জাল শেষ পর্ব

#জাল
শেষ পর্ব
পুলিশ আমাকে ওয়ার্নিং দিলো যেন আমি পর্নার কাছে না যাই। পর্নার ফ্যামিলিও আমাকে একই দোষে অভিযুক্ত করলো। আর সেই দোষ ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত সহদের ঘাড়েই পড়ল। সহদ দিশেহারা হয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, এসব কী হচ্ছে ম্যাম?
আমি আনমনেই বলে ফেললাম, মস্ত বড় এক জালে আটকানোর চেষ্টা চলছে। যেন সে জাল ছিড়ে আর বেরোনো সম্ভব না হয়।
সহদ বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। আমি স্বাভাবিক ভাবেই মাথা ঠান্ডা রাখলাম। পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বললাম। ভদ্রলোক আমাকে বিশ্বাস করলেন, সেও বললেন পর্না কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ব্যাপার টা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও খুব লেখালেখি হচ্ছে। এবার আমার মনে হলো, হাত গুটিয়ে বসে না থেকে কিছু একটা করা দরকার। এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি।

আমি বুদ্ধি করে সেদিন পর্নার বলা স্টেটমেন্ট গুলো রেকর্ড করে রেখেছিলাম। শুধু পর্নার না, এখন পর্যন্ত যার যার সাথে কথা বলেছি সবারটাই রেকর্ড করে রেখেছিলাম নিজের সুবিধার জন্য। এমন কি সহদের টাও।

পর্নার কথাগুলো আমি দুইবার শুনলাম এবং দ্বিতীয় বারে খটকা টা ধরতে পারলাম। যেটা আগে ধরতে পারিনি। খটকা টা হলো, পর্নার বন্ধু বান্ধব নিয়ে। পর্নার বাবার যেহেতু অবস্থা তেমন ভালো নয় সেহেতু পর্না ছোটবেলা থেকে কিভাবে দামী স্কুল কলেজে পড়ছে!
আর দ্বিতীয় খটকা টা হচ্ছে পর্না আর সহদের কমন ফ্রেন্ড রা! আশ্চর্য ব্যাপার এরা এতো জোর দিয়ে কিভাবে বলছে যে সব দোষ সহদের!

এরপর দুটো দিন গেল মহা ব্যস্ততার মধ্যে। সহদের সাথে এরমধ্যে একবার কথা হয়েছে। ছেলেটা অলরেডি ডিপ্রেশনে চলে গেছে। আমি শুধু ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ওর সাথে কারও ঝামেলা হয়েছে কী না, আর পর্নার সাথে সম্পর্ক কবে থেকে।
ওর উত্তর ই সব রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করলো।
—————————————————
পুলিশ পর্না আর সহদের সব কমন ফ্রেন্ড দের এরেস্ট করেছে। অবশ্য বুদ্ধিটা আমার ই। এবার পর্না, প্রবাল সহ ফ্যামিলির সবার টনক নড়ল।

সহদ অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এসব কি হচ্ছে ম্যাম?
আমি স্মিত হেসে বললাম, এতোদিন যখন অপেক্ষা করেছ তখন আরও একটু অপেক্ষা করো। ধীরে সুস্থে সব বলছি।

আমি পর্নার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, পর্না তো আপনার একমাত্র মেয়ে তাই না!
লোক টা ভীত চোখে এক পলক আমাকে দেখে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
-আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?
ভদ্রলোক এবার শুকনো ঢোক গিলল, কোনো জবাব দিলো না। আমি বুঝলাম যে এর কাছ থেকে আর কোনো উত্তর ই পাওয়া যাবে না।
আমি একটু কেশে গলার শ্লেষ্মা পরিস্কার করে বললাম, আচ্ছা গল্পটা তাহলে আমিই শুরু করি কেমন!

পর্নার বলা স্টেটমেন্ট সবাইকে শোনালাম। তারপর আমি সহদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো অসংগতি কি ঠেকেছে তোমার কাছে?
সহদের চোখে মুখে ঈষৎ বিস্ময়। আমি বললাম, আচ্ছা অসংগতি টা বলছি, পর্নার ভাষ্যমতে তার বাবার সামর্থ্য নেই তার প্রয়োজন মেটানোর। তাহলে সে ভালো, স্কুল, কলেজ, কোচিং এ পড়েছে!
পর্না যেন একদম জোঁকের মুখে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যেই চোখ মুখের রঙ পাল্টে গেল। আমি খানিকক্ষন থেমে বললাম, পর্নার বাবার টাকা পয়সার অভাব নেই। খুব সম্ভবত ব্যাংকে তার অর্ধ কোটির সমান টাকা আছে, তাই না পর্না!

সহদ অবাক গলায় বলল, কি বলছেন এসব?
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, বলছি। পর্নার বাবার বিজনেস যেটা তুমি আমি দেখছি সেটা আসলে নামের বিজনেস। বহু বছর আগে বাপ দাদার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে সেটাকে এখন বড় অংকের টাকায় রুপান্তর করা হয়েছে তাই নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পর্নার টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। সে তার বাবার একমাত্র মেয়ে তাই সব ই তার। তাহলে পর্নার বলা ওই কথা টা মিথ্যে সেটাতে সন্দেহ নেই। এবার আসি হিমেলের গল্পটার ব্যাপারে, আসলে পর্না পাকা খিলাড়ি হলেও নার্ভাসনেসের জন্য ধরা পড়ে গেছে। বলা যায় ধৈর্য কম এইজন্যও ধরা পড়েছে। হসপিটালের বেডে দিনের পর দিন শুয়ে থেকে ফলের রস খেতে খেতে মুখটা কেমন পানসে হয়ে গেছিলো ওর। তাই মায়ের কাছে পিঠে খাওয়ার বায়না ধরে। আর সেখান থেকেই আমার কাছে ধরা পড়ে যায়। বুদ্ধিমতি পর্না ব্যাপার টা ঠিক সামলে উঠতে পারে নি। তাতক্ষনিক বুদ্ধি বের করে হিমেলের গল্পটা বানায়। আর প্রবাল কে দেখে মুখভঙ্গি বদলে ফেলাও তার পুর্বের পরিকল্পনা।
সহদ অবাক গলায় বলল, কিন্তু ও কেন এসব করছে?
-বলছি। এই সব কিছুই করেছে তোমাকে ফাসানোর উদ্দেশ্যে।
-আমাকে!
-হ্যাঁ। এই পুরো খেলার আসল খেলোয়াড় অন্য কেউ। যে পর্নাকে দিয়ে খেলাটা খেলাচ্ছে। না আসলে খেলাটা পর্না খুশি মনেই খেলছে।
সহদ অধৈর্য হয়ে বলল, আপনি প্লিজ সব টা খুলে বলুন।
আমি এবার পর্নার দিকে তাকালাম। পর্না ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, সহদ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় পিয়াস নামে একটা ছেলের সাথে ঝামেলা হয়েছিল?
-হ্যাঁ। কিন্তু তার সাথে এসবের সম্পর্ক কি?
-পিয়াস ছেলেটা বলেছিল তোমাকে দেখে নেবে। আর সেই দেখে নেয়ার জন্যই এতোকিছু। পর্না আর পিয়াস তখন সবেমাত্র সম্পর্ক শুরু করেছে। তখনই তোমার সাথে ঝামেলা, যার জন্য কলেজ থেকে পিয়াস কে ওয়ার্ন ও করা হয়। পিয়াস সেটা মেনে নিতে পারেনি, পারেনি পর্নাও মেনে নিতে। এরপর শুরু হয় তাদের প্ল্যান। তোমাকে প্রেমের জালে ফাসানো হয় কৌশলে। পর্নার দিক থেকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট তুখর অভিনয় চলছিলো। কিন্তু ব্যাপার টা হলো, একসময় পর্না তোমার প্রেমে পড়ে গেল। বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে গেল।
এদিকে পিয়াস ততদিনে আরও ডেস্পারেট হয়ে উঠেছিল। ওর প্ল্যান ছিলো ফাইনাল প্রফের আগে তোমাকে একটা মানসিক ধাক্কা দেয়া, আর সেই প্ল্যান অনুযায়ী পর্না প্রেগন্যান্ট ও হলো। কিন্তু এখানে সমস্যা সৃষ্টি করলো পর্না নিজেই। সে তোমাকে ভালোবাসে তাই এবোর্শন করিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
এইটুকু বলে আমি পর্নার দিকে তাকালাম। পর্না নিঃশব্দে কাঁদছে।

এর পরের অংশ ছিলো পর্নার কল্পনার বাইরে। পিয়াসের সাথে বহু ঝামেলার পর একটু স্বস্তির নিশ্বাস নেয়ার জন্য সকলের সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করে। সেখানেও জাল বিছিয়ে রাখা হয়, তবে এবারের জাল তোমার সাথে সাথে পর্নার জন্যও।
তোমাদের কমন বন্ধুদের সাথে প্ল্যান পরিকল্পনা করে পর্নাকে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পর্না যে ওইদিন ই বিয়ে করবে সেটা সকলের ভাবনায় ও আসেনি। যাইহোক তারা প্ল্যান চেঞ্জ করে নি। প্ল্যান মতো পর্নাকে তুলে নেয়া হয়, এবং তোমার উপর দোষ চাপানোর জন্য ফ্যামিলির উপর চাপ দেয়া হয়।
সহদ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলো। পর্নার মা আর বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে। আর পর্না একটু পর পর কান্নার দমকে কেঁপে ওঠে।
আর এই পুরো ব্যাপারটায় প্রবালও সাহায্য করলো।
তোমার বন্ধুরা যখন জোর গলায় বলছিলো, তারা তোমাকে সন্দেহ করে। তখন আমার মনে হয় নি কিন্তু আচমকাই মাথায় এলো, তুমি তো ওখানে ওদের সাথে ছিলে তাহলে এতো টা জোর কিভাবে দিচ্ছে!!
তারপর আর একটু খবর নিয়ে জানলাম যে ওইদিন খোঁজাখুজির পর্নাকে না পেয়ে পরদিন ফিরে এসে তারা ধানমন্ডির এক রেস্টুরেন্টে কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছে।

আর পর্নাকে রাগে, জেদে রেপ করেছে পিয়াস। সে পুলিশের কাছে এমনই স্টেটমেন্ট দিয়েছে। ভিডিও বানিয়ে পর্নাকে চাপ দেয়া হয় খেলার বাকী অংশ টা শেষ করতে।

এখন বাদবাকি পদক্ষেপ যা নেয়ার তুমি বুঝে নিও। আমার কাজ আপাতত শেষ। সহদ কোনো কথা বলল না। সে দু’হাতে নিজের মাথা চেপে বসে আছে। আমি ওই অবস্থায় রেখেই চলে এলাম।

সপ্তাহ খানেক পর একদিন সহদ আমার কাছে আসলো আমার পেমেন্ট টা দিতে। আমি হেসে বললাম,
-আমি তো কোনো রোগ সারাই নি!
সহদ হেসে বলল, রহস্য তো উদঘাটন করলেন। আমি খেয়াল করে দেখলাম ছেলেটার হাসি নিঃষ্পাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-এবার কী করবে?
-আপাতত বিসিএস এর জন্য পড়বো।
-আমি পর্নার কথা জানতে চেয়েছি?
একটু চুপ করে থেকে বলল, কিছুদিন আলাদা থেকে দেখি যদি একান্ত সম্ভব ই না হয় তবে না হয় ভেবে দেখব।
আমি হাসলাম, কিছু বললাম না। আমি জানি শেষ পর্যন্ত এরা একসাথেই থাকবে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here