মাতোয়ারা পর্ব ১৮

#মাতোয়ারা
#পর্ব_১৮

সকালে ঘুম ভাঙলো গায়ের উপর ঠান্ডা পানিতে। চোখ খুলে দেখি ইরিন দাঁড়িয়ে। আমি ধমক দেবার আগেই ইরিন বললো,
—মিলি ঢাললো।
—মিলিটা কে?
হাসি হাসি মুখে ইরিনের পেছন থেকে এক কিশোরী বললো,
—আমি দুলাভাই।
ইরিন চোখ দিয়ে ইশারা করলো। বুঝলাম, তাঁর নতুন মায়ের মেয়ে।
মিলি শুধু পানি দিয়ে আমায় ভিজিয়ে থামলো না, রং গুলানো বাজে পানিও আমার মাথায় ঢাললো।
ইরিনের অবস্থা তখন মরে যাই মরে যাই। না পারছে বোনকে সামলাতে, না আমাকে।
একসময় ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো,
—মিলি, উনার সাথে আর লাগলে আমি মারবো তোকে।
আমার খুব আশ্চর্য লাগছিলো ইরিনের স্বাভাবিকতা দেখে। মনে হচ্ছিলো মিলি ওর সত্যিকারের ছোটবোন।
বাড়িতে নতুন মা, বোনকে নিয়ে তাঁর বাবা আত্মীয়রা সবাই গদগদ করছে। অথচ সে খুব স্বাভাবিক। যেনো কিছুই নতুন ঘটেনি। এই পরিবারটি তাঁর বহু আগেই ছিল। এই মিলিও। অনেক পুরানো, অনেক মিশে থাকা সম্পর্ক যেনো ওর।
দুপুরে বৌভাতে ইরিনের মায়ের বাড়ির লোকজনের সাথেও ইরিন বেশ সহজ সাবলীলই থাকলো। আর আমি সর্বক্ষণ বিব্রত। শালি নামক নতুন উপদ্রবটি আমাকে একশোরকম ভাবে জ্বালিয়ে মারছিলো।
ইরিনকে ডেকে বললাম,
—এই মিলি এত পিছু ধরেছে কেন আমার? তোমার ফুফু লাগিয়েছে নাকি?
—ফুফু কেনো বলবে? ও নিজেই আপনার পিছু নিয়েছে। আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে কিনা।
—পছন্দের নমুনা শার্টে ময়দা মাখিয়ে দেয়া?
—দুলাভাই হিসেবে নয় নিজের জন্য পছন্দ হয়েছে। দেখবেন সে আরো নমুনা দেখাবে। আপনাকে জড়িয়ে ধরে চুমু টুমু খেয়ে লাভ ইউ টিউ বলতেও পারে।
আমি খুকখুক করে কাশলাম।
—তুমি কি করে বুঝলে?
—একটু পরপর বলছে। দুলাভাই সুপার, হেব্বি সুপার! নীল পাঞ্জাবি পরে আপনাকে তার প্রিয় নায়কের নত দেখাচ্ছে ।
—বলো কি?
—হু। ওর প্রিয় নায়ক কে জানেন?

ইরিন প্রিয় নায়কের নাম বলার সুযোগ পেলো না। তাঁর আগেই মিলি কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো। দুই মুঠোভর্তি ফুল আমার কোলের উপর রেখে বললো,
—আই লাভ ইউ টুস টুস দুলাভাই।
আমি ফুল ঝারতে নিলাম। মুহূর্তেই আমার হাত আর পাঞ্জাবি আঠা হয়ে গেল।
—কি ব্যাপার?
মিলি আঙুল দাঁতে কামড়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো। এই মেয়ের তো মারাত্মক ঘটনা।
আমি ইরিনের দিকে তাঁকিয়ে বললাম,
—ফুল পাঞ্জাবিতে এমন বেঁধে গেছে কেন? হাতেও আটকে যাচ্ছে।
ইরিন উদাস গলায় বললো,
—ওর প্রেম আপনার শরীরে আঠা বেঁধে গেছে জনাব।
—ঠাট্টা করবে না ইরিন। এক মিলির ঠাট্টাতেই অস্থির আমি। এই যে পাঞ্জাবি মেখে গেছে। গ্লু ট্লু কিছু মাখিয়ে দেয় নি তো? ও মাই গড।
—এত ভয় পাবার কিছু নেই। মিষ্টির রসে ফুল চুবিয়ে দিয়ে গেছে। আপনি পাঞ্জাবি বদলে হাত ধুয়ে ফেলুন। আমি অন্য টিশার্ট বের করে দিচ্ছি।
আমি মনে মনে বললাম,
এই দুই বোন তো বাঁধিয়ে রাখার মত। একজন আমার প্রেমে মরে যাচ্ছে, আরেকজনের প্রেমে আমি মরে যাচ্ছি । উফ্।

এত ব্যস্ততায়ও ইরিন আমাকে এটেন্ড করছিলো খুব নিয়ম করে। আমি মা’কে এই পরিস্থিতিতে আসতে মানা করে দিয়েছিলাম। মা এলে ইরিনের স্বাভাবিকতা নস্ট হবে, সে মরমে মরে যাবে এই ভয় কাজ করছিলো।

বিকেলে অনুষ্ঠানের শেষে ইরিনকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—তোমার খারাপ লাগছে না ইরিন?
ইরিন তখন গোসল সেড়ে চুল ঝাড়ছে। আমার কথাটা বোধহয় শুনলো না।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
—এই যে তোমার এতদিনের বাড়ি, সম্পর্ক সবকিছু বদলে গেছে তোমার তাতে মন খারাপ হচ্ছে না?
ইরিন তোয়ালে রেখে আমার পাশে এসে বসলো। মিষ্টি করে তাঁকালো। আমি দেখলাম ব্যথায় পুড়ে যাচ্ছে তাঁর চোখ।
—আমার মা মারা যায় আমার বয়স যখন এগারো বছর। মা মারা যাবার দিনে আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আমি প্রস্রাব করতে বসেছি দেখি সব রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি ব্যাপারটা তখন কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে মায়ের লাশ নিয়ে সবাই কান্নাকাটিতে ব্যস্ত। কাউকে বলতেও পারছি না কিছু। আমি আমার অচেনা অসুখ নিয়ে ভয়ে কান্নায়, ব্যথায় অস্থির। মায়ের লাশের পাশে বসে আমি চিৎকার করে বললাম, মা আমার কিছু একটা অসুখ হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না মা। আমার ফুফু তখন আমায় সামলালেন। এতটাই সামলালেন যে মায়ের লাশ ধোয়ানোর পর মা’কে কাছে থেকে দেখতে দিলেন না। বললেন, তোর শরীর নাপাক। দোয়া কালামের মাঝখানে এই শরীরে উপস্থিত হলে গোনাহ হয়। সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই জীবনে আমার একলা ভয় পাবার দিন এসে গেছে।
আমি ইরিনের কথাগুলো কি শুনছিলাম? নাকি অন্য একটা ইরিনকে চেয়ে দেখছিলাম শুধু ।
—তারপর থেকে আমার সব সমস্যা, সব জটিলতা আমি একা সমাধান করতে চেষ্টা করতে লাগলাম।
আমার মন, শরীর, সম্পর্ক সব আমাকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছে।
—এই নতুন মা’কেও?
—নতুন মা, নতুন সম্পর্ক এই ব্যাপারটা ভীষণ সুবিধার আমার জন্য। দেখুন মা মারা যাবার পর আমার জীবনে উৎসব মানে ছিলো কাজের দিন। প্রতিটা ঈদের দিনে, বাবা আর আমাকে দুজনে মিলে রান্না করতে হতো। সবাই যখন নতুন জামা পরে অলরেডি ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। বাবা আর আমি তখন ক্ষুধার্ত পেটে রান্না করছি। পরীক্ষার দিনেও আমাকে নিজের খাবারটা রেঁধেই খেতে হয়েছে। নতুন মা এসে তো ভালই হলো বরং, এখন তো ঈদের দিনে আর আমাকে রান্না করতে হবে না।
—তুমি সত্যিই খুশি?
—খুশি না আবার অখুশিও না। আমার অনুভূতিটা আপনাকে কিভাবে যে বুঝাই? সায়েন্সের ভাষায় বললে বুঝবেন?
আমি না বুঝেও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
—ধরেন আমার বা আপনার কারো শরীরের কিছু অংশ পুড়ে গেলো। এভাবে তাঁকাবেন না, আমি মনে মনে ধরতে বলেছি। ওকে… এক্ষেত্রে বিজ্ঞান কি বলে? বিজ্ঞান বলে, মানব শরীর বা শরীরের কোনো অংশ যখন আগুন লেগে পুড়ে যায়, তখন সেই পুড়ে যাওয়া অংশের জীবাণুও পুড়ে যায়। অর্থাৎ ওই অংশ জীবাণুমুক্ত! কিন্তু আমরা সেই পোড়ায় যখন ডিমের কুসুম লেপে দিই বা লবণ দিই বা পেস্ট দিই বা অন্য কিছু। এতে করে কি হয় জানেন? জায়াগাটা বা ক্ষতটা নতুন করে কন্টামিনেট হয়। কিন্তু পোড়া ক্ষততে শুধু যেটা দেওয়া ভালো বা উচিত তা হলো পিওর রানিং ওয়াটার। নরমাল ওয়াটার।
—তো? এখানে তোমার অনুভূতি কই? আগুনে পোড়ার সাথে তোমার অনুভবের কি সম্পর্ক?
—অনুভূতি কিভাবে পুড়ে যায় জানেন? কষ্টের তাপে। আমার অনুভূতিও পুড়ে গেছে। এখন আছে জীবাণুমুক্ত অনুভব। এর জ্বালা কমাতে আমি যদি ইচ্ছে করে অন্য অনুভূতি চেয়ে এনে বসাই, তাতে কন্টামিনেট হয়ে ক্ষতি হওয়ার চান্স বেশি।
—কিন্তু শরীর পোড়ায় তো তুমি রানিং ওয়াটার দিচ্ছোই?
—এখানে দিচ্ছি না কে বললো? এই জীবনটা তো রানিং। এই জীবনে নরমালি আসা সব অনুভূতি তো আমার পোড়া অনুভূতিতে লাগছেই। কন্টামিনেটও করছে না, জ্বালা কমাচ্ছে। অল্প অল্প করে।
—আমিও কি সেরকম ইরিন?
ইরিন হাসলো৷
—আমার বিয়ের কি প্ল্যান ছিলো জানেন? বিশাল জনসংখ্যাওয়ালা পরিবারে বিয়ে হবে। গিজগিজ করবে লোকজন। ঝগড়া করবো, হিংসা করবো, চিৎকার চেঁচামেচি করবো। কিন্তু সেই তো হলো, একলা ঘরে। এক মায়ের এক ছেলে।
—ওহ এই বিয়েতে তাহলে তুমি খুশি নও ইরিন?
ইরিন চোখ পাকিয়ে তাঁকালো।
—খুশি নই বললেই আপনি রিয়া’র কাছে চলে যাবেন?
—আমি কোথাও যাবো না ইরিন। আমার কারো কাছে যাবার নেই।
—তাহলে আমারও এই বিয়ে নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই তো! এতে তো আমার হাত ছিলো না। আপনারও না। হবার কথা ছিল, হয়ে গেছে।
—ব্যস?
—হু ব্যস!
—আমি বা আমার বাড়ির কোনোকিছু আলাদা নেই তোমার কাছে?
—আছে তো! অবশ্যই আছে। আপনাদের বাড়িতেই আপনি একমাত্র লোক যে দোতলার বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে গান গাইলে সেটা একতলা থেকেও শোনা যায়।
আমি হতাশ চোখে তাঁকালাম। এই মেয়েটা সবসময় এত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে কথা বলে কেন? হুহ….

ইরিন হঠাৎ করে আমার খুব কাছে চলে এলো। ভীষণ কাছে। আমি ওর নিঃশ্বাস টের পেতে লাগলাম।
ইরিন চোখ টিপে ফিসফিসিয়ে বললো,
—একটা ভীষণ জরুরি কথা আছে আপনার সাথে। ইদানীং আপনার একটা ব্যাপার আমি খুব করে খেয়াল করছি জানেন? একেবারে আলাদা ব্যাপার।
আমি কোনোরকমে বললাম,
—কি?
ইরিনের চোখের তারা আমার দৃষ্টির সাথে সাথে ঘুরছে।
আমি অনুভূতির জোয়ারে কেঁপে কেঁপে জেগে উঠছি। ভাঙছে, গড়ছে, ডুবছে টাইপ সব অনুভূতিতে একাকার হচ্ছি আমি।
ইরিন আরো দৃষ্টির কাছে চলে এলো আমার। আমি ঠোঁট এগিয়ে নিচু করলাম। সুখের মুহূর্ত, সেরা মুহূর্ত থেকে আমি মাত্র কয়েক সুতো দূরে। এই পৃথিবীতে, এই আমার জীবনে, এই দিনের সময়ে সবথেকে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটতে আর কয়েক ন্যানো সেকেন্ড বাকি। ইরিনের তপ্ত নিঃশ্বাসে আমার ভেতরকার সব বরফের জমাট কাটবে বুঝি এখনি।এখনি!
ইরিন মোলায়েম স্বরে বললো,
—ইদানীং আমি খেয়াল করছি, আপনি যখন কোনো কথায় অবাক হয়ে আমার দিকে তাঁকান। তখন আপনার এই চোখদুটো ট্যারা হয়ে যায়! আপনাকে তখন দেখতে মনে হয় ট্যারাক্যাবলা। আসলে ঘটনাটা কি দেখতেই আমি আপনার চোখের কাছে এলাম। হুহ…

আমি হাত মুঠো করে দাঁত কামড়ে নিজেকে সামলালাম। আমার তখনি মনে হলো এই ইরিন একটা অন্য রসায়নের নারী। শুধু তাঁর শরীর ছুঁয়েই আমি তাঁকে পাবো না। তাঁকে পেতে হলে আমাকে তাঁর মন ছুঁতে হবে। কিন্তু সেই মনে পৌঁছুবার রাস্তা কি সেটাই তো আমি জানি না।

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here