হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ১৩

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১৩)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
নিচে তাকিয়ে দেখলাম। আরিয়ান বা আয়াত কাউকেই চোখে পড়লো না। ভাবলাম হয়তো ওরাই আমাকে ডাকছে। আয়াতের রুমে গিয়ে দেখলাম, মিরা আয়াতের টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা সফট্ ড্রিংকস্ এর গ্লাস। গোল গোল করে গ্লাসটা ঘুড়িয়ে আপাতত ওতেই মনোনিবেশ করে আছে।
.
মিরা আমাকে দেখেই রাগান্বিত হয়ে, আমার হাতের কনুই ধরে টান মেরে ওর সামনে আনলো। আমার হাতটা এতো জোরে টান মেরেছে যে, ওর হাতের নখের আঁচড়ে আমার হাতের চামড়া উঠে রক্ত বের হয়ে গেল। ও আমার দিকে তাকিয়ে অহংকারী কন্ঠে বললো,
— ইসস্, খুব ব্যাথা পেয়েছো তাই না ? ওয়েইট, টিসু দিচ্ছি। মুছে ফেলো রক্তটা।
এটা বলেই আয়াতের টেবিল থেকে একটা টিসু নিয়ে নিজের মুখমন্ডলের ঘাম মুছে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আর বললো,
— এই নাও,,,,
আমি নিচ্ছি না দেখে বললো,
— ওহ্ অবাক হচ্ছো বুঝি ? হা হা হা,,,, তুমি তো সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস খুব পছন্দ করো। আমার ডিভোর্স দেওয়া বরকে বিয়ে করতে যাচ্ছো, আমার ছেলের মুখে মাম্মাম ডাক শুনছো। তাই ভাবলাম, টিসু টাও,,,, হা হা হা।
.
ওর ব্যবহারে আমি মোটেও অবাক হচ্ছি না। আমি জানতাম এমন কিছুই করবে। আমার নিরবতা দেখে ওর গায়ে যেন আগুন ধরে যাচ্ছে। হাতের সফট্ ড্রিংকস্ এর গ্লাস টা ফ্লোরপ আছাড় মারলো। সাথে সাথে গ্লাসটা ভেঙ্গে গেলো। আবারও সে বলতে লাগলো,
— আমি ভেবেছিলাম তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু আজ জানলাম এখনো বিয়ে হয়নি। তুমি নাকি আমার ছেলের কেয়ারটেকার। হা হা হা। তোহ কেয়ারটেকার, যাও রুমটা ক্লিন করো। গ্লাসের টুকরো কাঁচ গুলো তুলে ফেলো তো জলদি।
.
ও ভেবেছিলো আমি হয়তো এবার রেগে গিয়ে ওকে দুটো কথা শুনাবো। কিন্তু ওর ভাবনায় পানি ঢেলে আমি কাঁচ গুলো তুলতে লাগলাম। এবার ও আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। প্রতিশোধ করার প্রধান অস্ত্র নিরাবতা। যার জন্য ও পাল্টা জবাব আমাকে দিতে পারছে না। নিজের রাগ মিটাতে, আমার সামনে আসলো। আমি হাঁটু গেঁড়ে বসে কাঁচ তুলছি। যেই আর একটা কাঁচ তুলতে যাবো, অমনি আমার হাতের উপর ও ওর হাইহিল সমেত জোরে করে পারা মারে ধরে থাকলো। আমার হাতের নিচে কাঁচের টুকরো আর উপরে ওর পা। অনুভব করলাম আমার হাতের তালুতে, তরল কিছু গলিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় রক্ত। আমি বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে ওকে অনুধাবন করার চেষ্টা করছি আসলে ওর মাঝে ঠিক কতটা রাগ আছে ? সেই রাগ কি আমাকে পুড়াতে সক্ষম ?
.
.
— মিরা (প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে আরিয়ান চিল্লায়ে উঠলো)
.
পিছন ঘুরে দেখি রুমের সামনে আরিয়ান। সাথে ফাহমিদা আন্টি আর আন্টির কোলে আয়াত। আরিয়ানের পরিপাটি করা চুল গুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। নিজের গায়ের কোট টা খুলে ফ্লোরে ছুরে ফেললো।
.
ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজে রুমের মধ্যে ঢুকে, আয়াতের স্টাডি চেয়ারটা তুলে ড্রেসিংটেবিলের উপর চেঁলে আঁছার মারলো। চেয়ারটা মিরার পিঠের খুব কাছ থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ড্রেসিংটেবিলের কাঁচটা ঝর ঝর করে ভেঙ্গে পরলো। ওর এই কাজে আমি কাঁপছি। না না, খেয়াল করে দেখলাম সবাই কাপছে।
.
এতো রাগ,,,,, বাব্বাহ্। সার্টের হাতা ফ্লোড করতে করতে মিরার ঐ পায়ে একটা লাত্থি মেরে ওর পা আমার হাতের উপর থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর আমার পাশে ধপ্ করে বসে পরলো আরিয়ান। হাতটা আলতো করে তুলে দেখলো, কাঁচের টুকরোটার অর্ধেকটা আমার হাতের মধ্যে গেথে গিয়েছে, আর বাকি অর্ধেক টুকরাটা যেন আরিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলছে যে দেখো তোমার প্রিয়তমার রক্ত কতো সুন্দর লাল। হাতটা দেখার সাথে সাথে উঠে দাড়িয়ে পরলো। কয়েক কদম পিছিয়ে নিজের মাথাটা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখটা বন্ধ করলো।
.
হাতটা দেখে আমি এতোক্ষণে অনুভব করতে পারলাম যে হাতটা খুব ব্যাথা করছে। মিরা আরিয়ানের রিয়েক্ট দেখে কেঁটে পরতে চাইলো। কিন্তু বাধ সাধলো আন্টি, একদম রুখে ওর সামনে দাড়ালো যেন ওকে চিবিয়ে খাবে। আমি আমার অন্য হাত দিয়ে এই হাতের কাঁচটা টেনে বের করে ফেলে দিলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। চোখের সামনে সবাইকে দেখলাম অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। কানের পাশে চিঁইইইই করে শব্দ শুনতে পারছি,,,,,
.
.
জ্ঞান ফিরার পর আমার আম্মুর সহযোগিতায় বিছানায় হেলান দিয়ে বসলাম। শরীর টা খুব একটা খারাপ লাগছে না। দেখলাম হাতটা ব্যান্ডেজ করা। এই বার ভালো করে খেয়াল করলাম আমি আরিয়ানের রুমে শুয়ে আছি। আমার এক পাশে আম্মু আর একপাশে ফাহমিদা আন্টি। পায়ের কাছে আয়াতকে কোলে নিয়ে আংকেল বসে আছে। আমার কলিজাটা কাঁদতে কাঁদতে দূর্বল হয়ে আংকেলের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে আমাকে একমনে দেখছে। রুমের টু’সিটার সোফাতে মিরার বাবা আর মা বসে আছে। সোফার হ্যান্ডেলে মিরাও মাথা নিচু করে বসে আছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে বিচার সভার আসামি।
.
অতঃপর আমার চোখ গেল দেওয়ালে হেলান দিয়ে থাকা আরিয়ানের দিকে। তার চোখ আমার হাতের দিকে। ওর চোখের কোনায় এক ফোটা পানি চিকচিক করছে। যা এখনো গাল গড়িয়ে পরেনি। আমার চাহনি দেখে, ডান হাতটা ওর মুখের উপর রাখলো। হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল আর মধ্যমা আঙ্গল দিয়ে দু’চোখের কর্নারে চেপে ধরে ঘুরাতে থাকলো। পুরো বাড়ি কেমন জানি নিস্তব্ধ। আচ্ছা সব মেহমানরা কি তাহলে চলে গিয়েছে ? কে জানে !
.
আংকেল আমাকে স্নেহের সাথে বললেন,
— পাখি মা, আজ তুমিই সিদ্ধান্ত নিবে যে, মিরাকে ওর করা জঘন্য কাজের কি শাস্তি দেওয়া হবে। বলো মা তুমি ওকে কি শাস্তি দিতে চাও !
.
আমি এমনই একটা দিনের অপেক্ষা করছিলাম।মনে মনে বললাম, এইবার ওর চরিত্রকে কিছুটা হলেও সুধরাতে পারবে।
.
আমি আমার দু’হাত বাড়িয়ে আয়াতকে কাছে ডাকলাম, আয়াত খুব ধীরে আমার কোলে উঠে বসলো। আমার কলিজাটা ভয় পাচ্ছে, যদি আমি ব্যাথা পাই। হি হি। আমি মিরার চোখে চোখ রেখে আয়াতকে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,
— আয়ু সোনা, আমাকে একবার “মা” বলে ডাকবে ?
.
আয়াত আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— মা !
— আর এক বার !
— মা !
— আর একটু জোরে !
— মা !
এইবার আয়াত কেঁদে দিলো। আর আমার মনে এক পৈচাসিক আনন্দ হতে লাগলো। আমি মিরাকে উদ্দেশ্য করে একটা কথায় বললাম,
— “তোর ভাগ্য এখন আমার, হতভাগি।”
.
মিরার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো। হতভাগিটা এক ছুট দিয়ে রুম থেকে পালালো। এইবার যদি ওর শিক্ষা হয়। নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিক সবাইকে এইবার হয়তো সুখে রাখতে পারবে। ওর বাবা মাও মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল।
.
আর আরিয়ান,,,, আসলেই পাগল। মিরাকে আমার দেওয়া শাস্তিটা ওর হয়তো পছন্দ হয়নি। এটা বুঝলাম ওর রাগে। কেননা ওরা রুম থেকে বের হওয়ার পরই আরিয়ান আমার দিকে কটমট করে তাকালো।আবারও ধুপধাপ পায়ে ওর রুমের বারান্দায় চলে গেল।কিন্তু যাওয়ার সময় বারান্দার দরজাটাকে নিজের গায়ের সব শক্তি দিয়ে ধরাম্ করে ধাক্কা দিলো।যেন সব দোষ ঐ দরজার,,,,,,,,,।
·
·
·
চলবে…………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here