#ছায়া_হয়ে_মিশে_রব_কল্পনাতে
পর্ব:- ৪ ও ৫
.
সকালে ঘুম থেকে উঠতে অথৈর দেরি হয়ে গেছে আজ। গতকাল সারারাত ও কেঁদেছে। “তাপৌষি মিসিং” দিশার বলা এই একটি শব্দ মাথার মধ্যে লাটিমের মতো পাক খাচ্ছে। নিজেকে দোষ দিতে ইচ্ছা করছে। ওর জন্যই তো বর্ষণের এতো কষ্ট।
আচ্ছা তাপৌষি হারিয়ে গেল কোথায়?
-” আম্মা আপনে খাবেন না?”
-” না বাপি খিদা নাই।”
-” আম্মা মফিজরে দিয়া টাটকা বাকরখানি আনাইসি। চায়ের লগে খাইয়া দেহেন একটা।”
-” না বাপি খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-” কী হইসে আপনার?”
-” বাপি আমাকে একটা রাজশাহীর টিকিট করে দিতে পারবা? তাপৌষি পিচ্চিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি যাই? ”
-” আপনে গেলে ওগো কী লাভ?”
-” কোন লাভ নেই। আমি মনের খোরাক মিটাতে যাব। যদি আমি কোন হেল্প করতে পারি?”
-” একলা যাইবেনন? ”
-” বাপি..”
-“যাইয়েন। আম্মার মতোন জেদি হইসেন। কিন্তু আপনে গেলে যে আপনার আম্মায় পেরেশান হয়ে যাইব।”
-” আম্মাকে তুমি সামলাবা।”
অথৈর এখন অনেক কাজ। ব্যাগ গুছাতে হবে। বর্ষণের পাশে দাঁড়াতে হবে। জানে, বর্ষণ ওর সাহায্য নিবে না। তাতে কী? অথৈ সাহায্য করেই ছাড়বে।
___________________________________________
আজকে সকালের পত্রিকা খুলেই সামিরা তাপৌষির নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেখতে পেল। গতকাল দুপুরে কামাল ভাইয়ের ফোন পেয়েই সামিরা হোস্টেল থেকে বের হয়ে এসেছে। তাপৌষি যখন রাতেও ফিরল না তখন রেশমি সম্পূর্ণ হোস্টেলের মেয়েদের জাগিয়ে ছেড়েছে। সামিরা বুঝে পায়না এসব। একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য কীসের এতো দরদ রেশমিদের? কামাল ভাই যদিও ওকে বলেনি তাপৌষি কোথায় কিন্তু সামিরা জানে এরা তাপৌষিকে আটকে রেখেছে। আরে যেই সুন্দর মেয়ে! এরে ছাড়া যায় নাকি? কয়েকদিন খেয়ে ছেড়ে দিবে।
.
বাড়িতে সামিরা গতকালই চলে এসেছে। কামাল ভাই বলেছে হোস্টেল থেকে দূরে থাকতে। ভাইদের সংসার। রাজশাহীতে বাড়ি থাকতেও ওকে হোস্টেলে থাকতে হয়। বাবা-মা মরার পর ভাইগুলো যেন পর হয়ে গেছে। কখনো কোন সাহায্য করেনি। বিয়ের কথাও তুলে না। সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে যে।
পেপার পড়ে সামিরার হাত পা কাঁপছে। এই কারণেই ওই শয়তান কামাল ওকে সরে যেতে বলেছে? আর এই বিজ্ঞপ্তি ? ওর জানা মতে তো তাপৌষির এখানে কেউ নেই। হঠাৎ কোথায় থেকে এই খালাতো ভাই টপকাল? দ্রুত ফোন বের করে ও অনলাইনে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে টিকিট কেটে নিল। কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। কামাল আহসানের ফোনেও বারকয়েক ট্রাই করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।
.
এখন দুপুর দুটো। সামিরা গোসল করে এসে খেতে বসেছে। কিন্তু ভাতের প্লেট থেকে লোকমা তোলার আগেই একজন মহিলা ওকে টেনে বাড়ির সদর দরজায় নিয়ে আসলো। পুলিশ!
.
-” আমি কিছু জানি না, বিশ্বাস করেন তাপৌষি কোথায় আমি জানি না।”
যতবার সামিরাকে “তাপৌষি কোথায়” প্রশ্ন করা হচ্ছে ততবার সে জানি না জানি না করে চেঁচাচ্ছে।
-” স্যার মেয়ে মুখ খুলে না। ”
-” আদালতে তুলবো। বি রেডি। সাত দিনের জন্য তো রিমান্ড চাবোই।”
সামিরা ভ্রু কুচকে ওর সামনে বসা অফিসারের দিকে তাকাল। রিমান্ড কেন? মনকে প্রশ্ন করল,
“সত্য বলে দিব?”
___________________________________________
-” ভাইয়া সামিরা মেয়েটাকে পুলিশ ধরেছে।”
বর্ষণ সেই সকালে পুলিশের সাথে বের হয়েছিল তাপৌষির হোস্টেলের উদ্দেশ্যে। নাছোড়বান্দা বর্ষণকে পুলিশ কিছুতেই নিজেদের থেকে আলাদা করতে পারেনি।
বাধ্য হয়েই এএসপি ওবায়দুল হক বর্ষণকে নিতে রাজি হন। সেই সাথে মন্তব্যও করেন সঙ্গী পুলিশদের উদ্দেশ্যে,
” বুঝলেন উনি হচ্ছেন প্রেমিক মানুষ। উনাকে এখন কোন মতেই আটকিয়ে রাখা যাবেনা। ”
.
হোস্টেলে যেয়ে বর্ষণ তাপৌষির এক ক্ষুদ্র দুনিয়ার সাথে পরিচিত হয়। একটা আঠারো বছরের বাচ্চা মেয়ে, যে জীবনের আসল অর্থই বুঝেনি অথচ জীবন তাকে কত ভয়াবহ পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
হোস্টেলের প্রতিটি মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের পুরো সময়টা জুড়ে বর্ষণ চুপচাপ একটা চেয়ারে বসেছিল। মাথা ব্যাথা করছিল ওর। রাতে ঘুম হয়নি। ভীষণ অস্বস্তি ফিল করছিল। মেয়েগুলো কেমন যেন ঘুরে ঘুরে ওকে দেখছিল।
.
সামিরা বিষয়ক ক্লু পুলিশ রেশমির কাছে পায়। সন্দহের নিহর আরও পরিষ্কার হয় যখন জানতে পারে তাপৌষির মিসিং এর পরের দিন সামিরা নিজের বাড়িতে গেছে। মেয়েটার ফোনে বারবার ট্রাই করে পুলিশ নাম্বার বন্ধ পায়। হোস্টেলের নিচের সিসিটিভি দেখে জানতে পারে তাপৌষি নিখোঁজের দিন ও সামিরার সাথেই বের হয়েছিল। এরপর আর ফিরে আসেনি।
.
বর্ষণ গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে বলল,
-” চল থানায় চল।”
-” এখন।”
-‘ হ্যাঁ, রেডি হ।”
___________________________________________
“আমার একলা আকাশ, থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
তুমি চোঁখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাঁদে এসে
ভোরের শিশির ঠোট ছুঁয়ে যায় তোমায় ভালবেসে
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার ক্লান্ত মন ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম
পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন
ঘর ভরা দুপুর, আমার একলা থাকার সুর
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায় কতদূর
আমার বেসুরে গীটার সুর বেঁধেছে, তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে তোমার হাসি হেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
অলস মেঘলা মন
আমার আবছা ঘরের কোণ
চেয়ে রইতো, ছুঁতে চাইতো
তুমি আসবে আর কখন
শ্রান্ত ঘুঘুর ডাক
ধূলো মাখা বইয়ের তাক
যেনো বলছে, বলে চলছে
থাক অপেক্ষাতেই থাক
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে……”
.
-” অথৈ আম্মা।”
-” জি বাপি?”
-” ফাটাফাটি গাইসেন আম্মাজান”
-” ধন্যবাদ বাপি।”
-” আপনার টিকিট। ট্রেনে যাইতে পারবেন তো? ”
-” ট্রেন ছাড়া তো কোন উপায় নেই বাপি। আজকে তো রাজশাহী রুটে কোন প্লেন চলবে না।”
-” তাও কথা। তো আম্মা যাওয়া টা কী ঠিক দেহায়? বর্ষণ বাবাজি আপনেরে ভালো মনে নিবে?”
-” বর্ষণ এখন একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাপি। হোক না হোক এর অনেকটা কারণ আমি। আমার ভুলের জন্যই তো এমন হচ্ছে। আমি তোমার মেয়ে হয়ে এতো নিচে কীভাবে নামতে পারলাম বাপি?”
-“আম্মাজান কাঁদে না। আপনে তো বর্ষণ বাবাজিকে ভালোবাসেন বলেই এমন করসেন।”
-” বাপি আমি ওদের সামান্য সাহায্য করতে পারলেও নিজেকে ধন্য মনে করবো।”
-” আম্মাজান যাচ্ছেন তো, কিন্তু সাবধানে থাকবেন। গাড়ি ছাড়া চলবেন না। বুঝবার পারতাসি না আপনি কী সাহায্য করবেন। যাইতে চাচ্ছেন, জেদ তুলসেন বলে আমি আর আপনার আম্মায় রাজি হইসি। তয় কইয়া দিলাম সুস্থ সবল যাইতাসেন, সুস্থ সবল আইবেন।”
অথৈ ওর বাপির কথায় ঘাড় নাড়াল। বাপি আসলেই বেস্ট।
___________________________________________
-” হ্যালো শুভ জন্মদিন প্রিয়তা।”
-” ধন্যবাদ রেখা।”
-” মাসুদ ভাই তোমাকে ডেকেছে। অফিসে উপস্থিত থাকতে বলেছেন সকাল এগারোটার মধ্যে।”
-” আমি তো ছুটি নিয়েছিলাম। আজ বাসা থেকে বের হতে পারবো না রেখা। মা বের হতে দিবে না”
-” মাসুদ ভাই রেগে আছেন। তুমি কী ব্ল্যান্ডার করেছ?”
প্রিয়তার গলা শুকিয়ে গেছে। গত কালকের “শাক বাবার” ইন্টার্ভিউ নিয়ে ঝাড়বে না তো? চাকরিটা থাকবে তো? এমনিতেই চাকরি পাওয়া যে মুস্কিল!
-” আসছি। ”
.
আসছি…বলে তো দিয়েছে। কিন্তু এখন যাবে কী করে? প্রান্ত.. নামটা মাথায় আসতেই প্রান্ত বলে সজোরে চিৎকার দিল প্রিয়তা।
-” কী হয়েছে বুবু?”
-” গেট লাগিয়ে আমার ঘরে বসে থাকবি। আগে মা কে বলে আয় ফ্রেন্ডের বাসায় যাবি। বারান্দা দিয়ে ঢুকে আমার জন্য বারান্দা খুলে রাখবি।”
-” আবার?”
-” প্লিজ ভাই। মাত্র দুই ঘণ্টা।”
প্রান্ত এক গভীর নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” আচ্ছা।”
.
প্রিয়তা রেডি হয়ে বারান্দা দিয়ে লুকিয়ে বের হয়েছে। প্রিয়তা বের হওয়ার পরপরই প্রান্ত প্রিয়তার ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। আপতত ঘুষ স্বরূপ প্রিয়তা তার ট্যাব প্রান্তর কাছে দিয়ে গেছে। সেই ট্যাবেই মনের সুখে প্রান্ত গেম খেলছে।
.
.
চলবে…..
[সকলের কাছে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। গল্প কেমন লাগছে আপনাদের? ভুল- ত্রুটি চোখে পড়লে অবশ্যই জানাবেন।]