তোমার পরিনীতা – ৪৫
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
সুমনের পিড়াপীড়িতেই শেষ পর্যন্ত কাপড় গোছানোতে হাত দিলো নির্মলা। প্রীতি ঘটা করে তার ছেলের জন্মদিন করবে, তাতে ওদের সবাইকে দাওয়াত করেছে আদিত্য নিজের বাড়িতে। শান্তনু আর বন্দনাও যাচ্ছে শ্রাবনদের সাথে। নির্মলা তাই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুমন এ ব্যাপারে নাছোড়বান্দা বললো, “মা আদিত্য বার বার করে তোমায় যেতে বলেছে, আর তা না হলে আমাদেরও যেতে বারন দিয়েছে।”
শেষ পর্যন্ত নির্মলা তাই ব্যাগটা আলামারী থেকে নামালেন। সবগুলো মিলে তাকে নিয়ে ছাড়বে বেশ বুঝেছেন তিনি, আর শ্রাবণের এতে বেশ মত আছে।
শ্রাবণ মনটা আজ বেশ ফুরফুরে । বহুদিন পর সুমন নিজে থেকে কোথাও যেতে চাইছে আর শুধু চাইছে বললে ভুল হবে, নিজেই সেধে সেধে সবাইকে কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছে। এমনকি অনুষ্ঠানে শ্রাবণ কি পরবে তাও বার দুই জিজ্ঞেস করে সুটকেসে ভরেছে। শ্রাবণের তো মনে হচ্ছে প্রীতির এক ফোনে মোটামুটি ম্যাজিক হয়ে গিয়েছে ওর জীবনে। বোনের বাড়ি যেতে পারলেই যে সুমো এতো হাসিখুশি আর স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এটা যদি শ্রাবন আগে থেকে জানতো তাহলে কবেই প্রীতির বাড়ি থেকে দুই তিনবার ঘুরিয়ে আনতো।
” শ্রাবন আমরা তোমার শালীর বাড়ি গিয়ে কিন্তু চুপ করে বসে থাকবো না, আমাদের আশেপাশের সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে হবে তোমায়, ” বন্দনা আব্দার করে বসলো।
” বৌদি, প্রীতি আবার কবে থেকে আমার শালী হলো.. ওতো আমার চেয়ে তোমার ঘরে ঘুরঘুর করতো বেশি,” শ্রাবন কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
” সেতো ওই নেইলপলিশের লোভে, মঞ্জু মামীতো সেই লোক… সহজে কোন কিছু ওদের কিনে দিতো না। কিন্তু এখন প্রীতি বড়োলোকের বউ, এখন কি আর আমাদের সে গুনবে? ”
” তা বটে এবছরই বোধহয় আদিত্য ওদের নিয়ে দুবাই থেকে ঘুরে এলো,” শ্রাবণ বলে উঠে।
” হ্যাঁ, “সুমন এবারে মুখ খুললো। প্রীতি দুবাই থেকে আসার পর একবারও এদিকে আসেনি। সুমনের যে কতো কথা জমে আছে ওকে বলবার জন্যে, ওদের দেখবার জন্য।
.
.
.
পরদিন সকাল সকাল ট্রেন ধরতে হবে বলে, অনিন্দিতাকে নিয়ে সোজা বিছানায় চলে এলো সুমন খাবার খেয়েই। মেয়েটা একদম বাপ নেওটা হয়েছে তার। মাত্র আটমাস বয়স হলো আর এক্ষুনি সে বাবার গলার স্বর শুনলে লাফিয়ে উঠে বাবার কোলে যেতে চায়।
আর শ্রাবণের কোলে একবার গেলে রক্ষা নেই.. তারা তখন রাত বারোটা বাজার আগে আর ঘুমুবে না। কিন্তু কাল সবাইকে আগে আগে খেয়ে ট্রেন ধরতে হবে, আজ অনিকে তাই একদমই জেগে থাকতে দেবেনা সুমন।
শ্রাবণ যখন বিছানায় এলো সুমন আর ছোট্ট অনিটা তখন ঘুমে কাঁদা।
খুব নিঃশব্দে একটা শ্বাস ছাড়লো শ্রাবণ। সুমন আর অনিকে নিজের দু’হাতের পরিধির ভিতরে নিয়ে এলো। এরাই ওর পৃথিবী এখন আর তারাই যদি মুখ ফিরিয়ে রাখে তাহলে ওর বেঁচে থাকাটা অহেতুক হয়ে যায়। সুমন এখন কেবল ওর কাছে একটা শরীর হয়ে ধরা দেয়, আত্মার মিলটা আর হয়না। শ্রাবণ চেষ্টা করে খুব কিন্তু কোন ভাবেই দুটি সুর আর মেলেনা, ছন্দের ফাঁক ফোকর কিভাবে যেনো থেকেই যায়। শ্রাবণ ডুব সাঁতার দিয়েও সুমোর ভিতরের সেই রঙিন মনকে আর খুঁজে পায়না।
স্যাতস্যাতে উষ্ণ কিছু একটা সুমনের গলার কাছটা ভিজিয়ে দিচ্ছিলো, সুমন ঘুম ঘুম চোখে চোখ মেলতেই প্রশ্নের সমাধান মিলে। লোকটা আবার কাঁদছে… কি যে হয় লোকটার থেকে থেকে?
” কি হলো, তুমি কাঁদছো কেন? ” আড়মোড়া ভাঙ্গে সুমন। এতো ভারী শরীর নিয়ে ওকে এভাবে জাপ্টে ধরে রাখলে সুমন পারে? দম লেগে আসে ওর।
শ্রাবণ বুঝে উঠতে পারেনা, এ সুমনের কেমন হেঁয়ালি… যে নিজে ওর গলা চেপে ধরে বলে বসে আরে তুমি শ্বাস নাওনা কেন, সেখানে আদৈ কি আর কোন উত্তর দেয়ার অবকাশ আছে?
শ্রাবন তাই উত্তর দেয়ার বৃথা চেষ্টা করেনা। থাক ওর দুঃখ গুলো একান্ত ওর হয়ে। সুমন তো একদমই নাই হয়ে গিয়েছিলো চার চারটে বছর ওর কাছ থেকে… এখন অন্তত মুখটা ও সামনে তো দেখতে পায়।
কিন্তু সুমন অনেকদিন পর আজ মন থেকে ভীষন খুশি… শক্ত দরজাটা তাই একটু ঢিলে হয়ে আসে ওর। জানালার ফাঁক দিয়ে শেষ রাতের আবছা আলোটা তখনও গাঢ় নীলচে রঙের আচ্ছাদন তৈরি করে আছে জ্বল জ্বলে তারাদের সাথে মিতালি করে। সুমন ঘুম কাতুরে স্বরে হঠাত জানতে চায়, “কি হলো বলছোনা কেন… তুমি এরকম করে কাঁদছো কেন? ”
অভিমানটা চুইয়ে পড়ে শ্রাবণের, সুমনের কথাটা বুমেরাং হয়ে ফিরে যায় সুমনের কাছেই… ঝনঝন করে বলে উঠে, ” তুই জানিস না.. নাকি বুঝতে চাস না, কোনটা সত্যি বলতো সুমো? ”
অদৃশ্য একটা কষ্ট সুমনের চারপাশে অন্ধকারের মতো জেঁকে বসে। মুখ খুলবে কি খুলবে না… দ্বিধা এসে মনের দরজায় হাজার বার করে কড়া নাড়ে। কিন্তু আজ সুমনের মনটা চঞ্চলা হরিনী… মুখ ফসকে কথাটা আজ বেড়িয়ে আসে তীরের বেগে।
” ওই মুহূর্তে আদিত্য যদি না বলতো, তুমি তো লাবন্যদিকেই বিয়ে করতে।”
ব্যাস এটুকুই, আর কিছু বলে না সুমন।
তারপরই অখন্ড নীরবতা। শ্রাবন কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না,কথাটা দিনের আলোর মতোই সত্যি। আদিত্য না বললে আজ এখানে সুমোর বদলে লাবণ্য থাকতো। ভাবতেই কেমন বুকটা কেঁপে যায় শ্রাবণের, সুমনকে আরো জোরে আকড়ে ধরে,সত্যি জেনেও অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে, ” না, কক্ষনো না।”
” কি না, করতে না বিয়ে লাবণ্যদিকে? ”
সুমনের পলকা হাসি কাচের চুড়ির শব্দে ভাঙ্গতে থাকে। শ্রাবণের কানদুটো ঝালাপালা হয়ে আসতে চায়। সুমোটা কি নিষ্ঠুর হয়ে গেছে… কি করে ওই কথাগুলো ও হেসে হেসে বলে? ওর প্রানে একটুও মায়া নেই শ্রাবণের জন্য। শ্রাবণ কি শখ করে ভালোবেসে লাবণ্যকে বিয়ে করতে গিয়েছিলো.. হ্যাঁ, তারপরও দোষ ওর হয়েছে সেটা ও মানছে।
এখন দিনরাত তার জ্বালা তো ও সইছে, আরো কতো… আর কতোদিন… এর শেষ কোথায়? কোনদিন কি আর ওরা সুখি হবেনা?
” কি হলো বলো? ”
” সুমো আমিতো জানতাম না তুই বিয়ে করিসনি আদিত্যকে… আমিতো রাগ হয়ে রাজি হয়েছিলাম, সাথে মা আর মৌমি দিন রাত বিয়ে করো বিয়ে করো বলে ঘ্যানঘ্যান করতো, আমি ওদের না করতে পারিনি।”
” সেই তো বলছি, না করবে কেন… লাবন্যদি কি না করার মতো মেয়ে? ”
” সুমো তুই সেই রাগ করেই এখনো কথাগুলো বলছিস আমি জানি , কিন্তু আমার সিচুয়েশনটাও একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমার জায়গায় তুই থাকলে হয়তো বুঝতে পারতিস যে আমি কি যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে সময়গুলো পার করেছি। ”
” আমি বুঝতাম না, কারন আমি তুমি নই,” তরল স্বরে কথাগুলো বলেই আবার ফিক করে হাসে সুমন,তারপর অপ্রতিভ ভাবে বলে উঠে, “জানইতো আমার মাথা বরাবরই ডাল ছিলো।”
” সুমো তুই…” শ্রাবন খেই হারায়। সুমো কেমন করে এতো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে? আগে এক পাতা পড়তে গেলে ওর কাছে মার খেয়ে ভুত হতো যে মেয়ে, আজকাল সেই মেয়েকে রীতিমতো সমঝে চলে শ্রাবণ, তাও একটুও নরম হয়না।
” আচ্ছা সরো দেখি, সকাল সকাল স্নান সেড়ে সবাইকে তৈরি করতে করতে অনেক বেজে যাবে, এখন বিছানা না ছাড়লে হবেনা।”
কিন্তু শ্রাবন যেন কিছুই শোনেনি এমন ভঙ্গিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। ও মরে গেলে তবে বোধহয় সুমো ওকে ক্ষমা করবে। জিজ্ঞেস করে দেখবে একবার… কিন্তু তাও জিজ্ঞেস করা হয়না। আজকাল সুমো ওর সব কথাই শুধু হেসে এড়িয়ে যায়। যদি ঠোকাঠুকি হতো তবে শব্দ হতো, তাতে অল্প অল্প করে হলেও দুঃখ গুলো বেরিয়ে আসতো, কিন্তু সুমো তো মুখে কুলপি এটে আছে।
” কি হলো ছাড়ো… না হলে আজ সব উল্টোপাল্টা হবে।”
” হোক উল্টোপাল্টা, সব সোজা হয়েই বা কি হবে?”
” তাও ঠিক, ” সুমন আনমনে সায় দেয়, কিছুই তো ঠিক নয় ওদের জীবনে।
শ্রাবণ ভিতরে ভিতরে সুমনের নীরব আলাপনে ফুঁসে ওঠে। আক্রোশের সাথে সুমনের ঠোঁটদুটিকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয় ঝড়ের মতো , মাথায় এখন ওর আগুন জ্বলছে আর নিভছে। কিছুতেই শান্তি হয়না, তবু বার বার ওর ছুটে ছুটে আসা.. কিছুটা সময় ওই শরীরে ডুব সাঁতার কাটা, হয়তো এভাবেই একদিন সব শেষ হয়ে যাবে ওর।
সুমন হাসে, ওর চোখের কোন তখনও চিকচিক করছে। শ্রাবণকে, সুমন কখনো ফেরায় না… না আধপেটা রাখে… যখন যেমন দরকার সুমন আছে দম দেয়া কলের পুতুলের মতো, দিনে কি রাতে
কিন্তু তবু কেন যে শ্রাবনের মন শান্ত হয়না।
.
.
.
আদিত্য বড়ো বড়ো দুটো গাড়ি পাঠিয়েছে শ্রাবণদের স্টেশন থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে। বাড়িতেও ওদের খাবার দাবারের জন্য ভীষন এলাহী এক কারখানা চলছে , রাজ্যের খাবার রেঁধে ওদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে প্রীতি।
খেতে বসে রীতিমতো লজ্জা পাচ্ছিলো শ্রাবণ। আদিত্য যতোবার পারছে ওকে খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে, শ্রাবণ শেষ পর্যন্ত আর পারছিনা বলে উঠে পড়লো টেবিল থেকে।
নির্মলা সবার আগে লক্ষ করলেন সবাই খেতে বসলেও সুমন এখানে নেই। প্রীতিকে তাই বলে বসলেন,”হ্যাঁরে প্রীতি, সুমন কোথায় গেলোরে মা? ওকে এখনই খেয়ে নিতে বল, না হলে মেয়ে খাওয়াতে বসলে দেখা যাবে ওর আর খাওয়াই হবেনা।”
” সুমনদি বোধহয় উপর তলায় আমার শাশুড়ির ঘরে বড়োমা, আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি,” প্রীতি উপরে উঠতে যাচ্ছিলো, শ্রাবণ ওকে ডেকে থামায়।
” প্রীতি তুই বোস আমি দেখছি। তোরা বোধহয় না খেয়ে অপেক্ষা করছিলি আমাদের জন্য, এখন যা আদিত্যকে সাথে করে আগে খেয়ে নে। ”
” তুমি তাহলে সুমনদিকে নিচে এসে খেতে বলো শ্রাবনদা, আমি খেয়ে তোমাদের বিশ্রাম করার ব্যবস্থা করছি।”
শ্রাবণ এর আগে কখনো প্রীতির শ্বশুরবাড়ি আসেনি। আদিত্যরা যথেষ্টই বিত্তবান, সুমো শুধু টাকার জন্যও যদি ওকে ভুলে আদিত্যকে বিয়ে করতো তবে তেমন কোন দোষের বোধহয় আসলেও হতোনা… শ্রাবন নিজের মনে ভাবতে থাকে।
একসময় হাটতে হাটতে যে ঘরের সামনে গিয়ে সুমনের কন্ঠস্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল, সে ঘরে উঁকি দিয়ে শ্রাবণ আদিত্যর মা অঞ্জনা দেবী, সুমন আর প্রীতির ছেলে আষাঢ়কে, অনিন্দিতার সাথে খেলা করতে দেখতে পেলো।
শ্রাবণের সাথে কুশল বিনিময়ের পর অঞ্জনা দেবী জানতে চাইলেন ওদের সবার খাওয়া শেষ হয়েছে কিনা? সেই সুযোগে শ্রাবণ জানিয়ে দিলো, একমাত্র সুমন ছাড়া ওদের বাকি সবার খাওয়া মোটামুটি শেষ।
কিন্তু তারপরও সুমনের মধ্যে সেখান থেকে উঠে আসার কোন লক্ষন শ্রাবণ দেখতে পেলো না। সে একভাবে আষাঢ়কে কোলে নিয়ে বসে আছে, আর আষাঢ়, অনিন্দিতার হাতের মুঠি টেনে টেনে খুলছে আর মেয়েটা তার হাত ফিরে পেতেই আবার মুঠ করছে।
শ্রাবণ প্রথম একবার, দুবার ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করলেও তৃতীয়বারে আস্তে করে বলে বসলো,
” আষাঢ় ও তো ছোট্ট মানুষ, এতোবার করে ওর হাতের মুঠি টেনে খুলতে গেলে দিদিটা ব্যথা পাবে।”
” কিন্তু আমিতো শুধু খেলছি, ওকে ব্যাথা দিচ্ছি না।”
” তুমি দিচ্ছো না, কিন্তু ওর লাগছে,” শ্রাবন মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। প্রীতি ছেলেকে কিছু শেখাচ্ছে না, বড়োদের মুখে মুখে জবাব দেয়।
” আশ্চর্য তুমি ওর পেছনে লাগছো কেনো বলতো, ও তো একেবারে আস্তে করে অনির হাত ধরছে আর আমি দেখছি.. অনির কিছু হবেনা।”
সুমনের কথায় শ্রাবণ বেশ বিব্রত হলো। সুমনের কাছে কি এখন শ্রাবণের সব কাজই বাঁকা মনে হয়? শ্রাবণ আর কথা বাড়ালো না কিন্তু আড়চোখে খেয়াল করলো আষাঢ় তখনও একইভাবে অনির হাতের ছোট্ট মুঠিটা টেনে টেনে খুলছে।
অঞ্জনা দেবী হাসলেন, তিনি স্বভাবতই শ্রাবণের নিজের মেয়ের জন্য চিন্তিত হওয়াটা টের পাচ্ছিলেন।
” সুমন তুমি মেয়েকে তার বাবার কোলে দিয়ে নিচে খেতে যাও, সবাই খেয়ে নিলে শেষে তোমাকে একদম একলা খেতে হবে।”
অঞ্জনা দেবীর কথায় শ্রাবণের কুঁচকে আসা কপালটা স্বাভাবিক হলো, আসলেই মেয়ের উপর এই অহেতুক অত্যাচারটা ওর পছন্দ হচ্ছিলো না আর আষাঢ়কে কড়া করে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তবে ছেলেটা যথেষ্ট চঞ্চল… অনিকে ওর কাছ থেকে সামলে সামলে রাখতে হবে, ভাবলো শ্রাবণ।
………………………….
” আচ্ছা বলছি কি… আষাঢ়ের জন্মদিনে আমরা কি দেব? ”
শ্রাবণ অনিকে মাত্রই ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলো, সুমনের কথায় সেটা ভেঙ্গে গেলো… মেয়েটা চট করে আবার শ্রাবণের বুকের উপরেই উঠে বসার জন্য পড়িমরি করে চেষ্টা করতে লাগলো।
শ্রাবণের মেজাজ হঠাত তিরিক্ষি হলো, সুমন এখানে আসা অব্দি মেয়ের যত্ন মাথায় তুলে ওই নিয়ে পড়ে আছে। আরে বাবা শ্রাবন তার পুরো পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছে.. ওর কি মাথায় কোন বুদ্ধি নেই যে শালীর বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসে কি দিতে হবে ওর ধারনা নেই? কিন্তু সুমন, শ্রাবনের দিকে খেয়াল না করেই বলে বসলো,
” বলছি একটা বড়ো খেলনা গাড়ি কিনে দিলে হতো না ছেলেটাকে, ওই যে বাচ্চারা চড়ে খেলে।”
” এক কাজ করি একটা বাড়ি কিনে দেই, সেটা ভালো হয়না? ” শ্রাবণ নিজেকে বহুকষ্টে থামালো।
“বাড়ি! ওইটুকু বাচ্চা বাড়ি দিয়ে এখন কি করবে? তবে আমার বাড়িটা তুমি অনুমতি দিলে আষাঢ়ের নামে লিখে দিবো… আর কেউ না হোক প্রীতি তাহলে ও বাড়িতে যেয়ে উঠতে পারবে।”
শ্রাবণের জ্বালাটা এবার একদম চিড়বিড় করে উঠলো। শ্রাবণের কি পরিমান কষ্ট হয়েছে এই বাড়িটা কিনতে সেটা একমাত্র ও জানে আর বউ ওর সেই উপহার আরেকজনকে হাসতে হাসতে দিয়ে দিবে। আর সবচেয়ে বড়োকথা শ্রাবণ যে ফিলিংসটা নিয়ে জিনিসটা কিনেছে, সেটার কোন মূল্যই সুমনের কাছে নেই… সে আছে তার মামা-মামীর ঋন শোধের চিন্তায়।
” কেন… ওই বাড়ি না থাকলে প্রীতির আর কোথাও ওঠার জায়গা নেই? আমরা কি ওদের কেউ নই নাকি? ”
” হ্যাঁ, সেতো পারেই তারপরও ওটা ওর ঠাকুরদার বাড়ি… কতো কতো অনুভূতি ওতে জড়ানো,” সুমন উদাস হয়ে উত্তর দেয়।
” ওটা শুধু প্রীতি না আমাদেরও অনেক স্মৃতির জায়গা সুমো। ও বাড়ি আমি না কিনলে আমার বন্ধু আরেক লোকের কাছে বেঁচে দিতো… আর আমি বেঁচে থাকতে ও বাড়িতে অন্য কোন মানুষ ঘুরে বেড়াবে আমার সহ্য হতোনা। তাই অভিজিতকে এক রকম অনুরোধ করেই ওটার বিক্রি বন্ধ করিয়েছি, টাকাও প্রায় দেড়গুন লেগেছে আমার। ”
” সে হোক, তুমি তো ওটা আমায় উপহার দিয়েছো… আমি ওটা আষাঢ়ের নামে লিখে দিতে চাই।”
শ্রাবণের আর কোন কথাই বলতে ইচ্ছে হলোনা। সুমো যদি মনে মনে ডিসিশন নিয়েই থাকে যে ও বাড়িটা প্রীতির ছেলের নামে দিয়ে দিবে সেক্ষেত্রে ও কি করতে পারে? তবে নিজের মেয়ের জন্য যদি সুমন এর অর্ধেকও ভাবতো তবে শ্রাবণ ধন্য মনে করতো নিজেকে। আসলে শুধু আদিত্য না, সুমনের কাছে ওদের গোটা পরিবারটাই এখন বিশাল কিছু আর শ্রাবণের সাথে সাথে ওর পরিবারের লোকজন সব তুচ্ছ, এমনকি সুমন নিজের মেয়েকেও সেই একই দলে ফেলে দিয়েছে।
.
.
.
আদিত্য নিচে দাড়িয়ে পুরো বাড়িতে লাইটিং ঠিক মতো করা হলো কিনা দেখছিলো। আষাঢ় এসে পাশে দাড়াতেই প্রীতি ছেলেকে ভিতরে পাঠানোর জন্য চেঁচাতে লাগলো উপরের ব্যালকনি থেকে।
” বাবা আমি তোমার সাথে এখানেই থাকবো, কি সুন্দর আলো জ্বলছে আর নিভছে না বলো?”
ছেলের কথায় আদিত্য হাসলো।
” কিন্তু আষাঢ় মা ডাকছে, একটু পরে সব মেহমান চলে আসবে তখন তুমি এই কাপড়ে থাকলে লোকে কি বলবে বাবা , যে আষাঢ় একটা পচা ছেলে আর আষাঢ়ের একটাও ভালো জামা নেই।”
” তাহলে আমি জামা পরে আসি, তুমি কিন্তু এখানেই দাড়িয়ে থাকবে আমি না আসা পর্যন্ত।”
” আচ্ছা, তুমি দৌড়ে মার কাছে যেয়ে কাপড় পরে এসো। ”
আষাঢ় দৌড়ে ভিতরে যেতেই শান্তনু, দিব্য, বন্দনা আর শ্রাবণ এসে আদিত্যর পাশে দাড়ালো। ওরা সবাই মিলে আজ সকাল থেকে খুব ঘুরেছে চারপাশটা। নির্মলা, অনিন্দিতাকে তার কাছে দিয়ে সুমনকেও যেতে বলেছিলেন কিন্তু সুমনের এসব এলাকা পরিচিতো , সুমনের তাই তেমন কোন আগ্রহ নেই আর শ্রাবনও কোন রকম জোর করেনি। আসলে কাল রাতের পর থেকে শ্রাবন যথা সম্ভব চুপ করে আছে। সামনে কিছু না বললেও সুমনের ওই বাড়িটা আষাঢ়ের নামে দেয়ার কথাটা শ্রাবণের একদমই মনে ধরেনি। শুধু টাকার ব্যাপারটাই না… অনিন্দিতাকে বঞ্চিত করে আষাঢ়কে নিয়ে সুমনের এই অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখানোটা শ্রাবণের জন্য যথেষ্ট মনঃকষ্টের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু কিছু বললেই শ্রাবন হবে এখন সুমনের দুচোখের বিষ, ভালেবাসা তো সেই কবেই উবে গেছে সুমনের ওর জন্যে।
………………………………………………
অনিন্দিতাকে জামা পরাতে যেয়ে সুমন একদম পেরেশান হয়ে গেলো। যতোবার মেয়েকে সুমন শোয়াচ্ছে সে ততবারই উল্টে যাচ্ছে… আর সুমন চোখ গরম করলেই অনি হয় ভ্যা করে কেঁদে দেয় নয় খিলখিল করে হাসে।
শেষ পর্যন্ত সুমন যখন জামাটা মেয়ের গায়ে পরাতে পারলো ততক্ষনে শ্রাবণ এসে ঘরে ঢুকেছে।
সুমনকে, অনিন্দিতাকে তৈরি করাতে দেখে এতো মন খারাপের মাঝেও শ্রাবণের মনটা একটু ভালো হয়ে গেলো। অনিন্দিতাকে গল্পের টিংকার বেলের মতো লাগে শ্রাবণের কাছে, যে ওর জীবনটা আলোয় আলোয় ভরে দিয়েছে। তা না হলে তো একদম অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল ওরা দুজন ব্যার্থতা আর গ্লানির ভারে। অনি আসার আগে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত টানতে পারবে কি না সেটা নিয়েই ধন্ধ লাগতো শ্রাবণের।
একমাত্র অনির জন্যই না….
যা হোক সুমো মাঝে মাঝে ওর সাথে নিজের রাগ ভুলে দু’ একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলে এখনো।
” একটু ধরতো ওকে, আমি মায়ের কাছ থেকে ওর সোনার চেইনটা নিয়ে আসি,” সুমন মেয়েকে শ্রাবনের হাতে ধরিয়ে দেয়।
” সুমো ওগুলো এই গরমে থাক না, বাচ্চা মানুষ একটু পরেই চিল্লাবে।”
” কিন্তু কিছু না পরালে আবার কেউ কেউ বলবে তুমি ওকেও কিচ্ছু দাওনি।”
” মানে? আমি আমার মেয়েকে দেবনা তো কাকে দেব? ”
” ও কিছু না, আচ্ছা থাক তাহলে কিন্তু মা কিছু বললে সব তোমার দোষ, আমি কিছু জানিনা।”
” মা কিছুই বলবেনা, মা কি তোর মতো বুদ্ধি নিয়ে চলে নাকি… ছোট্ট বাচ্চা মানুষ তাকে সোনার চেইন পরানো কতো রিস্কি বুঝিস আর তারপরে এই গরমে… ও তো সব এক্ষুনি টেনে ছিড়বে।”
ওর মতো বুদ্ধি নিয়ে চলে না মানে, সুমনের মাথায় কোন বুদ্ধি নেই… তাইতো? রাগে মুখটা বেঁকিয়ে ভেঙচি কাটে সুমন, বেশি বেশি ভাব। বাচ্চা মানুষ, গরম… ইশশ কতো ভাবনা, সব খালি উনি একাই বোঝেন, নয়মাস পেটে উনিই ধরেছিলেন কিনা মেয়েকে .. যত্তোসব।
সুমনকে মুখ ভেঙচাতে দেখে শ্রাবন খুব অবাক হলো, মনে হলো কতোযুগ পরে ও এই দৃশ্য দেখছে… ঝুপ ঝাপ বৃষ্টির মতো কিছু একটা ওর চোখের কোনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। এই একটু আগেও মনটা খুব খারাপ ছিলো ওর… অথচ এখনি মনটা ভালো লাগায় পূর্ণ হয়ে গেলো।
এখন খুব বেশি চাওয়া নেই শ্রাবণের জীবনের কাছে। অনিন্দিতা আছে… সাথে সুমো শুধু ওর সাথে সুখি থাক আর খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই ওর । শ্রাবন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সুমন যদি ও বাড়িটা প্রীতির ছেলের নামে দিতেই চায় দিক তবু ও যদি স্বাভাবিক হয়, শ্রাবণ সন্তুষ্ট।
.
.
.
সুমন, শ্রাবণের নতুন পাঞ্জাবিটা মাত্র বিছানায় রাখছিলো অমনি ভীষন জোরে এক চিৎকার হলো। বুকটা কেমন কেঁপে গেলো সুমনের।
” কি হলো? ”
হন্তদন্ত হয়ে যে যেখানে ছিলো নিচে ছুটলো বাসার।
” এক্ষুনি অ্যাম্বুলেন্স ডাকো, দাদুকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে,” অঞ্জনা দেবীর ডাকে আদিত্যর ঘোর ভাঙ্গলো। ছেলে তার সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে একদম নিচে এসে পড়েছে… কপাল কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত আসছে, মেঝে পুরো ভিজে যাচ্ছে রক্তে।
” হ্যাঁ, কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকো,” পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো আদিত্যর আত্মীয়।
” আমার মনে হয় আদিত্য, অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। আমাদের গাড়িতে করে যতো দ্রুতো সম্ভব হাসপাতালে যাওয়া উচিত। তার আগে কেউ আষাঢ়ের কপালটা জোরে চেপে ধরো কাপড় দিয়ে।”
” আমি ধরছি,” প্রীতি দৌড়ে এসে আষাঢ়ের কপালটা চেপে ধরলো শাড়ির আঁচলের কোন দিয়ে।
” কেউ ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো এক্ষুনি, ” আদিত্য কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠে , এতো রক্ত আদিত্য কখনো দেখেনি এভাবে। ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি ছেলের জন্মদিনে পরবে বলে শখ করে বানিয়েছিলো প্রীতি, ওর জন্য.. এখন সেটা রক্তের সমুদ্র হয়ে গেছে।
ডাক্তার দেখেই বললো দ্রুত সেলাই করতে হবে, পায়ের হাড় একটা ভেঙ্গেছে অপারেশনও লাগবে, সাথে প্রচুর রক্ত পড়ছে… পেশেন্টকে দ্রুত স্যালাইন আর রক্ত দিতে হবে।
অপারেশনের কথায় প্রীতি ভয়ে কান্না জুড়ে দিলো। আদিত্যও কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে… শ্রাবণের মনে হলো ওদের কারোর মাথাই ঠিকমতো কাজ করছে না, ওকেই সব সামলাতে হবে।
শ্রাবন আর শান্তনুই দৌড়াদৌড়ি করে আদিত্যকে দিয়ে সব কাগজে সই করিয়ে কাউন্টারে গিয়ে টাকা পয়সা জমা দিয়ে দিলো।
” আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ, আমার মাথাই কাজ করছিলো না কিছুক্ষন, ” আদিত্য একটা চেয়ার পেয়ে তাতে হেলান দিয়ে বসলো। ওর শরীর আর চলছে না, ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে।
“আপনি আমার জন্য এরচেয়ে অনেক বেশি কিছু করেছেন আদিত্য, সেই তুলনায় এটা কোন কিছুই না।”
” আমি আপনাদের নিজের আত্মীয় মনে করে করি… ওটা কোন ঋন ছিলোনা শ্রাবনদা। ”
” আমিও ঋনশোধের উদ্দেশ্যে এগুলো করিনি আদিত্য, আপনারাও আমার আত্মীয় হন, তাই ধন্যবাদ দিবেন না প্লিজ।”
“ওগো শুনছো.. ”
আচমকা প্রীতির ডাকে চমকে উঠে ওরা।
” কি হয়েছে? ” আদিত্য সোজা হয়ে বসে, খারাপ কিছু নাতো?
” দেখো সুমনদি কেমন পাগলের মতো করছে, তুমি একটু এদিকে এসো না।”
” সুমো পাগলের মতো করছে মানে! সুমো কোথায়?” শ্রাবণ অবাক হয়। এতোক্ষণ তো এখানেই বসে ছিলো সুমো ও যখন টাকা জমা দিচ্ছিলো আদিত্যকে সাথে নিয়ে।
আদিত্য, প্রীতিকে ইশারায় না বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই প্রীতি বলে বসে, ” সুমনদি ওখানে, ও ঘরে।”
শ্রাবণ এক কোনের একটা ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখতে পায় সুমন ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
” সুমো… কি ব্যাপার, কি হয়েছে? তুই এখানে কেন? ”
” শ্রাবনদা…..” সুমনের কন্ঠ কেমন অসহায় শোনায় অনেক অনেকদিন পর।
” হ্যাঁ….” শ্রাবণ ভড়কে যায়, শ্রাবনদা!
“আমার রক্ত ওর সাথে মিলেনি… জানো? ”
শ্রাবণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুমনের কথার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু সব ধোয়াশা লাগে ওর। পরে মনে হয় সুমন, আষাঢ়ের মাসি হয়… রক্তের সম্পর্ক, কষ্ট লাগাটাই স্বাভাবিক।
” সুমো এতে কান্নার কিছু নেই বোকা মেয়ে, তোর মিলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আদিত্য, প্রীতি ওদের কারো সাথে মিলবে তো নিশ্চিত,” শ্রাবন, সুমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মেয়েটা যতোই ভাব ধরুক আসলে এখনো মনে মনে বাচ্চাই রয়ে গেছে।
” ওদের সাথে মিলবে কিনা জানিনা, কিন্তু তোমার সাথে মিলবে আমি জানি, তুমি ওকে বাঁচাবে প্লিজ,” সুমন আকুতিভরা চোখে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কথাটা শ্রাবণের সামনের উজ্জ্বল আলোটাকে ধীরে ধীরে ঘোলাটে করতে করতে একদম অন্ধকারে ঢেকে দিতে থাকে। সুমোর এ কথার মানে কি? এতো লোক থাকতে ওর সাথে মিলবে কেন?
এই কেনর উত্তর সহসা আসে না, তারপর এক সময় সম্ভাবনাগুলো শ্রাবণের চোখে আঙ্গুল তুলে তুলে অনেক কিছু আজ ওর কানে বলে দিতে থাকে।তোমার পরিনীতা -৪৬ ( শেষ পর্ব)
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
“শ্রাবনদা একটু এদিকে আসবেন,” আদিত্যর ডাকে হুশ হলো শ্রাবণের। তা না হলে বোধহয় ঘন্টা কেটে যেতো ওর আজ এখানেই।
” অ্যা…?” বিভ্রান্তের মতো এলোমেলো চাহনিতে আদিত্যর দিকে তাকায় শ্রাবণ।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে এখনো ও। সুমনের কথাগুলো ওর সামনের পৃথিবীকে পুরো পাল্টে দিয়ে গেছে। এখন সব জগাখিচুরি হয়ে থাকা ঘটনাগুলো কিভাবে যেন দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যাচ্ছে আপনা আপনি।
“একটু এদিকে আসুন। ”
শ্রাবণ উঠে আদিত্যর পিছে পিছে ছোট একটা ঘরে যেতেই এক লোক এসে হাফ সিরিঞ্জ রক্ত নিয়ে ওদের রুমের বাইরের বেঞ্চে গিয়ে বসতে বলে।
” কতো সময় লাগবে আদিত্য? রক্ত নিলে তারপর আপারেশন শুরু হবে তাই না? ” নিস্তেজ সুরে প্রশ্ন করে শ্রাবণ। ঠিক সময়ে রক্ত না পেলে ছেলেটা হয়তো ওর বাঁচবে না। অজান্তেই ঢোক গিলে শ্রাবণ। ছেলেটা তার শেষ পর্যন্ত বাঁচবে তো?
” হ্যাঁ, আপনি চিন্তা করবেন না ডাক্তার আসতে আসতে সব রেডি হয়ে যাবে। ”
“আদিত্য…”
“বলুন… শ্রাবনদা।”
” ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবোনা, কিন্তু আপনি কি সত্যি রক্ত মাংস দিয়ে তৈরি? ” শ্রাবণ যেন এই প্রথম আদিত্যকে দেখছে, নতুন করে।
“যে মেয়েটাকে আপনি বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন তার পেটে আরেক লোকের সন্তান জেনেও আপনি তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, তার বোনকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিয়ে করছেন… তারপর তার সন্তানকেও নিজের পিতৃপরিচয় দিয়েছেন। এটা কিভাবে সম্ভব? ”
আদিত্য বেশ অনেকটা সময় নেয়। মৃদু হেসে নিজেকেই কিছু বলে তারপর মাথা নাড়ে,” না শ্রাবনদা… আপনি যতো সহজে কথাগুলো বলছেন ব্যাপারটা এতো সহজও ছিলো না। সুমনদি প্রেগনেন্ট এই জিনিসটা আমি প্রথম জানতে পারি বিয়ের মন্ডপে উঠে। আসলে সুমনদি না চাইলেও বিয়েটা হতো কিন্তু ওই উপরে আছে না একজন… যে সব কলকাঠি নাড়ে সে আসলে চায়নি আর এখানেই আপনি সিক্সারটা মেরেছেন। ওনাকে আগে থেকেই নিজের দলে সেট করে রেখেছেন। একেবারে মন্দিরে যেয়ে বিয়ে সেরে ফেলেছেন শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে আর কথায় আছে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তো যেই কিনা আমার চোখ আপনার স্ত্রীর উপর পড়লো আমি তাতে ঘন কালো এক মেঘ দেখলাম আর তার খানিক পরেই উনি জায়গায় জ্ঞান হারালেন। বিয়ের কনে অজ্ঞান হলে এমনিতেই কথার ঝড় উঠে তারমধ্যে আমার আবার যৌথ পরিবার।”
“সুমো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো? ” শ্রাবণ বিচলিত কন্ঠে জানতে চায়।
” হ্যাঁ, বেচারি এতো স্ট্রেস আর নিতে পারেনি। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিলো।”
” তারপর?” শ্রাবণ উদ্বেগের সাথে জানতে চায়।
“তারপর আর কি? ডাক্তার এসে আমাকে আড়ালে ডেকে পুরো ঘটনাটা শুনতে চান। আমি শুনে সুমনকে জিজ্ঞেস করতেই উনি সব আমাকে খুলে বলেন। বিয়েতে যে তার মত নেই, কোনকালেই ছিলো না, কেবলমাত্র আমার শ্বশুরবাড়ির মান সম্মানের কথা ভেবে রাজি হয়েছিলেন সেটাও বলেন, তারপর আমাকে পারলে পায়ে ধরে অনুরোধ করতে থাকেন আমি যেন প্রীতিকে বিয়ে করি। প্রীতি ওনার মতো খারাপ মেয়ে না, প্রীতিকে বিয়ে করলে আমি সুখে থাকবো। আমার তখন কি ভীষন এক মানসিক অবস্থা। ”
কথাগুলো বলে আদিত্য একা একাই হাসতে থাকে অপ্রকৃতস্থর মতো।
” আদিত্য আমি.. আমি বুঝতে পারছি।”
” না শ্রাবনদা আপনি বুঝতে পারছেন না, আপনি কোনদিন বুঝতে পারবেনও না আর আমি সেটা চাইও না। আসলে আপনি খুব কপাল করে এসেছেন পৃথিবীতে, সেটা জানেন তো? তা না হলে এতো ভুলভাল করেও সোনার ছড়িটা আপনার হাতেই আবার কিভাবে ফেরত গেলো? ”
“আদিত্য.. আমি.. ”
” দেখুন শ্রাবনদা… ভুলচুক যা করার আপনারা দুজন মিলে করলেন আর ছেলে আমি হারাচ্ছি।”
আদিত্যর কথায় অসন্তোষের স্পষ্ট ঝংকার ফুটে ওঠে, ছেলেকে সত্যিই খুব ভালোবাসে সে।
“আদিত্য… আমি.. আমি…আমার,” শ্রাবণ খেই হারিয়ে ফেলে, সত্যিই তো ওদের ছেলেমানুষির খেসারত বাচ্চাটাকে দিতে হতো যদি আদিত্য সেই সময় বাবার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করতো।
” আমি জানি আপনি করবেন শ্রাবনদা, আপনি ওর বাবা.. আপনি করবেন না তো কে করবে বলুন? ” বলতে বলতে আদিত্যর কন্ঠটা বুজে আসে।
শ্রাবণ অশ্রুসজল চোখে আদিত্যকে দেখতে থাকে। সত্যি কি ও আষাঢ়ের বাবা হওয়ার যোগ্য? কেবল রক্তের সম্পর্কের জোরেই কি কারো বাবা হওয়া যায়?
সুমন পাগলের মতো প্রীতির কোলের উপর মাথা রেখে বেডের একপাশে শুয়েছিলো। ওকে কেবিনে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা, অপারেশন থিয়েটারের সামনে থাকতে দেয়নি,অথচ ছেলেটা কখন বের হবে… সুমন অস্থির হয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে অঞ্জনা দেবী আর নির্মলাও চলে আসলেন। অনিন্দিতা এতেটা সময় বাবা- মা কাউকে দেখতে না পেয়ে কান্না জুড়ে দিচ্ছিলো বারবার। কিন্তু হাসপাতালে এসে বড়ো ছেলের কাছে যে কাহিনী শুনলেন, তাতে সেখানেই নির্মলার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো। আষাঢ় তাহলে তার বংশধর, চৌধুরী বাড়ির ছেলে!
আর সে নিজের বাড়ি ছেড়ে কতোদূরে মানুষ হচ্ছিলো!
যদিও প্রীতি আর আদিত্য আষাঢ়ের কোন অনাদর করেনি, ভালোবাসারও কমতি রাখেনি তারপরও নিজের রক্তের টান আলাদা কিছু… দুশ্চিন্তা চারগুন হয়ে গেলো নির্মলার মুহূর্তের মধ্যে।
পুরো অপারেশনের সময়টায় আদিত্য আর শ্রাবণ দুজনের কেউই এক সেকেন্ডের জন্য অপারেশন থিয়েটারের সামনে থেকে নড়লো না। ছোট একটা স্টীলের হাতলওয়ালা একটা চেয়ার রাখা তাতে নির্মলাকে বসতে দেয়া হলো। পুরো অপারেশন শেষ করতে দুই ঘন্টা লেগে গেল প্রায়। ডাক্তার যখন ওটি থেকে বেরিয়ে এলেো শ্রাবণের পা দুটো ততক্ষণে বিশ্রাম চাইছে কিন্তু ওর মনের অপরাধের ভার যে আরো বেশি।
………………………
” প্রীতি, ও আমাকে আজ মেরে ফেলবে দেখিস কিন্তু তুইতো জানিস আমার আর কোন উপায় ছিলো না,” সুমন, প্রীতির কোলে মুখ গুঁজে দেয়।
” বালাই ষাট, শ্রাবনদা অমন কিচ্ছু করবেনা আর করলে আমি এখনো আছি সুমনদি। শ্রাবনদা তোমার গায়ে একবার হাত তুলে দেখুক, তারপর যদি শ্রাবনদাকে আমি বড়োমার হাতে মার না খাওয়াই তো আমার নামও প্রীতি না। সব কিছু কে পুতুল খেলা মনে করে সে, বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছে অথচ বাবার কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই। ”
প্রীতির কথায় সুমনের মনের অবস্থার কোন উন্নতি হয়না। শ্রাবণের হাতে মার খাওয়া বড়ো বিষয় না কিন্তু ছেলের খবর এভাবে সুমনকে দিতে হবে এটাই এখন একটা ভীষন বিপর্যয়ের ব্যাপার ওর কাছে। সাথে এখন হুট করে আষাঢ়ের জন্ম নিয়ে কে কি বলবে সেটা নিয়েও শ্রাবণের মানসিক অবস্থা সব মিলিয়ে আশেপাশের পরিবেশ সুমনকে একদম পারলে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিলো।
শ্রাবণ কেবিনে ঢুকতেই সুমন বেডের মাঝখান থেকে দেয়ালের দিকে সিটিয়ে যায়।
” কিচ্ছু হবেনা আমি বলছি তো, তুমি শক্ত থাকো,” প্রীতি ফিসফিস করে সুমনের কানে কথাগুলো বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
.
.
.
“আমি.. আমি অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে বলতে বিশ্বাস করো,” সুমন ফুঁপিয়ে উঠে। শ্রাবন ওকে ঠিক ভুল বুঝবে।
“সশশশ…,” শ্রাবন মুখে আঙ্গুল ঠেকিয়ে সুমনকে থামাতে চায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুমন তারমতো কেঁদেই চলেছে।
” সুমো আমি,” শ্রাবন অনেকটা সময় নিজেকে আটকে রেখেছিলো কিন্তু আর পারেনা। সুমনকে সজোরে আকড়ে ধরে। আর তার পরক্ষনেই সুনামির আভাস দেখা যায়।
” তুমি আমাকে না বলেই জাপানে চলে গেলে, আমি মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছি,” সুমনের কান্নার তুফান ততক্ষণে বিপদসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে, প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়ছে সমুদ্র তটের বিশালতার মাঝে। শ্রাবণ নিজেও ততক্ষণে ঝড়ের সাথে তাল মিলিয়েছে নোঙর ছেড়া মাস্তুলের মতো।
দুজনেরই অব্যাক্ত অনুভূতিগুলো লাভার মতো স্রোত তুলে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে থাকে। আসলে অনুভূতিগুলোর আর দোষ কি? খাঁচায় বন্দী থেকে থেকে ওদের বাঁচার রঙ আর সাধ দুটোই লোপ পেয়ে যাচ্ছিল যে।
” আমি জানো সেই বিয়ের দিন একবার মনে করেছিলাম বিষ খাই, কিন্তু ছেলেটা তখন পেটে আর আমি বিষ খেলে মামার অনেক বদনাম হতো, প্রীতিকে নিয়ে মানুষ নানা কথা বলতো, ওর সহজে বিয়ে হতো না। আমি আর অকৃতজ্ঞ হতে পারছিলাম না জানো , তাই বউ সেজে মন্ডপে উঠেছিলাম কিন্তু সত্যি বিয়ে হলে আমি বোধহয় এমনি মরে যেতাম।”
সুমনের কথায় আমূলে কেঁপে উঠে শ্রাবণ। ওর একটু ভুল ওদের জীবনকে কতোটা পালটে দিয়েছে। ওর একটু ভুল বোঝা ওর নিজের সন্তানকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসেছে। ঠিক ওই সময়ে আদিত্য যদি ওদের আশ্রয়টা না দিতো? সুমো আর আষাঢ় তাহলে কোথায় থাকতো? ভাবতেই আবার হোঁচট খায় শ্রাবণ, নিজেকে বড্ডো ঘৃণা হয়।
” সুমো আমি… আমার আসলে কথা বলার কোন জায়গা নেই। আমার ইগো আমাকে এতোটা অন্ধ করে দিয়েছিলো যে আমি জাপানে যেয়ে মোবাইল ই খুলিনি যেটায় মেসেঞ্জার ছিলো। আর যখন খুলেছি তখন তুই মেসেজ গুলো সব মুছে দিয়ে আমায় ভালো থাকতে বলেছিলি। আমার মাথায় আগুন চড়ে গিয়েছিলো।”
” আর কি লিখতাম বলো, তুমি তো আমার মুখই দেখতে চাইছিলে না।”
কথাগুলো তিতো হলেও প্রচন্ড সত্যি।
” কিন্তু তুই আমায় মাকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসার পর এড়াচ্ছিলি কেন? আমার তো সেইজন্য খুব অভিমান হয়েছিলো তোর উপর। আর.. আর আমি তোর স্বামী আমি তোকে ছুঁতে পারবোনা কেন… কতোগুলো দিন অপেক্ষা করেছিলাম জানিস? ”
” আমি.. , “সুমন চুপ হয়ে যায়। নিজের শ্বশুরকে এতোকাল বাদে তার ছেলের চোখে ছোট করে কি হবে? কারনটা আজ যদি শ্রাবণ বিশ্বাসও করে, শাশুড়ির কান অব্দি পৌছালে তিনি কতো দুঃখই না পাবেন। সুমনের বুকটা মুচড়ে ওঠে। না ওদের দুঃখ দিয়ে ওর কোনদিন সুখে থাকা হবেনা। বড়োমা ওকে অসম্ভব ভালোবাসেন, তার স্বামীকে ছোট করার দুঃসাহস ওর নেই। তারচেয়ে অন্যকিছু বলা ভালো। কিন্তু সেই অন্যকিছুটা কি বলবে ও যা শ্রাবণ বিশ্বাস করে নিবে, সুমন হাতড়ে মরতে থাকে।
“তুই আমাকে তখন ওরকম না এড়ালে আমি হয়তো তোকে ভুল বুঝতামনা সুমো,তুই.. তুই আর কোনদিন আমাকে ওভাবে এড়াবি না। দরকার হলে সামনে বলবি, ঝগড়া করবি নিজের অধিকার আদায়ের জন্য… আগের মতো কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে রাখবি না, কক্ষোনা না।”
“না আর গুটিয়ে রাখবো না তো, সেই প্রয়োজন মিটে গেছে” সুমন যেন নিজেই নিজেকে কথাগুলো শোনায়। কিন্তু গত ছয়টা বছর ওর দিনগুলো কি নিদারুন অন্ধকারে ছেয়ে ছিলো, তার হিসেব ওকে কে দেবে?
………………………………..
অনিন্দিতাকে বুকে নিয়ে সুমনের অস্থিরতা যেনো আরো বাড়ে। ছেলেটা এখনো ওষুধের কারনে ঘুমে, সুমনের কেমন সবসময় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। আগে ও আষাঢ়ের মাসি সেজে থাকলেও কাছে থাকতো কিন্তু এখন থাকেই দূরে। নিজের স্বার্থে আষাঢ়কে এভাবে প্রীতি আর আদিত্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে স্বার্থপরের মতো, আষাঢ় জানতে পারলে কখনোই হয়তো ওকে ক্ষমা করবেনা।
শ্রাবন যতোই আষাঢ়কে দেখছিলো ততো বুকের উপর চাপটা বাড়ছিলো। কাল আর আজের মধ্যে কি ভীষন পার্থক্য। কাল যেখানে আষাঢ়কে, সুমনের বেশি প্রাধান্য দেয়া দেখে শ্রাবণের ভীষন বিরক্ত লাগছিলো আজ তার কয়েকশ গুন বেশি টেনশন হচ্ছে ছেলেটাকে এমন ভাবে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে। ছেলে ঘুমের মধ্যে একটু নড়লেই ওর মনে হচ্ছে স্যালাইনের লাইনটা খুলে পড়বে না তো? ডাক্তার হাড়টা ভালো করে জুড়েছে তো, আষাঢ় আবার আগের মতো দৌড়াবে তো? এই বুকের কাছে গুমড়ে ওঠা অনুভূতি নিয়ে শ্রাবণ কোন কিছু করেই শান্তি পাচ্ছিলো না।
থেকে থেকে খারাপ চিন্তা গুলোও পাগলের মতো ঘিরে ধরছিলো শ্রাবনকে। ওদের পাড়াতেই শম্ভু বলে এক ভিখিরি আছে, ও বেচারা ছোট থেকেই এমন ল্যাংড়া। শ্রাবণ ওকে কোনদিন হাটতে দেখেনি, রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে।
তাই সুমন যখন ওর দিকে অসহায় হয়ে তাকাচ্ছিলো, শ্রাবণ আরো অসহায় বোধ করছিলো। এমন মুহুর্তের মুখোমুখি শ্রাবণ হয়নি এর আগে, অনিন্দিতাকে নিয়ে শ্রাবণের একলার দুশ্চিন্তাটাই বরাবর বেশি ছিলো।
আষাঢ়ের মৃদু মা ডাকটা ওদের কানে আসে পরের দিন ভোর বেলা। আনন্দ আর কান্নার হিড়িক একসাথে পড়ে যায় কেবিনের ভিতরে। পরে নার্স এসে জোর করে কেবিন খালি করতে বলে। শেষ পর্যন্ত একদম অল্প দু,একজন থাকার অনুমতি দেয় ডাক্তার।
পুরো দেড়টা মাস শ্রাবণের দৌড়ঝাঁপ করতে করতে কেটে যায়। বৌ, ছেলে- মেয়ে এক জায়গায়, ওকে কাজের জন্য ছুটতে হয়েছে আরেক জায়গায়। শেষ পর্যন্ত যখন সুমনদের বাড়ি নিয়ে আসতে গেলো শ্রাবণ তখন অলিখিতোভাবেই আদিত্যর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না।
অবস্থা এমন শ্রাবণ নিজেও কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলো না। কিন্তু আষাঢ়কে ছেড়ে থাকাও এখন আর ওর পক্ষে সম্ভব না, সুমনতো পারবেই না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আশ্চর্য জিনিসটা সুমনই করলো। সবার সামনে বলে বসলো, আষাঢ়কে ওরা সাথে করে নিয়ে আসবে না। আষাঢ় যেমন এতোদিন আদিত্যর ছেলে হয়ে ছিলো তেমনি থাকবে। কেবল ওরা মাঝেমাঝে আষাঢ়কে এসে দেখে যাবে।
শ্রাবণ কি বলবে ভেবে পেলোনা। কস্ট হচ্ছিলো খুব কিন্তু সুমনের কথার উপর এখানে বোধহয় ওর আর কথা চলেনা। ওই যে কেবল জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়না তেমন। সত্যিই তো আদিত্য আর প্রীতি প্রকৃত অর্থেই আষাঢ়ের বাবা-মা।
ট্রেনে ওরা যখন চড়লো তখনো সুমন হাসিমুখেই আষাঢ়কে বিদায় জানায়, শ্রাবণ তখনও স্বার্থপরের মতো আষাঢ়কে সাথে নিয়েই আসতে চাইছিলো। কিন্তু সুমনের মুখের হাসি অটল হয়ে ছিলো পর্বত চূড়ার শ্বেতশুভ্র বরফের মতো, তাতে একফোঁটা মলিনতার ছিটেফোঁটাও ছিলো না।
.
.
.
” তোমার আমার উপর খুব রাগ হচ্ছে নাগো ? ” সুমন ট্রেনের বার্থে বসে শ্রাবণের কাঁধে মাথা রাখে।
“নাহ, তুই যা ভালো মনে করেছিস তাই করেছিস। তবে হ্যাঁ, আমি আমার ছেলেকে সাথে করেই নিয়ে আসতে চেয়ে ছিলাম। ”
“আদিত্য আর আষাঢ় দুজনেই কষ্ট পেতো, প্রীতিও।”
” আর তুই? তোর কষ্ট হচ্ছে না? ”
” হচ্ছে, কিন্তু এখন আমার আষাঢ় আর অসহায় বলে কারো আশ্রয়ে নেই, এখন ও আর কারো দয়ায় মানুষ হচ্ছে না। এখন ও আদিত্যদের কাছে আছে কারন আদিত্য আর প্রীতি নিজে থেকে ওকে চেয়েছে আর সবচেয়ে বড়ো কথা এখন ওর জন্ম পরিচয় আছে।”
” হমম ” শ্রাবণ আলতো করে সুমনের হাতটা নিজের বুকের কাছে চেপে ধরে। সব পাওয়ায় যেমন সুখ থাকেনা, তেমনি সব হারানোতেও দুঃখ থাকতে নেই৷ মানুষ এক জনমে সব পায়না আর এটাই বাস্তব, এটাই নিয়তি।
.
.
.
” সুমো? ”
” কি? ”
” তুই আমাকে একটুও ভালোবাসিস না.. যা তুই থাক তোর ছেলে-মেয়ে নিয়ে, আমি যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাবো।”
” এ আবার কেমন কথা? ”
“এটাই কথা, তোর তো এখন আর ভয় নেই। ছেলের মা…. সম্পত্তি বেহাত হওয়ার আর কায়দা নেই। বাড়ি ঘরের অবস্থাও মন্দ না। ব্যাংকে আমার নামে যা আছে তা আর কেউ দাবীও করতে আসবেনা, কেবল আমি যতোদিন বেঁচে আছি ততোদিন ওখান থেকে থাকা খাওয়ার খরচটা একটু চলবে। বাকিটা নিশ্চিন্তে তোর ছেলে- মেয়ের জন্য থাকবে।”
কথা শেষ হতে না হতেই আহ্ করে শব্দ করে উঠে শ্রাবণ।
” উহ কি অবস্থা… ডাইনী নাকি তুই? এতো জোরে কেউ খামচি মারে? ”
” তুমি এরকম বাজে কথা বললে এরপর আমি কামড়ে দিবো,” সুমন ঠোঁট ফোলায়। ওর বুকটা কেমন মোচড় খাচ্ছে আর আরেকজন সেই নিয়ে মশকরা করছে।
” বাহ বাজে কথা কোথায় বললাম, তুই আমাকে ভালোও বাসবি না আবার মারবি এতো বড়ো অন্যায়। ছেলের মা হয়েছিস বলে কি দেমাগী বেশি হয়ে গেছিস নাকি? মনে রাখিস ছেলের বাবা কিন্তু আমি।”
” আমি কখন ছেলে নিয়ে দেমাগ করলাম বরঞ্চ তুমি বারবার ছেলে নিয়ে খোটা দিচ্ছে বার বার, যেন সব দোষ আমার একলার ছিলো।”
” তোরই তো দোষ, এই ছেলে নিয়েই না বিয়ের পর দুই বছর আর আগে চার বছর আমার সাথে কোন কথাই বলিস নি, ময়না পাখি কোথাকার।”
” তুত.. তুমি একটা শয়তান আর অসভ্য লোক। ”
” বারে ময়না পাখি ডাকলাম তাও বলিস শয়তান!”
” তুমি কি ভালোবেসে বলো? বলোতো আমি কালো বলে আর.. আর, ” সুমন তোতলাতে থাকে।
” আর.. কি? ”
” হুহ.. আমি একটু বেশি কথা বলি তাই ওরকম করে বলো,” সুমন মুখ ঝামটা দেয়। ” অসভ্য বাদুর কোথাকার।”
“তার পরও তো তোর এই অসভ্য বাদুরের সাথেই থাকা চাই।”
সুমন রেগেমেগে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু কাজের মেয়ের ডাকে তাতে ইস্তফা দেয়।
“ছোট বৌদি, বড়োমা তোমাদের ডাকছেন।”
“কেন? ”
“তা জানিনা বৌদি, বড়োমা শুধু বললেন তোমাদের দুজনকে ডাকতে। এক্ষুনি যেতে বলেছেন।”
সুমন আর শ্রাবন একরাশ কৌতুহল নিয়েই নির্মলার ঘরের দিকে ছোটে।
” আসুন শ্রাবনদা।”
ঘরের মধ্যে আদিত্য আর প্রীতিকে দেখতে পেয়ে যারপরনাই অবাক হয় শ্রাবন, আর তার পরিমান এতোটাই বেশী যে মুখের সামনে বোকার মতো বলে বসে, “আদিত্য আপনারা? ”
” হ্যাঁ, অনেক অবাক হয়েছেন জানি তারপরও আসতে হলো। আপনার ছেলেকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিতে এলাম।”
শ্রাবণ আর সুমন একজন আরেকজনের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায়।
” সেকি? ”
” জানি অনেক অবাক হচ্ছেন, কিন্তু আপনি যেদিন গেলেন তখনও সত্যিকার অর্থে আপনাকে আমার ছিনতাইকারী মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আপনারা যখন চলে আসলেন তখন থেকে আমার কেবলি মনে হতো, আপনি ওর প্রকৃত বাবা হয়ে যদি সন্তানের ভালোর জন্য ওকে ছেড়ে আসতে পারেন তবে আমি কেন না? আমিও আষাঢ়কে ভালোবাসি আর আমি ওর বাবা। আর সেজন্যই আষাঢ়কে আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে এলাম। ”
“কিন্তু আদিত্য আমরা জানি আষাঢ় আপনার কাছে অনেক ভালো থাকবে,” শ্রাবন ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলে বসে। সত্যিই আদিত্য আষাঢ়কে ওকে দিয়ে দিবে! শ্রাবণের কেমন বিশ্বাস হতে চায়না। আষাঢ়কে দেখেই শ্রাবণের বুকের মধ্যে নিয়ে পিষে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে৷
“হয়তো বাট এক সময় ওর মনে হীনমন্যতা তৈরি হবে। ও মনে করবে আপনারা ওকে ভালোবাসেন না বলে ওকে আমি মানুষ করছি। আর আজ ও ছোট কিন্তু এক সময় আষাঢ় বড়ো হবে। তখন এইসব ইমোশনের চেয়েও উত্তরাধিকার বড়ো সংশয় হয়ে দেখা দিবে। আর তখন কোন কারনে ভুল ভাবে কোন কথা ওর সামনে এলে সেটা প্রলয় ঘটাবে। আমি চাইনা এরকম কিছু হোক, আষাঢ়, ” আদিত্য দম নেয়, ” ও আপনাদের কাছেই ভালো থাকবে।”
শ্রাবণ নিঃশব্দে মাথা নাড়ে,চোখ দুটো ওর জলে ভরে গিয়েছে। কিন্তু আজ তাতে সুখেরা বড্ডো বাড়াবাড়ি করছিলো। আদিত্য যখন দু’হাতে ঠেলে আষাঢ়কে শ্রাবণের কোলে তুলে দেয়, তখন শ্রাবণ সবকিছু ঝাপসা দেখছিলো। আষাঢ়ের আনাড়ি হাতের ছোঁয়ায় সেই জলের ভার মোটেও কমছিলো না।
.
.
.
“কেমন অদ্ভুত একটা ঘ্রান না গো? ”
” হমম,” শ্রাবণ সায় দেয়।
চারদিকটা রূপালী চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিলো। আজ অনিন্দিতার প্রথম জন্মদিন ছিলো। সারাদিন অনেক খাটাখাটুনি শেষে এখন অবসর মিলেছে ওদের। তাই পিছনের টানা বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে ওরা। ছেলে-মেয়ে দুটোও বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে ওদের পিছে পিছে এসে বসেছিলো। কিন্তু নিচের দোলনচাঁপার ঝার থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে, তাতে মৃদুমন্দ বাতাস, দুটো বাচ্চাই কোলের উপর শুয়ে ঘুমে কাঁদা হয়ে গেছে।
শ্রাবণ নিচু হয়ে ছেলের চুল গুলো আবার একটু এলেমেলো করে দেয়। তারপর বুক ভরে শ্বাস নেয়। রক্তের টান কতটা সত্যি জানেনা ও তবে শ্রাবণ জীবনে এখন শান্তি খুঁজে পেয়েছে আর কোন আক্ষেপ নেই। ওর ছোট্ট মেয়েটা তখনও ঘুমের মধ্যেই ওর শার্টের বোতাম মুঠিতে পুড়ে রেখেছে।
সুমন ঘুমঘুম চোখে শ্রাবণকে দেখে। শ্রাবন আজকাল রাগেই না বলতে গেলে। সুমনের মনে হয় ওর মেয়ে হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে তার বাবা রাগতেও পারে। আনমনেই হেসে ফেলে সুমন, সেই রাগী পরপুরুষ শ্রাবনদা এতোদিনে সত্যিকার অর্থে ওর নিজের পুরুষ হয়েছে।
” কিরে হাসছিস যে, ” শ্রাবণ ঘোর লাগা চোখে জানতে চায়। আজ সুমনকে দেখে রক্তে দামামা বাজছে। কানের দুল, এলো খোঁপা, চুড়ির টুংটাং, লেপ্টানো কাজল সব অন্য কিছু বলতে চাইছে। শরীর চঞ্চল হয়।
” কিছু না, রাত অনেক হয়েছে শোবে চলো… ওদের মশা কামড়াচ্ছে। ”
“হমম.. তুই অনিকে নে, আমি আষাঢ়কে নিচ্ছি।”
মশারী গুঁজতে গুঁজতে সুমন টের পায় ওর খোঁপাটা একটানে খুলে গিয়ে পিঠে লুটিয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে সুমনের চুলের ভাঁজে ভাঁজে বকুলের গন্ধ ভেসে আসে।
” এটা কোথায় পেলে? ” সুমন দুই হাতের তোলায় নিয়ে বকুলের মালা শুঁকে, বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠে।
শ্রাবণ চাঁদের হালকা আলোতেও সেই সৌন্দর্যের অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পায়।
” যখন কেক নিয়ে ফিরছিলাম তখন কিনেছি,” শ্রাবণ ফিসফিস করে বলে উঠে। সুমন টের পায় শ্রাবণের ভারী স্বরের সাথে সাথে ক্রমশ ওর চুলের ভার বাড়ছে…. হাতের চুড়ি, কানের দুল একটা একটা করে গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
এরপর অন্ধকারে নক্ষত্রের দেখা মেলে… একটু একটু করে টুকরো আলো ছড়িয়ে পড়ে সুমনের শরীরের প্রতিটি বাঁকে।
সুমন অন্ধকারেও হাসে। রাত আরও উত্তাল হয়।
ভালোবাসা আসলে এমনই, খুব বেহায়া। হাজার ঝড়ের পরেও যেই আগের চেনা জানা পরিবেশ খুঁজে পায় অমনি বসন্তের ঝরে পড়া পাতার স্তুপের ভিতর থেকে লুকিয়ে মাথা তোলে। তারপর সেই নরম ভিতের উপর কচি কচি পাতা মেলে আবার নতুন করে লতিয়ে লতিয়ে পথ চলা শুরু করে।
সমাপ্ত ★
(জানিনা কতোটুকু কি ফুটিয়ে তুলতে পারলাম, চেষ্টা সর্বোচ্চ ছিলো। একটাই অনুরোধ যাদের ভালো লাগলো তারা অন্তত এই লেখাটির কথা নতুন পাঠকদের মাঝে ছড়িয়ে দিবেন। সহজ করে বিস্তৃত করে লেখার একটাই কারন কঠিন বলে যারা এড়িয়ে যায় তারা যেন হালকা হলেও শরৎচন্দ্রের লেখার একটা আঁচ পায়। এটুকু হলেই আমি সন্তুষ্ট।
আমার ইন্ডিয়ান বন্ধুদের কাছে মন্তব্য আশা করছি। কেমন লাগলো এটা।