#হয়ত
পর্ব:- ২
-‘ এই যে ছোট আপু তুমি এই ঝগড়ুটির সাথে কখনো মিশবে না। এই মেয়ে তোমাকে খারাপ করে দিবে। এক নাম্বার ফাঁকিবাজ।’
তাপৌষির তাড়াতাড়ি বোকার মতো মাথা উপর নিচ করতে লাগলো। ওর কাণ্ড দেখে দুই ভাইবোন হেসে উঠলো।
-‘ মাথার স্প্রিং কি নড়ে গেছে?’
মাথায় দুই হাত দিয়ে ডানে বামে নড়িয়ে তাপৌষি উত্তর দিলো,
-‘ কই না তো ভাইয়া। ‘
এবার তনয়া বেগমও হেসে উঠলেন। মেয়েটা ছোট মানুষ, কথাবার্তাও ছোটদের মতো। ওরা ওকে নিয়ে মজা করছে আর এই মেয়ে তা বুঝতেও পারছে না।
পিঠা মুখে তুলে নিতে নিতে দিশা বললো,
-‘ ভালো সময় এসেছ তাপৌষি। রিমি আপুর আক্দ কাল। মজা হবে অনেক? ‘
-‘ রিমি আপু? ‘
-‘ আমার চাচাতো বোন। এই যে পাশে মাটির চৌচালা বাড়ি দেখছো না? এটা আমাদের দাদুবাড়ি। রিমি আপুরা ওখানেই থাকে। খাওয়া শেষ না? চলো আমার ঘরে চলো। কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করা যাবে।’
দিশা যে তাকে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছে তা ভালোই বুঝতে পারছে তাপৌষি। সে নিজেও ব্যস্ত থাকতে চায়। একা থাকলে তার কান্না পায়। ভীষণ কান্না পায়।
.
দিশার রুমটা দুইতলাতেই। তাপৌষির রুম থেকে দুই রুম আগে। বিশাল বড় রুম। রাজশাহীতে তাপৌষিরা যে বাসায় থাকে সেই বাসায় মোট দুটো রুম। সেই দুটো রুমকে এক করলেও হয়তো এই রুমটা হবে না। একপাশের পুরো দেয়াল জুড়ে পাঁচপাল্লার আলমারি সেট করা। খাট-টাও অনেক বড়। রুমের একপাশে একটা কম্পিউটার টেবিল, তারপাশে বুকশেলফ। আলমারির অপজিট সাইডে একটা বড় ড্রেসিংটেবিল। তাতে রাখা হয়েছে অনেক কসমেটিকস আর মেকআপ আইটেম। এতো কিছু তাপৌষি কখনো চোখেই দেখেনি।
আলমারির একটি পাল্লা খুলতে খুলতে দিশা বললো,
-‘ আমরা কাল শাড়ি পড়বো ঠিক আছে? ‘
তাপৌষি কখনোই শাড়ি পড়েনি। সেইরকম কোন অনুষ্ঠানে যাওয়াই হয়নি কখনো। বাবা-মা’র লাভ ম্যারেজ। পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন উনারা। ফলে কোন আত্মীয়স্বজন নেই বলেই তাপৌষি জানতো, যদি না তিন বছর আগে তনয়া বেগম দেখা না দিতেন।
-‘ আমি তো কখনো শাড়ি পড়ি নি আপু। আমি থ্রি-পীচ পড়ি? ‘
-‘ শাড়ি পড়তে চাচ্ছ না? লেহেঙ্গা পড়বে? আমার কাছে লেহেঙ্গার অনেক কালেকশন আছে।’
লেহেঙ্গা পড়াই যায়। শাড়ির মতো প্যাঁচ নেই এতে। কুচি সামলানোর চিন্তা নেই।
-‘ জি আপু পড়বো। ‘
তাপৌষির সামনে আলমারির আরেকটা পাল্লা খুলে দিলো দিশা।
ইশ, কত লেহেঙ্গা এতে! ওর অনেক আগে থেকেই লেহেঙ্গা পড়ার শখ ছিল। তবে বাবা কিনে দিতে পারেন নি।
-‘ কোনটা পছন্দ দেখে নাও। এরপর আমরা চুল আর মুখের মেকআপ নিয়ে আলোচনা করবো।’
আকাশী আর সাদা রঙের একটা জরজেট লেহেঙ্গা বের করলো তাপৌষি।
-‘ তোমার পছন্দ তো খুব সুন্দর। তোমাকে মানাবে এতে। অবশ্য ফর্সা মানুষ যা পড়ে তাতেই মানায় তাকে। যাও একবার পড়ে দেখে আসো ফিটিং ঠিক আছে নাকি? না হলে মা ঠিক করে দিবে। মা খুব ভালো দর্জির কাজ পাড়ে।’
দিশার প্রশংসায় তাপৌষি লজ্জা পেলো খুব।
যা ভেবেছিল তাই হলো। দিশা তার চেয়ে অনেক চিকন। একদম পার্ফেক্ট ফিগার দিশার। হাইটেও অনেক লম্বা। এই লেহেঙ্গা তাপৌষির কিছুতেই ফিটিং হচ্ছে না। এবার?
-‘ আপু লেহেঙ্গা ফিটিং হচ্ছে না। ‘
-‘ হচ্ছে না তাইনা? আমিও তাই ভাবছিলাম। ডায়েট করতে করতে দেখো আমার গায়ে আর মাংসই নেই। চিকন থাকার জন্য কম খাই। তবে এখন আফসোস হচ্ছে তোমার মতো কিউট না বলে।’
তাপৌষির মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন উকিঁ দিলো। তবে ও দ্বিধায় পড়েছে, প্রশ্নটা করা ঠিক হবে নাকি হবে না তা নিয়ে। মন বলছে প্রশ্ন করে ফেল আবার মস্তিষ্ক বলছে না করিস না। এই দ্বন্দ্ব নতুন না। মস্তিষ্ক কে পরাজিত করে মনের ডাকে সাড়া দিলো সে।
-‘ দিশা আপু তোমার হাইট আর ওজন কত? ‘
সামনে দাঁড়ানো বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকালো দিশা। এই মেয়েটি সত্যি খুব রূপবতী। কী সুন্দর ফরসা গায়ের রঙ। নাকটা যেন আলাদা ভাবে একেঁ ওর মুখে বসানো হয়েছে। চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা ভাব ফুটে আছে। কথা বললে উপরের ঠোঁট উঁচু হয়ে যায় ঠিক সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুদের মতো। গালে একটা কাটা দাগ আছে। হাসলে টোল পড়ে সেখানে। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে চোখের নিচে কালো দাগ পড়লেও তাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।
-‘ হঠাৎ এই প্রশ্নের কারন? লেহেঙ্গা ফিটিং হয়নি বলে মন খারাপ?’
-‘ না আপু এমনি। তুমি তো অনেক লম্বা। তাই।’
-‘ বেশি না। এই পাঁচ ফুট সাত। মা-বাবা লম্বা তো। তাই আমরা ভাইবোন সবাই লম্বা। ছোট ভাইয়া কে দেখলে না? ভাইয়া ছয় ফুট। আর বড় ভাইয়া তো আরও লম্বা। ছয় ফুট তিন। ভাইয়া ঢাকায় গেছে। চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে। রিমি আপুর বিয়েতে আসলে দেখতে পাবে। ‘
অনেকটা বিজ্ঞের মতোই মাথা নাড়াল তাপৌষি। ঠোঁট দুটো চোখা করে বলে উঠলো,
-‘ ওহ আচ্ছা। আর হাইট? ‘
দিশার এবার হাসি পেয়ে গেলো। মেয়েটা আসলেই বাচ্চা। তিন বছর আগের দেখা তাপৌষির সাথে এই তাপৌষির যেন কোন অমিল নেই।
-‘ পঞ্চান্ন কেজি। তোমার কত?’
-‘ হাইট পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির একটু বেশি। আর আমারও ওজন পঞ্চান্ন কেজি। তবে তুমি লম্বা বলে তোমাকে মোটা লাগে না।’
গায়ের সামনের ওড়নাটা সরিয়ে দুই কোমরে হাত দিয়ে তাপৌষি অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বললো,
-‘ দেখো আমাকে কত্ত মোটা লাগে! মা অনেক খাওয়ায়। না খেলে নাকি কথা বলবে না আমার সাথে। ব্ল্যাকমেইল করে খাওয়ায় জানো?’
আচমকা যেন দূরের আকাশে বিদ্যুত্ চমকালো। তাপৌষির ভ্রম কাটলো। মা তো এখন নেই। খাইয়েও দেয় না আর। ব্ল্যাকমেইলও করে না। কই এখন তো তাপৌষি খায়; তবে মা কেন কথা বলে না? বুক চিড়ে কান্না আসছে তার।
-‘ আপু মাথা ব্যাথা করছে। একটু ঘুমাবো। তোমার পছন্দ মতো একটা শাড়ি বাছাই করে রেখো আমার জন্য। ‘
দিশা বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে বুঝতে পেরেছে, তাপৌষি পালাতে চাচ্ছে এখন। ওর হয়তো এখন কাঁদতে মন চাচ্ছে! মন খারাপের সময় কখনো কাউকে আটকে রাখতে নেই। এতে সামনের মানুষটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। না পাড়ে কাঁদতে আর না পাড়ে চুপ করে বসে থাকতে।
-‘ আচ্ছা। আমি তোমার ঘরে কয়েকটা শাড়ি রেখে আসবো। তুমি পছন্দ করে নিও।’
.
বাথরুমের ট্যাপ ছেড়ে অনবরত মুখে পানি ছিটাচ্ছে তাপৌষি। মা নেই, মা নেই বিড়বিড় করে চলেছে।
টাওয়াল দিয়ে মুখটা মুছে বালিশে মাথা রাখলো। বড্ড ঘুম পেয়েছে তার। চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে যেন।
.
চলবে.
.
.
[দিল খুলে সমালোচনা করলে ও ভুল ধরিয়ে দিলে খুশি হবো]