অদ্ভুতুড়ে (রহস্য গল্প)
ঘুমের মধ্যে ফিসফিস করে কেউ একজন আমার সাথে কথা বলে। এই কথা বলা শুরু হয়েছে সপ্তাহ দু’য়েক আগে৷ দুই সপ্তাহের মধ্যে মোট তিনবার এরকম হয়েছে। মাঝরাতে হঠাৎই কানের কাছে এক নারীকণ্ঠ বলে উঠলো, ফাহিম রান্নাঘরের গ্যাস লিক হয়ে গেছে। শিগগিরই উঠে পড়ো নাহলে সবাই মারা পড়বে। আমি জেগে উঠে ভুত ভুত বলে চিৎকার করলাম। সাথে সাথে মা, রুবা আপু, ভাইয়া তিনজনেই ছুটে এলেন। বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন না। আমি কাঁদতে লাগলাম। রুবা আপু ধমকে বলল, ইউনিভার্সিটি তে পড়া ছেলে স্বপ্ন দেখে এমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিস! লজ্জা করে না!
আমি নিজেকে একটু ধাতস্থ করে বললাম, স্বপ্ন না। এক মেয়ে ভুত কানের কাছে এসে কী সব যেন বলল!
ভাইয়া হেসে বলল, কী বলল তোর মেয়ে ভুত?
আমি সব টা খুলে বললাম। রুবা আপু আর ভাইয়া দুজনেই আমাকে বকাবকি করলেন। মা দোয়া পড়ে মাথায় ফু দিতে দিতে বললেন কিচ্ছু হয় নি বাবা।
আমি তবুও কাঁদতে লাগলাম। রুবা আপু বললেন, সব তোর মনের ভুল। দেখবি প্রমাণ করে দেব?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। রুবা আপু বলল, চল এখনই আমার সাথে রান্নাঘরে।
অনিচ্ছাস্বত্তেও রুবা আপুর সাথে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। কিছুদূর যেতেই গ্যাসের তীব্র গন্ধে সবাই ভয় পেয়ে যায়।
এরপর থেকে সবার ধারণা আমাদের বাড়িতে পরী আছে। আর সেই পরী আমার উপর আছড় করেছে। বাবা এক হুজুরের কাছ থেকে তাবিজ কবজ নিয়ে এসে আমাকে দেয়। মা প্রতিদিন রাতে দোয়া পড়ে মাথায় ফু দেয়। প্রথম কয়েকদিন ভাইয়া আমার পাশে ঘুমিয়েছে। ঘুমিয়েছে বললে ভুল হবে, সারারাত জেগে ফোনে কথা বলেছে। তারপর আমি নিজেই বারন করে দিয়েছি।
দিন ছয়েক পর আবারও সেই একই কন্ঠস্বর বলে উঠলো, ফাহিম ফাহিম তাড়াতাড়ি রুবার ঘরে যাও। রুবা বিষ খেয়েছে।
আমি ধরফড় করে উঠে রুবা আপুর রুমের দিকে ছুটে গেলাম। এবার আর ভয়ের কথা মনে রইলো না। এবার শুধু মাথায় একটা ব্যাপার ই ছিলো যে রুবা আপু মরে যাচ্ছে। তাকে বাঁচাতে হবে।
রুবা আপুর ঘরে গিয়ে রুবা আপু বলে ডাকাডাকি করেও যখন সাড়া পাচ্ছিলাম না তখন আমি, ভাইয়া, বাবা, দারোয়ান চাচা এরা মিলে দরজা ভেঙে ফেললাম। দরজা ভেঙে দেখি রুবা আপু অচেতন হয়ে পড়ে আছে। মুখ থেকে এক ধরনের বিশ্রী পদার্থ বের হয়েছে। স্থানীয় হসপিটালে নেয়ার পর জানা গেল গাছে দেয়া ওষুধ খেয়ে রুবা আপুর ওই অবস্থা হলো।
মোটামুটি পরিবেশ শান্ত হওয়ার পর ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুই কী করে জানলি ফাহিম?
কেন জানিনা আমি সত্যি টা বলতে চাইলাম না। আমি বললাম অনেকক্ষন ধরে রুবা আপুকে ডাকছিলাম কিন্তু সাড়া পাচ্ছিলাম না তাই ভয় পেয়ে যাই।
ভাইয়াসহ বাকীরাও আমার কথা বিশ্বাস করলো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়ালো। কে এই মেয়ে! সত্যিই কী ভুত বলতে কিছু আছে!
টেকনোলজি ভুত বিশ্বাস করে না।
তাহলে কী সত্যিই জ্বীন পরী টাইপের কিছু!
আমি এই ব্যাপারে আর কাউকে কিছু বললাম না। নিজেই ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে জ্বীন সম্প্রদায় সম্পর্কে জেনে নিলাম। তবুও অস্থিরতা কমছিলো না বলে ইউনিভার্সিটি তে গিয়ে কথাগুলো ইরাকে বললাম।
ইরা আমার ইউনিভার্সিটির ক্লোজ বন্ধু। আমার কথা শুনে ইরা গম্ভীর গলায় বলল, এই কথাটা আমি ছাড়া আর কাউকে কী তুই বলেছিস?
-না।
-চল, আমার পরিচিত এক সাইক্রিয়াটিস্ট আছে। তার কাছে যাই।
ইরার কথামতো আমি সত্যিই সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে গেলাম। সাইক্রিয়াটিস্ট ভদ্রলোক বুড়ো। সে আমার সমস্যা শুনে খসখস করে কাগজে ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়ে বলল, রাতে ঘুমানোর আগে গরম দুধে মধু মিশিয়ে খাবেন।
ভদ্রলোকের আচরনে আমি হতাশ হলাম। গল্প উপন্যাসে সাইক্রিয়াটিস্ট সম্পর্কে যা পড়েছি উনি তার উল্টো।
সাইক্রিয়াটিস্ট এর দেয়া ওষুধ আমি দুদিন খেয়েছিলাম। তারপর থেকে শুধু ঘুমিয়েই দিন কাটে। এমনকি খাওয়ার টেবিলেও ভাত মুখে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে যাই।
আমার বাবা, মা, ভাইয়া ভাবলেন আমি নেশা জাতীয় দ্রব্য খেয়ে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি। শুরু হলো আমার উপর নজরদারি। ভাইয়া রাতে ঘুমাতে আসে। সারারাত জেগে ফোনে কথা বলে ভোরবেলা ঘুমিয়ে যায়।
রুবা আপু এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু তার সুইসাইড এর চেষ্টার কারণ সম্পর্কে আমি কিছু জানলাম না। তবে আন্দাজ করলাম বয়ফ্রেন্ডঘটিত কোনো ব্যাপার। রুবা আপুর বিয়ের চেষ্টা করছে বাবা, মা। রুবা আপু আমাদের বাসায় থাকে। তার মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবার বিয়ে করেছেন তাই সে বাবার সাথে থাকেন না। তার বাবাও খুব একটা খোঁজ খবর নেন না মেয়ের। কিন্তু সুইসাইড এর ঘটনার পর সবাই খুব সচেতন হয়ে যায় তার ব্যাপারে।
এরপর ঠিক আটদিন পর আবারও সেই একই কন্ঠস্বর আমাকে জানান দেয় যে দক্ষিণ পাড়ায় আগুন লেগেছে। আর লুনা একা একঘরে আটকে পড়েছে। এই লুনাও আমার সাথে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি তে পড়ে। আমার চেয়ে পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় লুনা আমার চোখের বিষ।
আবারও সেই গা ছমছমে অনুভূতি। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। আগুনের লালচে রঙ আকাশে একটু একটু ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে মানুষের মৃদু আওয়াজ।
আমি চিৎকার করে লোকজন ডাকলাম। ভাইয়া জেগে থাকায় ছুটে এলো। ভাইয়া দমকল বাহিনীকে ফোন করতে গেলে আমি বললাম, ভাইয়া লুনা একা আটকে গেছে। এখনো আগুনের টের পায় নি। ওকে বাঁচাতে হবে।
আগুনপর্ব নেভানো হলো দ্রুতই। লুনা সত্যিই ঘুমিয়ে ছিলো। আর ওর বাবা মা বাড়িতে ছিলো না। কিন্তু
সেই ঘটনার পর আমার জীবনে আধার নেমে এলো। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তুই কী করে জানলি ফাহিম?
আমি এবারও উত্তর দিতে পারলাম না। অবচেতন মন বারবার বলছিলো ফাহিম কাউকে কিছু বলিস না। আমার চুপ থাকার কারন হিসেবে সবাই ভেবে নিলো আমি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।
এই ঘটনার পর সবাই আমাকে ভয় পেতে শুরু করলো। কেউ কেউ বলে আমার সাথে জ্বীন আছে। আবার কেউ কেউ ভাবে হঠাৎই এক অদ্ভুত ক্ষমতা আমি লাভ করেছি।
আমার মা দিনরাত কাঁদে। বাবা বাড়িতে পীর, ফকির নিয়ে আসে। তারা আমাকে দেখে। পানি পড়া, মাদুলি, তাবিজ দিয়ে যায়। আর আমি মাকে খুশি করতে সেগুলো ব্যবহার করি। বাবার কড়া নির্দেশে ভাইয়া আমার ঘরে প্রতিদিন থাকতে শুরু করে। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, ভাইয়া থাকাকালীন সময় এই কন্ঠস্বর আমি শুনিনি।
এক রাতে ভাইয়া কিছু সময়ের জন্য বাথরুমে গেলে আবারও সেই ফিসফিস কন্ঠস্বর আমি শুনতে পাই। এবার আর আমি ঘুমের মধ্যে শুনিনি। জেগে ছিলাম। এই কন্ঠস্বর শোনার আগে আমি ঝুমঝুম একটা শব্দ শুনলাম। তারপর ই কানের কাছে একটা বাতাস টের পেলাম। এরপর ই সেই গা ছমছমে কন্ঠস্বর! ফাহিম বড্ড দেরী হয়ে গেছে। দুটো প্রান শেষ হয়ে গেছে। রুবা আর ওর অনাগত বাচ্চাটা মরে গেছে।
চলবে……
পর্ব-১
সাবিকুন নাহার নিপা
(পাঠকদের গঠনমূলক মন্তব্য চাই)