তবুও তোমায় ভালোবাসি পর্ব ১৮

#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আচঁল নিপা
#পর্ব-১৮/সারপ্রাইজ পর্ব

(নোট- শেষ পর্ব ১০ তারিখ রাত ৮ টায় দেবো।)

জাহিন সাহেবের দিকে তাকাতেই উনি মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। নিমিষেই একটা অবিশ্বাসের ছায়া চোখ থেকে সরে গেল। নিস্তব পথ দিয়ে যখন হাঁটতেছিলাম তখনও মনে হাজারটা সংশয় ছিল জাহিন সাহেবকে নিয়ে। অজানা একটা ভয় যেন তখন ঘিরে ধরেছিল। মনে হচ্ছিল জাহিন সাহেবকে বিশ্বাস করে আমি ভুল করছি না তো। তবে সে অবিশ্বাসের চাদরটা সরে গেল জাহিন সাহেবের কান্ড দেখে। এত বড় সারপ্রাইজ যে পাব সেটা আশাও করতে পারিনি। লক্ষ্য করলাম অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চা বেলুন নিয়ে এসে আমার দিকে দৌঁড়ে আসছে। সবগুলো ছোট বাচ্চা আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমার দিকে কেউ বেলুন এগিয়ে দিচ্ছে কেউ ফুল। অসম্ভব ভালো লাগার একটা মুহূর্ত তৈরী হয়েছিল। আমি অবাক চোখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে উনার দিকে তাকালাম আর শান্ত গলায় বললাম

– এত বাচ্চা কোথায় পেয়েছেন?

উনি হালকা হেসে বলল

– এটা একটা ইয়াতিমখানা।এখানে অনেক বাচ্চায় আছে।

– হুট করে এত বড় সারপ্রাইজ কেন দিলেন? এটা কী আগে থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলেন?

– সারপ্রাইজ তো পরিকল্পনা করেই দেওয়া হয়। আমার খুব ইচ্ছা হলো আপনাকে একটা সুন্দর দিন উপহার দেই। তাই ছোটখাট সারপ্রাইজটা দিলাম। এখানের বাচ্চাদের সাথে থাকলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। আমি যখনেই সময় পাই এখানে চলে আসি। এদের সাথে কথা বলি সময় কাটাই।আমার কাছে তখন ঐ সময়টা সবচেয়ে বেস্ট মনে হয়।

– এখানে আসেন কতদিন যাবত?

– অনেকদিন হবে। স্টুডেন্ট অবস্থায় টাকা জমিয়ে এখানের বাচ্চাদের জন্য চকলেট আনতাম। সত্যি বলতে এ কাজগুলো মনে প্রশান্তি দেয়। এখন চাকুরি পাওয়ার পর কিছু অংশ এ বাচ্চাদের জন্য বরাদ্ধ রেখেছি। আপনি কিন্তু মাঝে মাঝে আমার সাথে এসে এদের সাথে দেখা করতে পারেন।

আমি হালকা গলায় বললাম

– অবশ্যই আসব।

সেদিন পুরোটা দিন বাচ্চাদের সাথে কাটিয়েছিলাম। মাকে কল দিয়ে বলে দিয়েছিলাম ফিরতে দেরি হবে। এতটা ভালো সময় ছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। দুপুরে বাচ্চাদের সাথে বসেই খেলাম। ফেরার সময় সবগুলো বাচ্চা এসে ঘিরে ধরেছিল। কত মায়া এ বাচ্চাগুলোর মধ্যে। কত অল্প সময়েই আমাকে আপন করে নিয়েছে। সবগুলো বাচ্চার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় আসার জন্য রওনা দিলাম। একটা রিকশা ভাড়া করে পড়ন্ত বিকেলে হালকা মৃদুমগ্ন বাতাস উপভোগ করে বাসায় আসলাম। বাসায় আসার সাথে সাথে জাহিন সাহেব বলে উঠল

– এখনও তো সন্ধ্যা হতে বাকি। চলুন একটু ছাদে যাওয়া যাক। দুজন একসাথে নাহয় আকাশ দেখব।

আমি জাহিন সাহেবের কথায় দ্বিমত করলাম না। উনাকে নিয়ে চলে গেলাম ছাদে। এর মধ্যে জাহিন সাহেব হাঁটু ঘেরে একটা ফুল নিয়ে বলল

– আপনাকে অনেকদিন যাবত একটা কথা বলতে চেয়েও পারিনি। আমি আপনাকে ভালোবাসি। কথাটা জানিনা কতটা আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য তবে আমি সত্যিই আপনাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি।

জাহিন সাহেব যখন আমাকে কথাটা বলল আমার শরীরটা কেঁপে উঠল। চোখে জল ছলছল করছিল। হালকা রাগী চোখে তাকিয়ে কোনো কথা না বলেই ছাদ থেকে চলে আসলাম। কারন আমি জাহিন সাহেবকে সবসময় ভালো একজন বন্ধু ভেবে এসেছি। আর আমার অবস্থাও দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। এখন জাহিন সাহেবের এমন আবেগে আমাকে সাড়া দিলে হবে না। জাহিন সাহেবকে ভালো লাগে তবে উনার পাগলামিতে সায় দিয়ে আমি পাগলামি বাড়াতে পারব না। এসব ভেবে ঘরে এসে বেলকনিতে দাঁড়ালাম। ছন্নছাড়া মনটা আজকে অনেক বেশি বেপোয়ারা হয়ে গেছে। আয়ানকেও কেন জানি খুব বেশি মনে পড়ছে। একদিকে এতকিছুর পরও আয়ানকে ভুলে থাকতে পারলেও পুরোপুরি ভুলতে পারেনি অন্যদিকে জাহিন সাহেব। কেন জানি না এসব ভেবে চোখ দিয়ে উপচে জল পড়ছে। ঠিক তখনই মা আমার পাশে এসে দাঁড়াল। মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখটা মুছে নিলাম। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

– কী হয়েছে মা এত বিমর্ষ কেন?

– তেমন কিছুই না মা।

– আমাকে বল হালকা লাগবে।

– সত্যিই তেমন কিছু না।আচ্ছা মা আমার অপারেশনের ডেট টা কবে?

মা কন্ঠটা ভারী করে ভাঙ্গা গলায় জাবাব দিল

– আর পনেরদিন পর। কেন রে মা?

– নাহ মা এমনি। আচ্ছা মা আমার কিছু হলে কী তোমার খুব বেশি খারাপ লাগবে?

কথাটা শোনে মায়ের চোখের জল যেন গড়গড়িয়ে পড়ছে আমাকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে বলল

– আমার মেয়েটার কিছুই হবে না। মা রে তুই এমন বলিস না।

আমিও ঢেকুর তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললাম

– মা আমিও তোমার বুকে এভাবে থাকতে চাই।

বলেই মাকে কতক্ষণ জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের হয়তো নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তাই মা আমাকে বেলকনিতে রেখে রুমে চলে গেল। এর মধ্যেই জাহিন সাহেবের বোন আনিসার আগমণ ঘটল। আনিসা আসতেই আমি আমার চোখের জল মুছায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আর আনিসা হুট করে কেন আসলো সেটাও ভাবতে লাগলাম। এর আগে আনিসা কখনো আসেনি। সেই যে কথা হয়েছিল এরপর আনিসার সাথে তেমন কথা হয়ে উঠেনি। আনিসা ঠিক আমার পাশে দাঁড়াল তারপর বলল

– একটা কথা বলব

– কী বলতে চাও বলো।

– ভাইয়াকে কেন ফিরিয়ে দিলে?

– সবকিছু চাইলেও জড়িয়ে নেওয়া যায় না আনিসা।

– তোমাকে ভাইয়া অনেক ভালোবাসে। আমার ভাইটা আজকে কষ্ট পাচ্ছে। তবে তুমি তাকে গ্রহণ করোনি তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে না। কষ্ট পাচ্ছে তুমি কষ্ট পেয়েছ এটা ভেবে।

বলেই আনিসা চলে গেল। সারারাত আমি জাহিন সাহেবের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে উঠেই বেলকনিতে গিয়ে দেখলাম জাহিন সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। দেরি না করেই ছুটে গেলাম উনার কাছে। উনি ভাঙ্গা সুরে বলল

– আপনাকে কী আমি খুব বেশি কষ্ট দিয়েছি? আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে দুঃখিত।

– কষ্ট দেননি। তবে আমি সময় চাই নিজের জন্য। এক সম্পর্ক শেষ করার সাথে সাথে আরেকটাতে জড়িয়ে যেতে পারব না। আর পনের দিন পর অপারেশন। যা চিন্তা করার এরপর করব। আপাতত আমার জন্য অপেক্ষা করুন।সুস্থ হয়েই নাহয় পথচলার সাথী হব।

জাহিন সাহেব আমার কথাটা শোনে পুলকিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– আপনি সুস্থ হন আগে। আমাকে গ্রহন করুন বা না করুন তাতে আমার কোনো কষ্ট নেই। আপনি সুস্থ আর হাসিখুশি থাকলেই আমি খুশি।

এক কথায় দুই কথায় যেন সে কথার বাঁক টা ছুটে চলে হাজার কথায়। আস্তে আস্তে দিন পেরিয়ে যাচ্ছে।জাহিন সাহেবের সাথে বন্ধুত্বটা আরও ভালো হয়েছে। পনের দিন পার করেছি বেশ আনন্দে। সবচেয়ে ভালো সময় বলা যায়। সময় করে সে ইয়াতিম খানায় যেতাম জাহিন সাহেবের সাথে একটু কথা বলতাম। পরিবারকে সময় দিতাম। নিজের যত্ন নিতাম। বেশ ভালোই কেটেছিল এ পনের দিন।

কালকে আমার অপারেশন জানি না সে অপারেশনে আমি বাঁচব কিনা।কেন জানিনা আয়ানকে বড্ড মনে পড়ছে। এর আগে আয়ানের সাথে পথে ঘাটে দেখা হলেও গত পনেরদিন আয়ানের কোনো দেখায় পায়নি। কেন জানি না এ পনেরদিনে মাঝে মাঝে মনে হত আয়ানের কিছু হয়নি তো। তবুও নিজেকে সামলে নিতাম। আজকে কেন জানি না আয়ানকেই খুব মনে পড়ছে। মনে মনে ভাবছি এত দিনের ভালোবাসা কী সত্যিই আমি ভুলতে পেরেছি। হয়তো না। প্রথম ভালোবাসা সত্যিই ভুলা যায় না। আজকে আয়ানকে কেন জানি না বড্ড চিঠি লিখতে মন চাচ্ছে। তাই ডায়রিটা বের করে শেষ চিঠিটা আয়ানকে লিখলাম

প্রিয়তম

প্রতিটা ক্ষণে প্রতিটা স্পন্দনে প্রতিটা মুহুর্তে না চাইতেও তোমার কথা মনে পড়ে। আমার কেন জানি না মনে হয় তুমি আমাকে ঠকাতে পারো না।জানি না এটা আমার ভুল বা মিথ্যা ধারণা কিনা। কত অভিমান জমিয়ে রেখেছি ক্ষণে ক্ষণে এটা ভেবে যে তুমি এসে আমার অভিমান ভাঙ্গাবে।আজকে কেন জানি না তোমার কথা ভেবে ব্যকুল মনটা তোমাকে দেখতে চাচ্ছে।আচ্ছা আমি মরে গেলে তুমি আসবে তো আমাকে দেখতে? তখন আরশিকে নিয়ে এসো।আরশি পড়ে থাকবে লাল বেনারশি আর আমি মুড়িয়ে থাকব সাদা কাফন। কেন জানি না এত কিছুর পরও
#তবুও ভালোবাসি তোমায়।

হাসপাতালের করিডোরে বসে আয়রার ডায়রিটা পড়ে শেষ করল আনিসা। অপারেশন থিয়েটারে এখনো আয়রার অপারেশন হচ্ছে। জাহিন সাহেব করিডোরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চোখের জল ফেলছে। আয়রার মা পাথর হয়ে বসে আছে। আনিসার মনে আয়ানের প্রতি তীব্র ক্ষোভ জাগল।ভাবতে লাগল একটা মেয়ে শেষ স্পন্দন পর্যন্ত তার কথা ভেবে এসেছে সে কীভাবে পারল এমন ঘৃন্য একটা কাজ করতে। সত্যিই দুনিয়াটা বড়ই অদ্ভুত কেউ ভালোবাসা পায় না কেউ ভালোবাসার মূল্য বুঝে না। এর মধ্যেই ডাক্তার আসলো। সবাই উৎসুক চোখে তাকাল ডাক্তারের দিকে আয়রার খবর জানতে।

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here