হয়ত পর্ব ৬+৭

#হয়ত
পর্ব:- ৬ ও ৭
.
-‘ বাবা-মা’রা এমন করে কেন? ছোটবেলা থেকে মেয়েকে অপরিচিত ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেয়না। অপরিচিত ছেলেদের থেকে দূরে রাখে। তাদের একটাই কথা ছেলে ফ্রেন্ড থাকা যাবে না। অথচ বিয়ের সময় একটা অপরিচিত ছেলের হাতে মেয়েকে কীভাবে তুলে দিতে পারেন ইনারা? বিয়ের পর মেয়ের কোন ক্ষতি হবে না এই নিশ্চয়তা তাদের কে দেয়? আচ্ছা রিমি আপু বলো তো রাস্তায় যেই ছেলেগুলোকে আমরা দেখি তারাও তো আমাদের অপরিচিত, তাইনা? তাদের কে আমরা চিনি না। কারন তাদের সাথে আমাদের কথা হয় না। তোমার বাবা-মা যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছেন সেও তো তাইলে তোমার অপরিচিত।’
বাচ্চা মেয়েটার কথায় ঘরে উপস্থিত প্রত্যকের মনে প্রলয় তুলেছে। রিমির মনে কাজ করছে একই সাথে ভীতি ও উদ্রেক। তাও নিজের কথায় জোর আনতে সে বললো,
-‘ পিচ্চি খোঁজ নিয়েই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হ্যাঁ এটা সঠিক আমার বিয়ে একটু জলদি হচ্ছে। তবে আশে পাশের মানুষের থেকে ওদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়েছে।’
-‘ সেটা তো আর্থিক অবস্থা আর পরিবার সম্পর্কে খোঁজ। মানুষটা সম্পর্কে খোঁজ? বিয়েতে বিশ্বাসের সাথে চিন্তার মিল দরকার হয়। মনের মিল তখন এমনি হয়ে যায়। স্কুল, কলেজে আমরা তাদেরকেই আমাদের বেস্টফ্রেন্ড বানাই যাদের সাথে আমাদের চিন্তা শতভাগ না মিললেও এটলিস্ট আশিভাগ মিলে যায়। বন্ধু তৈরি করতেও আমরা কত ভাবি। আর এটা তো জীবন সাথী বাছাই। তুমি যদি তার সাথে কথা না বলো তাহলে তুমি তার চিন্তা সম্পর্কে জানবে কীভাবে?’
.
রাবেয়া বানু দিশার ঘরের দিকেই যাচ্ছিলেন। রিমির হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক এসেছে। প্রথমে হলুদের অনুষ্ঠান করবেন না ভেবেও হবু জামাইয়ের বাড়ি থেকে আগত লোকদের আবদারে তিনি রাজি হয়েছেন। হলুদের অনুষ্ঠান হবে দেখেই তিনি রিমিদের খবর দিতে যাচ্ছেন। হাতে সময় খুব অল্প। ওদের সাজগোছ আছে। তবে ঘরে প্রবেশের সময় তাপৌষির এই পাকাপাকা কথা শুনে রাগ উঠে যায় তার।
-‘ এই মেয়ে কী সব ভুলভাল বুঝাচ্ছো ওদের। বিয়ে নিয়ে খুব জ্ঞান তাইনা। মায়ে যেমন মেয়েও তেমন। পীরিত করে বিয়ে বয়বার চায় খালি। কী চাও তোমার মায়ের মতো আমার পুতিনও ভাগবে? ফাজিল মেয়ে কোনেকার। তনয়ারে আগেই কইসিলাম এই মাইয়্যারে না আনবার। শুনে নাকি আমার কথা?’
-‘ দাদি কী বলছো এসব। ও বাচ্চা মানুষ। ওর কথা কেন ধরছো? বাদ দাও।’
-‘ তুই চুপ থাক রিমি। যা ওই বাড়ি থেকে মেহমান আসছে। খেদমত কর গা। আর এই মেয়ে, তোমাকে না যাইতে বললাম। যাও নিজের ঘরে যাও।’
দিশা তাপৌষির দিকেই তাকিয়ে ছিল। মেয়েটার ঠোঁট কাঁপছে। কান্না আটকানোর জন্য ঠোঁটদ্বয় চেপে রাখতে চেষ্টা করছে। বৃদ্ধ মহিলাটি তার মা-কে অপমান করলো। সেই মানুষটিকে যার এখন শরীরিকভাবে কোন অস্তিত্বই নেই।
.
ঘরে বসে বসে বর্ষণের হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠে হাত পা ঝাড়া দিলো সে। হাতে ওয়ালেট আর মোবাইল ফোন নিয়ে গায়ে শার্ট চাপালো। একটু ঘুরে আসা যাক। এখন তার মন খুব একটা ভালো না।
ইন্টার্ভিউ ভালোই হয়েছে। তবে চাকরিটা তার হবে না। ইন্টার্ভিউ রুম থেকে বের হওয়ার সময় তাকে বলা হয়েছে,
” মি. বর্ষণ আই মাস্ট সে, ইউ আর অ্যা ট্যালেন্টেড গাই। বাট উই নিড এন এক্সপিরিয়েন্সড পারসন।”
কত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে তার চাকরি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। আগে জানলে ছোটকাল থেকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকরি করে করে এক্সপিরিয়েন্স জোগাড় করতো। যত সব উদ্ভট কথাবার্তা।
.
ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই বর্ষণের মনে হলে কেউ ওর সামনে দিয়ে দৌড়ে তনয়া খালামনির মেয়ের রুমটাতে ঢুকে গেলো। পিছে পিছে দিশা চিল্লাতে চিল্লাতে আসছে,
-‘ এই তাপৌষি শুনো আপু। কথা শুনো। দাঁড়াও প্লিজ।’
তাপৌষি নামের মেয়েটা ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো। দিশা বর্ষণের সামনে দিয়েই তাপৌষি তাপৌষি বলতে বলতে ছুটে গেলো তাপৌষির ঘরের সামনে। এই মুহূর্তে দরজা ধাক্কিয়ে চলেছে সে। বর্ষণ আস্তে করেই জিজ্ঞেস করলো,
-‘ কী হয়েছে রে?’
দিশা যতটা সম্ভব সংক্ষেপে তার ঘরে হওয়া ঘটনা খুলে বললো। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে দুই ভাইবোন দরজা ধাক্কাচ্ছিল। একসময় দরজা ধাক্কানো বন্ধ হলেও নাম ধরে ডাকাডাকি চলতেই থাকে। বর্ষণের প্রচুর রাগ উঠছে।
হঠাৎ গেট খুলার আওয়াজ পেতেই দুই ভাইবোন চোখ তুলে তাকায়। মেয়েটা কাঁদছিল। দুই চোখ ফুলে উঠেছে। নাক, গাল লাল হয়ে গেছে। ফর্সা আদুরে মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে।
বর্ষণ ঠাস করেই তাপৌষির গালে চড় বসালো। ফাজলামির একটা লিমিট থাকে। আহ্লাদ যেন উপড়ে পড়ছে। বাপ-মা’য়ের এক মেয়েগুলো আসলেই আহ্লাদী হয়। কিছু হলেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। ফালতু মেন্টালিটির মেয়ে মানুষ।
.
হঠাৎ এরকম চড় তাপৌষি দিশা কেউই হজম করতে পারলো না। তাপৌষি গালে হাত দিয়ে বর্ষণের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার মেঘ জমেছে। শুধু বর্ষণের অপেক্ষা।
দিশা কী বলবে বুঝতে পারছে না। ও নিজেও ভয় পেয়ে গেছে। তাও সাহস সঞ্চয় করে বললো,
-‘ ভাইয়া ওকে মারাটা কী ঠিক হলো? মেয়েটার এমনিতেই মন খারাপ। তার উপর দাদীর কটু কথা। আবার তুমি মারলে। চড় মারা উচিত হয় নি।’
বর্ষণ দিশার কথার উত্তর না দিয়ে তাপৌষিকে সরিয়ে ওর ঘরে প্রবেশ করলো। দিশাও পায়ে পায়ে ঢুকলো। বলা তো যায় না, যদি আবার মেরে দেয়!
.
এই আকস্মিক ঝড়ে তাপৌষি বিহ্বল হয়ে পড়েছে। সে এখনো বুঝতে পারছে না কেন মারা হলো তাকে। লোকটাকে কী তার দাদী পাঠিয়েছে তাপৌষিকে মারার জন্য?
-‘ আমাকে মারলেন কেন?’
-‘ বসো এখানে। দিশা যা তো ওই চেয়ার টা নিয়ে আয়।’
বর্ষণ বসেছে খাটের উপর। এই ঘরে আসবাবপত্র বলতে আছে একটা খাট, একটা টেবিল, একটা আলমারি আর শোভাবর্ধনকারী কিছু ল্যামশেড।
.
বর্ষণ তাপৌষিকে নিজের সামনে বসালো।
-‘ তুমি রিমির সামনে কী বলেছ তুমি বুঝতে পারছো?’
তাপৌষি এখনো গাল থেকে হাত নামায় নি। এই হাত হচ্ছে ওর প্রটেকশন। যদি আবার মারে তাইলে হাত তাকে রক্ষা করবে। তাপৌষির কোন জবাব না পেয়ে বর্ষণ বলতে লাগলো,
-‘ তাপৌষি তো তাইনা?’
তাপৌষি মাথা উপর নিচ করলো।
-‘ তো শুনো তাপৌষি, রিমির কাল বিয়ে। এখন তোমার কথাগুলো ওর উপর মারাত্মক ইফেক্ট করবে। বিয়ের আগেই ওর মনে নতুন পরিবারটিকে নিয়ে ভয় জন্মাবে। ও নিজের পরিবার ছেড়ে আরেক পরিবারে চলে যাচ্ছে। ওর এ সময় সাহস আর মানসিক শক্তি দরকার। তোমার কথাগুলো ওকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিবে।’
-‘ আমি তো ভুল কিছু বলি নি।’
বর্ষণ এবার ভালোমতো তাকালো তাপৌষির দিকে। মেয়েটা নাক টানছে। মুখে একটা আহত বিদ্ধস্থ ছাপ। ফর্সা মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বর্ষন বললো,
-‘ তুমি ঠিক বলেছো। তবে এই যে দেখাদেখি, কথা বলাবলি এসব এই জায়গায় হয়না। আমাদের মেজো চাচার পরিবার অনেক রক্ষণশীল।’
-‘ তাও অন্তত একমাস তো দেখা করতে, কথা বলতে দেওয়া উচিত ছিল।’
-‘ শুনো তাপৌষি তোমার কথা গুলো একদম সঠিক। তবে সামান্য একমাসের মেলামেশায় তুমি কাউকে চিনতে পারবে না। যদি কেউ দুমুখো হয় তাহলে হাজার চেষ্টা করেও তুমি তার অন্তর পড়তে পারবে না। একটা মানুষ অসৎ হলে সে অবশ্যই তোমার সামনে তা তুলে ধরবে না। আবার অনেকে সাত-আট বছরের সম্পর্ক করে বিয়ে করে। অথচ দেখা যায় বিয়ের পরও সে অপর মানুষটিকে চিনতে পারছে না অথবা অপর মানুষটি পাল্টে গেছে। কিছু কিছু জিনিস ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হয়।’
-‘ আপনি ভাগ্যে বিশ্বাস করেন?’
-‘ হুম করি তো। মানুষ কর্ম করে। আর ভাগ্য মানুষকে কর্ম অনুযায়ী সাফল্যের পথে নিয়ে যায়। এখন যাও সবার সাথে আনন্দ করো। ঘরে একলা বসে থাকতে হবে না। আর আমি খুব সরি। তখন রাগ উঠেছিল। তোমার মতো টিনেজ মেয়েরা একটুতেই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তাই ভয় পেয়েছিলাম।’
ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বর্ষণ তাপৌষির চুল গুলো এলোমেলো করে দিলো।
.
এতক্ষণ ধরে ঘটা ঘটনাগুলো দিশা বড় বড় চোখ করে দেখছিল। বর্ষণ বের হতেই সে তাপৌষির সামনে বসলো।
-‘ তাপৌষি ভাইয়ার কথায় রাগ করো না। ভাইয়ার রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না। আর মন খারাপ করে থেকো না।’
-‘ না আপু মন খারাপ করি নি। সব কথাই ঠিক বলেছেন উনি। আচ্ছা আপু আমার কি এখন দাদী আর রিমি আপুর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত?’
-‘ না। এখন আমাদের বাজারে যাওয়া উচিত।’
-‘ কেন?’
হাতের মোবাইলটা তাপৌষির সামনে উঁচু করে ধরলো দিশা। সম্ভবত কোন ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে ম্যাসেজ ভেসে আছে তাতে।
-‘ কী হয়েছে আপু?’
-‘ বুঝতে পারো নি? রিমি আপুর আজকে হলুদ। বাজারে যাবো আমরা। রেডি হয়ে নাও। দেখেছো কাণ্ড, বর্ষণ ভাইয়া কে তো কিছু বলাই হলো না! তুমি রেডি হও আমি ভাইয়াকে খুঁজে দেখি।’
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here