#মাতোয়ারা
#পর্ব_৮
হাসপাতাল থেকে ফিরে ইরিন বাড়িতে এসে মায়ের সাথে প্রথম যে কথাটা বললো তা হলো,
—আমি কি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে একঘরে থাকবো?
মা তো ভীষণ আশ্চর্য!
—স্বামী-স্ত্রী আলাদা কেন থাকবে? আবার ভাইয়া ডাকছো…?
—না মানে, বিয়েটা সেরকম মজবুত ভাবে হয়নি তো… আন্টি। দুজনকেই চাপে পড়ে গোল খেতে হয়েছে। তাই জিজ্ঞেস করছি। ডিসিশন নিয়ে দেখি দু’জনেরই একটা সেকেন্ড থটে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা?
—মজবুত ভাবে বিয়ে হয়নি মানে কি? দরকার পড়লে আবার বিয়ে হবে৷
মা সেই রাতে আমাদের আবার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
আমার মেজাজ তখন আকাশ-পাতাল। সেই ঘরোয়া বিয়েতে মা আমার মায়ের দিকের আত্মীয়স্বজনদের ডাকলেন।
সবার মাঝখানে বসে আমি আর ইরিন আবার বিয়ে করলাম।
বিয়ের সময় ইরিন এত জোরে কবুল বললো যে, আমি চমকে উঠে তাঁর দিকে তাঁকালাম। ইশারায় বুঝাতে চাইলাম, এত জোরে কবুল বলা ঠিক হয়নি।
লাল শাড়িতে রাগী রাগী মুখ করে সেও তাঁকালো। তাঁর চোখের ভাষা জবাবে বলছিলো, নেরে পাঠা কবুল নে, কবুল নিয়ে শান্তি হ….
ইরিনের বাবাও এসেছিলেন বিয়েতে। আমার হাত ধরে মিনতি করে বললেন,
—মেয়েটা যেনো পড়াশোনাটা চালিয়ে যায়।
আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে বললাম,
—ওর পড়াশোনা, ও করবে। আমার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করার কি আছে?
ইরিন গম্ভীর জ্ঞানীর মত বললো,
—এসব বলতে হয়। এসব বলে বলে মেয়ের জামাইকে মেয়ের অথরিটি বানিয়ে দেয়া হয়। একঘরে তো আর স্বামী-স্ত্রী থাকে না। থাকে বস আর এমপ্লয়ি। এই যে আমার পড়াশোনার দায়িত্ব এখন সুড়সুড় করে আপনার ঘাড়ে চলে গেলো। আমি কিন্তু এখন সব টিউশনি ছেড়ে দেবো।
আমি কড়া করে ধমক দিলাম।
—কোনো টিউশনি ফিউশনি ছাড়া যাবে না। বিয়ের আগে যেভাবে সব মেনেজ করেছো, সেভাবেই সব করবে তুমি। বিয়ে করেছো বলেই এখন তুমি বাস, রিক্সা ফেলে আমার গাড়ি পাবে না।
ইরিন তাতে যেনো উৎসাহ পেলো খুব।
—আমি সব আগের মতই করবো?
—হুঁ করবে। তোমার সব দায়িত্ব তোমার। আমার সব দায়িত্ব আমার। ব্যস…..
ইরিন মহানন্দে দু-গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাঁকিয়ে থেকে বললো,
—রাতে কি আমরা এক বিছানায় ঘুমোবো? মানে একসাথে ঘুমোলে যদি কিছু ঘটে যায়? এসব ঘটলে নাকি মন থেকে মায়া পড়ে যায় খুব… তখন নাকি সম্পর্কটা রিয়েল হয়ে যায়।
—কি ঘটবে?
ইরিন অন্যদিকে তাঁকিয়ে বললো,
—আমি বলবো কেন? আপনি সব আমাকে দিয়ে বলাতে চাচ্ছেন তো… হবে না! আমি আর কিছু বলবো না।
রাতে একসাথে ঘুমোতে হবে ভেবে আমারই গলা শুকিয়ে আসছিলো তখন।
ইরিন ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হাঁটতে মহানন্দে আমার ঘরে শিফ্ট করে গেলো।
বারবার বলতে লাগলো,
—আমাদের বিশাল বাড়ি, তারপরও আমাদের দুজনকে কেনো একই ঘরে থাকতে হবে? আমার একটা আলাদা ঘর হলে কত ভালো ছিলো।
—আমাদের বাড়ি মানে? তোমার কখন হলো?
—বিয়ে হয়ে গেলে স্বামীর বাড়িকে আমাদের বাড়ি বলতে হয়… এটা নিয়ম। আমার একটা একলা ঘর হলে খুব ভালো হয়… মেয়েদের কত পারসোনাল ব্যাপার স্যাপার আছে, আপনি তো বুঝবেন না।
আমার মেজাজ চটে গেলো।
—কি পারসোনাল ব্যাপার তোমার?
—এই যে পিরিয়ড হবে, সেই সময় আমার খুব লজ্জা করবে। এই ব্যালকনিতে ব্রা শুকাতে দিলে যদি আপনি রেগে যান? আর আমি কাপড় বদলাবো যখন, তখন?
আমি একবার বলতে চাচ্ছিলাম, তখন কে তাঁকিয়ে থাকছে তোমার দিকে? পরক্ষণেই নিজেকে সামলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম।
ইরিন যতক্ষণ আমাকে সামনে পাচ্ছে, কথা বলছে।
আমি রুম থেকে বের হবার সাথে সাথে সেও রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
—আমি কি কাল থেকেই ইউনিভার্সিটি যাবো?
—যাবে না কেন?
—মানে নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তো… সবাই কি বলবে? কাল কোথাও বেড়াতে গেলে হয় না?
—তোমার পা ভালো হোক আগে..
—আচ্ছা, আমরা কিন্তু প্রথমে চিড়িয়াখানায় যাবো। তারপর শিশুপার্ক, তারপর জাদুঘর…
—আর সংসদভবন? সেখানে যাবে না?
—ওখানে তো ঢুকতে দেয় না। দূর থেকে দেখে কি লাভ? আপনি কখনো এমপি টেমপি হলে যেতে পারতাম। আচ্ছা রাজনীতিতে আপনার অবস্থা কেমন? কখনো সংসদ সদস্য হওয়ার চান্স আছে?
আমি জবাব না দিয়ে ইরিনকে চোখ রাঙ্গালাম। ইরিন তাতেও থামলো না। বললো,
—আরে বাবা, এখনি কে হতে বলছে? আস্তে ধীরে হলেই হবে।
আমার মাথায় তখন রিয়া ঘুরছে শুধু। রিয়াকে নিয়ে ইরিন কি ভেবেছে সেটাও চিন্তা। রিয়ার মত ইরিনও কি আমাকে মেয়ে ঘাটানো ছেলে ভাবে?
রাতে ঘরে এসে দেখি ইরিন আরেকটা বিছানা পাতিয়েছে ঘরে। আমাকে দেখিয়ে তুড়ি মেড়ে বললো,
—ভালো করেছি না? এখন যে যার বিছানায় হাত-পা মেলে যত ইচ্ছে শোও বাবা। কে মানা করছে?
আমার বুক থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো।
কিন্তু ঘুমোবার সময় ইরিন আবার আমার কাছে এসে বসলো,
—আপনার কি সত্যিই অামার সাথে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না?
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম,
—না।
—একা থাকতে পারবেন?
—এতদিন তো একাই থেকেছি আমি।
—আজ আর এতদিন কি এক হলো? এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে আপনার?
—বাহ্, আমার বিয়ে হয়েছে নাকি? তুমি না বললে তো জানতেই পারতাম না।
ইরিন আমার খোঁচা বুঝতে পারলো।
গম্ভীর মুখ করে উঠে চলে গেলো এবং ঠিক সাথে সাথেই এসে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লো।
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
—আমি সাধু সন্ন্যাসী না ইরিন, আমি খুব সাধারণ মানুষ, রক্তমাংসের মানুষ। তুমি এরকম পাশে শুয়ে থাকলে… ভুল হয়ে যেতে পারে। লুস ক্যারেক্টার পদবী আছে আমার। বি কেয়ারফুল।
ইরিন বোধহয় আমার কথাটা ঠিকঠাক শুনলো না।
কারণ সে তাঁর সবুজ নাইটির বেশিরভাগটাই হাঁটুর কাছাকাছি তুলে দিয়ে তক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়লো।
আমি পাশে জেগে সিগারেট ধরালাম। আমার হাতে সিগারেট আর চোখে ইরিন নিয়ে সেই রাতে আমি এক কঠিন পরীক্ষায় পড়ে গেলাম।
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা