হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -১৪

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#আনিশা_নিঝুম
#উপসংহার

(প্রথমাংশ)

আঁধার গগণে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি পড়বার পূর্বাভাস। বৃষ্টি হলো সৃষ্টিকর্তার একটি রহমত! বৃষ্টিকে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে মানে এযাবৎকালীন দুটি সম্মিলিত হৃদয়। তেমনই আজ বিষন্ন দুটি হৃদয়ের বিষন্নতা বৃষ্টিসরূপ ঝরে পড়বে। গগণের মেঘমালা সম্মিলিত ভাবে বৃষ্টিসরূপ ঝরতে শুরু করে দিয়েছে সেই সাথে প্রচণ্ডরকমের বজ্রপাত সারা চট্টগ্রামের বুকে আঁছড়ে পড়ছে। ত্রিধার শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো তার হৃদয়েশ্বরীকে। যেনো ছাড়লেই হারিয়ে যাবে তার হৃদয়েশ্বরী। হসপিটালের সামনে আসতেই ত্রিধার স্নিগ্ধতাকে পাজাকোলে তুলে হন্তদন্ত করে প্রবেশ করলো। চুল থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পরছে। হসপিটালের সকলে বিস্মিতপূর্ণ,কৌতুহলী দৃষ্টিপাত দিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে! হৃদয়ভাঙ্গা এক প্রেমিকের তার অসুস্থ প্রেমিকাকে নিয়ে ছোটাছুটি! বেশ আগ্রহ পেলো উপস্থিত সকলে। কিন্তু তারা তো জানে না আসল কাহিনী! এই হৃদয়ভাঙ্গা হৃদয়েশ্বরের হৃদয়েশ্বরীকে হারানোর কাহিনী। নার্স ত্রিধারকে এভাবে পাগলের মতো ছুটতে দেখে বাঁধা দিলো, কপট তেজ দেখিয়ে শুধালো,’মিস্টার এটা হসপিটাল। এভাবে ছুটাছুটি করছেন কেনো?’

ত্রিধার তার কোলে থাকা স্নিগ্ধতাকে দেখিয়ে বলে,’ওর গলায় ছুড়ি লেগেছে। এখনো নিশ্বাস পড়ছে আপনারা দ্রুত কিছু করুন। যত টাকা লাগবে আমি দিবো।’

নার্স ত্রিধারের পাগলামোতে বিরক্ত সূচক শব্দ উচ্চারণ করলো মুখে,গম্ভীর স্বরে বলল,’পেশেন্টকে দেখে মনে হচ্ছে ক্রিটিকাল অবস্থায় আছে। ছিড়া পোশাক, গলার রক্ত ওড়নায় ভিজে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে।’

ত্রিধারের রাগ হলো! ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,’বুঝতেই যেহেতু পারছেন অবস্থা ক্রিটিকাল তবে কেন অপেক্ষা করছেন?’

নার্সেরও রাগ হলো, তবে সে পরিস্থিতি উপলব্ধি করলো, শান্ত ভঙ্গীতে বলল,’এই কেবিনটায় পেশেন্টকে রেখে আসুন আমার সাথে। ভর্তির ফর্ম ফিলাপ করতে হবে।’

‘পেশেন্ট মরে যাচ্ছে আর আপনি পরে আছেন আপনার ফর্ম নিয়ে! জীবন কি ছেলেখেলা মনে হয় আপনাদের কাছে? স্কাউন্ড্রেল সবকটা!’

নার্স কিছু বলতে নিবে এর পূর্বে এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেলো।

‘এখানে এতো চিৎকার কিসের? হসপিটালে চিৎকার চেঁচামেচি করা একদমই এলাউড না জানেন না আপনারা? মিস রাহা আপনিও তার সাথে সাথে ইনসেইন হয়ে গিয়েছেন? আপনার কাছে আপনার চাকরী প্রিয় নাকি ঝগড়া?’

ডাঃ শাহরিমের কথায় নতজানু হয়ে গেলো নার্স। নিচুস্বরে বলল,’ম্যাম, এই লোকটির স্ত্রী গুরুতর ভাবে আহত হয়েছে আমি বললাম তাকে শুইয়ে আপনি চলুন ফর্ম ফিলাপ করতে উনি তা নিয়েই তর্ক করছেন। আমাদের কাছে নাকি জীবন মানে ছেলেখেলা। এখানে কারো জীবন যাচ্ছে আর আমরা নাকি ফর্ম ফিলাপ নিয়ে বসে আছি। কিন্তু ম্যাম তো নিয়ম।’

‘মিস্টার আফশান ফায়াজ অবশ্যই ঠিক বলেছে মিস রাহা। আমিও জানি এটা নিয়ম কিন্তু জীবনের থেকে নিয়ম বড় নয়। ফর্মটা পরেও ফিলাপ করা যেতো যাইহোক তুমি চিকিৎসার সব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকো। আমি এখনই আসছি।’

নার্স কিছু না বলে দ্রুত চলে গেলো সেখান থেকে৷ ত্রিধার স্নিগ্ধতাকে কেবিনে শুইয়ে দিলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে স্নিগ্ধতার চিকিৎসা শুরু হলো। কেবিনের বাহিরে বসে তা দেখতে লাগলো ত্রিধার। তখনই হন্তদন্ত করে প্রবেশ করলো পলাশী,মুমিন। মুমিনক্র দেখতেই মীরার কথা মনে পরলো ত্রিধারের তখন সেই বসে থাকা চুপচাপ মেয়েটি মীরা ছিলো! মুমিনের কয়েকমাস পূর্বে হারিয়ে যাওয়া ছোট বোন। সে মুমিনকে তখন এই কথা বলতে পারেনি তার হারিয়ে যাওয়া বোনটির কথা তবে মুমিন জানলো কিভাবে?মুমিন ত্রিধারের সামনে এসে বলল,’দোস্ত! আমি আমার মীরাকে খুঁজে পেয়েছি! ভাবী যেই ট্রলারে ছিলো সেই ট্রলারে আমার ছোট্ট বোন মীরাও ছিলো।’

মুমিনের চোখে অশ্রু। মলিন হাসলো ত্রিধার,বলল,’মীরা কোথায়?’

‘ওকে বাসায় রেখে এসেছি এখানে। পলাশীর জন্য! মেয়েটা সেই কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে ভাবীকে দেখার জন্য! দোস্ত ভাবী এখন কেমন আছে?’

ত্রিধার মলিন মুখে জবাব দিলো,’জানি না। চিকিৎসা চলছিলো ভেতরে।’

পলাশী ধপ করে বসে পরে করিডোরের সামনে। হিচকি তুলে তুলে কাঁদতে লাগলো।

১৮.

‘পেশেন্ট এখন সুস্থ আছে। কিন্তু তার শরীরে ড্রাগের প্রভাবটা বেশি ছিলো সে কি ড্রাগ নিতো কোনো ভাবে?’

‘নাহ, সে নিতো না তাকে দেওয়া হতো।’

‘ওহ,তার শরীরে ড্রাগের উপস্থিতি যতটুক পেয়েছি আমরা তা পরিষ্কার করে দিয়েছি৷ আপনারা এখন দুশ্চিন্তামুক্ত থাকুন।’

‘আমি কি দেখতে যেতে পারবো তাকে?’ কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো ত্রিধার। ডক্টর শাহরিম মুচকি হেসে বলল,’সিওর, মিস্টার আফশান ফায়াজ।’

ডক্টরের কথায় খটকা লাগলো ত্রিধারের৷ মেয়েটি বারবার তাকে তার নামে কিভাবে সম্বোধন করছে? ফর্ম ফিলাপের সময়ও সে উপস্থিত না তবে জানলো কি করে? ভাবতে ভাবতেই কেবিনে প্রবেশ করলো ত্রিধার। স্নিগ্ধতা অবচেতন অবস্থায় শুইয়ে আছে। ডক্টর শাহরিম বলল,’জ্ঞান ফিরতে হয়তো কিছু সময় লাগবে।’

ত্রিধার ডক্টর শাহরিমের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?’

‘এমনি শুনেছিলাম কোথাও’ বলেই শাহরিম চলে যেতে নেয়। তখনই ত্রিধার বলে

‘আপনি কি শাহরিম?’ শাহরিমের পা চট করে থেমে যায়। জবাবে কিছু না বলে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘ত্রিধার!’ শাহরিম বলল

‘হুম।’ সোজাসাপ্টা জবাব দিলো ত্রিধার।

‘আমি যেদিন পালিয়ে যাই অনেক কষ্ট পেয়েছিলিস তাইনা?’

ত্রিধার স্নিগ্ধতার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,’বেশি না।’

‘ত্রিধার নামে তোকে কেউ ডাকে এখনো?’

‘আমার স্ত্রী ডাকে।’

ত্রিধারের কথায় শাহরিম হাসলো। ত্রিধার আর সে স্কুল জীবনে অনেক ভালো বন্ধু ছিলো। শাহরিম একদিন মজার ছলে প্রিয় বন্ধুর নাম রেখেছিলো ত্রিধার। কথা ছিলো এই নামেই সে তাকে ডাকবে। ত্রিধারও রাজী হয়ে যায়! তখন থেকে শাহরিমের প্রতি তার সুপ্ত অনুভূতির জন্ম নেয়। ত্রিধার বুঝেও তা নিয়ে ঘাটাতো না। তাদের বড় হওয়ার পর আচানক শাহরিম পালিয়ে যায় ত্রিধাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে। শাহরিমের পালিয়ে যাওয়ায় ত্রিধার ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলো তার প্রিয় বন্ধু তাকেও বলেনি এই ব্যাপারে কিছু এইটা তাকে আরো বেশি আঘাত করেছে। শাহরিমের প্রতি ক্ষোভ জন্ম নিলো সেদিন থেকে শাহরিমের সব স্মৃতি মস্তিষ্ক, মন থেকে মুছে ফেললেও তার দেওয়া নামটি মুছতে পারেনি! চেয়েছিলো তারপরও পারেনি ত্রিধার। শাহরিম তাকে মজার ছলে বলেছিলো একদিন,’ত্রিধার কোনোদিন যদি আমি হারিয়ে যাই তবে তুই দয়া করে এই নাম মুছিস না। অনেক শখ করে দেওয়া নাম আমার।’ হয়তোবা শাহরিমের আবদারের জন্যই মুছতে পারেনি। শাহরিমের ভেতরে বিবেক না থাকলেও তার ভেতরে আছে।

১৯.

চোখ বন্ধ করে শাহরিম আর ত্রিধারের কথা শুনছিলাম আমি। নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে আমার, অপরাধবোধ জেগেছে মনে। আমি একটুর জন্য অবিশ্বাস করেছি ত্রিধারকে! আর এই মানুষটা আজীবন আমাকে ডিফেন্ড করে গিয়েছে! আমি তার যোগ্য না! চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। পারলাম না চেপে রাখতে শব্দ করে বোকার মতো কেঁদে উঠলাম! আটকাতে চেয়েছিলাম কান্না তবে পারিনি। আমার কান্নায় ত্রিধার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! তড়িৎ আমার মাথার কাছে বসে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,’স্নিগ্ধতা, কষ্ট হচ্ছে কোথাও? এভাবে কাঁদছো কেনো?’

‘আমি কি ক্ষমার যোগ্য ত্রিধার? আমি আপনাকে অবিশ্বাস করেছি! ডিভোর্সের কথা নিজেকে সামলাতে পারিনি! চেয়েছিলাম আপনার মুখ থেকে সব শুনতে কিন্তু তার আগেই এইসব হয়ে গেলো সব।’

‘ডিভোর্স?’

আমি তখনকার ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো বললাম ত্রিধারকে। সব শুনে ত্রিধার রাগে ফেটে পড়লেন। তখনই কেবিনে পলাশী আপু আর মুমিন ভাইয়া প্রবেশ করলো। মুমিন ভাইয়া ত্রিধারকে বললেন,’আফশান, রাফাত ধরা পরেছে। চট্টগ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছিলো আমাদের পুলিশ ফোর্স হাতে নাতে ধরে ফেলে।’

ত্রিধার বক্রহেসে বললো,’ওকে বেঁধে রাখতে বল। আমি এখনি যাবো। ভেবেছিলাম ওকে সহজ ভাবে আইনের হাতে তুলে দিবো কিন্তু ও আজ যা করলো ওকে আমি কঠিন শাস্তি দিবো। ওর আত্মাও কাঁপবে।’

চলবে….

| বেশি অপেক্ষা করতে হবে না আপনাদের। শেষাংশ আজকে রাতেই পোস্ট করবো। |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here