জাল পর্ব ১

#জাল (রহস্য গল্প)

প্রতি বছরের মতো এবারও ডিসেম্বরের ছুটিতে ঢাকায় এসেছি। হাতে কাজ নেই, সংসারের ঝামেলা নেই অফুরন্ত সময়। তাই ঘুরেফিরেই সময় কাটে। হোটেল থেকে খাবার এনে খাব আর ঘরে বসে বই পড়ে দিন কাটাবো এমন টাই ভাবছিলাম। কিন্তু সেই ভাবনায় ছেদ ঘটে এক সকালে। সকালে সবে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছি তখনই দেখলাম একটা অল্পবয়সী ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। ছেলেটা আমার চেনা কেউ না। যেহেতু দেশে প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময় অনেকদিন থাকা হয় সেহেতু কিছু বন্ধু বান্ধব জুটিয়েছি নিজের জন্যই। কিন্তু এই ছেলেটা কে তেমন চেনা পরিচিত হলো না। আমি স্বভাবসুলভ বিনয়ী হাসি দিয়ে ছেলেটার পরিচয় জানতে চাইলাম। ছেলেটা নিজের পরিচয় না দিয়ে পাগলের মতো বলল, আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।
আমি এতক্ষনে ছেলেটাকে খেয়াল করে দেখলাম। ছেলেটার বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চব্বিশ কিংবা তার একটু বেশী হবে। চুলগুলো রুক্ষ, বোঝাই যাচ্ছে যে অনেক দিন চুলে চিরুনি দেয়া হয়নি। চোখের নিচে বিশ্রি রকমের কালিও পড়েছে। আমি হাতের কাছে রাখা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললাম, আপনি কি কিছু খাবেন?
ছেলেটা এবারে ভাঙা গলায় বলল, ম্যাম আমি খুব সমস্যায় আছি। আপনার সাহায্য খুব প্রয়োজন।
-আমি সব শুনবো কিন্তু তার আগে আপনি নিজে সামলে উঠুন।
ছেলেটা এবারে পানিটুকু খেয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি আমার এক দুঃসম্পর্কের মামার কাছ থেকে আপনার ঠিকানা পেয়েছি। সে আমাকে বলেছে আপনার কাছে আসলে সব সমস্যার সমাধান হবে।
-আচ্ছা আপনার সমস্যা বলুন।
ছেলেটা এবারে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আমিও তাকে আর তাড়া দিলাম না। হয়তো নিজেকে সামলাতে সময় নিচ্ছে। আমি ছেলেটাকে সহজ করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী?
-আমার নাম সহদ। আমি এবার ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি।
-আপনার কি সমস্যা বলুন।
ছেলেটা আবারও কেমন বিব্রত হতে শুরু করলো।
আমি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, আপনি ধীরে সুস্থে ব্যাপার টা বলুন। এতো বিব্রত হবেন না।
ছেলেটা এবারে একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো। আমতা আমতা করে বলল, ১৯ দিন আগে আমার বিয়ে হয়েছে।
-বাহ! লাভ ম্যারেজ?
-হ্যাঁ আমরা ব্যাচমেট। ফ্যামিলিও তাই খুব একটা আপত্তি করে নি।
আমি খেয়াল করে দেখলাম ছেলেটা একটু একটু করে সহজ হচ্ছে ছেলেটা আবারও বলল,
-আমাদের বিয়েটা হয়েছে হুট করে। ফ্যামিলি আগে থেকে সম্পর্কের কথা জানলেও আমরা হুট করেই বিয়েটা করি।
-আচ্ছা তারপর? ফ্যামিলি কি বিয়ের খবর জানে?
-হ্যাঁ জানে। বিয়ে করার পর আমরা ফোনে জানিয়েছি।
-আচ্ছা। আপনার স্ত্রীর নাম কী?
-ওর নাম পর্না। পর্না মজুমদার।
-আচ্ছা। এখন কী সমস্যা হয়েছে আপনাদের? একদম শুরু থেকে গল্পটা বলুন।
ছেলেটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের প্রেম শুরু হয়েছিল ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই। পর্না আর আমি দুজনেই দুজনকে বুঝতাম। আমাদের মধ্যে তেমন সিরিয়াস ঝগড়াও ছিলো না। একটু আধটু মান অভিমান ছিলো, তাও সাময়িক।
-আচ্ছা তারপর?
-ফাইনাল প্রফের পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো সেদিন আমরা ব্যাচমেট রা মিলে ঠিক করলাম যে কক্সবাজার ঘুরে আসবো। সেইভাবে সবকিছু প্ল্যান ও করা হলো। যাওয়ার একদিন আগে পর্না আমাকে ফোন করে ধানমণ্ডি লেকে ডাকলো। হঠাৎই জেদ করলো বিয়ে করার জন্য। অর্থাৎ ওইদিনেই বিয়েটা হবে। ও সেভাবেই বাসা থেকে তৈরি হয়ে এসেছে। বন্ধুরা সব ঠিকঠাক করায় ওইদিন ই আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পর আমরা ফ্যামিলি কে ফোন করে সব জানালাম। সবাই খুশি হলোনা ঠিকই কিন্তু সেরকম রাগও করেনি। সব ঝামেলা মিটিয়ে পরদিন আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা হলাম।
-আচ্ছা। সমস্যা কী শুরু হয়েছে কক্সবাজার থেকে ফেরার পর?
-না। আমাদের কক্সবাজারে যাওয়াই হয় নি।
-কেন?
-কারন সেদিন গাড়িতে যাওয়ার সময় পথে একদল মানুষ গাড়ি থামিয়ে পর্নাকে তুলে নিয়ে যায়।
আমি এবার চমকে গেলাম। ছেলেটা এবারে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আমি স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর?
-পর্নাকে দুদিন পর মধুপুরের জঙ্গলে পাওয়া যায় আধমরা অবস্থায়। গ্যাং রেপ করা হয় পর্নাকে।
কথাগুলো বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল সহদ। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পর্না এখন কেমন আছে?
-জ্যান্ত লাশ যেমন থাকে তেমন।
আমি এরপর আর বলার জন্য কিছু খুঁজে পেলাম না। এমন একটা ব্যাপার যে সহদ কে আমি শান্তনাও দিতেও বিব্রতবোধ করলাম।
আমি বেশ কিছুক্ষণ পর বললাম, আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন।
সহদ বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল,ওই ঘটনার পর উনিশ দিন কেটে গেছে। পর্না হসপিটালে এখন একটু সুস্থের দিকে। কিন্তু ও কোনো কথা বলেনা, এমনকি কাঁদেও না।
-দেখুন সহদ, এতো বড় একটা ঘটনার পর সামলে উঠতে তো একটু সময় লাগবেই।
ছেলেটা আমতা আমতা করে বলল, আমার মনে হয় পর্নাকে যারা তুলে নিয়ে গেছে তাদের পর্না চেনে, কিংবা ওর পরিচিত কেউ।
-সেরকম কেন মনে হচ্ছে?
কারণ গাড়িতে পর্না ছাড়া আরও মেয়ে ছিলো। তাদের কিন্তু কিছু করেনি।
-হতে পারে। এই ব্যাপারে আপনাকে পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কেউ হেল্প করতে পারবে। আমি তো সাইক্রিয়াটিস্ট। আমার কাজ মনের রোগ সাড়ানো।
-আমি জানি। সাইক্রিয়াটিস্ট ফারজানা মাহবুব কে আমি চিনি। আমি শুধু চাই আপনি একবার পর্নার সাথে দেখা করুন। ওর মনের খবর টা জানার চেষ্টা করুন।
-দেখুন সহদ পর্না একটা যে মেন্টাল ট্রমায় আছে সেটা কেটে গেলেই ও কথা বলতে শুরু করবে। আপনারা বরং একটু অপেক্ষা করুন। মেয়েটাকে একটু সময় দিন। সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
সহদ খানিকক্ষণ কপালে হাত দিয়ে বসে রইলো। তারপর বলল, ঠিক হতে হতে এদিকে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে ম্যাম। পর্নার বাবা মা আমার নামে পুলিশে কমপ্লেইন করেছে। তাদের ধারণা আমি প্ল্যান করে সবকিছু করেছি।
এমনকি আমার সাথে থাকা প্রত্যেক টা মানুষ বলছে আমি এই কাজে যুক্ত যেকারণে পর্না কোনা কথা বলছে না।

চলবে……….
পর্ব-১
সাবিকুন নাহার নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here