উপুর হয়ে ঘুমিয়ে আছে দিহান।আর তার বিছানার কোণায় ছোট্ট করে জায়গা করে নিয়েছে একজন ।চোখ পিটপিট করে দেখে যাচ্ছে । পিঠের কাছাকাছি ঠোঁট এনে স্পর্শ ছাড়াই চুমু খেলো।এতেই শরীরে খেলে গেলো বিদ্যুতের ঝটকা।অনুভুতিগুলো আরও প্রগাঢ় হলো।খানিকের মাঝেই মাথায় শয়তানি বুদ্ধিও খেলে গেলো।কলম এনে পিঠের উপর আর্ট শুরু করলো।দিহান কিছুটা নড়ে ওঠে পিঠের উপরের অত্যাচারে।আস্তে আস্তে মাথা ঘুড়িয়ে তাকায়।আবছা দেখালেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে এটা শয়তানি রিনি।দিহান ঘাড় ঘুরাতেই রিনি দড়িয়ে পরে।ভদ্র মেয়ের মতো পড়ার টেবিলে আসন গ্রহন করে।চোখ কচলে উঠে বসে।শাসিয়ে বলে
–” এমন ফাজলামো দ্বিতীয় বার যেনো না দেখি।”
ফ্রেস হয়ে এসে রিনিকে পড়ানো আরম্ভ করে।
জেনারেলে ম্যাথের একটা অংক নিয়ে প্রচুর চিন্তিত দিহান।বার বার চেষ্টা পরও মিলছে না।গুরুগম্ভীর মুখ নিয়ে ম্যাথ সলভ করতে ব্যস্ত আর তার দিকে উৎসুক একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে।গভীর ভাবেই তাকিয়ে আছে।ম্যাথ তার গোল্লায় যাক। টিচার মিলাবে তার কি? সে টিচারকেই দেখে যাবে। পা টা প্রসারিত করে হালকা করে দিহানের পায়ে পা রাখলো।আবার সরিয়ে নিলো আবার পায়ে পা রাখলো।দুই তিনবার এমন করার পরে বিরক্ত নিয়ে রিনির দিকে তাকায়।
–“রিনি তুমি কি আমার এটেনশন ব্রেক করার চেষ্টা করছো?চাও টা কি বলবা?এইভাবে জ্বালা দেয়ার মানে কি?”
এতক্ষণ রিনি যেনো এই সুযোগই খুজছিলো কখন দিহান ভাই মুখ খুলবে।তার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।সে আঙুল মোচরাতে মোচরাতে জোরেসরেই বলে উঠে
–“তাহলে আপনি আমার দিকে তাকান না কেন দিহান ভাই?”
–” পড়াতে বসে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো?”
–“কেন থাকবেন না দিহান ভাই? আমি সাজলে আপনি দেখেন না, চোখ দিয়ে ইশারা করলে দেখেন না,চোখ টিপ মারলে দেখেন না। দেখবেনটা কি?কি দেখালে আপনি আমার দিকে তাকাবেন?আপনি বুঝেও বুঝতে চান না দিহান ভাই।আমি আপনাকে ভালোবাসি বোঝেন না?
এবার দিহানের মাথায় হাত।এই পাগল মেয়ে এতোটা পাগল কে জানতো?তার গ্রামের মেয়েরা ভালোবাসি শব্দ শুনলেও লজ্জা পায় আর এই মেয়ে কিনা বার বার অকপটে পছন্দ করে সে কথা স্বীকার করছে ।হ্যা এটা ঠিক দিহান রিনির ইশারা ইঙ্গিত বুঝেও বুঝতে চায় না।কারণ সুযোগের সৎ ব্যবহার সব ক্ষেত্রে করতে নেই তা দিহান বোঝে।আর অনেকটাই দায়িত্ব থেকে।কারো খেয়ে পড়ে তার ক্ষতি করার মতো ব্যক্তিত্বহীন ছেলে দিহান না।
এবার দিহান রিনিকে জোরে ধমক দিলো
— “এই তোমার লজ্জা নেই তো জানতাম ভয়ও নেই?পা খুচিয়ে উশকে দিচ্ছো। আমি কি করতে পারি আন্দাজ আছে কোনো?”
রিনি লজ্জাসুচক হাসল।
— “তুমি করলে করবেন আমি কি না করেছি?আমি তো চাই ই আ…..”
দিহান কথা শেষ করতে দেয় না।খোচা মেরে বলে
— “সব ছেলের সাথে এমন করো বুঝি?”
— “এমা আপনি কি যে বলেন দিহান ভাই।সব ছেলে কি আপনি নাকি যে করবো? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি দিহান ভাই।তোমাকেই পটাতে চাই দিহান ভাই।”
রিনি দুষ্ট হাসলো।
এই মেয়ের সাথে কথায় পারা মুসকিল। নাইন পাস করা মেয়ে পটাতে চায় তাকে। দিহানের প্রচুর হাসি পায়, কি নিঃসংকোচ আবেদন কিন্তু দিহান হাসে না রিনির সামনে।আবারব জোরেসোরে ধমক দেয়
— “তুমি এখনই যাবে এখনই তোমার এখন আর পড়তে হবে না।যাও বাসায় যাও বলছি।এখন ই যাবে।”
— “থাকি না দিহান ভাই আর একটুই তো।আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন দিহান ভাই?”
–“আবার কথা?বললাম না যাও????নইলে কিন্তু তোমাকে আর পড়াবোই না তোমার মাকে বলব আপনার মেয়ে রিনি আমাকে কি দিয়ে খোচায় একটু জিজ্ঞেস করেন।”
রিনি ব্যথিত গলায় বললো
— “ঠিক না দিহান ভাই একদম ঠিক না।আপনি আমাকে খালি বকেন আমার খুব কষ্ট হয় তবুও বকেন। আপনি খুব পচা খুব। আর আসবো না আপনার কাছে।”
ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না করতে করতেই রিনি দিহানের রুম থেকে বিদায় নিলো।
কপালের ঘাম এক আঙুল দিয়ে মুছে ফেললো দিহান।এই অবস্থায়ও দিহান নিজেকে সামলাতে পেরে নিজেকেই দুবার বাহবাহ দিলো। থাকলে পাগলামি বাড়তো তাই ই পাঠিয়ে দিয়েছে।রিনি কালই আবার ধমক মাইর সব ভুলে দিহান ভাই দিহান ভাই করবে তা দিহান ভালোই জানে।এমন অকাজ কুকাজ করলে ছেলেদের মাথা ঠিক থাকে না। মেয়েটা তার কি বুঝবে?কিছুই বুঝে না।দিহান তবুও ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ব আর দায়িত্ব থেকেই নিজেকে সামলে নেয়।অবুঝ মেয়ে মাথায় যা আসে তাই করবে বলে দিহান কেন আশকারা দেবে ?এটাই দিহানের যুক্তি।
এই যুক্তিতে অনড় থাকতে দিহানের বড্ড বেগ পেতে হয়।পাগল মেয়ে যেসব কাজ করে তা মুখে আনার মতো না।শত নিষেধ করলেও সে করবেই আর দিহানকে দেখিয়েই করবে।দিহান মাঝে মাঝে ভাবে “আমিও কি রিনিতে আটকে যাচ্ছি?ওই বাচ্চা মেয়েটাতে?”
দিহান মুচকি হাসে না চাইতেই। এ বাড়িতে আসা হয়েছিলোই অদ্ভুতভাবে।আর বাড়ির মেয়েও অদ্ভুত।
_______________
বছর দুয়েক আগে রিনির বাবা তার গ্রামের বাড়ি গিয়ে এক্সিডেন্ট করে খারাপভাবে। তখন ঘটনা স্থল থেকে তাকে হসপিটাল নেয়া থেকে শুরু করে নিজের ব্লাড দিয়ে মুনির হোসেনকে সেদিন দিহানের বাবা ফিরোজই বাচিঁয়েছিলো। গ্রামে ইমিডিয়েট কিছুই পাওয়া যায় না।এই মানুষটা না থাকলে মুনির হোসেন হয়তো বাচতেন না।সেই থেকেই মুনির হোসেন ও তার ফ্যামিলি ফিরোজের পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ।তারপর থেকে গ্রামে আসলে মুনির হোসেন ফিরোজের সাথে দেখা করবেই।
এরকম একদিন মুনির হোসেন নিজের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এসে ফিরোজের বাড়িতে যায় দেখা করতে। গল্প করতে করতে একসময় ফিরোজ বলে
— “মুনির ভাই আমার ছেলেটার ঢাকার বড় এক ভার্সিটি তে চান্স হইছে।কিন্তু হোস্টেলে সিট পায় নি।ম্যাচে যে থাকবে তেমন টাকা পয়সাও আমার নাই।কি যে করি।ভাবতেছি গ্রামেই আমার মুদির দোকানে বসিয়ে দি।কেমন হয় বলেন তো?”
মুনির হোসেন আকাশ থেকে পরে।অবাক হয়ে বলে
–” এইটা কি বললেন।আপনার ছেলের যা রেজাল্ট দেখেছেন?ওর তো ব্রাইট ফিউচার।আর আপনি কিনা!!!”
ফিরোজ সল্প আওয়াজে বলে,
–“টাকা পয়সা নাই তো ভাই।ব্যবসা তেমন একটা বড় করতে পারতেছি না।”
মুনির হোসেন কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
— “আপনার ছেলে আমার বাসায় থাকবে ভাই।খাওয়া দাওয়া সব আমাদের বাসায় করবে।বলতে পারেন এটা আপনার কাছে আমার দাবি না করবেন না।ভাই ভেবেই বলছি।এমনিও আপনার কাছে আমি অনেক রিনি।”
ফিরোজ অবাক হয়।ব্যক্তিত্বেও হানা দেয় খানিক।
— “না ভাই থাক।এসবের দরকার নাই”
— “চুপ একটাও কথা না।শহরে গেলে কোনো ছেলেই বসে থাকে না। মেধাবী স্টুডেন্টরা প্রাইভেট পড়িয়েই নিজের খরচা নিজে চালায়।যখন দিহান ইনকাম করবে তখন না হয় দিবে কেমন? এবার তো রাজি হন ভাই।”
ফিরোজ কিছুক্ষণ ভেবে সম্মতি জানিয়ে দেয়।
_______________
ভার্সিটি শুরু হবার দুদিন আগেই দিহান ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।গ্রাম ছেড়ে আসতে বুকের ভেতর অদ্ভুত ব্যাথা অনুভব করে সে।তবুও শহরে পাড়ি জমাতেই হবে।
মুনির হোসেনের বাড়ি খুজে পেতে বেগ পেতে হয় তার। খুজতে খুজতে মুনির হোসেনেরই সামনে পরলো।নামাজ পরে ফিরছিলো সে।
— “আরে বাবা এসে পরেছ? ফোন দিতে আমি নিয়ে আসতাম।”
মুখে হাসি রেখেই দিহান বললো
— “না আংকেল ঠিক আছে।কোনো সমস্যা হয় নি।”
মুনির হোসেন যে বাড়ির ভিতর তাকে নিয়ে গেল সে বাড়িটা অত্যন্ত সুন্দর দোতলা বাড়ি। চারপাশে বাউন্ডারি দেয়া দেয়াল সুন্দর গেট করা।গেটে কাগজি লতা গাছ।এককথায় সুন্দর।দোতলা বাড়ির থেকে একটু পিছিয়ে টিনসেট দেয়া দুই রুম বিশিষ্ট একটা ছোট্ট বিল্ডিং।বাইরে থেকে দেখে দিহানের এটাই মনে হলো। বিল্ডিঙের রং এর কম্বিনেশন অত্যন্ত সুন্দর বলা চলে।দিহানের নজর কাড়ে স্বপ্ন বাড়ে আরও।
মুনির হোসেন দিহানকে ঘরে ভিতরে নিয়ে গেলেন।দিহান ঘরে ঢুকে হাতের ব্যাগ দুটো রাখলো।রেখে সোজা হয়ে দাড়াতেই এক ঝাক বাচ্চা ছেলেমেয়ে সহ সেভেন কি এইটে পড়া দুইটা মেয়ে দিহান আর মুনির সাহেবের মাঝ খান দিয়ে ঝড়ের গতিতে দৌড়ে গেলো। এদের গায়ের ধাক্কায় দিহান ধপাশ করে নিচে পরে যায়। দিহান বেশ বুঝতে পেরেছে মেয়েটা ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিয়েছে।কি আর করা দিহান চুপ হয়ে গেলো। নতুন এসেই কাকে কিই বা বলবে?মেয়েটা বিনীত ভংগীতে বললো
–“ভাইয়া সরি ব্যাথা পেয়েছেন?”
দিহান খুব কষ্টে দাত কামড়ে জবাব দিলো
–“না আপু একদমই ব্যাথা পাই নি।”
মুনির হোসেন দিহানকে টেনে তুললেন
–“বাবা ব্যাথা পাওনি তো?এই রিনি করিস কি হ্যা?ছেলেটা পরল কিভাবে?”
রিনি অসহায় মুখ করে বললো
–“বাবা আমি কি জানি বাবা?ভাইয়াটার হয়তো ব্যালেন্স কম।পরে যাওয়া ব্যারাম ট্যারাম আছে হয়তো। ”
পাশের বাচ্চাগুলো সহ রিনি দাত কিটকিটিয়ে হাসতে শুরু করলো।দিহানেদ লজ্জা রাগ ক্লান্তি সবই লাগছে।
মুনির হোসেন আর এক চোট ধমক দিল রিমিকে।দিহান বুঝতে পারে ওটাই মুনির আংকেলের মেয়ে।দিহান ভদ্রতাসূচক মুনির সাহেবকে বললো
— “কাকা থাক না বাচ্চা ছেলে মেয়ে বুঝে নি।”
দিহান মনে মনে বললো” আমাদের গ্রামের মেয়ে হতি তো গাছের সাথে ঝুলাতাম। দিহানের সাথে কিনা ফাজলামো?”
এবার দিহান মেয়েটার দিকে একবার তাকায়।নজরকারা গায়ের রং।শহুরে মেয়ে বলে কথা।এটা তো মোটামুটি কমন বৈশিষ্ট্য।লম্বা ৫ ফিট ২ হবে হয়তো ।বাচ্চাদের মতো ফেস।হাত পা টুনির মতো সরু চিকন।পিংক লিপ্স।প্রচুর ঘন সোজা চুলগুলো কোমর ছাপিয়ে গেছে।চোখের ঘন পিশি বার বার একত্রিত হচ্ছে।গায়ে একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর একটা ঢিলাঢালা টি-শার্ট। মেয়েটার গায়ে ওরনা না থাকায় দেখা যাচ্ছে টি-শার্টে লেখা “আমার দিকে তাকাবি তো চোখ তুলে নেব”
এবার দিহানের চোখটা নেমে গেলো। কি সাংঘাতিক ভাবা যায়?
চলবে,
‘নিশীথচিত্র’ (সূচনা পর্ব)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে
✔