“দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-১১২ (শেষপর্ব💘🌹)
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
নিজের দিকে মুখ তুলে তাকায় মিতু।
আজ একেবারে অন্যরকম লাগছে তাকে,নিজেকে দেখেই যেন অবাক হয়ে রয় মিতালী।
গত বছর যখন বউ সেজেছিল তখন কি এমন লেগেছিল?ভাবার চেষ্টা করে,
“গতবার কি এমন লেগেছিল?আর লাগলেই বা কি…সে তো আমার দিকে ভালো করেও তাকায়নি..আর আজ…?’
পারুল একেবারে আয়োজন করেই সব কিছু সাথে করে এনেছে,তার ব্যাগ থেকে গয়নার বাক্স বের করে মিতুর।
মিতুর সেই বিয়ের গহনা!দেখেই অবাক হয়ে যায় মিতু,তবে সব নয়, ওর দাদী শ্বাশুরির ও তার বিয়েতে পাওয়া আরও কিছু গহনা ওগুলো তার ঘরেই নিরাপদ জায়গায় লকারে আছে।
তবে বন্ধন তার কিনে দেয়া ও তার মায়ের কানের দুলগুলোসহ, সোনার এ গহনাগুলো পারুলের কাছে পৌঁছে দেয় আগেই।
“উফহ্ মিতু আপু তোমাকে যা লাগছে না …? তোমার উনার তো পুরাই মাথা খারাপ হবে আজ…!’
বিউটিশিয়ানরাও মনের মাধুরী দিয়ে সাজালো মিতালীকে।
শাড়ীটার বেশ প্রশংসা করলো তারা।
মিতালীর দুহাতে খুব সুন্দর আল্পনা এঁকে দিলো।
তারপর তাতে মুঠো ভরে রাজস্থানী লালচে খুব সুন্দর বিয়ের চুরি।
মেহেদী সাজও বাদ গেলোনা।
হাতে কনুই এর উপর চমৎকার আল্পনা এঁকে দিলো।
সবচেয়ে আকর্ষনীয় লাগছিল মিতুর চোখ জোড়া।
বন্ধনের ভাষায়,
“ভাসা ভাসা মায়াবী চোখ… ঐ চোখের সাগরে বারবার ডুবে যেতে ইচ্ছে করে,যদি তাকাও এমনি করে?’
স্মৃতিগুলো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে মিতুর।
পাঁচ মাস আর গত তিন মাস বাদ দিলে গত এক বছরের সংসারে মাত্র চারটা মাস বন্ধন তাকে ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়েছে।
অথচ তাতে কতোই না জাদু…!ছিল খুব কম সে জাদুর পরশ কিন্তু এর গভীরতা কোনো কিছু দিয়ে পরিমাপ করা তো যাবে না?
“ফের যদি ফাঁকি দেয় বন্ধন?’আবারও মনে কোণে অজানা আশংকা মিতালী মিতুর।
অবশেষে মিতালী রহমান মিতু আবারো বধু সাজে প্রত্যাবর্তন করে তার ঘরে।
যে ঘর তার কতো না প্রিয়,আর কত যে আপন!
নানু আর বাবাইকে দেখে ভীষন খুশী হয় মিতালী।
কোলে জড়িয়ে নেয় বাবাইকে।
সবচেয়ে অবাক হয় বাড়ীটাকে বিয়ের সাজে সাজানো হয়েছে।বাড়ীর বাইরে লাইটিং, ছাদে মাইক টানানো বিয়ের সানাই এর সুর ভেসে আসছে তাতে।
মিতুকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে পুরানঢাকা থেকে পালকীর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
ধানমন্ডিতে বন্ধনের পাঠানো গাড়ীতে চেপেই বাসায় আসে মিতু।
তবে তাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে গলির মুখে মিতুর জন্য পালকী পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মুহিন, রানুর স্বামী, বন্ধনের এক চাচাতো ভাই ও জামান কাঁধে চাপিয়ে পালকীতে করে পৌঁছে দেয় মিতুকে তার আপন ঠিকানায়।
ঘরে প্রবেশ করতেই প্রিয় মানুষগুলোকে দেখে ভীষন আনন্দ মিতালীর।নানুকে সালাম করে বুকে জড়িয়ে নেয় আত্মহারা মিতু।
নানু ওর মুখে পায়েশ দিয়েই মিষ্টি মুখ করায়।
রানুও এসেছে দেশ থেকে।সেও সেজেছে সুন্দর করে হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে সেও এগিয়ে আসে মিতালীর দিকে।
আর বুয়া মিতালীকে দেখার সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে,
“আফামনি আফনে আইসেন?আপনারে ছাড়া এই সোনার সংসারের কি দশা হইসিল?কারো মনে সুখ আসিলো না আফামনি…?’
“কেমন আছো বুয়া?কেঁদোনা আমি ফিরে এসেছি এবার সব ঠিক হবে…।’
সবাইকে দেখার পর মিতুর সেই চোখ জোড়া তাকেই খোঁজে এবার, যার কারনে তার ভাসা ভাসা চোখ জোড়ায় ভালোবাসার সমুদ্র জমে আছে?
হঠাৎ পেছন দিক থেকে কেউ জাপটে ধরে মিতুকে।
কোন কথা না বলেই একেবারে কোলে তুলে নেয় নববধুকে সবার সামনে!
সে আর কেউ নয় বন্ধন আহমেদ বাবু।
খুব সযতনে সিঁড়ি বেয়ে নিয়ে যায় তার সেই ঘরে যে ঘরটির জন্যে মিতালী মিতু হাহাকার করেছিলো।
যে স্বপ্নের কথা লিখেছিল মিতু নীরব অভিমানে,বন্ধন যা পড়ে জেনেছিল সুদূর ইংল্যান্ডে টেমস নদীর ধারে, একা দাঁড়িয়ে….।
নিজের ঘরে আসার পর অারো বেশী অবাক হয় মিতু।
তাদের বিছানায় ফুলে ফুলে ছাওয়া…
ঘরের চারকোনা পাশগুলোতে ছোট ছোট প্রদীপ জ্বলছে।
ঘরের সুদৃশ্য কাঁচের টেবিলটায় ভাসমান ফুলেল পাঁপড়ীতে ছেয়ে আছে।
মিতু আজ কল্পনাও করেনি এতোগুলো চমক অপেক্ষা করছিল তার জন্যে!
বিশাল শোবার বিছানায় অসংখ্য তাজা বেলী ফুল দিয়ে সাজানো অদ্ভুত সুন্দর বাসর শয্যা।
আর বিছানায় গোলাপের পাঁপড়ী দিয়ে সাজানো তাতে হার্ট শেডের মতো করে আঁকা।
উপরে মিতু ও নীচে বন্ধন লেখা হার্টের ভেতরে আর তার মাঝে ভেদ করছে ভালোবাসার তীর চিহ্ন।
ভীষন খুশিতে আত্মহারা মিতু।
তার ঘরের বাইরে সানাই এর মধুর সুর বেজে আসছে,
জানলা গুলো খোলা,তা থেকে আজ সারাদিনের বৃষ্টিরও এক ঝলক মিষ্টি ঘ্রান বেয়ে আসে।
বেলী ফুলের মিষ্টি মাতাল করা সুবাসে ছেঁয়ে যায় ঘরটায়, কী ভীষন ভালো লাগে মিতালীর।
পেছন থেকে আবারও জড়িয়ে ধরে বন্ধন মিতালীকে,
“হ্যাপি এনিভার্সারি মিতু…।’
“হ্যাপি এনিভার্সারি বাবু…!’
“তুমি খুশী তো জান?’
পেছন থেকে এবার মিতুর সামনে আসে বাবু।
“অনেক অনেক…. কী যে ভালো লাগছে! বলে বোঝাতে পারবো না আপনাকে…!’
ফের বন্ধন বলে
“তাই সোনা?আমার ওপর আর রাগ রেখোনা লক্ষীটি…?’
কিছু একটা ভেবে বন্ধনের বুকে দুহাতের মুঠি দিয়ে কিল ঘুষি দেয় এবার,আবার সেই আল্লাদিপনা শুরু হয় মিতুর।
“কেন এমন করেছিলেন আপনি?আপনি জানেন আমার কেমন লেগেছিল এ তিনটা মাস?কিভাবে ছিলাম আমি, কিভাবে কেঁটেছিল একেকটা দিন….একেকটা রাত…?’
“জানি গো…?’
“মিথ্যে কথা…যদি মরে যেতাম তখন বুঝতেন?’
মুখটা হাতটা দিয়ে আঁটকে দেয় বন্ধন প্রায় সাথে সাথে
“উঁহু আর একবারও নয়…মরার কথা আর কোনোদিনও বলবে না তুমি বুঝেছো?’
ক্ষিপ্রত্যয়ে বলে ওঠে বন্ধন।
“তাহলে আমাকে কথা দেন আর কখনো আমাকে এভাবে কষ্ট দিবেন না,কখনো এমন করে আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন না?’
“এই আমি তোমায় ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি বাবু…’
“ছোটবাবু আছে কিন্তু ও কিন্তু শুনছে…।’
বন্ধন মিতালীর পেটটাতে মাথা দিয়ে বলে,
“এই আমি আমাদের সোনামনিকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি কখনো তার মামনীকে কষ্ট দিবোনা…. কখনো যাবোনা ছেড়ে তোমাদের ফেলে..।’
মিতু খেয়াল করে দেখলো বন্ধনের গায়ে সেই পাঞ্জাবী,যেটা গতবছর অক্টোবরে বাবুর জন্মদিনে মিতু কিনে দিয়েছিল।
শুভ্রসাদা রঙা পাঞ্জাবী,তার বুকে নীলচে কাজ করা।
বন্ধন এবার তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা বক্স বের করে,সেটি খুলে মিতুর পাটা বাড়াতে বলে,
“কী এটা বাবু?’
“পা টা দাও বলছি..।’
বা পা বাড়াতেই বন্ধন তাতে পরিয়ে দেয় সুদৃশ্য সোনার নুপূর।
“সে কি আপনি নুপূর এনেছেন আমার জন্যে?আপনার মনে ছিল আমার নুপূর হারিয়েছিল সেকথা?’
“কেন মনে থাকবে না,তোমার সবকথাই আমার মনে থাকে বুঝেছো সখী…?’
“কিন্তু কি দরকার ছিলো?আমি তো পেয়েছি আমার হারিয়ে যাওয়া নুপূর।’
“বেশ তো ভালো হয়েছে দুপায়ে দুটো পড়বে।’
“আচ্ছা আমায় ওভাবে সিঁড়ি বেয়ে কোলে নিয়ে আনলেন কেন সবার সামনে?’
“তো?আমি আমার পোঁয়াতি বউকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দিবো?’
“তাই?ইশ এতোদিন বুঝি আমি আপনাকে ছাড়া ছিলাম না?তখন? ‘
“তখনটা তখন শেষ এখন আমি আছি, তোমার স্বামী ?’
“হু যখন আপনি থাকবেননা? ‘
“আবার থাকবোনা?তো কই যাবো?’
“আরে যখন অফিসে চলে যাবেন?ইশ এত কম বুঝেন কেন কথা?’
“যাবোনা অফিস,তোমার কাছে থাকবো সারাক্ষন… হইলো?’
ফের শুরু হয় হাসিঠাট্টা খুনসুটি বন্ধনের সাথে।
হঠাৎ আবারো চুপ হয়ে যায় মিতু কি যেন একটা ভেবে।
মিতুর মুখটা খুব ভালো করে দেখে বন্ধন
কি যে সুন্দর লাগছিল মিতুকে যখন আবারো দ্বিতীয় বারের মতো তাকে বউ সাজানো হলো।
হাতে,পায়ে মেহেদি আর সুন্দর ডিজাইনের আলপনা।
আস্তে আস্তে বন্ধন সেসব জায়গায় তাতে ঠোঁটের আলিংগনে মাখামাখি করে।
তারপর একে একে মিতুর শরীরে সুসজ্জিত গহনা গুলো বন্ধন খুলে সরিয়ে নেয় আর তাতে উষ্ণ ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দেয় তীব্র অধরের মধুকরী আবেশে,
বন্ধনের চোখে চোখ রাখে মিতু,
“তুমি আজ সেজেছো প্রিয়া শুধু আমারি জন্যে,জানি সেরাতে প্রথম বাসরে আমি তোমায় একাকীনি করে রেখেছিলাম,কিন্তু বিশ্বাস করো মিতু,সে আমার ইচ্ছাকৃত নয়… সেরাতে আমারও খুব খারাপ লেগেছিল, সেদিনও বাসরঘরে ফুল ছিল কিন্তু তাতে ঘ্রান ছিল না আর আজ দেখো মিতু তোমার বাসর হবে বলে ফুলগুলো থেকে কি তীব্র মাতাল সুঘ্রান আসছে…
তোমার স্বপ্নে বাসরে আজ আমি তোমাকে মন ভরে সাজাবো আমার ভালোবাসা দিয়ে,আর দুচোখ ভরে স্বপ্নের জাল বুনবো…!’
এভাবেই প্রেমময় কথায় কখন যে রাত আরও ঘনীভুত হয়,ক্লান্ত প্রদীপও ধীরে ধীরে নিভে যেতে থাকে।সারারাত ধরে ভালোবাসার উত্তাল সমুদ্রে দুটো ভালোবাসা ভালোবাসিময় মানুষ ডুবে রয়।
একজন আরেকজনের বাহুবন্ধনে প্রানের উত্তাপ আর একরাশ আনন্দে স্বস্তি খুঁজে পায় কতোদিন পর।
“ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়?’
হঠাৎ মিতুর চুপ হয়ে যাওয়া দেখে জিজ্ঞেস করে বন্ধন,
“কি হলো আবার মিতু?কি ভাবছো?’
“ভাবছি,মুহিনটা তো একা হয়ে গেলো?’
“কেন একা হবে?তোমার ভাই কি আমার কেউ নয়?’
“সত্যি বন্ধন?প্লিজ ওর জন্য কিছু করেন?ওর যে কেউ নেই?’
“ঐ যে আবার সে এক কথা?ওর সবাই আছে, শোনো এখন থেকে মুহিন এখানেই থাকবে আর যত দ্রুত স্কলারশীপ নিয়ে ওকে বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো,তুমি ওতো ভাববেনা বুঝছো?’
মিতুর চোখের কোণাটা আবারো ভিজে যায়,
“আপনি এতো ভালো কেন বাবু?এ পৃথিবীতে আপনি না থাকলে আমার যে কি হতো…?অথচ আমি আপনাকে না জানি কতো ভুল বুঝেছিলাম?’
মিতুর কপালটায় আবারো চুমু খায় বন্ধন,
“কি বুঝেছিলে?আমি একটা খারাপ মানুষ,তোমাকে ধোকা দিয়েছি?’
মাথা নীচু করে ফেলে মিতু লজ্জায়,
“শোনো মিতালী, নিঃশ্বাসের সাথে কেউ কখনো ছলনা করতে পারে না, পারে না ধোকা দিতে ?আর নিঃশ্বাসকে ছেড়ে গেলে কেউ বাঁচে না…. সো বন্ধন বাবু যদি সত্যি তোমাকে ধোকা দিতো তবে আজ সে তোমার বুকে থাকতো না…আর কখনো এভাবে হতো না সাজানো তোমার স্বপ্নের বাসর।’💘
বন্ধনের কথায় বুক ভরা স্বস্তি ফিরে পায় মিতু।
এই একই কথাটা অনেক আগে একবার মিতালী বলেছিল ঠিক এভাবে। বন্ধন সেই কথাটাই খানিকটা ঘুরিয়ে মিতুকে ফেরত দিলো।
ফেরত দিলো তার এতোদিনের অপেক্ষার সে প্রহর,কত সাধনার স্বপ্নের বাসর।
বন্ধনের এই কথার পরে আর কোনো কথা গ্রাহ্যনীয় নয় কোনোমতেই,
একজন স্ত্রী হিসেবে সে এখন বন্ধনের প্রেমিকা,নিঃশ্বাস আর তিলে তিলে গড়া বিশ্বাসের একনিষ্ঠ অধিকারীনি মিতালী রহমান মিতু।💘
যার বুকে ঠাঁই নেবার পর তার স্বপ্নের সাজানো বাসর তার সম্মুখেই সত্যি হতে পেরেছে।
হয়তো কিছুটা দেরীতে তবু দ্বিতীয় বারের মতো বাসরে না পাওয়া প্রথম বাসরের কোন অতৃপ্ততা বা অবসাদ চিহ্নই বন্ধন আর তাকে মনে রাখতে দেয়নি।
দিবেও না কখনো, মিতু বন্ধনের নতুন জীবনে, সে শপথ যেন গড়েছে; ভালোবাসাময় তাদের বহু কাক্ষিত স্বপ্নের বাসরে।💜🌹
(সমাপ্ত)
গল্পটি কেমন লাগলো প্লিজ জানাবেন আর প্রতিদিন নিত্যনতুন গল্প পড়তে ভিজিট করুন গল্পের ঠিকানা ওয়েবসাইট এবং গল্পের শহর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন যাতে করে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই নোটিফিকেশন পান। যদি আপনারা চান তাহলে দ্বিতীয় বাসর ২❤️ আসবে।কমেন্টে জানাবেন অবশ্যই ❤️
……
Allah …khub valo laglo golpo ta pore🥰🥰🥰🥰🥰😘😘…golper nam dekhe prothome koto ki mone korechi🤦♀️🤦♀️🤦♀️….ending ta pore khub valo laglo💝💝💞💞💞💓💓❤❤❤
Thank you for your nice complement