হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব -১০+১১

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১০( বিয়ে স্পেশাল)
অবশেষে কাঙ্খিত দিনটি এসেই পরলো। আজ আরাবী আর জায়ানের বিয়ে।বউ সাজে বসে আরাবী।একটু পরেই তাকে জায়ানের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।বাহির থেকে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ আসছে।বরপক্ষ আর কনেপক্ষের মাঝে বরযাত্রী প্রবেশের টাকার জন্যে তুমুল ঝ’গড়া চলছে।জায়ান এসে পরেছে ওকে নিতে।আরাবীকে নিজের রানি করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এসে পরেছে।আরাবীর সারা শরীর কাঁপছে।চিন্তা, অস্থিরতা,ভয়,ভালোলাগা সব যে একসাথে ঝেঁকে ধরেছে ওকে।দুরুদুরু বুক নিয়ে বসে আরাবী। হাত দুটো মেলে ধরলো আরাবী। কি গাঢ় সে রঙ মেহেদীর।কাল জায়ান নিজে ওর নাম লিখে দিয়েছিলো আরাবীর হাতে।হাতে জায়ানের নামটা দেখে মুচঁকি হাসলো আরাবী।উঠে দাঁড়ালো আরাবী।আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে আরেকবার পরখ করে নিলো।লাল খয়েরী রঙের লেহেঙ্গা, মাথায় সোনালী রঙের ওড়না দেওয়া,খোঁপা করা চুলগুলো লাল,সাদা গোলাপ ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো।গা ভর্তি স্বর্ণের গহনা সাথে ব্রাইডাল মেক-আপ।একদম পার্ফেক্ট বউ লাগছে আরাবী।ভীষণ সুন্দর।জায়ান ওকে বউ সাজে দেখে কি রিয়েকশন দিবে ভেবেই লজ্জাতুর হাসলো আরাবী।দুহাতে মুখ ঢেকে নিলো।
_________
-‘ ওই মিয়া?এতো কিপটা কেন আপনি হ্যা?আর বিয়ে তো আপনার না তাই নাহ?আপনি টাকা না দেওয়ার কে হ্যা? জায়ান ভাইয়া টাকা বাহির করুন জলদি।’

আলিফার কথায় ইফতি চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো।বললো,
-‘ মিয়া? এই মিয়া টিয়া এসব আবার কি হ্যা? আর সেম কথা তো আমিও বলতে পারি তাই নাহ?বিয়ে কি তোমার?তুমি টাকা চাইবে কেন?’

আলিফা রেগে বলে,
-‘ বান্ধবীটা আমার।সো আমি টাকা চাইবো না তো কে চাইবে হ্যা? এই ফিহা তুমি কিছু বলো?তোমারও তো বোনের বিয়ে।’

ফিহা নাকচ করে বলে,
-‘ উফ আলিফা আপু আমি কথা বললে তোমাকে এনেছি কেন?আমি এতো চিল্লাপাল্লা করতে পারবো না।আমার গলা ব্যাথা করবে।আমি দাঁড়িয়ে আছি এটাই অনেক।’

আলিফা ফিহার কথায় রেগে বলে,
-‘ ন্যাকা কোথাকার একটা।’

তারপর ইফতির দিকে ফিরে আবার বলে,
-‘ টাকা না দিলে গেট ছাড়বো না।আর আমার বান্ধবীকেও দিবো না।ফিরে যান আপনারা।’

ইফতি জায়ানের হাত ধরে বলে,
-‘ হ্যা, হ্যা আমরাও আসবো না।টাকা তো আমি দিবোই নাহ।এই ভাইয়া চলো তো তুমি।’

জায়ান অসহায় হয়ে দুপক্ষের ঝগড়া দেখছে।তার মন চাচ্ছে এক্ষুনি ছুটে আরাবীর কাছে চলে যেতে।আর ওরা কিনা কি ঝগড়াঝাঁটি করছে।আর ইফতি গাধাটাও বলছে চলে যাবে।এটার মাথা খারাপ নাকি।জায়ান ইফতির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।তারপর বলে,
-‘ ইফতি টাকাটা দিয়ে দে নাহ।’

আলিফা জায়ানের এহেন কথা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
-‘ দেখছেন আমাদের দুলাভাই কতো ভালো।ভাইয়া আপনি টাকা দিন।সবাই প্রবেশ করবে শুধু আপনার এই ভাইকে বাহিরে ফেলে রাখুন।একে ঢুকতে দিবো না আমি।ব্যাটা কিপটা।’

নূর হা করে আলিফার দিকে তাকিয়ে।আলিফা যে এমন ঝগড়া করতে পারে ও ভাবতেই পারেনি।এতোদিন তো কি সুন্দর করে ওদের সাথে কথা বলতো।নূর বলে উঠে,
-‘ আলিফা আপু।তুমি এমন ঝগড়া করছো কেন?’

আলিফা একহাত কোমড়ে রেখে আরেক হাত দিয়ে ইফতিকে দেখিয়ে নূরের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘ আমি ঝগড়া করছি নাকি তোমার এই ভাই ঝগড়া করছে।পুরাই মেয়ে মানুষের মতো ঝগড়াখুন্নি। ইভেন মেয়ে মানুষের থেকেও বেশি।’

ইফতি আলিফার কথা রেগেমেগে বললো,
-‘ এই মেয়ে এই ঝগড়াখুন্নি কি হ্যা? এইগুলা কেমন ভাষা?জীবনেও এসব শুনিনি আমি।হোয়াট ইজ ঝগড়াখুন্নি হ্যা?’

ইফতির বলার ধরণ দেখে আলিফা না হেসে পারলো না।বেচারা রেগে লাল হয়ে গিয়েছে।আলিফা খিলখিলিয়ে হেসে দিলো।ইফতির রাগ যেন সেখানেই গলে পানি হয়ে গেলো।আলিফার দিকে হ্যাং মেরে তাকিয়ে রইলো। আলিফার হাসির শব্দগুলো যেন ওর হৃদয়ের ঝংকার তুলে দিচ্ছে।ধ্যান ভাঙলো নূরের ধাক্কায়,
-‘ ইফতি ভাইয়া আর কতোক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবো?পা ব্যাথা করছে তো।’

ইফতি আলিফার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ দেখো তোমরা যা চাইছো এতোটা দিবো না।আমরা যা দিবো তাই নেও।তারপর গেট ছেড়ে দেও।’

আলিফা দৃঢ় গলায় বলে,
-‘ এক পয়সাও কম নেবো নাহ। জায়ান ভাইয়া আপনি টাকা দিবেন কিনা বলেন।এই ঝগড়াখুন্নি লোকটা বেশি করছে।এই বিয়ে কি আপনার? এমন করেন কেন হ্যা?’
-‘ বিয়ে কি তোমার?’
-‘ আমার বান্ধবীর বিয়ে।’
-‘ আমার ভাইয়ের বিয়ে।’
-‘ আপনি চুপ থাকুন।’
-‘ তুমি চুপ থাকো।’

জায়ান বিরক্ত হয়ে গেলো এই দুটোর ঝগড়া দেখে।ধৈর্য’র বাঁধ ভেঙ্গে গেলো বেচারার।জায়ান ধমকে উঠলো,
-‘ আমি বিয়ে করতে এসেছি এখানে।নাকি তোদের কমেডি শো দেখতে এসেছি হ্যা?আমাকে কি জোকার মনে হচ্ছে?এখানে আর কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো হ্যা?’

নূর ভাইয়ের কথায় ফিঁক করে হেসে দিলো।জায়ান নূরকে ধমক দিয়ে বলে,
-‘ তুই হাসছিস কেন?’

নূর একগাল হাসলো।বললো,
-‘ ভাইয়া আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।’

-‘ কি আইডিয়া জলদি বল।যদি আইডিয়া ভালো না হয়।তাহলে থা’প্পড় দিয়ে তোর গাল লাল করে দিবো।আমার মাথা কিন্তু অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে।’

জায়ানের কথায় নূর বিরক্ত হয়ে বলে,
-‘ কথায় কথায় শুধু ধমকাও। এমন কেন তুমি?’
-‘ তুই বলবি?’

নূর মুখ ভেংচি কেটে বলে,
-‘ বলছি।তুমি ওদের বলো ভাবিকে এখানে আনতে।ভাবি যদি বলে আলিফা আপুরা যতোটাকা চেয়েছে তাই দিতে তাহলে তুমি দিয়ে দিবে।আর যদি না আনে তাহলে তুমি টাকা না দিয়েই ভীতরে প্রবেশ করবে।আমি সিউর ওরা ভাবিকে এখানে আনবে না।আর তোমার টাকাও দিতে হবে না।ইফতি ভাইয়া আর আরাবী আপুর ঝগড়াও থেমে যাবে।’

জায়ান বাঁকি হাসি দিলো।বললো,
-‘ পুরো একদিনের জন্যে আমার কার্ড তোর।’
-‘ ইয়াহুউউউ!’

জায়ান এইবার গলা খাকাড়ি দিলো।আলিফার উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ আলিফা আমার কথা শুনো।’

আলিফা ইফতির সাথে ঝগড়া থামিয়ে জায়ানের দিকে ধ্যান দিলো।জায়ান আবারও বললো,
-‘ আমি একশর্তে টাকা দিবো।’

আলিফা ভ্রু-কুচকে বললো,
-‘ কি শর্ত?’

জায়ান বাঁকা হাসলো।বলে উঠলো,
-‘ আরাবীকে এখানে নিয়ে এসো।ও যদি নিজে আমাকে তোমাদের দাবি করা টাকা দিতে বলে আমি নির্দ্বিধায় টাকা দিয়ে দিবো।আর যদি ওকে না আনতে পারো তাহলে একটাকাও আমি দিবো না।তুমি গেট ছেড়ে দিবে এমনিতেই।’

আলিফা সাথে সাথে চেচিয়ে বললো,
-‘ অসম্ভব এখানে আরাবীকে আনাই যাবে নাহ।’
-‘ তাহলে গেট ছেড়ে দেও।টাকার আশাও।’

জায়ানের কথায় আলিফা কাঁদো কাঁদো মুখে তাকালো।ইফতি ফিঁক করে হেসে দিলো।আলিফার শরীর জ্ব’লে গেলো ইফতির হাসিতে।রেগে বলে,
-‘ এই একদম হাসবেন নাহ।একেবারে দাঁত ভেঙ্গে দিবো আপনার।’

ইফতি হাসতে হাসতেই বলে,
-‘ আমি তো হাসবোই দেখি তুমি কি করো।’

আলিফা রেগে কিছু বলবে তার আগেই জায়ান টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-‘ আলিফা কি করবে?আরাবীকে আনবে?নাকি বিনা টাকায় গেট ছাড়বে?’

আলিফা অগ্নিচোখে ইফতির দিকে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো।ইফতি আলিফাকে চলে যেতে দেখে ভাবুক গলায় বলে,
-‘ এই মেয়ে কি সত্যি সত্যিই ভাবিকে আনতে চলে গেলো নাকি?’

এদিকে জায়ান অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।আলিফা যে আরাবীকে আনতে গিয়েছে তা সে ভালোভাবেই জানে।আরাবীকে এখনি দেখতে পাবে ভেবেই মনটা আরো ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছে ওর।
————
আরাবী যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত তখন ঠাস করে দরজা খুলে ধুপধাপ পা ফেলে রুমে প্রবেশ করলো আলিফা।চমকে উঠলো আরাবী।আলিফা সেদিকে ভ্রু-ক্ষেপ না করে বলে,
-‘ তোর দেবরটা এক নাম্বারের হাড়কিপ্টা সাথে একটা ঝগড়াখুন্নি।গেটের টাকা দিলো না তো দিলোই না।উফ অসহ্য।’

তারপর আরাবীর হাত ধরে বলে,
-‘ এই চল তাড়াতাড়ি হাতে সময় নেই।’

আরাবীকে টেনে নিয়ে যেতে নিবে কিন্তু তার আগে আবারও থেমে গেলো আরাবী।আরাবীর সোনালী ওড়না সামনের দিকে লম্বা করে রাখা। মানে ওর মুখশ্রী ঢাকার জন্যে সামনে একটু বড় রেখেছে।আরাবী তা মাথার উপরে উঠিয়ে রেখেছে।আলিফা এইবার তা নামিয়ে দিয়ে আরাবীর মুখ ঢেকে দিলো।তারপর বলে,
-‘ জায়ান ভাইয়া বলেছে তোকে সেখানে নিয়ে যেতে।তুই যদি বলিস আমাদের দাবিকৃত টাকা দিয়ে দিতে তবেই সে দিবে।আর তোকে না আনলে সে একটাকাও দিবে না।টাকা ছাড়াই তাকে ঢুকতে দিতে বলেছে।এখন তোকে আমি সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।ভুলেও তুই ঘোমটা উঠাবি না বিয়ে পড়ানোর আগে তোর মুখ জায়ান ভাইয়া যেন না দেখে।তুই শুধু সেখানে গিয়ে আমাদের টাকা দেওয়ার কথা বলেই চলে আসবি সোজা এখানে,বুঝেছিস?’

আরাবী এতোক্ষণ হা করে আলিফার সব কথা শুনছিলো।পরমুহূর্তেই হেসে দিলো।আলিফা বিরক্ত হয়ে বলে,
-‘ হাসিস না তো চল।’

আলিফা সেখানে নিয়ে যেতে লাগলো আরাবীকে।আরাবী মনে মনে হাসলো।সে তো জানে কোন টাকা দেওয়ার কিছুই না। লোকটা তাকে দেখার জন্যেই এমন শর্ত দিয়েছে।তবে বিয়ের আগে তো ওকে দেখতে পারবে না জায়ান।ভেবেই মুচঁকি হাসলো আরাবী। এদিকে জায়ান লাল খয়েরী লেহেঙ্গা পড়া, সোনালী ওড়না মাথায় জড়ানো আরাবী আসতে দেখে উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে।কিন্তু ওর আশায় এক ঘামলা পানি ঢেলে দিয়ে আরাবী ইয়া বড় ঘোমটা দিয়ে ওর পুরো মুখ ঢেরে রেখেছে।আলিফাকে তো আরো একধাপ উপরে।সে আরাবীর সামনে একগাদা মানুষ দাঢ় করিয়ে দিলো।এতে আগে যাও একটু দেখতে পাচ্চিলো। এখন তাও দেখতে পাচ্ছে না জায়ান।জায়ান বিরক্ত হয়ে গেলো। অসহ্য কন্ঠে বলে,
-‘ এটা কি হলো আলিফা?’

আলিফা হেসে বলে,
-‘ কি হলো দুলাভাই? এনেছি তো আরাবীকে।এই আরাবী দুলাভাইকে টাকা দিতে বল।’

আরাবী তো ধ্যান মেরে তাকিয়ে জায়ানের দিকে।ওর হুশজ্ঞান নেই।ঘোমটার আড়াল থেকেই জায়ানকে দেখছে।লোকটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।খয়েরী রঙের সেরওয়ানির মাঝে সোনালী জারি সুতোর কাজ করা।মাথায় পাগরি পরে বর বেশে দাড়ানো জায়ানকে দেখে যেন আরাবীর হৃদয় থমকে গিয়েছে।আরাবীর মাঝেমধ্যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।এমন একটা সুদর্শন পুরুষ নাকি আর একটু পরেই ওর স্বামি হয়ে যাবে।ওর অর্ধাঙ্গ, ওর চিরজীবনের সাথী,ওর জীবনসঙ্গী। আলিফা আরাবীর নড়চড় না দেখে আরাবীকে ধাক্কা দিলো।এতে যেন হুশ ফিরলো আরাবীর।আলিফা করমর করে বলে,
-‘ কিরে কিছু বলছিস কেন?’

আরাবী যেন কথাই বলতে পারছে না। জায়ানকে দেখে যেন ওর বাকশক্তিও লোপ পেয়েছে।আরাবী বহু কষ্টে কাঁপা গলায় বলে,
-‘ দি..দিয়ে দিন না ওরা যা চাইছে।আজই তো এমন করবে।দিয়ে দিন।’

কথাটা বলতে দেরি।আলিফা ইশারা করলো আরাবীর এক কাজিনকে। সে দ্রুত আরাবীকে সেখান থেকে নিয়ে গেলো।ঘটনাটা দ্রত ঘটলো যে কেউ কিছুই বুঝলোই না।আলিফা ইয়া বড় হাসি দিয়ে বলে,
-‘ কি দুলাভাই আপনার শর্ত আমি মেনেছি।এইবার টাকা দিন।’

আর কিইবা করার আছে।বরপক্ষকে হার মানতে হলো কনেপক্ষের কাছে।জায়ান গুনে গুনে পাক্কা নগদ ত্রিশ হাজার টাকা দিলো আলিফার হাতে।আলিফা সুন্দর ভাবে কেঁচি দিলো জায়ানের হাতে।জায়ান গম্ভীর মুখ নিয়েই ফিতা কেটে দিলো।সবাই হৈ হৈ করে উঠলো।বরপক্ষকে ভীতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো। ইফতি যেতে নিতেই আলিফা হাতের টাকা দিয়ে বাতাস করার দেখিয়ে বলে,
-‘ ঝগড়াখুন্নি সরি সরি আপনি তো ছেলে ঝগড়াখুন্না হবে। এতোক্ষণ আমি ভুল বলছিলাম।যাক ঝগড়াখুন্না হেরে গেলো।’

ইফতি কিছুই বললো না।শুধু দু আঙুল ওর চোখের দিক ইশারা করে আবার আলিফার দিকে ইশারা করলো।এমন তিনচারবার করলো।মানে পরে তোমাকে দেখে নিবে।এমন বুঝালো।আলিফা ভেংচি কাটলো।ইফতি রাগে ফুসতে ফুসতে চলে গেলো।
———–
এদিকে আরাবীর কাজিন আরাবীকে রুমে দিয়ে আসতেই আরাবী দ্রুত ঘোমটা উঠিয়ে জোড়েজোড়ে শ্বাস নিলো।লোকটাকে দেখে তার শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছে।আরাবী বিছানায় বসে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি খেয়ে নিলো।ঠিক তখনই ব্যাগে রাখা আরাবীর ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠলো। আরাবী ফোনটা বের করে দেখে জায়ান মেসেজ করেছে।আরাবী দুরুদুরু বুক নিয়ে মেসেজ ওপেন করলো।সেখানে লিখা

‘ আমার তৃষ্ণা পেয়েছে।ভীষণ রকম তৃষ্ণা।স্নিগ্ধ এক কাঠগোলাপকে দেখার তৃষ্ণা পেয়েছে।আমার এই তৃষ্ণা যেন কাঠগোলাপ দ্রুত মিটিয়ে দেয়।আমি সেই অপেক্ষায়।’
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১১(বিয়ে স্পেশাল)
আরাবী আর জায়ানকে মুখোমুখি করে বসানো হয়েছে।তাদের সামনে লাল রঙের ওড়না দিয়ে দেওয়া।যাতে একে-অপরকে দেখতে না পারে।কিন্তু ওড়নাটা পাতলা জায়ান এতে আরাবীকে দেখতে পারছে।কিন্তু সমস্যা একটাই আরাবী ওর সেই সোনালী রঙের ওড়না দিয়ে ইয়া বড় ঘোমটা টেনে বসে।তাই আরাবীর চেহারা দেখতে পারছে না ও।জায়ান বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো শব্দ করলো।অবশেষে কাজি সাহেব নিজের কাজ শেষ করে জায়ানের উদ্দেশ্যে কবুল বলতে বলবেন।জায়ান একপলক আরাবীর দিকে তাকিয়ে ফটাফট তিন কবুল বলে ফেললো।এইবার আরাবীর পালা তাকে কবুল বলতে বললো কাজি। কিন্তু আরাবী নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।ওর কেন জানি মনে হচ্ছে ও কবুল বললেই ও আর ওর বাবা মায়ের থাকবে না।চিরতরের জন্যে বাবা, মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাবে।আরাবী ক’লিজাটা বোধহয় কেউ চেপে ধরে রেখেছে।বুক ফেটে কান্না আসছে ওর।কিছুতেই মুখ থেকে কবুল শব্দটা বের হচ্ছে না।ভীষণ কষ্ট লাগছে তার।বিশেষ করে ওর বাবা আর ভাইয়ের জন্যে।কাজি সাহেব আবারও কবুল বলতে বললেই।আরাবী ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
-‘ আব্বু, ভাইয়া।আমি কবুল বলবো না।আমি বিয়ে করবো না। আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো না।যাবো না।কবুল বলবো না।’

জিহাদ সাহেব মেয়ের কান্না দেখে তিনিও কেঁদে দিলেন।তাড়াতাড়ি মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন।ফাহিমেরও চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে।সে চাইলেও কাঁদতে পারছে না।ও কাঁদলে তো হবে না।ওর বাবা আর বোনকে তো ওকেই সামলাতে হবে।আরাবী বাবার বুকে মুখ গুজে চিৎকার করে কাঁদছে।সে কিছুতেই কাঁদছে।ওর একটাই কথা কবুল বললেই নাকি ও চিরজীবনের জন্যে ওর পরিবার থেকে দূরে সরে যাবে। ফাহিম এসে আরাবীর পাশে বসলো।আরাবীর মাথায় রাখতেই আরাবী জিহাদ সাহেবের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তাকালো।ফাহিম দেখেই আবারও ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।
-‘ ভাইয়া,আমি যাবো না ভাইয়া।যাবো না।আমি বিয়ে করবো না।কবুল বলবো না।’

ফাহিম আরাবীকে বুকে জড়িয়ে নিলো।আরাবীর মাথা য় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-‘ আচ্ছা আচ্ছা।তুই আগে শান্ত হো দেখি।যাস না তুই।এখানেই থাকিস।ঠিক আছে?আমি যেতে দিবো না।কিন্তু বিয়ে তো করতে হবে তাই নাহ বোন? সবাই নাহলে আমাদের বলবে দেখো দেখো বিয়ের আসরে মেয়ে বিয়ে না করেই চলে গেছে।তখন আমাদের কতোটা খারাপ লাগবে ভাব।জায়ানেরও তো মন খারাপ হবে।’

আরাবী কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।জায়ান শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেঁদেকেটে বাবার আর ভাইয়ের বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে।অবশেষে প্রায় আধাঘন্টা যাবত জিহাদ সাহেব আর ফাহিম আরাবী বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করলো।কিন্তু আরাবীর কান্নার রেশ কমলো না।আরাবী হেঁচকি তুলতে তুলতে কবুল বলে দিলো।সবাই ‘ আলহামদুলিল্লাহ!’ বললো।তারপর কাবিননামায় জায়ানের স্বাক্ষর নিয়ে তারপর আরাবীর স্বাক্ষর নেওয়া হলো।আজ থেকে জায়ান আরাবী জুড়ে গেলো একে-অপরের সাথে সারাজীবনের জন্যে।স্বামি স্ত্রীর মতো পবিত্র বন্ধনে বাধা পরলো দুজন।আজ থেকে তাদের চিরজীবনের জন্যে একে-অপরের হাত রেখে সকল বিপদ-আপদের মোকাবেলা এগিয়ে যাওয়ার পথ পারি দেওয়া শুরু হলো।আজ থেকে তারা একে-অপরের পরিপূরক। অবশেষে সকল নিয়ম-রিতি শেষ করে বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেলো।আরাবী ওর বাবা আর ভাইকে খামছে ধরে আছে।সে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না যাওয়ার জন্যে।কান্না করতে করতে একটা কথাই বলছে,
-‘ আমি যাবো না।যাবো না আমি।আব্বু,ভাইয়া তোমরা তো বললে আমায় যেতে দিবে না।তাহলে এমন কেন করছো?যাবো না আমি।’

জিহাদ সাহেবও কাঁদছেন।তিনি আরাবীর হাত জায়ানের হাতে তুলে দিয়ে।কান্নারত গলায় বলেন,
-‘ আজ থেকে আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা।আমার মেয়ের খেয়াল রেখো।কখনো ওকে কষ্ট দিও না। সহ্য করতে পারবো না।’

জায়ান আরাবীর হাতটা শক্ত করে ধরলো।দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
-‘ এইযে ধরলাম আর ছাড়ছি না।সারাজীবন ওকে আগলে রাখবো।কথা দিলাম আব্বু।’

জিহাদ সাহেব কান্নায় পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন।নিহান সাহেব বলেন,
-‘ জিহাদ সাহেব কাঁদবেন না।ইনশাআল্লাহ আপনার মেয়েকে আমি আমার মেয়ে করেই রাখবো।আমার নূর যেভাবে থাকে আরাবী মাও সেইভাবেই থাকবে।কাঁদবেন নাহ।’

জিহাদ সাহেবকে লিপি বেগম ধরে রাখলেন।ফিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তার বেশ ভালোই লাগছে।আরাবীকে একটা মুসিবত মনে হয় ওর।ভালোই হবে ও বিদায় হলে।ভাবলো ফিহা।

এদিকে আরাবী জায়ানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফাহিমের কাছে গিয়ে ওকে ঝাপ্টে ধরে।শক্ত করে ধরে রেখেছে।আদরের বোনকে এইভাবে কাঁদতে দেখে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারলো না ফাহিম।ওর চোখ দিয়েও গড়িয়ে পরলো একরাশ কষ্টের অশ্রু। আরাবী বলছে,
-‘ ভাইয়া আমি যাবো না।তোমরা আমাকে পাঠিয়ে দিও না ভাইয়া।আমি থাকতে পারবো না ভাইয়া।এমন করো না আমার সাথে।’

ফাহিম আরাবীকে বুকে নিয়েই আগাচ্ছে।ওর আরাবীকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে,
-‘ আজ একটু যা আরাবী।এইতো কালই আমরা আসছি। তোকে কালই নিয়ে যাবো।ভাব তুই বেড়াতে যাচ্ছিস।একটা রাতই তো।’
-‘ নাহ, যাবো না। যাবো না আমি।’

ফাহিম ইশারা করলো জায়ানকে। জায়ান ইশারা বুঝতে পেরে আরাবীকে টেনে ফাহিম থেকে সরিয়ে আনলো আরাবীকে কোলে তুলে নিলো একঝটকায়।আরাবী ওর হুশে নেই। সে এককথাই বলছে। ও যাবে না।জায়ান কোলে নেওয়ায় জায়ানকে খামছি,কিল,ঘুষি সব দিচ্ছে।একসময় আরাবী ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পরলো জায়ানের বুকে।তবুও ওর চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পরছে।ফাহিমের কষ্ট বুক ফেটে যাচ্ছে।জায়ান ফাহিমকে আশ্বাসবাণী দিলো,
-‘ কান্না করো না।ইনশাআল্লাহ তোমার বোনকে রানি বানিয়ে রাখবো।কোন কষ্টকে তাকে ছুতে দিবো না।’

ফাহিম মাথা দুলাতেই জায়ান আরাবীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।নূর এইবার এসে ফাহিমের সামনে দাড়ালো।নূরও কাঁদছে এটা ভেবে এভাবে তো ওকেও একদিন চলে যেতে হবে ওর পরিবারকে ছেড়ে।তাই আরাবীকে দেখে নিজেও আর কান্না থামাতে পারেনি।নূর কান্নারত স্বরে ফাহিমকে বললো,
-‘ আপনি কাঁদবেন না।আমি ভাবির খেয়াল রাখবো।কোন চিন্তা নেই।ভাবির যখন মন চাইবে ভাবিকে এখানে নিয়ে আসবো।ভাইয়া নিয়ে না আসলেও আমি নিয়ে আসবো।আর আপনার যখন মন চাইবে আপনিও আমাদের বাড়ি এসে যাবেন।কাঁদবেন না।আপনি কাঁদলে আংকেলকে কে সামলাবে।’

নূর চলে গেলো।ফাহিম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের যাওয়ার পাণে।মেয়েটা কি সুন্দরভাবে তাকে বুঝ দিয়ে গেলো।একটু আগেও না কিভাবে বাচ্চাদের মতো লাফালাফি করছিলো।আর এখন কেঁদেকেটে অস্থির।জায়ানদের গাড়ি চলতে শুরু করলো।ফাহিম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।মনেপ্রাণে দোয়া করলো যাতে তার বোনটা সুখে থাকে আজীবন।
____________
মাইক্রোবাস নিয়েছে জায়ান’রা। ড্রাইভারের সাথে জায়ানের এক কাজিন বসেছে।তারপর বসেছে জায়ান আর আরাবী।তার পিছনে নূর আর ইফতি আর তাদের আরও একটা কাজিন।জায়ান আরাবীকে বুকে নিয়ে বসে আছে।অতিরিক্ত কান্নার কারনে মাথা ব্যাথায় ঝটফট করছে আরাবী।তাও ওর কান্না থামছে না।এখনো জায়ানের বুকে নিস্তেজ হয়ে আছে।জায়ান এইবার আরাবীর গালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
-‘ হয়েছে তো।আর কাঁদেনা।কালই তো নিয়ে আসবো তোমাদের বাসায়।’

আরাবী জায়ানের বুকের কাছটায় খামছে ধরলো।জায়ান পকেট থেকে রুমাল বের করে আরাবীর চোখের জলগুলো মুছে দিলো।কিন্তু লাভ কি আবারও গড়িয়ে পরছে তা আপনগতিতে।জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মেয়েটার চোখের এক একফোটা পানি তার কলিজায় ছু’রির ন্যায় আঘাত করছে।কিন্তু করার কিছু নেই। এইটাই প্রকৃতির নিয়ম।আদি যুগ থেকে এটাই হয়ে আসছে। জায়ান এইবার হাতের সাহায্যে আরাবী চোখের পানি মুছে দিলো।মাথাটা নিচু করে আরাবীর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
-‘ কাঁদে না তো আর।তুমি যখন চাইবে আমি তখনই তোমায় তোমাদের বাড়ি নিয়ে আসবো। এতো কান্না করলে অসুস্থ হয়ে পরবে আরাবী।এইভাবে চোখের জলগুলো ফেলে আমার বুকের দহন বাড়িয়ে দিও না।’

আরাবী জায়ানের বুকের কাছে যেই হাতটা দিয়ে খামছে ধরেছিলো সেই হাতের উপর হাত রাখলো জায়ান।একইভাবে আবার বলে,
-‘ কাঠগোলাপের অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া আমার হৃদয়ের পীড়া যে বাড়িয়ে দেয় তা কি সে জানে নাহ?এইভাবে কাঁদলে তো বুকের ভীতরটা ঝাঝ’ড়া হয়ে যায়। কাঠগোলাপের চোখে অশ্রু না।তার ঠোঁটে মুক্তজোড়া অমায়িক হাসিই বেশি সুন্দর লাগে।’

আরাবী কান্না থেমে গেলো জায়ানের এতো আবেগঘন কথা শুনে।বুকের ভীতরটা শীতলতায় ছেঁয়ে গেলো।হৃদস্পন্দন বেরে গেলো।মিইয়ে গেলো আরো জায়ানের বুকের মাঝে।জায়ান হাসলো তা দেখে।তারপর আরাবীর ঘোমটার উপরেই চুমু খেয়ে বিরবির করলো,
-‘ অবশেষে আমার অপেক্ষা শেষ হলো।তুমি আমার।শুধুই আমার। আমার কাঠগোলাপ।আমার বউ।’

#চলবে________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here