হৃদয়হীনা পর্ব -০৯ ও শেষ

#হৃদয়হীনা
Last part
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

দিন যতোই যাচ্ছে শায়েরী সেই মানুষটার উপর মুগ্ধ না হয়ে পারে না। পড়াশোনার পাশাপাশি সে সেই মানুষটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। জীবনটা সার্থক মনে হচ্ছে। সবকিছুর মধ্যেই আনন্দ, হাসি খু?জে পায়।কোন কিছুতেই বিরক্ত লাগে না তার! আসলে একটা সত্যিকার অর্থের ভালো মানুষ পাশে থাকলে জীবনটা রুপকথার মতোই ঝলমলে আলোর মতো হবে। সে মুচকি মুচকি হেসে পড়ায় মনোনিবেশ করল। মা এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসে বলে, প্রথম পরীক্ষা কি রে তোর?

শায়েরী বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখে বলে, বাংলা৷

— আহনাফ দেশে কবে আসবে?

— ওনার আসতে আসতে আরো দেড় মাস!

মা মুখ গোজ করে বলে, “তোর এতো বড় একটা পরীক্ষা, আহনাফের এসে গুড লাক উইশ করলে তুই মনে সাহস পেতি। তোর বাবা তো ওর সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে আছে।শ্রুতির জন্য নাকি কি-সব গিফট কিনছে কালকে ছবি পাঠালো।”

শায়েরী আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না।শুধু স্মিত হাসলো সে। মা-বাবা দুইজনই আহনাফকে ভীষণ ভালোবাসে। অবশ্য এ কয়েকদিনে আহনাফের মায়ের সঙ্গেও তার বেশ খাতির হয়েছে৷কিন্তু আহনাফ যেমন তার পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে, সে এভাবে মিশতে পারেনি আহনাফের ফ্যামিলির সঙ্গে। কিছু জড়তা, লজ্জা, ভয়, অস্বস্তি কাজ করে৷ সে দুধের গ্লাস হাতে নিতেই ইন্ডিয়া থেকে কল আসলো। সে পুনরায় মুচকি হেসে কল রিসিভ করল। মা ফোন আসতে দেখে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যান।

ওপাশ থেকে আহনাফের গলা শুনতেই তার সারাদিনের ক্লান্তি কোন দূর দেশে হারিয়ে গেল। মন জুড়ে স্নিগ্ধ সুভাস ছেয়ে যাচ্ছে। ক্ষণেই আহনাফ বলে উঠে, “পড়ছিলে?”

— পড়া শেষ। আধ ঘন্টা পর ঘুমাতে যাব।

— প্রিপারেশন কেমন?

— ভালোই তো।

— বোর্ড এক্সাম যেন কবে?

— দুইদিন পর৷

আহনাফ আগ বাড়িয়ে বলে উঠে, আমার বোর্ড এক্সামের সময় আম্মা ডিম খাইতে দিত না। যদি আন্ডা পাই এই ভয়ে। রাত দশটার মধ্যে বিছানায় ঘুম পাড়ায় দিত৷

শায়েরী দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে, আমিও রাতে জেগে পড়ি না। জলদি শুয়ে পড়ি৷ আপনি কী সত্যি দেড় মাস পরে আসবেন? নাকি আগেই চলে আসবেন?

— হ্যাঁ। দেড়মাস পরই আসব৷ কেন জিজ্ঞাসা করলে? কিছু লাগবে?

— নাহ এমনিতেই জিজ্ঞাসা করলাম।কিছু লাগবে না। ওলরেডি আপনি একবার এতোগুলা গিফট পাঠালেন আর কিছু দরকার নেই। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছেন?

— সত্যি বলতে এখানকার খাবার অনেক মজা, স্টিল আম্মার হাতের রান্না মিস করছি৷ গতকাল হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানি খেলাম, দুর্দান্ত টেস্ট। আচ্ছা তুমি ঘুমাও। রাখছি৷

— রাখছি।

এরপর দুইটা দিন খুব দ্রুত কেটে গেল। পরীক্ষার আগের দিন সকালে আচমকা শায়েরী আহনাফকে স্বপ্নে দেখে এরপর থেকেই ভেতরে ভেতরে মানুষটাকে একবার হলেও দেখার আকুলতা গ্রাস করে ফেলে।নিজের ইচ্ছাকে ধামাচাপা দিয়ে সে সারাটা দিন নিজের মতো করে পড়া রিভাইজ দেয়৷ সন্ধ্যার দিকে একবার তাকে কল দিলে ফোন অফ দেখালে সে আরো বেশি কষ্ট পায়। মানুষটা খুব বেশি ব্যস্ত?

রাত ন’টার দিকে শায়েরী খাওয়া-দাওয়া সেড়ে মা-বাবা, ফুপি, চাচা, আহনাফের মা সবাইকে ফোন দিয়ে দোয়া চইল। এরপর রুমে এসে আধ ঘন্টা একটু পড়ে শুতে চলে যায়। পরীক্ষার আগের দিন কখনই সে বেশি চাপ নেয় না। বিছানায় শুতেই চোখ লেগে আসল। দশটার মধ্যেই সে ঘুমিয়ে যায়৷ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকলেও সে রুমে দ্বিতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব টের পায়৷ কারো নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে। চোখ খুলে উঠে বসতেই পরিচিত কণ্ঠে বলে উঠে, “আরে জেগে গেলে তুমি?”

শায়েরী চকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। উনি বসে আছে বিছানায়। তখন বাজে রাত সাড়ে বারোটা। এতো রাতে উনি এসেছেন! সে কি স্বপ্ন দেখছে?

আহনাফ মুচকি হেসে বলে, “আমাকে দেখে ভয় পেলে নাকি?”

শায়েরী বলে উঠে, আমি অবাকের শেষ পর্যায়ে আছি। আপনি সত্যি এসেছেন?

— জি, ম্যাডাম। খুশি এবার?

–অনেক।

আহনাফ তার হাত ধরে বলে,” তোমার জন্য এই দিনটা অনেক জরুরি। আমি পাশে না থাকলে চলে কীভাবে?এজন্য আর্জেন্ট লিভ নিয়ে দুইদিনের জন্য এসেছি।”

শায়েরীর চোখ খুশিতে চিকচিক করতে লাগলো। সত্যি বলতে সে এতোটাই খুশি যা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। চোখে সম্ভবত জল চলে এলো।

আহনাফ তাড়া দিয়ে বলে,” ঘুমাও। সকালে উঠতে হবে।”

তারা দুইজনেই শুয়ে পড়ে। একটু পর শায়েরী নিজ থেকে আহনাফের বুকে মাথা রেখে বলে, আপনি কী জানেন আপনি খুব খুব ভালো?

— “নাতো! আজ প্রথম জানলাম।”

শায়েরী তার বুকে মুখ গুজে লজ্জা পাওয়া গলায় বলে, আপনি জানেন না তো, আমি সেই ক্লাস সিক্স-সেভেন থেকে আপনার ফ্যান ছিলাম। আপনার প্রতিটা মুভি আমি দশবার করে দেখতাম আর নায়িকার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতাম।

আহনাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “এইজন্য ফোনের লকস্ক্রিনে আমার পিকচার ছিল?”

— এই আপনি কীভাবে জানলেন? আমি তো বিয়ের পরের দিনই চেঞ্জ করে ফেলেছিলাম৷

আহনাফ শব্দ করে হেসে বলে, “বাসর রাতে দেখে ফেলেছিলাম, তুমি তখন ওয়াশরুমে ছিলে। হুট করে ফোনে নোটিফিকেশন আসলে আমি দেখে ফেলি। কিন্তু তুমি যখন ঘুমিয়ে পড়ার অভিনয় করলে ওইসময় আমি অপমানবোধ করছিলাম খুব। আমি তোমাকে সম্মান করি। তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-দুঃখের অনুভূতিকে সম্মান করে পাশে থাকতে চাই৷ আমার কাছে বিয়ে মানেই কেবল চাহিদা পূরণ করা না। অপর ব্যক্তিকে ভালোবাসা, তার সম্মতি, ইচ্ছা, শখ,স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, ভালোলাগাকে নিজের করে নেওয়াকেই বিয়ের সংজ্ঞা ভাবি। যদি তুমি আমাকে অপছন্দ করতে বা এই বিয়ে না মানতে আমি দ্বিতীয়বার তোমাকে ডিস্টার্ব করতাম না। ভাগ্যিস সর‍্যি বলে দিয়েছিলে নাহলে কিন্তু আর ফিরতাম না।”

পরের দিন শায়েরীকে এক্সাম হলে গাড়ি করে আহনাফ আর তার বাবা রাখতে গেলেন। বাবা হলে ঢুকিয়ে দিয়ে অফিস চলে যান কিন্তু পরীক্ষা শেষ না হওয়া অব্দি আহনাফ সঙ্গে থাকলো। হলের বাইরে অপেক্ষা করল।তিন ঘন্টা পর তারা দুইজন একসঙ্গে বাসায় ফিরে আসে। সেদিন বিকেলে ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরে আহনাফ। বাকি পরীক্ষা গুলো যথাযথ ভাবে এটেন্ট করে সে।

শায়েরীর যেদিন প্রাকটিকাল পরীক্ষা শেষ হলো, সে সারা রাত ধরে রাত জেগে শ্রুতি কে নিয়ে আহনাফের মুভি গুলো দেখলো। দুইবোন একসঙ্গে মুভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যায়৷

পরেরদিন আহনাফের মা বেড়াতে আসেন। ওনার মাধ্যমেই শায়েরী জেনে যায়, আহনাফ কাল ব্যাক করবে। সে মনে মনে ভাবে, মানুষটা তো তার জন্য অনেক কিছু করলো, অনেকবার সারপ্রাইজও দিলো, এবার না হয় সে গিয়ে রিসিভ করুক। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরদিন হতেই সে আহনাফের পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট মিযান ভাইকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গিয়ে অপেক্ষা করে৷ সেদিন এয়ারপোর্টে কোন মন্ত্রী বা কে যেন এসেছে। ক্যামেরাম্যান গিজগিজ করছিল এয়ারপোর্টের বাইরে। শোরগোল হচ্ছিল বেশ।

আহনাফ এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই খুশিতে চমকে উঠে বলে, ওহ মাই গড! আমি কি চোখে ভুল দেখছি?

শায়েরী হাসতে থাকে। ফুলের তোড়া এগিয়ে দেয় সে আহনাফকে।আহনাফ তাকে জড়িয়ে ধরে। তখনই অঘটন ঘটলো। কোথা থেকে প্রেসের লোক এসে ভীড় জমালো। আসলে আহনাফ বুঝতে পারেনি এমন কিছু হবে। মিডিয়ায় ধুম পড়ে গেল। ফেমাস অভিনেতা অপরিচিত একটা মেয়েকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে রেখেছে। ঘটনাটা অবশ্যই খুবই রসালো। হুট করে এতো ভীড়, মানুষ, ক্যামেরা, প্রশ্নের হাট দেখে শায়েরী ঘাবড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলে৷ আহনাফ নিজেও পরিস্থিতি সামলাতে তখন নাস্তানাবুদ অবস্থায় ছিল। যেই না সে শায়েরীকে কাঁদতে দেখলো, সবকিছু তুচ্ছ করে সে শায়েরীকে নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে কেটে পড়ে। তার পারসোনাল এসিস্ট্যান্টের উপর মিডিয়ার ব্যাপার টা ছেড়ে দিয়ে, শায়েরীকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

দুইজনে প্রায় পালিয়ে এসে গাড়িতে উঠে। গাড়িতে অনেকক্ষণ ধরেই পিনপতন নীরবতা থাকে৷ সেই নিরবতা ভেঙে শায়েরীই বলে উঠে, আমি আসলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এতো মানুষ দেখে। আমরা তো এসব দেখিনি কোনদিন। সাধারণ মানুষ আমরা। মিডিয়া সম্পর্কে ধারণাও নেই৷

— আই নো।

— আমি আসলে আপনার যোগ্যই নই। সবসময়ই আপনার জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়াই। আজকে আমার জন্য আপনার অপমান হলো।

— কি সব বলো! বরং আমার জন্য তোমার ইনসাল্ট হল। তোমার এইসব কাম্য ছিল না। আর তুমি আমার জন্য রহমত।

শেষের কথা কর্ণকুহর হওয়া মাত্র তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।

এরপরের কাহিনি খুব মজার। এই নেগেটিভ পাবলিসিটি আহনাফের ক্যারিয়ার এ প্রভাব ফেলে তবে সেটা পজিটিভ৷ কীভাবে?ওই যে, বাঙ্গালী অযথাই নাচে। তার বেলাও সেইম হলো।সোশাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে ধুম পড়ে গেল।সবাই তাকে দারুণ রোস্ট করতে লাগলো। মেয়েদের তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি উঠে।এক দল সমানে সমালোচনা করে গেল।এরজন্য অবশ্য তার মার্কেটিং ফ্রিতে হয়ে যায় যার দরুণ সদ্য রিলিজ হওয়া মুভিও দারুণ হিট হয়। তার এসিস্ট্যান্ট অবশ্য ওইদিন সবাইকে জানিয়ে দেয়, মেয়েটা আহনাফ হাসানের স্ত্রী। মিডিয়ায় সেটা প্রচার হয়, নায়ক আহনাফ বিয়ে করে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না স্ত্রীকে। আরো হেন-তেন। অবশ্য ওই সময় এইসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না কারো। কারনটা হলো, শায়েরী এয়ারফোর্সের লিখিত পরীক্ষা গুলোতে টিকে আইএসবির জন্য কল পেয়েছে। এতে অবশ্য বেঁকে বসলো শায়েরীর ফুপু। উনি আমেরিকা থেকেই বললেন, মেয়ে একা ট্রেনিং এ যাবে। কি হয় না হয়! মেয়ে নিরাপদ থাকবে না। উনি কার কাছে জানি শুনেছেন ট্রেনিং পিরিয়ডে নাকি কোন মেয়েকে ধ-র্ষ-ণ করা হইছে। ব্যাস, শায়েরীর যাওয়ার দরকার নাই। বাসায় থেকে ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। এতো চ্যালেঞ্জিং জীবনে গেলে সংসার হবে না।ডিফেন্সের জব খুব কঠিন।এই জবে ঢুকলে ঘর ভাঙ্গবে। এইসব যুক্তি শুনে বাবাও মানা করলেন। একটা সময় শায়েরী হার মেনে নেয়৷ থাক, স্বপ্ন পূরনের দরকার নেই। সে সুখী একটা সংসার চায়। যেখানে তার বাবু হবে। বাবু নিয়ে ব্যস্ত থাকবে সে। ফুপুর কথামতো যদি সত্যি তার সংসারে কিছু হয় এই ভয়ে সে পিছপা হলেও, তাকে পিছনে ফিরে যেতে দেয়নি একটা মানুষ। ভরসা দিয়ে বলেছিল, “তুমি নারী, তোমার সব সামলানোর ক্ষমতা আছে। বাংলার আকাশও যেমন সুরক্ষিত রাখবে ঠিক তেমনই নিপুণ গৃহিনী হবে। আদর্শ মা হবে।”

সেদিন এই মানুষটার দিকে তাকানোর পর সে বুঝতে পারে, তার অফিসার হওয়ার স্বপ্নটা কেবল তার একার মধ্যে সীমাবদ্ধ আর নেই। আরেকজনও আছে এই মধুর স্বপ্নটার ভাগীদার!

ছোট্টবেলায় আকাশে প্লেন উড়ে যাওয়ার পর মাথা তুলে তাকিয়ে যখন হাত নাড়ত সে, তখন বারবার মন চাইত সেও উড়বে। এই উড়ার জন্য তার মানুষটা অদৃশ্য এক ডানা তার কাঁধে খুব মজবুত করে লাগিয়ে দিল। প্রিয় মানুষটার লাগিয়ে দেওয়া ডানা তথা অনুপ্রেরণা তাকে সকল প্রতিকূলতা সামলিয়ে, রুঁখে দাঁড়াতে প্রতি পদে পদে সাহায্য করেছিল৷

পরিশিষ্টঃ

কোন এক বিজয় দিবসের দিন। আহনাফ হাসান তার মাকে নিয়ে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত। প্রতি বছরই সে বিজয় দিবসের অনেক অনুষ্ঠান- প্রোগ্রাম উপভোগ করে। কিন্তু এবার যেন কিছু একটা ব্যতিক্রম। কিছু একটা অতি বিশেষ। সে নিজেও বেশ ফিটফাট হয়ে প্রথম সাড়ির আসনে বসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হৈচৈ পড়ে গেল। কুচকাওয়াজ হতে লাগলো। সে মনোযোগ দিয়ে কুচকাওয়াজ দেখছে। ভালোই লাগে। আশপাশ থেকে হেলিকপ্টারের আওয়াজও ভেসে আসছে। ঢাকায় কোন জাতীয় দিবসের আগে আগে এতো শব্দ করে প্লেন, হেলিকম্পটার যায় যে কানে তুলা দিতে হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে তেজগাঁওয়ের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজের পাশাপাশি, আকাশে লাল-সবুজের সংমিশ্রণে জাতীয় পতাকা প্রদর্শনী করা হবে। বেশ কয়েকটি সরকারি প্লেনের মাধ্যমে এই বিশেষ কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করা হবে বিজয় দিবস উপলক্ষে। আহনাফ বেশ চিন্তিত। সবটা ঠিকমতো হবে তো?তার প্রিয়তমাও আকাশে থাকবে।

দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে এলো। মুহুর্তের মধ্যে আকাশ কাপিয়ে শব্দ হয়ে বেশ কয়েকটা প্লেন উড়ে যেতে দেখা গেল।আহনাফ ভাবতে লাগে, কোন প্লেনটায় তার প্রিয়তমা আছে?
প্লেনের পশ্চাৎভাগ দিয়ে স্বস্তঃফূর্ত ভাবে সবুজ আর লাল রঙ আকাশে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক ধরে আকাশে বাংলাদেশের পতাকার রঙ রয়ে গেল। অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য! চোখ ধাধিয়ে গেল যেন!চারপাশ থেকে তখন গান বেজে চলেছে৷ সম্ভবত দূর থেকে কোন শিল্পী খালি গলায় গাইছেন।

” একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার
সারা বিশ্বের বিষ্ময়, তুমি আমার অহংকার।”

এরপর আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনুষ্ঠান চলল। একটা সময় আহনাফ উঠে দাঁড়ালো এবং একেবারে পিছনের দিকে চলে গেল। এদিকটায় নিরিবিলি। নিশ্চুপ হয়ে আছে। পাখির আওয়াজ কানে আসছে। শীতের মধ্যেও তার একবিন্দু ঠাণ্ডা লাগছে না।

সে ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল দিবে তার আগেই পেছন থেকে তার নাম ধরে কেউ ডেকে উঠে। সে পিছন ঘুরে তাকাতেই তার নয়নজোড়া মুগ্ধতায় অবস হতে লাগলো। কি চমৎকার লাগছে তার প্রেয়সীকে। হালকা আকাশি এই ইউনিফর্ম, সঙ্গে হ্যাট এবং চোখে সানগ্লাস। তাকে দেখে যেমন পরিপূর্ণ লাগছিল ঠিক তেমনই আহনাফের চোখে এই হৃদয়হীনা রমনী পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী।অনেকে প্রশ্ন করতে পারে, আহনাফ তাকে হৃদয়হীনা বলে কেন ডাকে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, মেয়েটা বড্ড পাজী। আহনাফকে সেই ভোরে উঠিয়ে,দুজন নামাজ পড়ে মর্নিং ওয়াকে বের হয়। একটা মানুষ হৃদয় বিহীন নাহলে এতো সকাল-সকাল কীভাবে আরেকটা মানুষের ঘুম নষ্ট করতে পারে?হুহ!এছাড়াও আটমাস আগে যখন তার ডায়েবিটিস ধরা পড়লো, এই হৃদয়হীনা মেয়েটা তার প্রিয় রসকদম খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়ে দিলো। হুহ।

মেয়েটার হাসিমাখা মুখ দেখে তার মনে হল, যদি তার ক্ষমতা থাকত তাহলে এই মেয়েকে মিসেস ইউনিভার্সের এওয়ার্ড দিত!

শায়েরী মুচকি হেসে তার দিকে এগিয়ে এসে নিজের মাথা থেকে ক্যাপটা খুলে আহনাফের মাথায় যত্ন করে পড়িয়ে দিয়ে খুবই মিস্টি কণ্ঠে বলে, “ভালোবাস”।

ক্যাপটার অগ্রভাগে একটা বৃত্ত। বৃত্তের ভেতরে একটা উড়ন্ত ঈগলের প্রতিচ্ছবি এবং তার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখ,” বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত।” শায়েরী মুগ্ধ হয়ে তার ভালোবাসার মানুষকে দেখছে। মানুষটা দিন-দিন এতো হ্যান্ডসাম হচ্ছে কেন? ওহ আচ্ছা! শায়েরী এখনো বিয়ের প্রথম দিনের চিঠিটা খুলে দেখেনি। আজো সে চিঠিটা খুলতে পারেনা। তার অজানাই আছে চিঠিতে কী লেখা আছে।

শায়েরীর তাকে হ্যাট পরিয়ে দেওয়ার সময়কার ছবি কোন যেন একটা ক্যামেরাম্যান ক্যাপচার করে ফেলে। সেই ছবি দ্যা ডেইলি স্টারও ছাপা হয় এবং ব্যাপক হারে প্রশংসা পায় ছবিটা। এছাড়া ফেসবুকে এই ছবিটা ভাইরাল হয়ে যায়। বহু মানুষ এই ছবিটা শেয়ার দিয়ে ক্যাপশনে লিখে, বেস্ট হ্যাসবেন্ড ইভার। বেস্ট কাপল। একজনের ক্যাপশনটা আহনাফের মনে ধরে। ক্যাপশনটা হলোঃ “বিজয়ের দিনে আরেক বিজয়ীণির প্রাপ্তি!”

সমাপ্ত।

[ পরিশিষ্টতে লেখা সবটাই কাল্পনিক। ভুল-ভ্রান্তি,ক্রুটি ক্ষমাযোগ্য। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here