প্রেম সায়রের ছন্দপাত পর্ব ৪

#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত
#সাদিয়া_নওরিন

পর্ব—৪

” আজ খুব করে একটি বিষয় অনুভব হচ্ছে আমার, যখন কোন মেয়ে জানতে পারে তাকে ছাড়া একটি ছেলের অস্তিত্ব শূন্যের কোঠায়! তার প্রেমে এতোটাই মাতোয়ারা সে, তাকে ছাড়া বেচে থাকাটাও হয়তো কল্পনা করতে পারে না। তখন মেয়েটি তাকে সত্যি সত্যিই আর বাঁচতে দেয় না! ভালোবাসার পরিক্ষা সরুপ তার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করে সে তখন!
এভাবে হারিয়ে ভালোবাসার পরীক্ষা নেওয়ার চেয়ে টুঁটি চেপে ধরলেই তো পারো তুমি ছন্দ!”

ধরফরিয়ে উঠে বসে আরশী। বুকটি এখনো টিপটিপ করছে তার! হঠাৎ গাড়ির ঝাঁকুনিতে চোখদুটি লেগে এসেছিল তার। কিন্তু সেই ভয়েস রেকর্ড, তা যে বারবার হানা দেয় তার কল্পনায়! যেন এখনো কানে বাজে রেকর্ডটি তার! হেডফোন দিয়ে শোনা সেই ফিসফিসানি ধ্বনি, আজো আরশীর ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলে!
সেইসময় আইডি ডিএক্টিভ করতে জানতো না আরশী,, আর তাইতো বন্ধ করে দেওয়া আইডিটি আবার ওপেন করেছিল সে একবছর পর!

আঁড়চোখে পেছনের সিটের দিকে তাকালো আরশী। সিটের সাথে মাথাটি হেলিয়ে, চোখ বুঝে আছে ইরশাদ। হয়তো কিছু চিন্তায় ব্যাস্ত সে, তবে সে যে ঘুমায় নি খুব করে জানে আরশী! হাঁটুর ওপর তর্জনী দিয়ে আলতোভাবে বাড়ি দিচ্ছে ইরশাদ। আরশী জানে, এখন কেবল তাদের অতিত সম্পর্কে ভাবছে সে! কারণ এ লক্ষণটি কেবল ইরশাদের অস্হিরতারই প্রমান!
মাথাটি আলতো সামনের দিকে ঘুরিয়ে, আবার চোখ বুঝে আরশী। দুজনই হয়তো এখন ডুব দিয়েছে তাদের সেই সোনালী অতিতে। যার প্রতিটি পাতা সুখময়। ভালোবাসার চাদরে আবিষ্ট হয়ে, ভালোবাসায় রাঙ্গা হয়ে উঠা সেই কিশোর- কিশোরীর প্রথম পরিচয় থেকে প্রণয়ের সেই অতুলনীয় স্মৃতি!

অতিত🍁

মুটোতে পুরে, হাতে থাকা বাটন ফোনটি বারবার নেড়ে চেড়ে দেখছে আরশী। চোখে মুখে অদ্ভুত তৃপ্ততা ঝুলছে তার! এটি তার প্রথম ফোন, ভাবতেই অতিরিক্ত আনন্দ হচ্ছে তার।
আচমকা ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ফোনটি নিয়ে নেয় তার বড় বোন আইমান। অবাক দৃষ্টিতে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায় আরশী।কিন্তু তার দৃষ্টি একদমই স্বাভাবিক।
—- এইটা ঠিক না৷ এইটি আমার জেএসসিতে এ প্লাস পাওয়ার গিফট। তুমি এভাবে নিয়ে নিতে পারো না।
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে আরশী। কিন্তু আইমান স্বাভাবিকভাবে তার পাশে বসে বলে উঠে,
—— তোমার গিফট তো আব্বুকে বলে নিয়ে দিলাম আমি তোমাকে। ডিসের লাইন নিয়ে দিলাম না? তোমার না সিরিয়াল দেখতে ভালো লাগে? তো?
—– কিন্তু, আমার সব বান্ধবীদের তো পারশোনাল ফোন আছে।
—— আমি কখন ফোন পেয়েছি তুমি জানো? বিয়ের পর। আর আরশী, আমি চায় না তোমার অবস্হা আমার চেয়েও করুণ হোক। তোমাকে ভালো অবস্থায় দেখতে চায় আমি৷ আমি চায় না ইন্টার, এসএসসি শেষ করেই বিয়ে করে নাও তুমি। আমি চায় অনেক বড় কিছু হও তুমি। ভালো জব করো। নিজের পায়ে দাড়াও

আইমানের বলা কথাগুলো যেন এককান দিয়ে ডুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল আরশী! বায়োসন্ধিকাল টা হয়তো এমনই। কারো উপদেশ বা ভালো কথা সহ্য হয় না তখন তাদের। জিবনটা তখন ফুলের বাগান মতোই মনে হয়। কিন্তু সেই ফুলের বাগানেও যে পোকা আর কাটা থাকে তা তারা বেমালুম ভূলে যায়।

আরশী পচন্ড ভয় পায় তার বড় আপুকে। একদম চেহারার দিকে তাকিয়ে মনের কথাগুলো বুঝতে পারেন তিনি! আর তাই মা কে কোন ভাবে সামলানো গেলেই বোনটিকে সামলাতে হিমসিম খেতে হয় তাকে।তাই আমতাআমতা করে, মাথা নুইয়েই বলে আরশী,
—— আমি তো মন দিয়েই পড়ছি আপু। এই তো দ্বিতীয় সাময়িকে সানন্স থেকেই জিপিএ ৪.৫০ পেয়েছি আমি এইটা কি কম?
—– কিন্তু।
—- আর কোন কিন্তু না। কোচিং আছে আমার৷
এই বলে মুখ গোমড়া করে ফোনটি একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় সে।

আরশীর যাওয়ার পানে তাঁকিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে আইমান। আরশী মেয়েটি অতিরিক্ত সহজসরল।শুধু সহজসরল বললে হয়তো ভূল হবে। অনেকখানি বোকাও সে।আর এই কারনেই অন্যের কথা খুব সহজেই প্রভাবিত করে তাকে। নিজের ও যে বিবেক আছে তা যেন একপ্রকার ভূলে বসে থাকে তখন সে!
আর তার বান্ধবী প্রিয়া!
হতাশজনকভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইমান। তারপর আনমনেই ভাবে,
” পুরো দুনিয়ার সবাই বান্ধবী হোক, কেবল এই প্রিয়া বান্ধবীটায় না থাক আরশীর জিবনে!”

কোচিং এর গেইটের সামনে আসতেই প্রিয়ার ওপর নজর পড়ে আরশীর। পূলকিত হয়ে তাকাই সে প্রিয়ার পানে। নামের সাথে যেন তার বৈশিষ্ট্যের মিল শতভাগ। একদম টিপটপ গোছানো প্রিয়া। সুন্দর, স্মার্ট আর তার বাচনভঙ্গি, এ যেন আরশীর সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। কতো সহজে নিজের কথা দ্বারা যেকাউকে প্রভাবিত করতে পারে সে! হয়তো এই কারনেই অনেক ছেলেই তাকে প্রিয়তমা বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে! অন্যদিকে প্রিয়ার একমাত্র ক্লোজ বান্ধবী কেবল আরশী৷ অনেকে তো এই কারণে ঈর্ষা ও করে হয়তো আরশীকে, এমনটাই ধারনা আরশীর। তার মনের কোনে সুপ্ত ইচ্ছে জাগে মাঝে মাঝে। সেও প্রিয়ার মতো স্মার্ট হবে!

কোচিং শেষ হতেই প্রিয়া আলতো হাত রাখে আরশীর কাঁধে, তারপর টেনে টেনে বলে,
—- তোর কাজিন নাকি তোকে ফোন গিফট করলো ! কিরে ভালো তালো বাসে নাকি সে তোকে? কি চলেরে?
এই বলে ফিক করে হেঁসে দেয় প্রিয়া। যেন কোন বড় রসিকতা করে ফেলেছে সে। তারপর আরশীর হাতের ফোনটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে, আরশীকে একটি ফেইসবুক একাউন্ট ই খুলে দেয় সে!
আরশী চমকে তাকাই তার দিকে। তারপর তাড়াতাড়ি ফোনটি হাতে নিয়ে অবাক স্বরে বলে,
—- আমার পারমিশন ছাড়া আইডি খুললি কেন? আব্বু জানলে বকবে আমাকে।আর সামনে এতো পড়া, মনযোগ নষ্ট হবে তো।

প্রিয়া ভেঙ্চিয়ে বিরবিরিয়ে কিছু বলে, তারপর মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলে,
—– আফসুস আজ দুবছর ধরে তুই আমার বান্ধবী হয়েও এমন ডাফার থেকে গেলি। আমার চার চারটা আইডি।আমি কি পড়ছি না। আমার কি রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না?
আর আজকালকার যুগে তো সবারই আইডি আছে।আর মেসেন্জারে কথা বললে টাকাও কম কাটবে।ইচ্ছে মতো আমার সাথে গল্প করতে পারবি, গ্রুপ স্টাডি করতে পারবি৷ দুটাকাই চার এমবি। আর সেইটাও সাতদিনের জন্য। মানে সাতদিন কথা বলবি কেবল দুটাকা দিয়ে। কুল না?সারাদিন কথা বললেও ফুরাবে না আর। তোরটা বোতাম ফোন তো। তাই সবকিছুই কম।

তারপর ফেইসবুক সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য দেয় সে আরশীকে।আরশীও যেন অতিউৎসাহে তাকিয়ে রই প্রিয়ার পানে। আসলেই প্রিয়া না হলে হয়তো সে এতোকিছু জানতো না!খুশীতে গদগদ হয়ে ভাবে সে।

অনেকগুলো ছেলের আইডিতে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেয় প্রিয়া আরশীর আইডি থেকে, যা একদমই আরশীর অলক্ষ্যে! তবে আইডির নামটি আরশীই ঠিক করে দেয়।
প্রিয়ার মনটা যেন খুশীতে প্রফুল্ল হচ্ছে আজ!
আরশী নিঃসন্দেহে তার ভালো বান্ধবী। কিন্তু কথায় আছে,মাঝে মাঝে এক বান্ধবী অন্যবান্ধবীর ভালোটা সহ্য করতে পারে না।যার কারনে সৃষ্টি হয় প্রতিহিংসা! পড়াশোনায় তুলনামূলক ভালো রেজাল্ড আর শিক্ষকদের প্রশংসা, বেশীরভাগ সময়ই দুইজন বান্ধবীর মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, আর যদি হয় তারা কিশোরী, তাহলে তো বিষয়টি আরো ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here