হৃদয়হীনা পর্ব -০৭

#হৃদয়হীনা
Part–7
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

বিছানায় পা তুলে বসে নখ কামড়াচ্ছে শায়েরী। এখন তার আফসোস হচ্ছে কেন মানুষটার সঙ্গে মিসবিহেইভ করে বসলো সে? উনি তো তার সঙ্গে একবারও খারাপ আচরণ করে না?তাহলে সে কেন করে বসে? এটা তো ভারী অন্যায়। ওনার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে যে শায়েরী আনন্দ পায় এমন না। বরং তারও মনের অজান্তেই কষ্ট লাগে। সে দু’ঘন্টা যাবত রুমেই বসে আছে। উনি একবারও এরমধ্যে রুমে আসেনি। শায়েরী ভেবে রেখেছে উনি আসা মাত্র তাকে সর‍্যি বলবে৷ এমনই সময় শ্রুতি এসে বলে, “আপু আম্মু তোকে রান্নার কাজে সাহায্য করার জন্য ডাকছে। ”

শায়েরী উঠে দাঁড়ালো। সে মোটামুটি টুকটাক ভালোই রাঁধেই।মাকে সাহায্য করলে চাপ কম হয়। বাসায় মেহমান আছে। রান্না-বান্নার চাপ ভালোই। তাদের একজন সাহায্যকর্মী আছে তাও বিয়ে উপলক্ষে কাজের চাপ বেশ। সে গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরে গেল। যাওয়ার সময় শকুন চোখে একবার ড্রয়িংরুমের দিকে তাকালো। জনাব ড্রয়িংরুমে বসে তার ছোট ছোট কাজিনগুলোর সঙ্গে লুডু খেলছে। সে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই মা ডেকে উঠে, “ওইদিকে কী করিস?”

মায়ের প্রশ্নে আহনাফও তার দিকে তাকালো। দুজনের চোখাচোখি হতেই সে চকিত উঠে এক প্রকার দৌঁড়ে রান্নাঘরে পালিয়ে বাঁচে।

রান্নার আয়োজন চলছে। মা বলেন, “আহনাফ তো ভাত খেতে চাচ্ছে।বল তো কী কী রান্না করা যায়?”

শায়েরী একদণ্ড না ভেবে বলে দেয়, আম্মু সরষে ইলিশ করি?

শায়েরীর প্রস্তাব তার মায়ের মনে ধরলো। সে বলে উঠে, “ঠিক আছে। বাসায় সরিষা নেই। কিনে আনাচ্ছি। ততোক্ষণে মাংস বসিয়ে দিই৷”

বাজার থেকে সরিষা আনা হলে শায়েরী নিজ উদ্যোগে সরষে ইলিশ তৈরি করতে আরম্ভ করল। মানুষটার জন্য সে বেশ যত্ন নিয়ে রাঁধছে। তার লজ্জাও লাগছে আবার বেশ খুশিও লাগছে৷ মিশ্র অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে মনের ছোট্ট বাগানটায়!

ইলিশ রান্না করেই সে বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। সেইসময়ও একবার আড়চোখে আহনাফকে সে পরখ করে নেয়। সে বর্তমানে ফোন চালানোতে ব্যস্ত। আর তার কাজিনরা চকলেট খাওয়ায় ব্যস্ত৷ বুঝা যাচ্ছে চকলেটগুলো আহনাফ তাদের গিফট দিয়েছে।

সে ড্রয়িংরুমের সামনে দাঁড়ানো দেখে তার চার বছরের ছোট মামাত বোন একটা ইয়া বড় ডেইরি মিল্ক সিল্কের প্যাকেট এনে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “আপু নাও।”

শায়েরী তাকে আদর করে দিয়ে বলে, তুমি খাও। ছোট না তুমি! এগুলো তোমার জন্যই তো।

–“উহু, এটার তোমার জন্য।” বলে জোর করে চকলেটটা তার হাতে গুজে খেলতে চলে যায়।ডেইরি মিল্ক যে শায়েরীর সবচেয়ে প্রিয় এটা বাসার সবাই জানে। সে নিষ্পলক তাদের দিকে চেয়ে থেকে, অবাক না হয়ে পারলো না। তার মনে অন্যরকম একটা ভালোলাগা বয়ে গেল। সবার হাতে কিটক্যাট কিন্তু কেবল তার জন্য আলাদাভাবে ডেইরি মিল্ক আনা হয়েছে। মানুষটা এতো ভালো কেন? সে মাথা নুইয়ে ফেলে। মায়ের ডাকে পুনরায় ফিরে যায়৷

মা তাকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলছে। একটু পরই বাবা অফিস থেকে আসবে৷ শায়েরী রুমে এসে গোসল সেড়ে নতুন একটা শাড়ি পড়লো। এমনিতে সে তেমন সাজে না।কিন্তু আজকে চোখে কাজল দিল। আইলাইনার দিল। ঠোঁটে লিপস্টিকও দিল হালকা করে। চুলটা সুন্দর করে আঁছড়িয়ে খোপা বেধে নিল। খোপায় ফুল গুজে দিতে পারলে ষোলা আনা পূর্ণ হত কিন্তু ফুলের অভাবে তা হলো না। সে চকলেটটায় হাত বুলিয়ে আদর করলো। এসব তার পাগলামি।রুম থেকে বের হতেই বাবার সম্মুখীন হলো সে। বাবা তাকে দেখতেই বলে উঠে, “মা এক গ্লাস পানি দাও তো। ”

শায়েরী তৎক্ষনাৎ তার বোনকে দিয়ে পানি পাঠালো। বিয়ের দিন থেকে সে বাবার সঙ্গে কথা বলে না ঠিকমতো। বাবা অবশ্য তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না। এমন না যে তার বাবা মানুষটা খারাপ। সে অবশ্যই খুব ভালো একজন মানুষ। কিন্তু হুট করে বাবা মাঝেমধ্যে ভুলভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে৷ তার বাবা কোন সমস্যা হলে নিজের পরিবারের সঙ্গে কথা না বলে, তার ভাই-বোনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন। এইজন্যই বাবার উপর একটা রাগ আছে তার।সমস্যা তাদের নিয়ে তাহলে নিশ্চয়ই তাদের সাথেই আলাপ করা শ্রেয়। তার পরীক্ষা বাদ দিয়ে বিয়ের পীঁড়িতে বসতে বলার পেছনে তার বড়ফুপুর হাত আছে এটা সে বেশ বুঝতে পেরেছে। বড়ফুপু নিজে থাকেন আমেরিকায়৷ কিন্তু তারপরও তার চিন্তাভাবনা বড্ড সেকালে। তার ফুপির বদলৌতেই তো সে আজ বিবাহিত। আহনাফের আম্মু তো সসর্বপ্রথম ফুপির কাছেই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন।সোমা আপু নামে তার এক আত্মীয়ের বিয়েতে ভদ্রমহিলা তাকে এক দেখায় পছন্দ করে ফেলেন।সোমা আপু হলো তার ফুপির ননদের একমাত্র মেয়ে।

দুপুরে খাওয়ার সময় সে নিজেকে গুটিয়ে রাখলো৷ভাত বেড়ে দেওয়ার সময় তাদের দুজনের আরেক দফা সাক্ষাৎ ঘটে। সেই সময় আহনাফ তাকে দেখে হা হয়ে তাকিয়ে ছিল। ইশ, শায়েরীর বড্ড লজ্জা করছিল সে সময়। বাবা আহনাফ আর ছোটরা আগে খেতে বসলো। তাকেও বসতে বলা হয়েছিল৷ কিন্তু সে কাস্টার্ড বানাচ্ছে এই বাহানায় পাশ কাটিয়ে যায়। তবে আহনাফকে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখে সে নিজেও খুশি হয়েছে। এখন শুধু সর‍্যি বলার পালা। কিন্তু কীভাবে সে সর‍্যি বলবে? খাওয়া-দাওয়ার পর আহনাফ তার বাবার সঙ্গে হাঁটতে বের হলো। শায়েরী বুঝে পেল না এই ভরদুপুরে মানুষ হাঁটতে যায়?নিশ্চয়ই তাকে ইগনোর করার জন্য এই বুদ্ধি এঁটেছে।

রুমে এসে বসতে না বসতেই মা হন্তদন্ত করে ছুটে এসে বলে, শায়েরী, তোর ক্লাসটিচার কল দিয়েছিল।

শায়েরীর বুক ধুকপুক করতে লাগলো। সে বলে উঠে, কী বললো ম্যাম?

— মিসড কল হয়ে গেল রে। ধরতে পারিনি।

— ব্যাক কর মা প্লিজ।

তার মা ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে কল ব্যাক করল। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো। শায়েরী তখন প্রচুর ঘাবড়ে গেছে। ম্যাম নিশ্চয়ই তাকে টিসি দিয়ে বের করার খবর দিবেন? ভাবতেই কান্না পাচ্ছে তার৷

মা কথা বলা শেষ করে, ফোনটা তার কানে ধরিয়ে দিল। সে নির্মল কণ্ঠে বলে উঠে, আসসালামু আলাইকুম, ম্যাম।

ম্যাম সালামের জবাব দিয়ে বলে, “শুন, তুমি তো এক্সাম দাওনি। যার জন্য টেস্ট এক্সামে তোমার রেজাল্ট ফেইল আসছে। কলেজ এই অবস্থায় তোমাকে বোর্ড পরীক্ষা দিতে দিবে না।”

— জানি ম্যাম।

— কিন্তু তোমার অভিভাবক অনেকবার অনুরোধ করলেন তোমাকে সেকেন্ড চান্স দেওয়ার জন্য। তোমার অভিভাবকের সঙ্গে আমিও প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে অনুরোধ করেছি। লিখিত দরখাস্ত দিয়ে রেখেছি। টেস্ট এক্সামে কয়েকজন স্টুডেন্ট ফেইল করেছে। ওদের আগামী সপ্তাহে রি-টেস্ট নেওয়া হবে। তুমিও ওদের সঙ্গে পরীক্ষা দিবে। আর হ্যাঁ অবশ্যই ভালো মার্কস পেতে হবে। আমরা আসলে চাই না কোন স্টুডেন্টের ই ইয়ার লস হোক।সবাই পরীক্ষা দিক, ভালো ফলাফল করুক এটাই চাই আমরা। কাজেই মন দিয়ে পড়াশোনা করো৷

— ধন্যবাদ ম্যাম।

ম্যামের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর শায়েরী যেন আশার আলো দেখতে পেল।ভাঙ্গা স্বপ্নগুলো পুনরায় যেন অদৃশ্য ভাবে জোড়া লাগতে লাগলো। বাবা নিশ্চয়ই প্রিন্সিপালের কাছে অনুরোধ করেছে।

তখনই বেল বেজে উঠল। তারা বুঝতে পারলো, আহনাফ আর বাবা এসেছেন।

সে নিজ থেকে গেইট খুলে দিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে আনলো দু’গ্লাস। মনটা অনেক বেশি খুশি। সে এক গ্লাস শরবত আহনাফের দিকে এগিয়ে দিল। জনাব গ্লাসটা হাতে নিয়ে এমন ভান ধরলো যেন খুব ব্যস্ত সে। শায়েরী আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলে, উনি কাকে যেন ফোন লাগালেন। আর কথা হলো না তাদের মাঝে।

শায়েরী শরবত হাতে নিয়ে, বাবার কাছে গিয়ে সরাসরি বলে, আব্বু, তুমি কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে অনুরোধ করেছো তাই না? তোমার জন্য আমাকে সেকেন্ড টাইম এক্সাম দিতে বলছে। থ্যাংকস।

তার বাবা মুচকি হেসে শরবত হাতে নিয়ে বলে উঠে, থ্যাংকসটা আমাকে না। আহনাফকে দাও। ও-ই অনুরোধ করেছিল। তোদের তো ক্যান্টনমেন্ট কলেজ। ওর পরিচিত এক মেজরকে দিয়েও রিকুয়েষ্ট করিয়েছিল। আহনাফ ছেলেটা একদম নিজের ছেলের মতো হয়ে গেছে। বাড়ির প্রতিটা প্রবলেম সে নিজের প্রবলেম হিসেবেই দেখছে।

বাবার কথা শুনে সে বিষ্মিত হলো। মানুষটা তার জন্য এতোকিছু করেছে,অথচ তাকে দেখো! সে ঠিকঠাক কথা পর্যন্ত বলে না। তার চোখ ভিজে উঠছে। ওনাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে। এমন চিন্তার কথা ভাবতেই সে লজ্জায় লাল হতে থাকে। সর‍্যির সঙ্গে তার একটা থ্যাংকস ও পাওনা রয়ে যাচ্ছে!

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here