তুমি এলে তাই পর্ব ৯

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৯
.
কথাটা শেষ করেই গুঞ্জন মৃদু আওয়াজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। অাবির অবাক হয়ে গুঞ্জনের কথা শুনে। মেঘলা তো কেঁদেই দিয়েছে। ওরা দুজনেই বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো যে কেউ কিছু বলেছে ওকে। আবির আবারও মেঘলাকে ইশারা করতেই মেঘলা বলল,

— ” কী হয়েছে বাচ্চা? কেউ কিছু বলেছে?”

গুঞ্জন কিছু না বলে বেশ অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মেঘলার কোল থেকে উঠে বসে চোখ মুছে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ” খিদে পেয়েছে আমার। কিছু খাইয়ে দাও প্লিজ।”

মেঘলা হেসে দিলো গুঞ্জনের কথায়। দরজার ওপাশ থেকে আবির ও মুচকি হাসলো। ওরা দুজনেই বুঝতে পারলো যে গুঞ্জন আপাতত এই বিষয়ে কথা বলতে চাইছেনা, তাই ওরাও আর ফোর্স করলো না। মেঘলা উঠে চলে গেলো গুঞ্জনের জন্যে খাবার আনতে, আর অাবিরও নিজের রুমে চলে গেলো। মেঘলা চলে যেতেই গুঞ্জনের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটে হেলান দিয়ে বসল। বেশ কিছুক্ষণ পরে মেঘলা খাবার নিয়ে এসে দেখে গুঞ্জন খাটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মেঘলা গুঞ্জনের সামনে বসে হালকা কাশতেই গুঞ্জন চোখ খুলে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” চলে এসছো?”

মেঘলা কিছু না বলে হেসে ভাত মেখে এক লোকমা গুঞ্জনের মুখের সামনে ধরল গুঞ্জন সেটা মুখে নিয়ে চিবোতে শুরু করলো। মেঘলা এবার গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” এবার বলতো তোর কী হয়েছে?”

গুঞ্জন কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথা ঘোরানোর জন্য বলল,

— ” আমারটা ছাড়ো। তুমিতো তোমার জবের কী হলো? ইন্টারভিউ দিয়েছিলে তো রেসাল্টের কী হলো?”

মেঘলা আফসোসের একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” ওহহহ দেখেছিস? এসবের মধ্যে তোকে বলাই হয়নি। আমার জব হয়ে গেছে।”

গুঞ্জন এটা শুনে খুশি হয়ে মেঘলাকে জরিয়ে ধর‍ে বলল,

— ” কনগ্রাচুলেশন মেঘুদি…”

মেঘলাও হেসে দিলো গুঞ্জনের কান্ডে। হাসতেই হাসতেই বলল,

— ” আরে বাবু ছাড় প্লেট পরে যাবে তো।”

গুঞ্জন মেঘলাকে ছেড়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,

— ” কোথায় হয়েছে? কী পোস্ট?”

মেঘলা গুঞ্জনের মুখে আরেক লোকমা ভাত দিয়ে হাসি মুখেই বলল,

— ” আরে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ এ। স্পন্দন চৌধুরীর পিএ এর পোস্টে।”

স্পন্দন চৌধুরী নামটা শুনেই গুঞ্জনের মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গেলো। গুঞ্জনের গোমড়া মুখ দেখে মেঘলা বলল,

— ” কীরে মুখটা এমন করে ফেললি কেনো? জানিস আমার স্যারকে দেখতে জাস্ট ওয়াও। পুরো ক্রাশ খাওয়ার মতো। পুরো হিরো টাইপ। যদিও শুনেছি বেশ রাগী আর ডিসিপ্লিন্ট। বেশ চাপ হয়ে যাবে ওনার সাথে কাজ করতে। তবে যাই হোক আমিতো..”

মেঘলা আর কিছু বলার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” প্লিজ দি থামোতো। তোমার বসের প্রসংশা শুনে আমি কী করবো?”

মেঘলা অবাক হয়ে বলল,

— ” কী হলো? একটু আগেও তো এত্তো ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছিলি? হঠাৎ কী হলো? ”

আজকের পর থেকে গুঞ্জনের কাছে স্পন্দনের নামটাও বিরক্ত লাগে তাই ও মুখ ফুলিয়ে বলল,

— ” মেঘুদি আমার খুব পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দাও না?”

মেঘলা বুঝতে পারলো গুঞ্জনের মুড ভালো নেই তাই আর কথা বারিয়ে ওকে খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়ে চলে গেলে।

_______________________

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে নিজের ব্যালকনির দোলনায় বসে কফি খেতে খেতে নিউসপেপার পড়ছে স্পন্দন। কিছুক্ষণ পর ধীরপায়ে স্পন্দনের পিছে এসে দাঁড়ালো সারা। স্পন্দন সারার উপস্হিতি টের পেয়েও কোনো পতিক্রিয়া করলো না আগের মতোই নিজের কাজ করে যাচ্ছে। সারা নিচু কন্ঠে বলল,

— ” ভাইয়া?”

সারার ডাক শুনেও স্পন্দন সাড়া দিলোনা আর ঘুরেও দেখলোনা আগের নিজের মতোই কাজ করতে লাগলো। এবার সারার পুরো কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্হা হয়েছে। স্পন্দন যে ওর ওপর ভীষণ রেগে আছে সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। সারা গুটিগুটি পায়ে গিয়ে আস্তে করে স্পন্দনের পায়ের কাছে ফ্লোরে বসে স্পন্দনের কোলের ওপর হাত রেখে বলল,

— ” আ’ম সরি ভাইয়া। আমি মানছি তোকে না বলে ওখানে গিয়ে আমি ঠিক করিনি। বিশ্বাস কর আমি নিজেও বুঝতে পারিনি এরকম কিছু হবে।”

স্পন্দন এবার নিউসপেপার থেকে চোখ সরিয়ে সারার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল,

— ” জাস্ট শাট আপ। বুঝতে পারিসনি? ওরকম জায়গায় কী হতে পারে এটুকু বুঝতে পারিসনি? এতো ছোট তুই? এতো শখ ছিলো তোর ইনজয় করার? কাল যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে? এনিওয়ে আমি কাজ করছি এখন যা এখান থেকে তোকে দেখলে আমার মাথা আরো বেশি গরম হয়ে উঠছে।”

সারা এবার ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

— ” প্লিজ ভাইয়া আমি আর কখনো এরকম করবোনা আই প্রমিস। তবুও তুই রাগ করে থাকিস না প্লিজ। এখন থেকে আমি যেখানে যাবো তোর থেকে পার্মিশন নিয়েই যাবো। প্লিজ মাফ করে দে।”

সারার কান্না দেখে স্পন্দন আর নিজের রাগটা ধরে রাখতে পারলো না। একটা শ্বাস ফেলে নিউস পেপারটা সাইডে রেখে সারাকে তুলে ওর পাশে বসালো তারপর একহাতে জরিয়ে ধরে বলল,

— ” তোকে কী আমি ঘরে আটকে রাখি? ফ্রিডম দেই না? তুই যেটা চাস আমি এনে দেই, যখন যেখানে যেতে চাস আমি নিজে তোকে ঘুরিয়ে আনি। এমনকি তুই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেলেও আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি শুধু তোকে সেসব জায়গায় যেত বারণ করি যেখানে তুই নিরাপদ না। তুই ভাব কাল কতো ভয়ংকর কিছু হতে পারতো? তুই বুঝতে পারছিস আমি কী বলছি?”

সারা মাথা নিচু করে মাথা নাড়ল। স্পন্দন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

— ” আর গেলি তো গেলি এমন একটা ইরেস্পন্সিবল মেয়ের সাথে গেলি যার কীনা মিনিমাম কমোনসেন্স নেই। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যাস্ত।”

সারা অবাক হয়ে গেলো স্পন্দনের কথায়। সারা অবাক হয়েই বলল,

— ” ভাইয়া তুই ভুল ভাবছিস। গুঞ্জন তো আমাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে। এমনকি বারবার আমাকে বলেছে এদিক ওদিক না যেতে ওদের সাথে থাকতে। নিজেও ঠিক মতো ইনজয় করতে পারেনি আমার খেয়াল রাখতে গিয়ে। শুধু কেক কাটার সময় একটু ডিসট্রাকট হয়ে গেছিলো। আসলে আমারই মাথা থেকে বেড়িয়ে গেছিলো ব্যাপারটা তাই..”

স্পন্দন একটু অবাক হলো তবুও কিছু একটা ভেবে বলল,

— ” ও তো জানতো তুই এসবে অভ্যস্ত নস? তাহলে তোকে ওখানে নিলো কোনো সেন্সে?”

সারা মাথা হালকা নিচু করে আঙ্গুল কচলে বলল,

— ” আসলে গুঞ্জন প্রথমে তুমি রাগ করবে বলে নিতেই চায়নি আমাকে আমিই অনেক জোর টোর করে রাজি করিয়েছি।”

স্পন্দন হালকা চিন্তায় পরলো তারমানে কালকে মেয়েটাকে ওভাবে বকাটা নিতান্তই অবান্তর ছিলো। শুধুশুধুই কতোগুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছে এবার ওর রাগটা সারার ওপর গিয়ে পরলো। রাগী দৃষ্টিতে সারার দিকে তাকিয়ৈ বলল,

— ” এতো কীসের ভাব তোর ঐ মেয়েটার সাথে সেটাইতো বুঝলাম না? তোর এক ক্লাস সিনিয়র তারওপর যে তোকে ভার্সিটির প্রথম দিনি ওভাবে র‍্যাগ করলো, তুই ওভাবে কাঁদলি। তার সাথে হঠাৎ এতো ভাব কীকরে হলো?”

সারা তো অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছে স্পন্দনের কথা শুনে। এবার ওর কাছে ক্লিয়ার হলো যে কেনো স্পন্দন সারাকে সহ্য করতে পারেনা। ও স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

— ” ভাইয়া তুই আবার ভুল করছিস। সেদিন গুঞ্জনরা আমাকে র‍্যাগিং করেনি আরেক সিনিয়র ভাইয়ারা করেছিল।”

স্পন্দন চমকে গিয়ে বলল,

— ” হোয়াট?”

এরপর সারা গুঞ্জনকে সেদিনের হওয়া ঘটনাটা পুরোটা খুলে বলল সব শুনে স্পন্দন তো পুরো অবাক। ও এবারও সারার দিকে রেগে তাকিয়ে বলল,

— ” সেটা তুই আমাকে আগে কেনো বলিসনি ড্যাম ইট? রাগের মাথায় কী না কী বলে এসছিলাম ওকে।”

সারা মুখ ফুলিয়ে বলল,

— ” আমি কীকরে জানবো তুই গুঞ্জনকে বকে এসছিস? তুই বলেছিলে যে আমায় র‍্যাগ করছিলো তাকে শিক্ষা দিয়ে এসছিস। আমিতো ভেবেছিলাম ঐ ছেলেগুলোর কথা বলছিস। আমি কীকরে জানবো যে কেস ওখানে উল্টো হয়ে আছে?”

স্পন্দন পুরো বোকা বনে গেছে। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ মিসেস চৌধুরীর ডাক পরতেই সারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” ভাইয়া মা ডাকছে, নিচে চলে আয় ব্রেকফাস্ট করবি তো? আমি গেলাম।”

সারা যেতেই দুহাতে মুখ চেপে ধরলো স্পন্দন। চারচারবার খারাপ ব্যবহার করেছে গুঞ্জনের সাথে। তারমধ্যে দুবার যে অকারণেই করেছে সেটাতো পরিস্কার হয়ে গেলো। বাকি দুটো কারণ যে কতোটা সত্যিই সেটা নিয়েও এখন যথেষ্ট প্রশ্ন জাগছে ওর মনে। হ্যাঁ এটা ঠিক গুঞ্জনের লাইফস্টাইল ওর পছন্দ না। কিন্তু ও তো দুবার অকারণেই খুব বেশি খারাপ ব্যবহার করেছে মেয়েটার সাথে। মনে মনে ভীষণরকমের গিল্টি ফিলিং হচ্ছে ওর যা এর আগে কক্ষণো হয়নি। এসব ভাবতে ভাবতেই নিচে চলে গেলো খাওয়ার জন্যে।

______________________

স্পন্দন বাড়ি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সবার আগে কালকের ঐ ছেলেগুলোকে দেখতে গেছিলো। পুলিশের ডান্ডা দিয়েই সবগুলোকে ইচ্ছেমতো মেরেছে ও। পাওয়ারফুল মানুষ হওয়ায় পুলিশরাও বাধা দিতে পারেনি। হ্যাঁ সবগুলোকেই অ্যারেস্ট করা হয়েছে এবং শাস্তিটাও যাতে কম না হয় সেটা ও নিজে দেখবে। এখন ওর উদ্দেশ্য গুঞ্জনদের ভার্সিটি। সকাল থেকে অনেক ভেবে দেখেছে ও। নিজের গিল্টি ফিলিং থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছে না। ও ডিসাইড করে নিয়েছে যা হয়েছে সেটা তো আর ফেরত নেওয়া যাবেনা কিন্তু গুঞ্জনকে সরি বলাতো ওর উচিত কারণ ভুলটা ও করেছিলো। এসব চিন্তা করতে করতে গুঞ্জনের ভার্সিটিল সামনে গাড়ি থামালো। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে গুঞ্জনের বেড়িয়ে আসার অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেট দিয়ে গুঞ্জনরা বেড়িয়ে আসছে সেটা দেখে স্পন্দন সোজা হয়ে দাঁড়ালো। গুঞ্জনের চোখ স্পন্দনের ওপর যেতেই স্পন্দন ওর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। গুঞ্জন থেমে গেলো সাথে ওর বন্ধুরাও। গুঞ্জনের সাথে সাথে ওর বন্ধুরাও অবাক হলো।তখনই গুঞ্জনের কালকের ঘটনা মনে পরলো সকলের সামনে ওকে চড় মারা, অপমান করা সাথে সাথেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। স্পন্দন মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে গুঞ্জনের দিকে এগোতে নিলেই গুঞ্জন পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে নিলেই ওর পাশ দিয়ে একটা ছেলে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে যেতেই গুঞ্জনের কাশি শুরু হয়ে গেলো। গুঞ্জন রেগে পেছনে তাকিয়ে হালকা কেশে বলল,

— ” ওই স্টুপিড? রাস্তায় এভাবে ধোয়া ছাড়ে কেউ?”

এটুকু বলে ওরা জিপে উঠে চলে গেলো। বাকিরা তাকালেও স্পন্দনের দিকে একবার ঘুরেও তাকায়নি গুঞ্জন। যে মেয়ের সিগারেটের ধোয়ায় কাশি থাকে সে স্মোক করতে পারে? তাহলে লাইটার কেনো চাইছিলো সেদিন? লাইটার দিয়ে ওতো রাতে ওখানে আর কী করা যায়? এসব ভাবতে ভাবতে স্পন্দনের চোখ খেলো পাশের চায়ের দোকানে। দোকানদারকে কাঠে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালাতে দেখে স্পন্দন কিছু একটা ভেবে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,

— ” ওহ সিট ম্যান।”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here