হয়তো তোমারি জন‍্য পর্ব ১১

হয়তো_তোমারি_জন‍‍্য
#সামানিয়া_জামান_প্রজ্ঞা
[পর্ব – 11]

এরপরই এলো সেই মাহিন্দ্রক্ষণ দিন। আমার আর অনুরাগ ভাইয়ার বিয়ের দিন। বিয়ের দিন পুরো একঘন্টার মতো গায়েব ছিলো অনুরাগ ভাইয়া। সবাই খোজাখুজি করেও পাইনি। এক ঘন্টা পরে অনুরাগ আর মাহির ভাইয়া ফিরলে উনি সরাসরি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারপর ই উনি আমাকে চওড়া গলাই রাগে টুইটম্বুর হয়ে বিয়েটা আটকাতে বলেন। কিন্তু আমি চেয়েও বিয়েটা আটকাতে পারিনি। যার ফলস্বরুপ আমি এখন উনার বিবাহিত স্ত্রী সঙ্গে ঘৃণার পাত্রী!!!

অতীত ভাবতে ভাবতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। অনুরাগ ভাইয়া এখনো ফিরেনি। আমি গিয়ে শাড়ীটা চেন্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বেলকুনিতে গেলাম। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। এতোদিন আমি অবিবাহিত একজন মেয়ে ছিলাম, কিন্তু আজ একজনের বিয়ে করা স্ত্রী। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ভাবনায় শুধু মাথায় আসছে সেটা হলো প্রাই একঘন্টার মতো ভাইয়া গায়েব ছিলো কোথায় গেছিলেন উনি? বেলকুনি থেকে বাহিরে তাকাতেই উনাকে দেখলাম নিচে একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। লোকটিকে চিনার জন‍্য বেশকিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম তারপর ভিতরে চলে আসি। এদিকে আঙ্কেল আন্টি আরো কিছু গেস্ট এখনো ঘুমাইনি। সবাই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমারো বেশ ঘুম পাচ্ছে কিন্তু উনি না আসায় দরজা লাগিয়ে ঘুমাতেও পারছিনা। আমার বেলকুনি থেকে ভিতরে আসার কিছুক্ষণ পর ভাইয়াও চলে আসে। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উনি আবারো বললেন,

-” দেখ তৃষাতুর এই বিয়েটা আমি মানিনা তাই তোকেও আমি বউ হিসাবে মানিনা। সো বউ যেহেতু না সেহেত তুই বিছানায় আমার পাশে ঘুমাবি না।”

উনার কথায় চোখ ছানাবড়া অবস্থা। বলেকি এই?

-” বিছানায় ঘুমাবো না মানে? তবে আমি কোথায় ঘুমাবো? তিনবার আল্লাহ্কে সাক্ষি রেখে কবুল বলে বিয়ে করলেন এখন বলছেন এই বিয়ে মানেন না?”

-” বিয়ে করেছি কিন্তু সেটা পেশারে আপাতত আমি এই বিয়ে মানিনা আর তোকেও বউ হিসেবে মানিনা। তোকে দেখলে আমার এখনো বোন বোন ফীল আসে।”

-“এ‍্যাহহহহহ! ”

-“এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই ওইযে সোফা দেখছিস ওটাই তোর বিছানা। যা ওখানে গিয়ে শুয়ে পর আমার তো খুব ঘুম পাচ্ছে আমি এখন ঘুমাবো।”

অনুরাগ ভাইয়া যে প্রচণ্ড রাগী সেটা আমি এইকয়েকদিনে বেশ ভালোই বূঝতে পেরেছি তাই আর দেরি না করে সোফায় গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম। অনেক রাত ঘুম ও পাচ্ছিলো তাই সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

_____________

সকালে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে চমকে উঠলাম আমি। রাত দুইটাই ঘুমিয়েছিলাম এখন বাজে সকাল সাতটা। এখনো ঘুম ভালো মতো পূরনই হয়নি আমার। উফফফফ্ ঝামেলা! দরজা খুলতেই কয়েকজন মেয়ে মুচকি হেসে বলল,

-“গুড মরনিং! মাহিমা আন্টি পাঠালো আমাদের। সকাল হয়ে গেছে তো বাসা ভর্তি মেহমান নিচে ডাকছে তোমাকে।”

-” জ্বী ধন্যবাদ। আন্টিকে বলো আমি তৈরী হয়ে আসছি।”

ওরা চলে যেতেই লাগেজ থেকে শাড়ী বের করে তৈরি হয়ে নিলাম। নিচে যাওয়ার জন‍্য পা বাড়াতেই অনুরাগ ভাইয়ার কথা মনে পড়লো। উনাকে একবার ডাকা উচিত কিন্তু যদি কিছু বলে। আন্টি তো ডেকেছে সমস্যা কোথায় আমি বেশ কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু সাড়া না পেয়ে চলে যাওয়ার পথ ধরলাম পরে কি একটা ভেবে হাতটা উনার কাধের দিকে এগিয়ে দিলাম। ঘুমের মাঝে হাতের স্পর্শ পেতেই উনি খপ করে হাতটা বুকে জরিয়ে শুয়ে পরলেন এদিকে আচমকা আমি উনার দিকে ঝুকে পড়লাম। আমি হাতটা ছাড়ানোর জন‍্য বারবার উনাকে ডাকতে লাগলাম কিন্তু ছাড়লেন না উনি। শেষে রেহানা ফুপির আওয়াজে লাফিয়ে উঠলেন উনি। ঘুম থেকে উঠে আমাকে এইভাবে উনার দিকে ঝুকে থাকতে দেখে উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

-” কি ব‍্যাপার কাহিনী কি? এইভাবে আমার দিকে ঝুকে ছিলি কেনো?

আমি উনার হাত থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে বললাম,

-” আমি কখন ঝুকে ছিলাম? আমি কি ইচ্ছে করে হাতটা দিয়েছি নাকি?আপনাকে আমাকে দুইজনকেই নিচে ডাকছে তাই উঠাচ্ছিলাম তো।”

আমার কোথায় উনি এখনো সুরু ভাবে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছু না বলে ড্রেসিংটেবিলে চুলটা আচড়েঁ ঠিক করতে লাগলাম। অনুরাগ ভাইয়া শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলেন তারপর চুলটা ঠিক করতে করতে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

-“শোন আমাদের ব‍্যপারে সবটা যেন সিক্রেট থাকে। এই বিয়েটা সম্পর্কে আমার যে তেমন মাথা ব‍্যাথা নাই এটা যেনো তোর আর আমার মধ‍্যে সিমাবদ্ধ থাকে। কি মনে থাকবে তো?

আমি মুখে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললাম,

-“হুম! চিন্তা করবেন না ভাইয়া। আমাদের মাঝের কোন ধরনের কথা কেউ কখনো জানবে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন আমি ওই টাইপের মেয়ে না । ”

আমাদের নিজেদের মধ‍্যে কথাবার্তা বজায় রেখে নিচে নামলাম। অনুষ্ঠানের পুরো হাইলাইটটা অনুরাগ ভাইয়া আর আমার উপরে ছিলো। আয়মান আঙ্কেল মাহিমা আন্টি আমাদের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এর মধ‍্যে আব্বু,আম্মু,মেধা, মাহির ভাইয়া সবাই উপস্থিত। মেধাকে সুস্থ দেখে ভিষণ ভালো লাগছে আমার আর অনুরাগ ভাইয়ার। এইভাবেই বেশ অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলাম আমরা।

অনুষ্ঠান মিটে যেতেই মেধা,আব্বু,আম্মু সহ প্রাই 80 পারসেন্ট রিলেটিভ সবাই চলে যায়। অনুষ্ঠানের লাস্ট পর্যায়ে রেহানা আন্টি, মানে অনুরাগ ভাইয়ার চাচাতো ফুপি তার একমাত্র মেয়ে প্রিয়ন্তি। সে যে আসবে কল্পনা করেননি অনুরাগ ভাইয়ার ফুপি। মেয়েটা আসতেই অনুরাগ ভাইয়াকে হাগ করে। এই বিষয় গুলো ছিলো খুবই চোখে পড়ার মতো। তবে বেশ শান্ত ভাবে সবটা হেন্ডেল করে অনুরাগ ভাইয়া। প্রিয়ন্তি নামের মেয়েটা আমার সামনে এসে অদ্ভুত ভাবে আমাকে দেখতে থাকে। ওর আমার দিকে তাকানো দেখে মনে হয়েছে খুব সার্থবাদী মেয়ে। আমার সামনে এসে কিছু বলবে তার আগেই অনুরাগ ভাইয়া তাকে নিয়ে দুরে চলে যায়।

__________

প্রিয়ন্তিকে সবার থেকে আড়ালে এনে অনুরাগ ভাইয়া বলতে লাগল,

-“তৃষাতুরকে কি বলতে যাচ্ছিলে প্রিয়ন্তি?”

ভাইয়ার কথায় অগাহ‍্য করে প্রিয়ন্তি বলে উঠল,

-” তো ওটাই সেই মেয়ে যার জন‍্য কখনো তুমি আমার ভালোবাসা একসেপ্ট করোনি?”

একটু রেগে আর জোরে বলে উঠল অনুরাগ ভাইয়া,

-” হেই লিসেন তুমি আমার ফুপির মেয়ে ওকে? সম্পর্কে আমার বোন হও ডোন্ট ডেয়ার সো মাচ”

প্রিয়ন্তিকে ছেড়ে অনুরাগ ভাইয়া চলে আসে আমি মাহিমা আন্টি আর আঙ্কেলের সঙ্গেই ছিলাম উনি ও আমার পাশে এসে বসলেন। একটুপর ফেমেলী ফটো তোলা হবে বলে মাহিমা আন্টিই উনাকে আমার পাশে বসতে বললেন। আর উনি সঙ্গে সঙ্গে এসে আমার পাশে বসলেন। আমার মনে হয় অন‍্য সময় হলে আপত্তি করতো কিন্তু এখন অনেক মানুষ আছে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না উনি।

অনুষ্ঠানের পর্ব মিটে যাওয়ার পর বেশ কিছু দিন হয়ে যাই। আমাদের তেমন কথা হয় না। উনিও উনার কাজ আর ল‍্যাব নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে আমি আন্টি আঙ্কেলের সঙ্গে ভালো মতো সময় কাটাই। মাঝে মাঝে আব্বু আম্মু আসে দেখা করতে তারপর আবার চলে যায়। অনুরাগ ভাইয়াও কোন বিশাল একটা প্রজেক্টে কাজ করছে তাই সবসময় বিজি থাকে ল‍্যাবে। কখনো ল‍্যাবে থাকে আবার কখনো বাসায় আসে তবে লেট করে অনেক রাতে। আর এতো রাতে আমি ঘুমিয়ে পরি তাই সেভাবে দেখা হয়নি। প্রাইদশদিন হয়ে যায় তারপর একদিন সন্ধ্যায় ভাইয়া বাসায় ফিরে আসে। উনাকে দেখে তো আমরা লকড্ আঙ্কেল আন্টির সঙ্গে চা নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম হঠাৎ উনি চলে আসলে আন্টি উনার জন‍্য কফি আনতে বলে। আমি কফি এনে দিতেই শুকনো একটা থাঙ্কস জানিয়ে বলে এটার দরকার ছিলো। এইকয়েকদিন প্রচুর বিজি ছিলাম কাউকে সময় দিতে পারিনি সমস্যা নেই আজ অনেক দিন পর ফ্রী হলাম। কথার মাঝে আন্টি বলে উঠলো,

-” দেখনা তৃষা বাড়িতে বসে বিরক্ত হচ্ছে তুই ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলেইতো পারিস। ওর ও ভালো লাগবে তোর ও ট্রেস কমে যাবে।আর এখন তো তৃষা মার কলেজে ছুটি চলছে পরে নাহয় ঘোরানোর বদলে কলেজ নিয়ে যাস। ”

অনুরাগ ভাইয়া কিছু একটা ভেবে বলল,

-” ঘুরতে নিয়ে যেতে প্রবলেম নাই। কিন্তু লাইক সিরিয়াসলি এই অনিরুদ্ধ জুবায়ের ওকে ওর কলেজে নিয়ে যাবে?”

আন্টি ভাইয়ার কথায় অবাক হয়ে বললেন সেকি নিয়ে গেলে প্রবলেম কি?

-” এই পিচ্চিকে নিয়ে আমি ওর কলেজ যাবো? আমি একজন সাইনটিস্ট কলেজের পার্ট সেই কবে গেছে জানোতো। আমি যদি ওকে নিয়ে কলেজ যাই সবাই বলবে অনিরুদ্ধ জুবায়ের শেষে কিনা এক পিচ্চি মেয়েকে বিয়ে করেছে আর তাকে কলেজ নিয়ে যায়।”

সবাই ভাইয়ার কথায় হাসলো সঙ্গে ভাইয়াও হাসছে। এদিকে বহুদিন পর উনাকে আগের মতো দেখছি বিষয়টি আমার কাছে অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু উনার কথা পুরোপুরি বোধগম্য হলে রেগে সবার দিকে তাকালাম। আঙ্কেল আন্টি থেমে যাই কিন্তু উনি এখনো হেসেই যাচ্ছে। আমি রেগে আঙ্কেল আন্টিকে বললাম,

-” আন্টি উনি আমাকে ডাইরেক্টলি অপমান করছে আর তোমরা হাসছো?”

আন্টি মুখ কাচুমাচু করে বলল,

-” এই না না। কে হাসছে। এই অনি তুই আমাদের মেয়েকে এইভাবে অপমান করছিস কেনো রে? তোর কি মার খাওয়ার শখ হয়েছে?”

– এই পিচ্চির জন‍্য তুমি আমাকে মারবে আম্মু বলে আবারো হেসে উঠল অনুরাগ ভাইয়া।

রাগে হাতের কফিটা পুরোটা শেষ করে উপরে চলে আসলাম। ভিষণ রাগ হচ্ছে এতোদিন পর আমাদের কথা কিন্তু এখন উনি আমাকে আজেবাজে কথা বলছে। সব সময় আমার সঙ্গে এমন ব‍্যবহার করার দরকার কি?এতো রুঢ় কেনো উনি? ভালোবাসা থাকলে সবসময় কষ্ট থাকবেই এটা স্বাভাবিক কিন্তু আমি কেনো মানতে পারিনা। আমি জানি বিয়েটা উনি জোর করে করেছেন আমি ও একি কাজ করেছি কিন্তু ভালো বাসিত উনাকে। তবে উনার মনে আমার জন‍্য কোন অনুভূতি নেই যেটা সবচেয়ে কষ্টের। অন‍্যকাউকে ভালোবাসে নাকি আল্লাহ্ জানেন?

কিছুক্ষণ পরে উনি রুমে এসে বললেন,

তৃষাতুর কালকে বিকালে রেডি থাকবি। আমরা ঘুরতে যাবো। যদিও ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু আম্মুর ইচ্ছে।

রাগে উনার কথায় পাত্তা দিলাম না। উনার ফোনে ফোন আসতেই উনি হুঠ করে বাহিরে চলে গেলেন। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। কিছু ভালো লাগছে না এখন আমার Rest in peace একপাক্ষিক ভালোবাসা!

~চলবে ইনশাআল্লাহ্

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here