হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব -০১

মধ্যরাত। এমপির ছেলে তরীর বাসায় মাতাল অবস্থায় মেঝেতে পরে রয়েছে। তরীর ছোটো বোন সাবিয়া চোখ-মুখ ভীত করে তরীর হাতের অংশ খামচে ধরে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা তরীর পেছন ঘেঁষে৷ ভীত নজরে ঘনঘন পলক ফেলতে ফেলতে মাতাল সিদাতকে দেখছে। তরীর মনে ভয় কাজ করছে না, এমন নয়। সে নিজেও কিছুটা ভীত। তাও ছোটো বোনের কারণে সে নিজের ভীত ভাবটাকে প্রকাশ করতে চাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ আগেই খুব জোরে কেউ দরজায় নক করেছিলো। সময়টা মাঝরাত। কোনো সংকেত বা কারণ ছাড়াই সদর দরজায় এমন বিকট, বিদঘুটে আঘাত পরলে যে কেউ-ই ভয় পাবে। তরী এবং সাবিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তার ওপর পুরো ফ্ল্যাটে দুজন একা মেয়ে। ঘরের কোনো গুরুজন বা অভিভাবক বাড়ীতে নেই। তরীর বাবা-মা উভয়েই উমরাহ হজ্জ করতে গিয়েছে। তাদের অনুপস্থিতিতে দুই মেয়ের দায়িত্বে ছিলো তরীর একমাত্র ফুপি। তারও হঠাৎ শ্বাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পরে। এখন না গিয়েও উপায় নেই। যার কারণে একপ্রকার বাধ্য হয়ে সে ছুটেছে হসপিটালে। বলেছে ভোরের আলো ফোটার পরপর-ই ফিরবে। তরী এবং সাবিয়া অবশ্য ভেবেছিলো এক রাত কোনো রকমে কেটে যাবে। এজন্য নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গিয়ে ঘটলো এই বিপত্তি। যতো সমস্যা, ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট আজই হতে হলো। ফুপির অনুপস্থিতির দিনেই।

দুজন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে অন্ধকার রুমে বসে রইলো শব্দ থামার অপেক্ষায়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কড়াঘাতের শব্দও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সবশেষে না পেরে তরী রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। তরীর পিছুপিছু সাবিয়াও এলো। ভয়ার্ত কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বোনকে বারবার বললো,
–“আমার বড্ড ভয় করছে গো আপু। চলো না রুমে চলে যাই!”

তরী তখন ছোটো বোনকে আশ্বস্ত করে বললো,
–“ভয় নেই। কিছু হবে না। আমায় ব্যাপারটা দেখতে দে।”

তরী সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই শুনতে পেলো পুরুষালি জড়ানো কন্ঠ। কড়াঘাত করতে করতে এলোমেলো বুলি আওড়াচ্ছে,
–“এই অনয়। ম*রা। এত ঘুমিয়ে কী হবে? খোল দরজা। ভীতুর ডিম। দরজা না খুললে ভেঙে ঢুকে যাবো। খোল!”

তরী বুঝলো অপরপাশের লোকটির কোথাও ভুল হচ্ছে। তরী দরজার দূরবীন কাচ দিয়ে লোকটির মুখ দেখতে চাইলো। কিন্তু সফল হলো না। মুখটা একদম দেখা যাচ্ছে না। এজন্যে তরী চেঁচিয়ে বললো,”কে?”

হঠাৎ পরিবেশ কেমন নীরব হয়ে গেলো। কেমন গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। সাবিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আবারও বাহির থেকে পুরুষালি কন্ঠ শোনালো। কথার সুরও ছিলো অদ্ভুত।
–“তোর কন্ঠ মেয়েদের মতো কবে হলো রে অনয়? কোনো ভয়েজ রেকর্ড প্লে করেছিস নাকি? চালাকের বাপ, দরজা খুল!”

তরী এবার বুঝতে পারলো আগন্তুক লোকটি পাশের ফ্ল্যাটে না গিয়ে ভুলবশত তাদের ফ্ল্যাটের সামনে চলে এসেছে। তরী ভেতর থেকে-ই চেঁচিয়ে বললো,
–“আপনি ভুল ফ্ল্যাটের সামনে এসেছেন। আপনি যাকে খুঁজছেন সে হয়তো পাশের ফ্ল্যাটে!”
পরপর ওপাশ থেকে শোনা গেলো,
–“দেখ অনয়। আমি ঠিক ফ্ল্যাটেই এসেছি। শুধু তুই আমাকে ভোলাচ্ছিস এসব বলে। আমি তোর সব চালাকী জানি। তাই ভালোয় ভালোয় বলছি দরজা খোল। অনয়!”

লোকটার ভুলভাল কথা-বার্তা এবং এত কোলাহলে তরী অতীষ্ঠ। ছোটো বোনটাও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। এজন্যে সিদ্ধান্ত নিলো সে দরজা খুলে প্রমাণ দিবে সে অনয় নয়। লোকটিও ভুল করে চলে এসেছে। তরীর এরূপ বেপরোয়া, হতজ্ঞান-হীন সিদ্ধান্তে পা ফেলে দরজা খুললো। তরী দরজা খুলতেই লোকটি হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আচমকা মাটিতে লুটিয়ে পরলো। কোনো রকম কথা-বার্তা ছাড়াই। এমন কর্মে দুই বোন-ই ভীষণ ঘাবড়ে গেলো। কেউ দেখে ফেলার ভয়ে তরী দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো।

সাবিয়া চিৎকার দিতে গিয়ে নিজেকে থামিয়ে ফেললো। কেমন চেনা চেনা লাগছে চেহারাটা। মিনিটখানেক মাথা খাটাতেই মনে পরলো এটা এমপি সাঈদ হোসেনের ছোটো ছেলে। সাবিয়ার মাদ্রাসায় এক অনুষ্ঠানে বাপ-ছেলেরা মিলে এসেছিলো। এই ছেলের নাম সিদাত। তবে এই ছেলে মঞ্চে না থেকে ছেলেদের আসনের মাঝামাঝিতে বসেছিলো। সাবিয়া বেশ কয়েকবার দেখেছে। তাই চেহারা মনে আছে। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়াতে বাপ-ছেলেকে প্রায় সময়ই দেখা যায়। তাই সিদাত মোটামুটি পরিচিত মুখ।

দুই বোন যখন সিদ্ধান্ত নেয় পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটাকে ডাকতে যাবে ঠিক তখনই ঘন ঘন পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। সাথে একাধিক কন্ঠস্বর। দুই বোনের আত্মা হিম হয়ে গেলো। তরী নিজের অজান্তেই রুমের লাইট বন্ধ করে দিলো। অতঃপর ভয়ে ভয়ে দরজার দূরবীন কাচে এক চোখ রাখলো। সাবিয়ার পিঠ তখন দেয়ালের সাথে লেপ্টে রয়েছে। মনে-প্রাণে আল্লাহ্কে ডাকছে। যত দোয়া-দরুদ জানে সব একে একে মিনমিন করে পড়ছে। ওদিকে সিদাত অচেতন হয়ে মেঝেতে পরে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই। সিঁড়ির বাতি জ্বালানো থাকায় তরী লোকগুলোকে দেখতে পেলো। প্রায় সাত-আটজন লোক। তাদের সদর দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। ওরা যত এগিয়ে আসছে তরী ততটাই ভয়ে জর্জরিত হয়ে দুর্বল হয়ে পরছে। ভীষণ ভয়ে হাত-পা জমে গেছে। নিঃশ্বাসটাও আটকে আসছে বারবার। ফ্ল্যাটে নক করতেই যাবে ওমনি একজন চাপা স্বরে বললো,
–“এটা না বস৷ পাশের ফ্ল্যাটটা!”

লোকটা ভ্রু কুচকে বললো,
–“তুমি শিওর তো?”
–“হ্যাঁ। খোঁজ খবর নিয়েই আসছি। এছাড়াও আমরা যখন আসতেছিলাম তখন দেখেছিলাম এই ফ্ল্যাটের লাইট জ্বলছে। এর মানে এই ফ্ল্যাটেই শিকার আছে!”
কথাগুলো শুনতেই সামনের লোকসহ সবাই পাশের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কড়া নাড়লো। তরী আর কাউকে দেখতে পেলো না। সাবিয়া কিছু বলতে নিলে তরী সঙ্গে সঙ্গে সাবিয়াকে খোঁচা দিয়ে থামিয়ে দেয়।

মিনিট দুয়েকের মাঝেই নিস্তব্ধ এই রাতে খুব করে ধস্তাধস্তির শব্দ শোনা গেলো। সাবিয়া এসব শুনে আর না পেরে দ্রুত ভেতরে চলে গেলো। নামাজে দাঁড়াতে হবে। এই বিপদে মাবুদের কাছে সাহায্য কামনা করতে হবে। তিনি ব্যতীত সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তরী তখনো মূর্তির মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সিদাত তখন নিশ্চিন্তে, বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আরও এক দল এলো। পরপর আবার সব দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পায়ের কেমন ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। ভবন যেন ভূমিকম্পের মতো কাঁপছে।

এরপর আর কোনো শব্দ নেই। নিস্তব্ধ, শব্দহীন পরিবেশ। তরী বিপদ কেটে গেছে ভেবে লাইট জ্বালালো। ফ্যান চালালো। লাইট জ্বালাতেই দেখলো সিদাতের মুখ, গলা জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তরী সিদাতকে ধরা তো দূর, কাছেও গেলো না। উলটো সরু চোখে সিদাতকে দেখতে দেখতে সিদাতের পাশ কাটিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। পেছন ফিরে সোফার ফোমে কনুইয়ের ভার দিয়ে কতক্ষণ সিদাতের দিকেই চেয়ে রইলো। এত কিছু ঘটে গেলো আর এই মহাশয় মাতাল হয়ে স্বস্তিতে ঘুমোচ্ছে। হায়রে বড়োলোকি কারবার। এদের কাছে ভালো-খারাপের বাছ-বিচার নেই। এরা খারাপ কাজকেই স্মার্টনেস দাবী করে। অন্তত কোনো ভদ্রলোকের ছেলে এরকম মাতাল হয়ে অন্যের ঘরে ঢুকবে না। তাইতো তরীর মনে সিদাতের প্রতি এক আলাদা বিতৃষ্ণা এবং বিরক্তি জম্মেছে।

তরী ফোমে মাথা ঠেকাল। ঘুমে চোখ জোড়া নুইয়ে আসছে। কিন্তু এই লোককেও তো বের করতে হবে। পাশের ফ্ল্যাটে এখন যাওয়াটা কী ঠিক হবে? যদি কোনো বদ লোক থেকে থাকে? তখন? এসব ভাবতে ভাবতে-ই তরীর চোখ লেগে গেলো।

কলিংবেলের শব্দে তরীর ঘুম ভেঙে গেলো। ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসে সে। আশেপাশে নজর ফেলে বুঝলো সোফাতেই ঘুমিয়ে পরেছিলো সে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। আধা ঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছে সে। তরী একপলক সিদাতের দিকে তাকিয়ে মাথার ওড়নাটা ভালো করে টেনে নিলো। অতঃপর হাই তুলতে তুলতে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দূরবীন দিয়ে আগে দেখে নিলো কে এসেছে। অপরিচিত মুখ। তরী ভেতর থেকেই বললো,
–“কে?”

পরমুহূর্তে বাহির থেকে শোনালো,
–“অনয়। দরকারে এসেছি।”

অনয় নামটা শুনেই তরী বুঝে গেলো সিদাত একেই খুঁজছিলো। কিন্তু তরী সাহস পাচ্ছে না দরজা খোলার। এক ভুল বারবার করতে চাচ্ছে না। বাহির থেকে আশ্বস্ত কন্ঠে অনয় বললো,
–“দেখুন, ঘাবড়াবেন না। আমি জানি আমার বন্ধু আপনার বাসায়। আমি ওকে নিয়েই বেরিয়ে আসবো। আর বিরক্ত করবো না।”

কথা-বার্তায় ভদ্র মনে হলো অনয়কে। তাও তরী ঘরের ভেতর থেকে ফুলের ঝাড়ুটা নিয়ে আসলো। আগে থেকে সাবধান থাকা ভালো। দরজার পাশের দেয়ালে সেটা হেলিয়ে রেখে তটস্থ হয়ে দরজাটা খুললো। দরজা খুলতেই অনয় দেখতে পেলো সদর দরজার কাছাকাছি মেঝেতে তার প্রিয় বন্ধু অচেতন হয়ে পরে আছে। নেশা করার গাল, নাক লাল। চুলগুলোও উষ্কখুষ্ক, এলোমেলো। অনয় ভারী অবাক হলো। সিদাতকে কেউ মনে হয় ছুঁয়েও দেখেনি। অন্তত ভদ্রতার খাতিরে মেঝে থেকেও ওঠায়নি। যেন সে কোনো তুচ্ছ বস্তু, অবহেলার পাত্র। এ নিয়ে অবশ্য তরীর কোনো রকম মাথা ব্যথা নেই।

–“আপনার দেখা শেষ হলে দ্রুত ওনাকে নিয়ে বের হোন।”
অনয় অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো তরীর দিকে। কয়েকবার পলক ফেলে হালকা গলা খাঁকারি দিলো। অতঃপর সময় বিলম্ব না করে ব্যস্ত হয়ে বললো,
–“হ..হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই!”

অনয় ভেতরে এসে সিদাতকে ধরে উঠে বসালো। অতঃপর সিদাতের এক হাত অনয়ের কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড় করালো। তারপর ধীরে-সুস্থে বেরিয়ে গেলো। অনয় যেতে যেতে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
–“ধন্যবাদ, সিদাতের বিপদের সময়ে তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য!”

তরী অনয়ের কোনো কথার জবাব না দিয়ে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। আর অনয় হতভম্ভ হয়ে চেয়ে রইলো। অনয় তো ধন্যবাদ দিলো। ধন্যবাদের উত্তরে এভাবে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো? অদ্ভুত মেয়ে তো! অনয় কোনোরকমে টেনে-টুনে সিদাতকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলো।

তরী দরজা লাগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এক রাতে কত কিছু ঘটে গেলো। তরী ঘাড় বাঁকিয়ে ঝাড়ুটার দিকে তাকালো। অতঃপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ঝাড়ুটা নিয়ে সঠিক জায়গায় রেখে রুমে এলো। রুমে এসে দেখলো সাবিয়া জায়নামাজেই শুয়ে ঘুমোচ্ছে। তরী সাবিয়ার কাছে গিয়ে তাকে হালকা ধাক্কিয়ে ডাকলো। সাবিয়া ঘুম জড়ানো কন্ঠে “উম” “হুম” করতে করতে কোনোরকমে উঠে বসলো। তরী শীতল গলায় বললো,
–“বিছানায় গিয়ে ঘুমা। বিপদ কেটে গেছে!”

বিপদের কথা শুনে সাবিয়ার ঘুমন্ত মস্তিষ্ক জেগে ওঠে। একে একে সব ঘটনা তার মস্তিষ্কে নাড়া দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সাবিয়ার তন্দ্রাভাব কেটে গেলো। ঘুমে আড়ষ্ট হওয়া চোখ জোড়ায় মুহূর্তে-ই ভয় জড়ো হয়েছে। তরী সেই ভীত চোখে চেয়ে আশ্বাস দিয়ে বললো,
–“আর ভয় নেই। সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। মাতালটাকে তার বন্ধু অনয় এসে নিয়ে গেছে।”

গলায় আটকে থাকা নিঃশ্বাসটাকে সাবিয়া স্বস্তির সাথে ত্যাগ করলো। অতঃপর মিনমিন করে “যাক আলহামদুলিল্লাহ” বলে জায়নামাজ তুলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। তরীও হাই তুলে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বোনের পাশে শুয়ে পরলো। শুয়ে পরতেই চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসলো।

© লাবিবা ওয়াহিদ
গল্পঃ #হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০১]

~[ক্রমশ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here