এখানে কোন বৃষ্টি নেই পর্ব ২

গল্পঃ এখানে কোনো বৃষ্টি নেই
পর্ব ০২
গানটা বন্ধ হবার পর অস্থিরতায়
অভির ঘরে একদিন সাহস করে অামি সত্যি সত্যিই ঢুকে পড়লাম। অভি ঘরে ছিলোনা। বেরিয়েছিলো।
মোটামুটি গোছগাছ ঘর। এত্ত বড় একটা মিউজিক সিস্টেম। সাউন্ড বক্সগুলো প্রায় অামার সমান। অামি সেগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। বেডসাইডের পুরো দেয়ালটা জুড়ে চার্লি চ্যাপলিন। অারেকপাশের পুরো দেয়ালটা জুড়ে বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম। দরজার এপাশটায়, মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত বিশাল বুকশেলফ। রিডিং টেবিলের উপরে তাঁর নিজের একটা ছবি, চার্লি চ্যাপলিনের মতো মাথায় হ্যাট পড়ে। এত সুন্দর ঝাঁকরা চুল যার সে কেনো হ্যাট পড়ে??
অামার মনে হলো, এই ঘরের প্রতিটি জিনিসে অভির ছোঁয়া অাছে। অামি ও’র বিছানায় গড়াগড়ি খেলাম। টেবিলে রাখা ও’র ডেইলি ডায়েরি ঘাটলাম।এবং ঠিক করলাম, অাজ থেকে ও’ওর ডেইলি নোটে যা লিখবে, অামিও দেখে দেখে তা লিখবো। কিন্তু কেনো লিখবো?? এই কেনোর উত্তর অামি জানতাম তখন, তবে অাবছা অাবছা, কিন্তু ব্যাখ্যাটা এখনের মত অতটাও স্পষ্ট ছিলোনা।
ব্যাখ্যাটা স্পষ্ট হলে বোধহয় তখনকার ওই মুহূর্তটা এত ভালো লাগতো না।
সেই তখন, অামার দৈনন্দিন কাজে অারেকটা জিনিস যোগ হলো, প্রতিদিন লুকিয়ে অভির ঘরে গিয়ে, ও’র ডেইলি নোট দেখে এসে সেটা নিজের ডায়েরিতে লিখে ফেলা।
একদিন নীলক্ষেতে অামি বই কিনতে গেছি। ঢাকাকে এত ভালো করে চিনিনি তখন। বইয়ের দোকানে বই ঘাটছি, হুট করে পেছন থেকে কেউ অামার মাথায় টোকা মেরে বললো,
——– ওঁই পরী! পরীস্থানে কি লাইব্রেরি নেই???
অামি ঘুরে তাকালাম। অভি।
———বই কিনছো নাকি??
——–হুঁ।
——–ক’টা কিনলে??
অামি হাতের ব্যাগ বাড়িয়ে দেখালাম।
অভি সেখান থেকে একটা বই তুলে নিয়ে বললো,
——–এটা কতো??
———চারশ টাকা। এরা অামায় থার্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে দিলো।
——–বাহ্! তুমি তো বেশ দরদাম করে বইও কিনতে পারো! কাম উইথ মি! অাই হ্যাভ সামথিং ভেরি ইন্টারেস্টিং টু শো ইউ!
অভি অামার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।ফুটপাতে। এই সেইম বইটাই সে সেখানের একটা দোকানে দরদাম করে কিনলো দুইশত ত্রিশ টাকায়!
অামি লজ্জা পেয়ে জিভ কাটলাম।
———-তোমাকে অামি ঢাকার কেনাকাটা শিখিয়ে দেবো, পরী! এখানে যা কিনবে, সবসময় দোকানী যা চাইবে, তিনভাগের একভাগ দাম বলবে। সেটা অফ সিজনে, অার অন্যসময় দোকানী যে দাম চাইবে, তাঁর তিনভাগের দুইভাগ দামে বেঁচবে এটা শিওর। সো টেকনিক্যালি ডিল ইট।
বাকী বইগুলো অভি অামার সাথে ঘুরে ঘুরে কিনে দিলো।
——–কিছু খাবে পরী???
এখানে অামার পরিচিত একটা দোকানে খুব ভালো চটপটি হয়!
অামি নিজে চটপটি খেলাম না। নিয়ে ঘাটাঘাটি করলাম।
মুগ্ধ হয়ে
অভির খাওয়া দেখলাম।
হুট করেই অভি বললো,
———তোমার পড়াশোনা ভালো হচ্ছে তো??
———জি জি হচ্ছে।
———বি ভেরি ভেরি সিনসিয়ার। তোমার জন্য অামাকে বাসার বাইরে ঘর ভাড়া নিয়ে জিম করতে হচ্ছে।
মেডিক্যালে না হলে তো অাবার ঘ্যাঁনঘ্যাঁন করবে, পড়তে পারিনি, অভির গানের জন্য পড়তে পারিনি। এইঁ পরী, তুমি অামায় কি ডাকো বলোতো??? অভি না অভিক??
———কিছু ডাকিনা তো!
———নাম ধরে ডাকবে না। খবরদার। ভাইয়া ডাকতে পারো। উঁহু! ভাইয়া না। বস বলবে।
——–জি অাচ্ছা!
——–প্রাকটিস নাউ, ফর ওয়ান টাইম।
———-অাপনি কি করেন বস???
———বাহ্! তুমি তো দারুণ ব্রিলিয়ান্ট! ট্রাই ওয়ান্স মোরটাইম।
——–বস, অাপনি মাথায় সব সময় কেনো হ্যাট পড়েন?? অাপনার চুল কি ভীষণ সুন্দর, বস!
অভি অামার দিকে তাঁকিয়ে হাসলো।
———তোমাকেও একটা হ্যাট কিনে দিই চলো! নাকি পরীরা হ্যাট পড়েনা?? পাখা পড়ে??
অভি অামায় একটা নীল রংয়ের হ্যাটও কিনে দিলো।
হ্যাট কিনতে গিয়ে অভির এক বন্ধুর সাথে দেখা, নাম অঞ্জন!
সে জিজ্ঞেস করলো, অামি কে??
অভি খুব স্বাভাবিক গলায় বললো
——— অারে বলেছিলাম না, ওই যে ছোটবেলায় বিয়ে করেছিলাম, অার বৌটা যক্ষ্মায় মরে গেলো, এটা অামার সেই বৌয়ের ছোটবোন! শালী…..
——–বলিস কিরে অভি, যক্ষ্মা ওয়ালীর ছোটবোন। তাহলে তো, এরও যক্ষ্মা হবে। এর যদি হয়, তাহলে তো তোরও হবে। ও মাই গড….
——–হলে হবে, (গানের গলায় সুর করে বললো) এখন চিকিৎসায় যক্ষ্মা ভালো হয়!
অামি উনার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম,
——–অাপনি কি করেন ভাইয়া??
———অভির সাথেই পড়ছি।ফিজিক্স! বেরিয়ে যাবো। সেমিস্টার শেষ অবশ্য।
——–বাব্বা, ফিজিক্স! এত কঠিন সাবজেক্ট কি করে পড়েন বলুনতো?? অামি তো ফিজিক্সই সবচেয়ে কম পারি। অামার তো মনে হয় অামি যদি অাবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিই,,ফিজিক্সে নির্ঘাত ফেইল করবো। ফিজিক্স তো অামার কাছে একটা দুঃস্বপ্ন!
এর মাঝে অভি বললো, ——–অঞ্জন
তুই পরীর সাথে দাঁড়া একটু,অামি গাড়িটা নিয়ে অাসি; ওদিকে পার্ক করেছিলাম ।
অামাকে সেই বন্ধুর সাথে দাঁড় করিয়ে দিয়ে অভি গাড়ি অানতে চলে গেলো। সেই যে দাঁড়িয়ে আছি তো অাছিই। অঞ্জন, বারবার অভিকে ফোন ট্রাই করলো। অভির ফোন বন্ধ। অামি চিন্তায় পড়ে গেলাম। অভি হারিয়ে যায়নি তো?? এত ভিড় ঢাকা শহরে।
প্রায় দু-ঘন্টা ওয়েট করার পর, অঞ্জন অামায় বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলো।
অামি ততক্ষণে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেছি। ভালো মানুষ, সুস্থ মানুষ, গাড়ি অানতে গিয়ে এভাবে কেনো হাওয়া হয়ে গেলো??
বাসায় ফিরে দেখি, ড্রয়িংরুমের সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে অভি
ঘুমোচ্ছে।
অামার রাগে গা কিরকির করতে লাগলো। অামি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। অভিকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোললাম।
———অাপনি অামায় ওখানে ফেলে এসে, নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন!
অাশ্চর্য মানুষ তো অাপনি।
অভি হাই তুলতে তুলতে বললো,
———অামি ফেলে এসেছি মানে কি??তুমি তো একাই গিয়েছিলে বই কিনতে। সেখানে শুধু অামাদের দেখা হয়ে গিয়েছিল।
——– মানে কি??? অাপনিই না, অামাকে অাপনার বন্ধুর সাথে দাঁড় করিয়ে এলেন??
——–ওহো! তাই নাকি?? দাঁড় করিয়ে ছিলাম নাকি??
তো?? অামাদের কি একসাথে ফেরার কথা ছিলো??
রাগে-দুঃখে অামার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো! এত অভদ্র অার উদাসীন একটা লোক হয় কি করে???
অামি দৌড়ে ছুটে ঘরে এলাম।৷বিছানায় হাউমাউ করে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। শয়তান, নিষ্ঠুর লোক একটা। ছাগলাপাঠা, গরুবলদ! অামি তাঁর জন্য কত্ত টেনশন করে মরে গেলাম অার সে????
অার কোনোদিন কথা বলবোনা, তাঁর সাথে! কোনোদিন লিখবোনা তাঁর ডায়েরি।
রাগ চূড়ান্ত হলেও অামার ডায়েরি লিখা থামলো না।
এর মাঝে একদিন, অামি কোচিং-এ বেরুচ্ছি। দেখি অঞ্জন এসেছে।
অামাকে দেখেই ডাকলো,
———বেরুচ্ছ পরী! কোচিংএ কি মডেল টেস্ট চলছে নাকি?? কত করে স্কোর হচ্ছে?? এবার হবে তো মেডিক্যালে???
———স্কোর সেভেন্টি পার্সেন্ট! তবে কয়েকটা তো সেই জিনিয়াস। নাইন্টিপার্সেন্ট করে কাটছে। অামার যে কি হবেনা অঞ্জন ভাই???
——–অারে সেভেন্টি পার্সেন্ট কিন্তু খারাপ না।হয়ে যাবে দেখো। অাচ্ছা, কোনটায় কম হচ্ছে???
অামাদের কথার মাঝেই অভি নামলো নিচে। এই কিছুদিনে অভির সাথে অামার একদম দেখা হয়নি।দেখা হবার প্রতিটা চান্স ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেছি অামি।অভি খাওয়ার জন্য নিচে নামলে অামি দরজা অাটকে তাতে পিঠ ঠেকে দাঁড়িয়ে থেকেছি। অভির বের হবার অাগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছি। ও’ফিরবার অাগেই রুমে ঢুকে একা বসেছি। সেদিনের সব অভিমান পাথর চেপেছিল বুকে।
অাজ হঠাৎ অভিকে দেখে চমকে গেলাম অামি। চোখদুটো যেনো অারো চমৎকার হয়ে গেছে, এই কটা দিনে। ডিপ ব্লু-ফরমাল ওয়ারে এত ভালো দেখাচ্ছিল, অামার মনে হচ্ছিলো ওই মুখটার দিকে হাজার বছর তাঁকিয়ে থাকতে পারি আমি।
মনে মনে বলছিলাম, অাপনি ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুন তো একটু। দেখি অামি। কয়েকটা ছবি তুলে নিই। কখন অাবার হারিয়ে যান!
অভিই কথা বললো অাগে,
———অঞ্জনকে বলতে পারো তো পরী!! কোনটায় উইক তুমি! ও এসে তো প্রতিদিন তোমায় দেখিয়ে দিতে পারে!
অামার এতদিনের রাগে ঘি পড়লো অাবার! দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো ভেতরটা।
অভিকে অগ্রাহ্য করে অামি বললাম
———অাসলে অঞ্জন ভাইয়া, কোচিং এ এত এত চাপ যে, এক্সট্রা টিউশান নেয়ার টাইম-ই যে….
অভি অাবার কথা বললো,
———তাতে কি হয়েছে পরী?? যখন যখন তুমি সময় পাবে, অঞ্জনকে একটা ফোন করে নেবে, ব্যস। ও’ এসে শুধু সে সময়টা দেখিয়ে যাবে!
অামার পিত্তি জ্বলে ওঠলো। তিনি নিজেও তো ফিজিক্স বিশারদ! এতদিন ধরে উনার বাসায় থাকছি, উনি নিজে কেনো দেখাচ্ছেন না?? হুহ…..
অঞ্জন হেসে বললো,
———সেটা তো তুই ও পরীকে দেখাতে পারিস অভি।
———অারে ধুর! এত টাইম কই অামার??ইদানীং তো অামার গান শোনাটাও ঠিকঠাক হচ্ছে না। বাইরে গিয়ে গান শুনছি।
স্পষ্ট অামাকে খোঁচা।
———অাচ্ছা, তুই সময় না পেলে অামিই অাসবো। ওহো…. তুমিও তো যাবে পরী তাইনা??? চলো, একসাথে বেরোই অামরা।
অঞ্জনকে অভিই থামালো,
———হু,… বেরোবো একসাথে?? লোকে বলবে তিনভাই একসাথে বেরিয়েছে!
পরী যেরকম শার্ট পরে বেরোয় না, যাস্ট হরিবল। অামি একা যাচ্ছি। অঞ্জন তুই বরং ও’কে নিয়ে অায়….
তারপর অামার কাছে এসে খুব কাছে এসে, যেনো অঞ্জন শুনতে না পায়, এমনভাবে বললো,
হ্যাটটা কোথায়?? হ্যাড টপে একটা খোঁপা করে চুলটা ঢুকিয়ে নিলেই তো পারো, একবারে ছেলে হয়ে গেলে ব্যস!
(চলবে)
লেখিকা: তৃধা আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here