এখানে কোন বৃষ্টি নেই পর্ব ১

গল্পঃ এখানে কোনো বৃষ্টি নেই….
ইন্টারমিডিয়েটর পর অামার যখন প্রথমবার মেডিক্যাল কলেজে চান্স পাওয়া হলোনা। তখন বাবা ঠিক করলেন এবার কোচিং ঢাকায় হবে। ঢাকার বিউটি পার্লারের সাঁজ অার ঢাকার কোচিং দিনকে রাত করতে পারে। সুতরাং এইবার চলো ঢাকায়। ঢাকায় অামার থাকার জায়গা হলো, বাবার বিজনেস পার্টনারের বোনের বাসায়।
কিন্তু এই বাসায় এসে অামার মাথা পুরোই ঘাটা ডাল হয়ে গেলো। এই বাড়ির কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন নেই। যে যার মত খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। একদল কাজের লোক নিজের মত করে কাজ করছে। কারও প্রতি কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ কোনো নিয়ম মানছে না।
এর মধ্যে প্রতিদিন সকালে অামার ঘুম ভাঙ্গে প্রচন্ড মিউজিকের শব্দে। যেমন তেমন মিউজিক না। হাইবিট সং!
অাওয়াজে অামার ঘরের জানালার গ্রিল পর্যন্ত কাঁপে। এতে পড়াশোনা কি করে সম্ভব??
একদিন ভয়ে ভয়ে অামি অান্টিকে বললাম,
———অান্টি সকালে যে এত জোরে গান হয়, অাপনাদের অসুবিধে হয় না???
তিনি অত্যন্ত অবাক হয়ে বললেন,
——–কেনো তোমার অসুবিধা হয়???
———না না অান্টি; অামার কিসের অসুবিধা?? এমনিই বললাম।
——-পরী, তুমি তো নিচের দখিন ঘরটায় থাকছো?? তাই না??
——–জি।
——-ওহো… তোমার ঘরটা তো অভির ঘরের নিচ বরাবর, এজন্যই বেশি সাউন্ড পাচ্ছো! ও অাসলে মিউজিক না বাজিয়ে জিম করতে পারেনা।অামি অভিকে বলে দেবো।
ওকে??
———জি অাচ্ছা!
অান্টি উনার ছেলেকে কি বললেন, অামি জানিনা, কারণ মিউজিকের সাউন্ডের কোনো হেরফের হলোনা।বরং টাইম ডিউরেশন বেরে গেলো। সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটা!
অামি অার কিছু বলতে গেলাম না। হুহ…..
একদিন রাতে, অামি খেতে বসেছি, একটু লেইট নাইট। সবার খাওয়া শেষ তখন। অামি সন্ধ্যার পর শুয়েছিলাম একটু ; রাতে পড়বো বলে….
সেই শোয়াতেই রাত দুটো।
…. ওভেনে তরকারি দিয়ে ওয়েট করছি।
এমন সময় কেউ এলো, উপরের ঘর থেকে। হাফপ্যান্ট পড়া, খালি গায়ে মাথায় হ্যাট, অাবার পায়ে মোজা, স্যান্ডেলের সাথে।ছেলেটার গেটঅাপ দেখে অামার হাসি পেয়ে গেলো!
কিন্তু সে এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
——–ভাত অাছে, বুয়া??
অামি থতমত খেয়ে বললাম,
———জি… অাছে।
——-তরকারি কি?? পাবদামাছের ঝোলফোল হলে অামি কিন্তু খাবোনা।এই বাড়িতে তো অাবার বারো মাস পাবদামাছ।
বিফের কোনো প্রিপারেশান অাছে??
অামি তাড়াতাড়ি তরকারির বাটি চ্যাক করে নিলাম। মাংসের একটা বাটি অাছে অবশ্য!
———জি অাছে।
ছেলেটি প্লেট ভাজ করে নিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো,
——–বুয়া…. অামাদের বাড়িতে কি কোনো মেয়েটেয়ে এসে থাকছে?? থাকে যদি বলবেন, সে যাতে কাল সকালেই আমার সাথে দেখা করে! ওকে???
——–জি অাচ্ছা।
———অাপনি খেয়েছেন বুয়া??
অামি জবাব না দিয়ে সামনে থেকে সড়ে গেলাম।
ছেলেটা মুখে ভাত দিয়েই থু
করে ফেলে দিলো।
——-এটা বিফ নাকি??? মাটনকে কেউ বিফ বলে?? ওয়াক থু…
বুয়া, অাপনাকে অামি কতদিন বলেছি, ডোন্ট টেল মি লাই।
তারপর সে ভাতের পাতে পানি ঢেলে দিয়ে
উঠে গেলো।
সেদিন থেকে অামি মহচিন্তায় পড়ে গেলাম, অামাকে বুয়ার মত দেখতে…..?? কি সর্বনাশ???
তারপর একদিন অামি কোচিং থেকে ফিরছি,
সবাই লাঞ্চে বসে গেছে, অামাকে দেখেই অান্টি বললেন,
———পরে ঘরে যেও পরী, অাগে বসো, খেয়ে নাও! অাজকে সব থাই ফুড হয়েছে!
সেই ছেলেটাও বসেছে খেতে, তবে অাজ মাথায় হ্যাট নেই, কি চমৎকার ঝাকড়া চুল মাথাভর্তি! অামি অারেকটা জিনিস বেশ ভালো করে লক্ষ্য করলাম, ছেলেটার চোখের মণি গাঢ় কালো অারো লালচের মাঝামাঝি। অন্যরকম ভীষণ সুন্দর দেখতে।
অামি ব্যাগটা রেখে বসলাম টেবিলে, খাওয়ার জন্য নয়। ওই চোখদুটো দেখতে। এমন দেবে থাকা গভীর ক্লান্ত চোখ অামি দেখিনি কখনো। ছেলেটা তখনি কথা বললো,
——–তোমার নাম কি পরী নাকি???
অামি জবাব দিলাম না। বুয়া ডাকবার চূড়ান্ত অপমান তো ভুলিনি অামি। কথা বলার প্রশ্নই অাসেনা।
অান্টি বললেন,
——-পরী, এর নিকনেইম। ভালোনাম অাফসানা চৌধুরী।
তারপর অামার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
তবে
সাদা ফ্রক পড়ে তুমি যখন খালি পায়ে ছাদে হাটো, অামার মনে হয় ছাদে সত্যি সত্যিই একটা পরী নেমে এসেছে। শুধু জুতোটা নেই বলে, সে পায়ের তলায় ব্যাথা পেয়ে একটু পরপর মুখ কুঁচকে ফেলছে।
অামি লজ্জা পেয়ে গেলাম।
ছেলেটা অাবারো কথা বললো,
(এবার থেকে অার ছেলেটা বলবো না, তাঁর নাম অভিক, ইন শর্ট অভি)
———-অামার মিউজিকে কি তোমার সমস্যা হয় পরী???
অামি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
অান্টি বললেন,
———অফকোর্স সমস্যা হয়! দ্রিম দ্রিম শব্দ করলে তো অার বেচারি পড়াশোনা করতে পারে না। সেকেন্ড টাইম মেডিকেল কলেজের জন্য ট্রাই করছে। এবার তো ও’র লাস্ট চান্স….
———-শোনো মা, যার ডাক্তার হওয়ার কথা, সে এমনিতেই ডাক্তার হবে।অামার মিউজিক তাঁকে অাটকে রাখবেনা। অার অত ভালো হলে ফার্স্টটাইমে হয়নি কেনো??? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেনো অামি ও’র ডাক্তার হওয়া অাটকে দিচ্ছি।
অামার খাওয়া অাটকে গেলো। কথা অাটকে গেলো। অামি সেই মুহূর্তটা জানি, পৃথিবীতে সেদিন সবচেয়ে বেশি কষ্ট অামি পেয়েছিলাম। অামার পড়াশোনা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য?? সেই অজানা অার অল্প পরিচয়ের সেই ঠান্ডা চোখের ছেলেটা অামার ভেতর ভেঙে গুড়িয়ে দিলো যেনো! অামি জানিনা, কেনো তাঁর কথায় পৃথিবীর সব মার্কস লুকিয়ে ছিলো???
তারপরের থেকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। সকালের মিউজিক বন্ধ! অামার খুব কৌতূহল হলো, অামি অভির ঘরে যাই, গিয়ে দেখি, সে কি করে ওই সকালের সময়টা???? কিন্তু সাহস হলোনা। বরং দোতলা ডিঙিয়ে ছাঁদে যাবার সময় অামার বুকের ভেতরটা দ্রিম দ্রিম করতো। এরকম হাতুড়ি পেটা অনুভূতি কেনো যে হতো????
(চলবে)
লেখিকা: তৃধা আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here