হৃদয়হীনা পর্ব -০২

#হৃদয়হীনা
Part–2
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আহনাফ এখনো একটা বৃহৎ আকারের ঘোরের জন্য বিরাজ করছে। সে বর্তমানে তার হবু বউয়ের বেডরুমের সামনে অবস্থান করছে। শায়েরী অজ্ঞান হওয়ার পরপরই তাকে সকলে মিলে রুমে এনে শুইয়ে দেয়। তার মামা নাকি ডাক্তার এজন্য আর ডাক্তার ডাকা লাগেনি। তবে তার মা রুম থেকে সব পুরুষ মানুষকে বেড়িয়ে যেতে বললে সে সুরসুর করে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যেই ছেলেপক্ষদের জন্য খাবারের আয়োজন শুরু করা হয়েছে৷ প্রথম ব্যাচ বেশ আয়েশী ভঙ্গিমায় খাওয়া-দাওয়া সারছে৷ আহনাফ সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিল। রুমের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার বড্ড নির্বোধের মতো লাগছে। কিন্তু আবার ড্র‍য়িংরুমে গিয়ে বসতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার। হুট করে মেয়েটার কী হলো?অসুস্থ ছিল কি সে?

এমনই সময় পান চিবুতে চিবুতে তার বন্ধু শিহাব এসে বলে, ভাবীর কি অবস্থা দোস্ত?

আহনাফ হাল্কা মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, “কী জানি? ভিতরে কি হচ্ছে জানি না।”

শিহাব কিছু বলবে তার আগেই আহনাফ বলে উঠে, “দোস আমি কি খুব বেশী কুৎসিত? ভয়ংকর দেখতে?”

পান চিবানো বন্ধ করে সে গম্ভীর গলায় বলে, শালা কী আবোলতাবোল বকিস রে? তোর একটা অটোগ্রাফের জন্য মাইয়া গো লাইন লাগে আর কস তুই দেখতে ভালা না।

— “তাহলে ও এমনভাবে জ্ঞান হারালো কেন? আমাকে দেখেই তো মেবি সেন্সলেস হয়ে পড়েছে৷”

সে বললো, মনে হচ্ছে ভাবী তোর ডাই হার্ট ফ্যান। তোরে দেইখা আর সইতে পারে নাই৷

আহনাফ হাতের ব্রেসলেট ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, এমন তো নয় ওর এই বিয়েতে কোন সমস্যা আছে?

শিহাব বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, আরেএ ধুর ব্যাটা তুই সবসময়ই দশ লাইন বেশি বুঝিস।

তখনই ভেতর থেকে শায়েরী বাবা মাহিম সাহেব বেরিয়ে এলেন। আহনাফ তাকে দেখে স্মিত হেসে বলে, এখন কি অবস্থা?

উনি চিন্তিত মুখে বলে উঠলেন, জ্ঞান ফিরেছে ওর। এতো মানুষ-জন দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল।

— অসুস্থ ছিল কি?

— নাহ তো।

আহনাফ আর মাথা ঘামালো না। সে ড্রয়িং রুমে তার আগের অবস্থানে ফিরে আসতেই তার মা ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে বলে উঠে, দেখ তো! কি ঘটে গেল। মেয়েটার বড় ধরনের কোন অসুখ নাই তো আবার?

তখনই সোফার আরেক প্রান্তে বসা তাদেরই সঙ্গে আসা এক আত্মীয় বলে উঠে, ভাবী, ঠিকঠাক মতো মেয়ের খোঁজ নিয়েছেন তো? কোন খারাপ রেকর্ড নাই তো!আজ-কালকার ছেলে-মেয়েদের ভরসা নাই। এভাবে হুট করে অজ্ঞান হওয়া তো খারাপ লক্ষণ। প্রেগ্ন্যাসিতে এমন হয়। মেয়েকে বমি করতে দেখেছেন কি? মেয়েটা আবার প্রেগ……

তার কথা শেষ হওয়ার পূর্বে আহনাফ তার দিকে আবেগশূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সেই দৃষ্টির দিকে চেয়ে থেকে মহিলা থেমে যান৷ আহনাফও চোখ নামিয়ে নেয়৷

খানিক বাদেই তাড়াহুড়ো করে শায়েরীর মা রুমে এসে বললেন, বিয়ের কার্যক্রম তাহলে আগাই?

— বউমা এখন কেমন আছে?

— মোটামুটি সুস্থ। যদি রুমেই বিয়ে পড়ানো হত তাহলে ও আরো স্বস্তি বোধ করত।

আহনাফ তার মাকে উত্তর দিতে না দিয়ে নিজ থেকে বলে, তাহলে তাই হোক৷

উনি কথার উল্টোপিঠে সামান্য হাসলেন। আহনাফ উঠে দাঁড়ালো এবং মাকে নিয়ে বেডরুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।

সে যখন রুমটায় প্রবেশ করলো তখন অস্বস্তি আর সংকোচে মাথা উঠিয়ে রাখতে পারছিল না সে। যা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মেলে না। মাথা উচিয়ে চলা তার স্বভাব কিন্তু আজ আপাতত এই মুহূর্তে লজ্জায় তার মাথা উচানোর সাহস নেই৷ তারপর ও বেশ সাবধানতা অবলম্বন করে সে চোরা চোখে শায়েরীর পানে তাকায়। মেয়েটাকে ঘিরে মহিলা মানুষের অভাব নেই। শায়েরীকে একজন মধ্যবয়সী মহিলা শরবত পান করাচ্ছে।

আহনাফ বেড বরাবর থাকা সোফায় গা এলিয়ে বসে দ্রুত দৃষ্টি নত করে ফেলে। এবং মোবাইলে সময় দেখে নেয়। ওলমোস্ট চারটা বাজতে চললো।

তার মা শায়েরীর দিকে অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মামনি এখন বেটার ফিল করছো?

শায়েরী মুখে উত্তর না দিলেও মাথা ঝাকালো।তিনি হাসি-মুখে ফিরে এলেন৷ ছেলের পাশে বসে উনি কাজী সাহেবকে ডাকার জন্য তাগদা দিলেন৷

অতঃপর দশ মিনিটের ব্যবধানে কাজী সাহেব এসে উপস্থিত হলেন এবং আগ্রহ নিয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। খানিক মুহূর্ত বাদেই তিনি বিয়ের কনেকে উদ্দেশ্যে বলেন, মা কবুল বলো।

শায়েরী চুপচাপ বসে ছিল। ভরাট কণ্ঠে কবুল বলার নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারলো না সে। নির্নিমেষ ভাবে কবুল শব্দটা উচ্চারণ করে ।একই ভাবে কাজী সাহেব আহনাফকে কবুল বলার জন্য তাড়া দেন।

আহনাফ বিনা সময় অপচয় করে কবুল বলে দিল। কাজী যখন বললেন, আলহামদুলিল্লাহ বিয়ে সম্পন্ন হলো। সেই মুহুর্তে তার কাছে মনে হলো, বিয়ে করা খুব সহজ কাজ। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ হলো বিয়ে করা!সাক্ষর করার জন্য খাতা এগিয়ে দিলে সে সাইন করে দেয় বেশ সাবলীলভাবে। দ্বিতীয়বারের মতো সে সময় দেখে নিয়ে,এরপরে মায়ের সঙ্গে গম্ভীর গলায় কিছু কথা-বার্তা সেড়ে রুম ত্যাগ করলো।যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে অনন্ত একবার শায়েরীর মুখমণ্ডল দেখার সাধ জাগলেও, সেই সাধ অপূর্ণ রেখে সে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

শায়েরীর নজরে সবটাই ধরা পড়েছে। সে তার যাওয়ার পানে নিষ্পলক চেয়ে থেকে মাকে খুঁজতে লাগে। প্রচুন্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছে তার। বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর বড্ড হালকা লাগছে তার নিজেকে। তার বিয়ে উপলক্ষে কয়েকজন ফ্রেন্ডের আসার কথা আছে। তারা কি আসবে? শায়েরী সকল সংকোচ একপাশে সরিয়ে রেখে রুমের বাইরে বের হলো। ড্রয়িংরুম মেহমান দ্বারা গিজগিজ। পা রাখার ও জায়গা নেই। তবুও তাকে দেখে একজন এসে জায়গা করে দিল। ইতিমধ্যেই ড্রয়িং রুমে আর ডাইনিং রুম জুড়ে তিনটা দল জুটে গেছে। সব ছোট-ছোট বাচ্চারা এক দল হয়ে মেতে আছে লুকোচুরি খেলায়। অপর দিকে কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা ড্রয়িং রুমে পাটি বিছিয়ে ফ্লোরিং করে আড্ডা দিচ্ছে আর ডাইনিং রুমে সব মুরুব্বি রা চেয়ার টেনে বসে কথা বলছেন, তার মা-বাবাও সেখানে উপস্থিত। সে ড্রয়িংরুমের দলটির সঙ্গে মুহূর্তে মিশে গেল। তাদের সঙ্গে টুকটাক কথায় কথায় সময় অতিক্রম হয়ে কখন এশার আযান দিল সেদিকে মোটেও লক্ষ্য ছিল না কারো। আযান পড়ে যেতেই পুরুষরা নামাজের জন্য বেড়িয়ে যায়। সেও তার রুমে এসে পড়ে৷ পরনে তখনো বিয়ের শাড়ি। বিয়ের শাড়িতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। শাড়িটা ভারী অনেক। মনে হচ্ছে এই ভারী জঞ্জাল গা থেকে সরালো স্বস্তি পাবে সে।তখনই তার আম্মু রুমে প্রবেশ করে বলে, রাতের খাবারের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আয় নামাজ পড়ে খেতে আয়।

— ওনারা কখন যাবে?

— রাতে খেয়ে যেতে বলেছে তোর বাবা।

— শাড়ি খুলে সালোয়ার কামিজ পরি?

তার মা এক মুহূর্ত ভেবে বলেন, ঠিক আছে৷ আমি আসছি৷

মায়ের অনুমতি পেতেই সে হাফ ছেড়ে বাচলো যেন। দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল চেঞ্জ করার জন্য।

ওয়াশরুমের ভেতর থেকেই সে গুটগাট আওয়াজ পাচ্ছিল। ব্যাপার টা আমলে না নিয়ে সে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সে পিলে চমকে উঠে। চোখের সামনে আহনাফ হাসান দাঁড়িয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে চার্জার সকেটে লাগানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে তার মোটেও খেয়াল ছিল না। দরজা ঘুট করে খোলার শব্দে সে চকিত দৃষ্টিতে তার পানে চায়৷ দুজনের চোখাচোখি হতেই শায়েরী ভীষণ বিব্রতবোধ করতে লাগে। তার মুখ ভেজা। কপাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ে গলার সামন ভাগ ভিজে যাচ্ছে। ওড়নাটাও বিছানায় রাখা। বলতে গেল এই পরিস্থিতিতে সে মোটেও তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। শুকনো এক ঢোল গিলল সে।

আহনাফ তাকে এভাবে দেখে নিজেও বিব্রত হলেও মুখে প্রকাশ না করে বলে, “এখন কেমন আছো?”

এই তিনটা শব্দ শুনেই শায়েরী শরীর বেয়ে মৃদ্যু কম্পন বয়ে গেল। সে আমতাআমতা করে বলে, ভ-ভালো।

— “আলহামদুলিল্লাহ। রেস্ট নিবে এখন? ”

— না। ডিনার করব৷

–” ওহ, আমিও ডিনার করিনি।”

শায়েরী ধরতে পারল না কেন সে আগ বাড়িয়ে নিজের না খেয়ে থাকার বলছে। সে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিল। সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে এক মুহুর্তের জন্য বুঝতে দিল না যে সে তার ভক্ত। শায়েরীর এই সময় মনে হচ্ছে, সে যদি জেনে যায় তার উপর ক্লাস সেভেন থেকে শায়েরী ক্রাশ খেয়ে বসে আছে তাহলে সে লজ্জায় তাকে মুখ দেখাতে পারবে না। মানুষটা নিশ্চয়ই হাসবে তার উপর। তার নির্বোধতার উপর! তারপরও সে নম্র সুরে বলে, আসুন খেতে যাই।

তার কথা শুনে যেন সে খানিকটা বিমূঢ় হয়ে পড়ে স্পষ্ট ভাষায় বললো, “চলো।”

শায়েরী রুমের বাইরে যেতে ধরলে সে ধারালো কণ্ঠে বলে, “একটু থামো তো।”

শায়েরীর পাজোড়া সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায়।

আহনাফ তার সামনে এসে দাঁড়াতেই তার গা থেকে ভকভক করে নামী-দামী পারফিউমের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা খেল। শায়েরী অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আহনাফের দৃষ্টি যেন প্রশান্ত সাগরের ন্যায় স্থির, প্রশান্ত কিন্তু গভীর। গভীর সেই বাদামী মণিজোড়ার দিকে শায়েরী দশটা সেকেন্ডও তাকিয়ে থাকতে পারছে না৷

আচমকা তার হাতটা শায়েরীর নাকে এসে পৌঁছে গেল। তার হাতের ছোয়ায় সম্ভবত ইলেকট্রন প্রভাব হচ্ছিল, যার দরুন শায়েরীর গা বেয়ে বিদ্যুতের কম্পনের ন্যায় কিছুটা ঝট করে লাগলো। সে আরো একটু নাকে ডলা দিয়ে কি জানি মুছলো। শায়েরী একদম স্তব্ধ রইল। মুখ দিয়ে টু আওয়াজ করলো না যেন বোবা সে।কিন্তু আপনা-আপনি তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

আহনাফ বলে উঠে, ” মুখ ধোয়ার সময় চোখের কাজল লেপ্টে গিয়ে নাকের ডগায় গিয়ে ভরে ছিল। সেটাই মুছে দিলাম। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কী ভয় পেয়েছিলে?”

— না তো।

— ওহ। আমি আরো ভাবলাম ভয় পেয়ে গেছ।

— ভয় কেন পাব? আপনি কি বাঘ যে খেয়ে ফেলবেন?

আহনাফ একথা শুনে সামান্য শব্দ করে হেসে বলে, অবশ্যই আমি বাঘ৷ পিউর রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here