে ত্রিধার আসলেই নিকৃষ্ট হতে পারে! সে সময় এতোটাই বিকারগস্ত ছিলাম যে অন্য কিছু ভাবার কথা চিন্তাও করতে পারিনি। রাফাতকে কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম আমি। ত্রিধার আমাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে! আমাকে দোটানায় ফেলে দিয়েছস কিছু না বলে! রাফাত নিজে নিজেই বলল,’তোমার আর আফশানের বিয়ের পরেরদিন আমিই জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ঢুকেছিলাম। তুমি তখন ঘুমে ছিলে তাই টের পাওনি।’

‘দরজা দিয়ে আসোনি কেনো?’ প্রশ্ন করলাম আমি।

রাফাত বলল,’দরজা দিয়ে আসলে হয়তো তোমার স্বামী আফশান আমাকে পুরো দমে মেরেই দিতো। একমাত্র তোমার ঘরেই জানালা ছিলো বলে পাইপ বেয়ে আমি খুব সহজেই তা ভেঙ্গে ঢুকতে পেরেছিলাম। চেয়েছিলাম ওইদিনই সব বলে দেই কিন্তু তুমি তখন এতোটাই ডেস্পারেট ছিলে যে তোমাকে কিছু বললে তুমি তো বিশ্বাসই করতে না উলটা আমাকে ভুল বুঝতে যেটা আমি চাইনা।’

‘আচ্ছা।’

‘তুমি আমার সাথে একটু হাঁটবে স্নিগ্ধ?এরপরই আমি চলে যাবো।’

রাফাতকে তখনো পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারি নি আমি! একজন ঠকবাজ বিশ্বাস করতে গেলেও দুবার বার ভাবা লাগে। যতক্ষন না আমি ত্রিধারের মুখে সত্য কথা শুনবো ততক্ষণ আমি রাফাতকে বিশ্বাস করতে পারবো না পুরোপুরি ভাবে! আমি না করার মুখ হা করতেই রাফাত করুণ স্বরে বলে উঠে,’প্লিজ স্নিগ্ধ!হয়তো আমি এখন তোমার ভালোবাসা নেই তবে শেষবারের মতো হাঁটতে পারো! অনেক আশা নিয়ে বলছি আশাহত করো না, দয়া করে। সব হারিয়ে আমি এখন পুরোপুরি ভাবে নিঃস্ব।’

বোকা আমি! রাফাতের এতো মিনতি ফেলতে না পেরে, মনে দয়া মায়ার সাগর নিয়ে রাফাতের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম অথচ আসল কাহিনী আমি জানলামই না! আমাকে রাফাত জানালোই না! ইচ্ছাকৃত ছলছাতুরী করে অর্ধেক কাহিনী শুনিয়ে আমার মন কোমল করে দিলো! এই জন্যই হয়তো সে আমার কাছে এসেছে একমাত্র আমিই তাকে দয়া দেখাতে পারবো।

রাফাত আর আমি পাশাপাশি হাঁটছি, দুজনের মাঝেই নিশ্চুপতা। আমি কথা বলতে চাচ্ছি না রাফাত বুঝতে পেরে নিজেই বলল,’স্নিগ্ধ, শেষবারের মতো একটা কথা বলি?’

আমি চকিত নয়নে চেয়ে বলল,’হুম।’

‘ভালোবাসি।’

আমি চমকে গেলাম! ছিটকে সরে গেলাম ওখান থেকে। নিজেকে সামলে রাগী কণ্ঠে বলে উঠলাম,’রাফাত! আমি তোমার সাথে এখানে শুধু দয়া দেখিয়ে এসেছি এর মানে নয় যে তোমাকে আমি এখনো ভালোবাসি।’

রাফাত মুচকি হেসে বলল,’জানি, তবে আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করলাম।’

রাগে আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরালাম। রাফাতের দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না আমার। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে শুরু করলাম, ঝাঁ ঝাঁ কণ্ঠে বললাম,’পলাশী আপু এখনি এসে পড়বে আমার যেতে হবে। উনি তোমার সাথে আমাকে দেখলে অনেক রাগ হবেন।’

রাফাতকে উত্তেজিত দেখা গেলো আমার কথা শুনে, সে তড়িঘড়ি করে বলল,’দাঁড়াও, তোমার জন্য ছোট একটা সারপ্রাইজ আছে। যেইটা পেলে হয়তো তুমি ভীষণ চমকে যাবে। তোমার জীবনের সেরা উপহার।’

আমি তাজ্জব বনে তাকালাম রাফাতের দিকে।বিচলিত কণ্ঠে কিছু বলতে যাবো তার পূর্বেই রাফাত আমার মুখে কিছু স্প্রে করলো। আমি ততক্ষনাৎ লুটিয়ে পড়তে নিলাম, কিন্তু নিজের কোমড়ে শীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। চোখ বন্ধ করতে করতে ভেসে এলো রাফাতের হাসিখানা! আমি হেরে গেলাম! রাফাতকে বিশ্বাস করে আবারো ঠকে গিয়েছি! কাউকে দয়া মায়া দেখাতে যেয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি! ত্রিধারের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসা অনুভব করতে নিলাম সেই মূহুর্তে কিন্তু তার পূর্বেই জ্ঞানশূণ্য হয়ে গেলাম! নিভে গেলো আমার অনুভব, সকল অনুভূতি! এরপর কি হলো আমার সাথে জানি না।

১৬.

পলাশীকে বসে কাঁদতে দেখে ত্রিধার অবাক হলো। বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো তখনই পলাশীকে রাস্তায় দেখে তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে পলাশীর কাছে গেলো, পলাশী তখন মাটিতে বসে কাঁদছে। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে বাজার করে আনা সব জিনিস। ত্রিধার বেশ অবাক হলো পলাশীর কাণ্ডে! হুট করেই ত্রিধারের বুক ধক করে উঠলো স্নিগ্ধতার সাথে আবার কিছু হলো না তো? ঝড়ের পূর্বাভাস পেলো ত্রিধার। পলাশীর কাঁধে হাত রাখল। পলাশী মাথা তুলে চাইলো তার দিকে। তার কান্নার গতি আরো বেড়ে গেলো ত্রিধারকে দেখে। ত্রিধার পলাশীর দু বাহু ধরে উঠালো, বিচলিত কণ্ঠে বলল,’পলাশী? কি হয়েছে এভাবে কাঁদছো কেনো?’

পলাশী কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট সুরে বলল,’স্নিগ্ধকে পাওয়া যাচ্ছে না আফশান! ওকে আমি এখানে রেখে গিয়েছিলাম সে দেখি ও নেই। ত্রিধার আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না! কি হলো মেয়েটার! কোথায় গেলো মেয়েটা!’

পলাশীর কথায় ত্রিধারের পুরো দুনিয়া থমকে গেলো কিয়ৎক্ষণের জন্য। কেঁপে উঠলো হৃদয়জুড়ে। মনে মনে ভেঙ্গে গুড়িগুড়ি হয়ে গেলো ত্রিধার। হৃদয়জুড়ে অনুভব করলো ভীষণ রকমের ব্যথা! প্রণয়ের ব্যথা! আমরা যখন আমাদের প্রিয় মানুষ হারিয়ে ফেলি তখন এই ব্যথা আমরা অনুভব করি! আমাদের হৃদয়জুড়ে এই ব্যথা দুমড়ে মুচড়ে আমাদের ছাড়খাড় করে দেয়! ত্রিধার চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। ঝাপসা চোখে পলাশীর দিকে তাকালো। পলাশীর একটুখানি মুখ দেখে বুকটা ধক করে উঠলো। নিজের স্ত্রীর সাথে যে পরবর্তীতে কোনো কিছু ভালো হতে যাচ্ছে না খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে। যেদিন বুঝতে পারে রাফাত চালাকি করে বেরিয়ে গিয়েছে সেদিন থেকে পনেরো দিনের ট্রেনিং এর বাহানায় এতোদিন ধরে রাফাতকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সারা চট্টগ্রাম জুড়ে! রাফাতের বাংলাদেশ ও চট্টগ্রাম শহর থেকে বের হওয়ার পুরো সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে রাফাতের জন্য সব পথ! একটি পথ খোলা আছে! তা হলো সমুদ্রপথ! তারমানে রাফাত এখন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যেই বের হয়েছে?চট করে নিজের ফোন বের করে মুমিনকে ফোন লাগালো। মুমিনকে সব বলতেই মুমিন দ্রুত পুলিশ ফোর্স সেখানে পাঠাচ্ছে বলে জানালো। পলাশীকে নিয়ে ত্রিধারও দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়লো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here