তোমার পরিনীতা – ৪১
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
শ্রাবন আর লাবণ্যর বিয়ের কার্ডটা যত্ন করে তুলে রাখলো সুমন ড্রইংরুমের বইয়ের আলমারিতে। শ্রাবন আজ নিজে এসেছিলো ওদের সবাইকে বিয়েতে দাওয়াত করতে। বিয়ের পরেই দুই সপ্তাহের জন্য সুইজারল্যান্ডে যাবে সে বউ নিয়ে, এসে হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে মঞ্জুদের সাথে আর এই মুহূর্তে তো সে ভারী ব্যাস্ত। বদ্দা খাবার দায়িত্বে তাই শ্রাবনকেই ছোটাছুটি করতে হচ্ছে নিজের বিয়ের নিমন্ত্রন করতে, মাঝে মাঝে অবশ্য নির্মলা সাথে যাচ্ছেন ছেলের। বৌভাতে তো বটেই, বিয়েতেও ওদের সবাইকে অবশ্যই যেতে হবে একথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলো শ্রাবণ।
এতোকাল পরে মঞ্জু এবার সত্যি একটু চিন্তায় পড়লেন। শ্রাবণের বিয়েতে কি উপহার দেওয়া যায়? এতোকাল না হয় সমীরের অজুহাতে একদম সস্তা কিছু দিতেন, কিন্তু এখন?
শান্তনুর বিয়েতে একসেট গ্লাস আর একটা জগ দিয়েছিলেন কাচের। কিন্তু এখন আদিত্যকে সাথে নিয়ে অমন গ্লাস, প্লেট নিয়ে কি করে যান? জামাইর একটা মান সম্মান তো আছে। অনেক ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত সুমনকে ডাকলেন মঞ্জু।
” বলছি দাওয়াতের কার্ড তো দেখলি, শ্রাবণের বিয়েতে কি দেয়া যায় বল দেখি? ”
মঞ্জুমামীর এমন প্রশ্নে সুমন সত্যি বিপাকে পড়লো। সত্যি তো বাড়ি ভর্তি লোক নিয়ে দাওয়াতে গেলে আজকের দিনে ভালো কিছু উপহার তো নিতেই হবে।
” ভালো কিছুই তো দেয়া উচিত মামী। সবাইকে যখন বলেছে তাও আবার দু’দুটো অনুষ্ঠানে, একদম সস্তা কিছু দিলে মান সম্মানটা আমাদের চেয়ে আদিত্যর বেশি যাবে।”
মঞ্জুও এটাই ভাবছিলেন। তাই আর ইতস্তত না করে সুমনকে বলে বসলেন, “এখন তো আমার হাতে পয়সা কড়ি তেমন নেই… বাড়িটা বেচলেই তবে হাতে টাকা আসবে। বলছি তোর একজোড়া পাতলা কানের ঝুমকো উঠনো ছিলনা, ওটা দিবি? পরে আমি টাকা পেয়েই তোকে ঠিক ওরকম এক জোড়া বানিয়ে এনে দেব।”
সুমন, মঞ্জুর কথা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো। তারপর হাসিমুখে বললো, “আচ্ছা। শ্রাবনদার বিয়েতে আমারো ভালো একটা কিছু দেয়ার ইচ্ছে ছিলো তার বউকে। এটাই বেশ হবে, আর আমাকে নতুন করে বানিয়ে দিতে হবেনা মামী। ও বাড়িতে আদিত্যর মান সম্মান রক্ষা হলেই আমার হলো, তা না হলে ওসব গয়না পরার আমার সময় কই? ”
সুমনের সম্মতিতে মঞ্জু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বহুকাল পরে সুমনের উপর আজ মঞ্জু মন থেকে খুশি হলেন।
.
.
.
শ্রাবণের মাথাটা যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছিলো। চা, কফি কোন কিছুতেই সে জ্বালা একটুও কমছিলো না। কপালের দু”পাশের রগ চেপে ধরে তাই মরার মতো পড়ে রইলো শ্রাবণ ইজিচেয়ারে।
আজ শ্রাবণ মনে মনে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো শত্রুর দুর্গে আঘাত হানবে বলে, কিন্তু গিয়ে কি দেখলো? সুমন দিব্যি আদিত্যর কোলে ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে ওকে নাস্তা দিতে ছুটছে… আর হাজির হলো এক বাটি পায়েশ আর বড়ো এক টুকরো পিজার কোন নিয়ে। শ্রাবণের ইচ্ছে হচ্ছিলো পুরো ট্রেটা সুমনের মুখের উপর ছুঁড়ে মারে, কিন্তু নেহায়েত ওদের ড্রয়ইরুমে আদিত্যর সামনে বসা ছিলো বলে আর কোন দুর্ঘটনা আজ ঘটেনি। কিন্তু ছেলে যখন আদিত্যর কোলে বসে ‘ বাবাই, মাল কাতে দাবো ‘ বলছিলো, শ্রাবণের তখন মনে হচ্ছিলো ওর ফুসফুসের বাতাস সব বেরিয়ে চিরদিনের জন্য শূন্য হয়ে গিয়েছে, বহুকষ্টে বাটির পায়েশের এক দুই চামচ মুখে দিয়েছিলো … মুখটা ততক্ষনে এক অদ্ভুত বিষাদে ভরে গিয়েছে।
……………………………
লাবন্যর বুকটা ঢিপ ঢিপ করছিলো আনন্দে। আজ ওর বিয়ে! সত্যি সত্যি শ্রাবণ আজ বর সেজে ওকে নিতে এসেছে। ওই তো লোকজন সব বর আসার আনন্দে গেটের কাছে ছুটে গেছে। শব্দের তালে পুরো এলাকা এখন বিয়ের আসর… কত রকম গান বাজনা আর হৈ হুল্লোড়, আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও পর্দা সরিয়ে বর দেখতে ব্যাস্ত। লাবণ্যর ইচ্ছে হচ্ছিলো আনন্দে কাঁদে।
” অ্যাই খবরদার যদি কাঁদিস লাবণ্য, তোর শাশুড়ির কাছে যেয়ে একদম বদনাম করে আসবো ছিঁচকাদুনে বলে,” লাবণ্যর কানটা একটু টেনে দিলো মৌমিতা। কি সুন্দর লাগছে আজ লাবণ্যকে।
মৌমিতার কথায় আজ একটুও রাগ হলোনা লাবণ্যর। স্বপ্নের রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে চলে এসেছে যে ওকে নিতে, আজ ও স্বপ্নপুরী যাবে। আর কারুর উপর রাগ নেই লাবণ্যর, আজ ও সব ব্যাথা ভুলে গেছে।
বসে থেকে থেকে মেজাজ বিগরাচ্ছে শ্রাবণের। লাবণ্যর বাবা দুনিয়ার সব মানুষ এনে পরিচয় করাচ্ছেন নতুন জামাইয়ের সাথে,মিথ্যা হাসি হাসতে হাসতে মুখ বাঁকা হয়ে গেলো ওর।
ওয়াশরুমের কথা বলে এই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অমিয়কে ধরলো শ্রাবণ, সত্যি ওর একটু খোলা বাতাস দরকার।
আসলে দেখতে না চাইলেও দু’ একবার মায়ের আশেপাশে বেঈমানটাকে দেখেছে ও। সেই এক ঢং ধরে মায়ের সাথে একই গাড়িতে করে এসেছে। কত বড়ো নির্লজ্জের নির্লজ্জ, ওর বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছে।
“তুই একটু বোস, আমি দেখছি, ” অমিয় লাবণ্যদের বাড়ির কার সাথে যেন আলাপ করলো। সে শ্রাবনকে উপরে নিয়ে চললো ওয়াশরুম দেখাতে। মাঝ সিড়িতে যেয়ে শ্রাবণ আর উঠতে পারছিলনা। সুমন ছেলে কোলে করে নিচে নামছে সিড়ি বেয়ে। এতো ঘেন্না করে ওকে দেখলে আজকাল শ্রাবণের যে পাশ ঘেষে নেমে যাবে মনে হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ওর জন্য কঠিন হয়ে দাড়ায়, মন হয় সুমনের আশেপাশের বাতাসটাও ওর জন্য বিষাক্ত। মুখ শক্ত করে সুমনকে পাশ কাটিয়ে উপরে ওঠার জন্য তৈরি হলো শ্রাবণ।
“একটু কথা ছিলো… ” ক্ষীন একটা শব্দ এসে আছড়ে পড়লো শ্রাবণের কানের দেয়ালে।
শ্রাবণের মনে হলো ও ভুল শুনছে, কিন্তু দ্বিতীয়বার একই কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাড়াতে বাধ্য হলো ও। বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো,
” কথা, আমার সাথে? ”
” হ্যাঁ, একটা জরুরি বিষয়ে কথা ছিলো। ” সুমন কাতর চোখে তাকালো।
“আমার সাথে আবার কি জরুরি কথা, ” কথাটা বলেই শ্রাবন না দাড়িয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত সিড়ি ভাঙ্গতে লাগলো।
“বাড়ি বিক্রির বিষয়টা তুমি যদি একটু দেখতে তবে তাড়াতাড়ি ওটা বিক্রি করে দেয়া যেতো,” সুমন মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করলো।
সুমনের আস্পর্ধায় শ্রাবণ এখন হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য। মনে মনে বললো বাড়ি বিক্রি তো দূর, তোর ওই ভিটে তে একটা কাকও আমি বসতে দেবনা, দেখি তোর আদিত্য ওটা কি করে বেচে।
সুমন প্রশ্নের কোন উত্তর না পেয়ে হতাশ হয়ে নিচে নেমে গেলো।
………..…….………..
শ্রাবণ দুইবার করে মুখ ধুয়েও নিজের মেজাজ ঠান্ডা করতে পারছিলনা, মনে হচ্ছিলো দুনিয়ার সব বিষ ওর মনের মধ্যে।
কুল শ্রাবণ কুল, আজ থেকে সুমো বলে কেউ নেই তোর জীবনে। যা আছে তার সবটাই লাবণ্য। লাবণ্যকে নিয়ে সুখী হতে চেষ্টা কর, তাতে বরং লাইফে শান্তি আসবে। ওই বেহায়া, লোভী মেয়েটা শুধু অকৃতজ্ঞ নয় বরং চরম কৃতঘ্ন ধরনের একটা মানুষ। দেখছিস না এতোদিন বাদে দেখা অথচ কি বলতে চাইলো? আর বললোই যখন, কেমন আছো সেটা তো জিজ্ঞেস করা যেতো নাকি? কিন্তু ওই যে নিজের ফায়দা বুঝে খালি, আসলে কতোটা লোভী এই মেয়ে তাতো আগেই বোঝা গেছে।
বেশ অনেকটা সময় গড়িয়ে গেল।
ওয়াশরুম থেকে বের নিচে নামতে গিয়ে কোনার রুম থেকে খিলখিল করে ভেসে আসা হাসির আওয়াজ বিভ্রান্ত করে দিলো শ্রাবণকে। এই ফ্লোরটা মোটামুটি ফাঁকা, লোকজন সব নিচেই। মাঝেমধ্যে কিছু মহিলারা বাচ্চা নিয়ে উঠানামা করছে ওয়াশরুমে যাচ্ছে বলে আর রান্নার বড়ো বড়ো হাড়িগুলো তুলে এনে রাখা হচ্ছে এক ঘরে। শ্রাবণ সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়েও আবার থমকে দাড়ালো। ফাঁকা জায়গায় একা হলে যে কেউ বিপদে পড়তে পারে। আসলে হাসির শব্দটা কেমন যেনো, শ্রাবণের কৌতুহল বাড়িয়ে দিলো।
.
.
.
প্রথমে শ্রাবণের কথার কিছুই সুমনের মাথায় ঢুকলোনা। কিন্তু তারচেয়ে বড়ো বিপদ হলো ও কিছুতেই শ্রাবণকে ধরে রাখতে পারছিলনা। শ্রাবণ পারলে আদিত্যর মুখে আরো দুটো কিল মারে। এতো অসহায় সুমন কোনদিন বোধ করেনি। কান্নায় চোখমুখ ভাসছিলো ওর। নিচে দাড়িয়ে ছিলো ও ছেলে কোলে করে, গোলমাল শুনে দৌড়ে উপরে উঠে এসেছে।
প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে এবার সুমন, শ্রাবণের হাত চেপে ধরলো,” ওকে মেরো না প্লিজ, ওর কোন দোষ নেই। ”
“দোষ নেই মানে! সুমো আমাকে ছাড়। ওর নাক মুখ আজ আমি থেতলে দিবো কালপ্রিট কোথাকার.. খুন করে ফেলবো সোজা।”
” তুমি ওর কিছুই করবে না, ছাড়ো ওকে।”
শ্রাবণের রাগ এবার যেন সাপের মতো ফনা তুললো। সুমো এতোটা অন্ধ আদিত্যর প্রেমে যে চোখের সামনে এসব দেখেও সেগুলো মেনে নিচ্ছে? এতো ভালোবাসা ওর ওই কুকুরটার জন্য।! ”
সুমনের প্রতি ঘৃণা আবার দ্বিগুন বেগে জমা হতে লাগলো শ্রাবণের মনে। সুমন সবার সামনে ওকে নিচু দেখাতে বিন্দু মাত্র কুন্ঠা বোধ করেনা অথচ আদিত্যর জন্য কি কেয়ার! ভিতরে ভিতরে কি এক দুর্দমনীয় ব্যাথায় শ্রাবণ ভেঙ্গে যাচ্ছিলো, সুমন এক বারের জন্যও যদি ওকে বুঝতো।
শ্রাবণ আর দাড়ালো না, ঘুরে হাটতে লাগলো। গোল্লায় যাক সুমন আর গোল্লায় যাক ওর বিবাহিত জীবন, শ্রাবণের কি?
” দাড়ান শ্রাবণবাবু, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই, ” আদিত্য, শ্রাবণের পিছু পিছু সিড়িতে এসে দাড়ালো।
কিন্তু শ্রাবন দাড়ালো না, নামতেই লাগলো। আদিত্যর মতো লম্পটের সাথে ওর কোন কথা নেই।
” আপনি যা দেখেছেন আমরা তার জন্য খুবই লজ্জিত কিন্তু আমরা অন্যায় কিছু করিনি, আপনি বিশ্বাস করুন। ”
শ্রাবণের ইচ্ছে হলো পায়ের জুতোটা তুলে আদিত্যর মুখে ছুড়ে মারে, আদিত্যর তো ন্যায় – অন্যায় বোধই নেই দেখা যাচ্ছে, লম্পটের চূড়ান্ত।
আর এর জন্য সুমো… ছি..।
” শ্রাবনবাবু প্রীতি আমার স্ত্রী। ”
ঝমঝম শব্দ করে কাচের ঝাড়বাতি ভেঙ্গে পড়লো যেনো। শ্রাবণ পা ফেলতে গিয়েও প্রায় অনেকটা সময় শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলো ডান পা টা। আদিত্য ঠিক কি বললো ঠাহর করতে পারলোনা। ঘুরবোনা ঘুরবোনা করেও একসময় ঘুরেই দাড়ালো শ্রাবণ।
” তার মানে! ”
” মানে প্রীতির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, চার বছর হলো। ওর ওয়াশরুমে কাজ ছিলো বলে আমি সাথে এসেছিলাম আর তার মধ্যে ওর কানের দুলের পুশটা গড়িয়ে নিচে….”
” প্রীতির সাথে মানে? ” শ্রাবণের মনযোগ তখন কেবল এই কথাটুকুর উপরে, বাকি আর একটা শব্দও ওর মাথায় ঢুকলো না।
প্রীতিও ততক্ষনে আদিত্যর পাশে এসে দাড়িয়েছে। প্রীতির কপালের লম্বা চওড়া সিঁদুরের দিকে এতক্ষনে চোখে পড়লো শ্রাবণের। কিন্তু তাতে সবকিছু পরিস্কার হওয়ার বদলে আরও তালগোল পাকিয়ে গেলো ওর। আদিত্যর সাথে প্রীতির বিয়ে হলে, সুমোর কার সাথে বিয়ে হয়েছে? মা যে বলেছিলো, সুমোর সাথে আদিত্যর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।
কেমন একটা শীত শীত করছে শ্রাবণের। মনে হচ্ছে ও বোর্ড পরীক্ষা দিতে এসেছে, হাত পা সমানে থরথর করে কাঁপছে ওর।
অথচ সুমন ওর সামনে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে আছে, পরিস্থিতিটা ভীষন অদ্ভুত।
শ্রাবণ, সুমনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেয়েও চুপ হয়ে গেলো। সুমনের শূন্য সিঁথি আর পরনের সাজ পোশাক ততক্ষণে ওকে সব স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে,
কিন্তু শ্রাবণ কোন কিছুর কোন হিসেব মেলাতে পারছেনা… ঘটনা দুইয়ে, দুইয়ে চার না হয়ে বার বার অঙ্কটা ভুল কেন বলছে?
চলবে……..
তোমার পরিনীতা -৪২
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
” সুমো আনসার মি? আদিত্যর সাথে বিয়েটা তোর জায়গায় প্রীতির সাথে কেনো হয়েছে? ”
তাজ্জব প্রশ্ন, মনে হচ্ছিলো আদিত্যর সাথে বিয়ে কেন হয়নি সুমনের, এটা উদ্ধার করাই আপাতত মুখ্য উদ্দেশ্য শ্রাবনের। সুমন উত্তর না দিয়ে পাশের জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগলো। আগে ওরকম জায়গা দেখলে ও ভয়ে মরে যেতো আর এখন জীবনটাই এমন লাগে ওর।
সুমনের এরকম নিরুত্তাপ আচরনে শ্রাবন ভিতরে ভিতরে আবারো চটছিলো, এই অসভ্য মেয়েটা ওকে নরকের আগুনে পোড়াবে, তারপর সেই পোড়া ছাই নিয়ে সিঁদুর পরবে… এক নাম্বারের মিচমিচে শয়তান।
” সুমো উত্তর দে বলছি, নাহলে কিন্তু আমি ঠিক এখন কুরুক্ষেত্র বাঁধাবো। তুই আদিত্যকে বিয়ে করিসনি তাহলে আমার সাথে এতোদিন যোগাযোগ করিসনি কেন?” শ্রাবণের আঙ্গুলের চাপে সুমনের চোয়াল প্রায় ভাঙ্গে।
কেন জানায়নি! সুমনের জিদ বাড়লো। কেন জানাবে ও? শ্রাবণ কেন একবার ওর খোঁজ করেনি? বিয়ে করা বউ ও তারপরও একবার ওর খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে, দরকার হয় ওকে মেরে ফেলতেই না হয় আদিত্যদের বাড়ি হাজির হতো সে। কিন্তু এখন এসব অবান্তর কথার কোন মানে খুঁজে পায়না সুমন, তাই কথা ঘোরাল।
” কারন আমার পরকালে ভয় আছে আর আমার স্বামী জীবিত আছে। স্বামী থাকতে আর একটা বিয়ে কি করে করবো? ” এবার স্বরটা একটু উচু শোনায় সুমনের, তবে তাতেও করুন সুরটা যেন ওর পিছু ছাড়ে না।
কথাতো নয়, মনে হলো থাপ্পরের মতো কিছু একটা শ্রাবণের কানের উপর এসে পড়লো। হাতটা খসে পড়ে সুমনের মুখ থেকে। ভীষন অসহায় লাগে, তাই তো.. সুমো তো দিব্যি রয়েছে তেমনি ওর হয়ে। ওই মাঝখান থেকে শুধু শুধু লাবণ্যকে… আর ভাবতে চায়না শ্রাবণ। এখন কি করে ও এই বিয়ে ঠেকাবে?
হতাশ ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে পড়ে শ্রাবণ। একটু পরেই সব কিছু শুরু হবে, কি রেখে কি করবে ও?
সমাধান হাতড়ে ফেরে সে।
এতোদিন শ্রাবণের মনে জ্বালা ছিলো, ধর্ম- অধর্মর বালাই ঘুচে গিয়েছিলো কিন্তু এখন সুমন স্বমহিমায় নিজের জায়গায় এসে হাজির হয়েছে, ও থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে তো আর কোনভাবেই সম্ভব হবে না এখন শ্রাবণের পক্ষে।
একবার মনে হলো সুমোকে নিয়ে পালায় কিন্তু পর মুহুর্তেই সেটা বাতিল করে দেয় শ্রাবণ। এখন আর সুমোকে এই প্রস্তাব দেওয়া যায় না, নিজেকে সুমোর সামনে আর ছোট করা যায়না। নিজেকে একদম নরকের কীট মনে হয় শ্রাবণের।
” নিচে চলো, তোমায় না পেলে সবাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে, ” সুমন উঠে দাড়াল। শ্রাবণের বিয়ের লগ্ন হয়ে আসছে, এখন বর মন্ডপে না পৌঁছালে অনর্থ ঘটবে।
শ্রাবণ আজ সত্যিই ভাঙ্গছিলো। সুমো কতো দূরে সরে গেছে ওর থেকে , কি নির্দ্বিধায় এসব কথা বলছে, এক ফোঁটা পানিও সুমোর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছেনা। এতো পাথর হয়ে গেছে ওর আদরের মানুষটা!
” ছেলেকে একটু রাখো, আমি দেখি দুই পাগল একসাথে কি করছে, “আষাঢ়কে, আদিত্যর হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রীতি দরজায় টোকা দিতে লাগলো। হাতে আর খুব বেশি সময় নেই আর , যা করার এর মধ্যেই করতে হবে।
” শ্রাবনদা, সুমনদি তোমাদের আলোচনা শেষ হলো? এক্ষুনি কিছু করো, নাহলে একটু পরে লোকের মধ্যে জানাজানি হলে, ভীষন কেলেংকারি হবে কিন্তু।”
প্রীতির কথাগুলো দরজার ওপাশ থেকে দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পেলো, কিন্তু শ্রাবণের মধ্যে নাড়াচাড়ার কোন লক্ষন সুমন দেখতে পেলো না।
.
.
.
নির্মলা ছেলের কথা শুনে বাজপড়া মানুষের মতো নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন শ্রাবণ বুঝি দুষ্টামি করছে, কিন্তু একটু পরে সেটাকে তার আর নিছক ফাজলামো বলে মনে হলো না। মাথা ঘুড়তে লাগলো নির্মলার বনবন করে। শ্রাবন, সুমনকে বিয়ে করে ফেলেছে, চার বছর আগে! ছেলে তার এতো বেয়ারা হলো কবে?
শ্রাবণকে প্রশ্ন না করে নির্মলা সোজা সুমনকে নিয়ে পড়লেন। কিন্তু সুমনকে প্রশ্ন করেও তিনি বিশেষ কিছু জানতে পারলেন না বিয়ের কথা ছাড়া। সুমন মোটে উত্তরই করতে চাচ্ছে না, আঁচলের কোনা দিয়ে কেবল চোখ মুঝছে বার বার আর ক্ষমা চাচ্ছে।
শান্তনু পুরো ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। ছোটকে জুতোপেটা করাই বোধ হয় এখন সবচেয়ে উচিত কাজ ছিলো, কিন্তু সমাজে শ্রাবন চৌধুরীর সুনামও একদম ফেলে দেয়ার মতো নয়, উকিল হিসেবে সে এই ক’বছরে যথেষ্ট নাম কুড়িয়েছে, তাছাড়া শান্তনু তার বাবা রামনাথের মতো নাক উঁচু আর কঠিন স্বভাবের নয়, বরঞ্চ এই স্বভাবটা উত্তরসূরী হিসেবে শ্রাবণের চরিত্রেই কিছুটা বেশি দেখা যায়। শান্তনু তাই মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো, পাত্রীপক্ষকে এখন সে পাত্রের ভাই হিসেবে কি জবাব দিবেন?
সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনার এক ঘরে লাবণ্যর পরিবারকে ডেকে আনা হলো, বিষয়টি পরিস্কার ভাবে তাদের জানানোর জন্য। এখন কোন অবস্থাতেই আর কথা লুকোনো সমীচীন মনে হলো না কারো।
লাবণ্যর বাবার এমন ভয়নক কথা শুনে জায়গায় প্রেশার বেড়ে গেল। শ্রাবণ বিবাহিত একথা শুনে মেয়ের কি হবে সেটা ভাবতেই বুকে ব্যাথা উঠলো তার। পুরো চৌধুরী পরিবার অনুতপ্ত হয়ে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলো লাবণ্যর পরিবারের কাছে।
কিন্তু লাবন্য আর তার পরিবার কিছুতেই শ্রাবণের এমন অদ্ভুত আচরন মেনে নিতে পারছিল না। শ্রাবণ যদিও এরকম একটা অবস্থায় লাবণ্যকে ফেলার জন্য ভীষন অনুতপ্ত এটাই বার বার বলার চেষ্টা করলো কিন্তু উত্তেজিত জনতার ভীড়ে সেই কথা তখন আর ভালোমতো শোনা যাচ্ছিলো না। সবাই তখন পাত্রর আস্পর্ধা আর স্বভাবের স্খলন এই নিয়ে উত্তাল আলোচনায় মেতে উঠেছে। কেউ কেউ আবার এই ফাঁকে পাত্রের পরিবারকে চুপিচুপি সাধুবাদও জানালেন, এই ঘটনা বিয়ের পরে জানা গেলে মেয়ের সতীন নিয়ে ঘর করতে হতো, তেমন আশঙ্কা থেকে।
নির্মলা আর শান্তনুও, শ্রাবণের এই আচরণ ক্ষমার অযোগ্য বলে লাবণ্যর পরিবারের কাছে বার বার ক্ষমা চাইলেন। লাবণ্য কাঠ হয়ে বসে সমস্তটা শুনলো কেবল, হ্যাঁ অথবা না কিছুই বললোনা।
বিয়ের আসর মুহূর্তেই শোকের আসর হয়ে গেছে, লাবণ্য বুঝতেই পারছিলনা শ্রাবণকে চাওয়াটা ওর জন্য এতো বড়ো অপরাধ কেন হলো? ওর ভালোবাসায় কি কোন ঘাটতি ছিলো যে
ও সুমনের মতো দু টাকার রোগা পটকা মেয়েটার কাছে হেরে গেলো? এতো বৈভব আর সৌন্দর্য থেকে তাহলে লাবন্যর কি লাভ হলো?
লাবন্যর সবচেয়ে বেশি কষ্ট হলো এই ভেবে যে সুমনকে, শ্রাবণ চার বছর আগেই পেয়ে গিয়েছে। তারপরও সুমনের সাথেই শ্রাবণের থাকার ইচ্ছেটা বহাল থাকলো… লাবণ্যকে সে চায় না। শ্রাবণের মনে ওর জন্য এক ফোঁটা জায়গাও নেই, এই কথা ঘুরেফিরে লাবণ্যকে পাগল করে তুলতে লাগলো।
………………………………….
সবার সামনে যখন শ্রাবণ, সুমনের সিঁথিতে সিঁদুর পরালো ঘড়ির কাটা তখন রাত তিনটার ঘরকে ছুঁই ছুঁই করছে । শ্রাবণের বিপরীতে সুমনের আচরন তখনও পাথরের মতো নিশ্চল আর অভিব্যাক্তিহীন। বাড়ির কেউ কারো সাথে বাড়তি কোন কথা বলছে না, এটা বিয়ে বাড়ি না ভূতুড়ে বাড়ি সেটা নিয়েই কেমন একটা সন্দেহ ঠেকছিলো প্রীতির। কিন্তু মঞ্জুকে বলতেই চোখ বড়ো বড়ো করে চোখ রাঙ্গালেন তিনি। মেয়েকে বললেন, “একদম চুপ করে থাক, এতোবড়ো একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেলো, এর মাঝে তুই আনন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছিস, নির্মলাদি শুনতে পেলে কিরকম রাগ করবে একবার ভেবে দেখেছিস! ”
হোক দুর্ঘটনা তবু আজ ওর সুমনদির পাওনার দিন, গত চার বছরে নিজেকে কতোটা কষ্ট দেয়া যায় সেটা সুমনকে নিজের চোখে পেতে দেখেছে প্রীতি, আদিত্যকে বলে তাই অল্প বিস্তর মিষ্টিমুখ করার আয়োজন করলো ও কানা রাতে।
সুমন যখন চৌধুরী বাড়িতে পা দিলো সূর্য তখন উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়াচ্ছে নব উদ্যমে। নির্মলা গতরাতে মুখ কালো করে রাখলেও আজ সুমনকে দেখে সেই রাগ ধুয়ে মুছে ফেললেন। প্রকৃত পক্ষে রাগ তার ছেলের এমন উদ্ভট আচরনে হয়েছিলো। এতোবড়ো উকিল হয়ে শ্রাবণ কি করে এমন বাচ্চাদের মতো খামখেয়ালিপনা করলো? এতোগুলো মানুষের সামনে কি নাস্তানাবুদই না হলেন পরিবারের সবাই মিলে। ছেলেকে কেমন শিক্ষা দিয়েছেন, ছেলের রুচিই বা কেমন… অসংখ্য কটুবাক্যে কান কাল ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিলো নির্মলার। ভাগ্যিস সুজয় এসে শেষ মুহুর্তে, লাবণ্যকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো বলে রক্ষে। তা না হলে হয়তো ছেলেকে আজ হাসপাতালের বেডেই পেতেন তিনি।
শ্রাবণ কাল সব অপরাধ একা নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছিলো, তবু কটুকথা সুমনের পিছু ছাড়ে নি। বড়লোকের ছেলের মাথা কেমন করে ও ঘুড়িয়েছে আর কি তার উদ্দেশ্যে, সেগুলো সবই সুমনের কানে এসেছে। জানা কথা টিপ্পনী কাটার লোকের কোনদিন অভাব হয়না কিন্তু এগুলো ছাপিয়ে যা ওর মনের মধ্যে তোলপাড় করছিলো সেটা কেন যেন চাইলেই সুমন বলতে পারছিলনা আর সেটাই কেমন গুমোট একটা আবহ তৈরি করছিলো ওর মনের চারপাশে।
শ্রাবণেরও এতোকাল বাদে কেমন একটা সংকোচ হচ্ছিলো, সুমনকে এতোটা গম্ভীর থাকতে দেখে। কি বললে, কি করলে সুমো পাগলীটা আবার আগের মতো লক্ষী বউ হয়ে যাবে উপায় হাতড়ে বেড়াতে লাগলো সে।
চলবে……..