#মাতোয়ারা
#পর্ব_০৯
সকালে ঘুম ভেঙে ইরিন অবিশ্বাস্য চোখে তাঁকিয়ে বললো,
—আপনি জেগে ছিলেন সারারাত?
—হুঁ…
—একটুও ঘুমোননি?
—চেষ্টা করেছি, ঘুম আসেনি।
—ও মাই গড… আমার দিকে তাঁকিয়েছিলেন সারারাত তাই না?
ইরিনের কথার জবাব না দিয়ে আমি পাশ ফিরে শুলাম। ইরিনের কথা অনেকটাই ঠিক। ইরিনের দিকে আমি রাতের বেশিরভাগ সময়ই তাঁকিয়ে ছিলাম। মাথা ঝিম ঝিম করিয়ে দেওয়া শরীর তাঁর। তাঁকানোর অপরাধ থেকে আমি নিজেকে সরাতে পারিনি।
প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম,
—আমি এখন ঘুমোবো কিছুক্ষণ; তুমি ভালো করে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে, দরজা আটকে যাবে। কেউ ঘরে থাকলে আমি ঘুমোতে পারিনা।
—না পারলে নেই, আমি এখন রেডী হবো। ইউনিভার্সিটি যাবো, আমি চলে গেলে আপনি ঘুমোবেন… কিন্তু যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ এই ঘরটা আমি ব্যবহার করবো।
ইরিনের সাথে তর্ক করা ফাও। আমি মুখের উপর কাঁথা টেনে দিলাম।
ইরিন আমার মুখের উপরের কাঁথা সরিয়ে বললো,
—ভেউউউ…..
আমি রেগে গেলাম খুব।
আমার রাগের কে তোয়াক্কা করছে?
ইরিন মাথা নিচু করে হাসি হাসি মুখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো,
—আপনি খুব ভালো, ফ্রেশ মানুষ!
—কেন?
—এই যে, সারারাত আমায় কিছু করেননি। আচ্ছা, আপনার কি একটু হাতে ছুঁতেও মন চায়নি আমাকে? সত্যি বলবেন কিন্তু…
আমি কাঁথাসহ উঠে দাঁড়ালাম। এখানে ঘুমোনো অসম্ভব। সামনে থাকলে ইরিন ননস্টপ কথা বলে যাবে।
ইরিন মিষ্টি করে হাসলো।
—আপনি অন্যঘরে গেলে আমারই ভালো। গোসল করে কিছুক্ষণ তোয়ালে পরে না হাঁটলে আমার মুড ফ্রেশ হয় না, বুঝলেন? এই দেখেন আমার পাও অনেকটা ঠিক। ক্রাচ ছাড়াই হাঁটতে পারছি এখন। মেরে ঠ্যাং তো ঠিক হো গায়ি…
আমি রেগে কিছু বলার আগেই ইরিন তোয়ালে ঘুরাতে ঘুরাতে গান ধরলো,
“শুনোগো দখিন হাওয়া… গোসল করবো আমি….”
আমি কাঁথা মুড়িয়ে এ ঘরেই আবার শুয়ে পড়লাম।
ইরিন গোসল করে এসে আবার প্যাঁন প্যাঁন শুরু করলো।
—আপনি রয়ে গেছেন, ওহো…. আমি এখন হাঁটবো কি করে? আশ্চর্য!! আমার বুঝি লজ্জা করেনা। এইবার কিন্তু ভালো হচ্ছে না। ঘুমে যা দেখেছেন, দেখেছেন। সজাগ সেটা তো অন্য ব্যাপার….. দেখুন আমার কিন্তু এটা ফার্স্ট টাইম। আপনার আগে হলেও হতে পারে। আমাকে কিন্তু কোনো ছেলে আগে দেখেনি.… এই যে একটুও না। হাতও ধরেনি কেউ।
দেখুন ইউনিভার্সিটিতে আমি আপনার নামও কিন্তু ছেলেদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করেছি। একটু উইক ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের মেয়েকে কিন্তু সব ছেলেই হাতাতে চায়।মনে করে, হাতিয়ে দিই। তাই আমি ইউনিভার্সিটির সবথেকে বড় ছাত্রনেতার নাম ইউজ করেছি। এতে কি আমার কোনো দোষ আছে বলুন? একটা মেয়ে যদি নিজেকে প্রটেক্ট করতে বলে, এই শহরের সবথেকে বড় অসুর আমার হবু বর। আর তাতে যদি বাকি ছোট ছোট অসুরগুলোর হাত থেকে মেয়েটা বেঁচে যায়, তাতে তো অপরাধের কিছু নেই। তাই না?
আমাকে অসুর বলা হচ্ছে, তাও আমি জবাব না দিয়ে চুপচাপ আছি। কারণ ইরিনের সাথে কথা বলা মানে তাঁর কথার স্পিড আরো বাড়িয়ে দেওয়া। একপর্যায়ে ইরিন, আস্তে আস্তে পা টিপে এসে আমার মুখের উপর থেকে কাঁথা সরালো। আমি গাঢ় ঘুমের ভান করলাম।
ইরিন লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আমার মুখের উপরে হাত নাড়লো, আঙুল ধরলো। তারপর বিড়বিড় করে বললো,
—ওহ, সত্যিসত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছেন দেখছি… গুড… ভেরি গুড।
ইরিন মহানন্দে তোয়ালে গায়ে কিছুক্ষণ ভাঙা পা নিয়ে নাচানাচির চেষ্টা করলো। তারপর রেডী হয়ে ব্যাগ গুছালো।ছোট্ট একটা কাগজে কিছু একটা লিখে সেটা দরজায় সাঁটালো এবং সর্বশেষ জানালার পর্দাগুলো ঠিক করে টেনে দরজাটা আস্তে করে আটকে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
আমি কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ঘুম এলোনা। জীবন আসলে আমার কাছে দুর্বোধ্য তখন। কি ঘটছিলো, কেন ঘটছিলো সব আমার কাছে তখন নাটকের ভাষায় বলতে গেলে “আচানক ঘটনা”।
ইরিনের কি হবে? আমার জীবনই বা কোনদিকে যাচ্ছে, বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। রিয়া কি হারিয়েই গেলো? আমিও কি ইরিনে আক্রান্ত হয়ে পড়বো…. এরকম ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম… ঘুম ভেঙে দেখি সন্ধ্যা। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? তাড়াহুড়ো করে মা’কে ডেকে বললাম,
—ডাকো নি কেন? এরকম দিন কেটে গেলো, বলোতো…
মা ধমকালেন উল্টো।
—নিজেই মানা করলি ডাকতে তো? খালিপেটে ঘুমোলি। শরীর খারাপ বাঁধিয়ে তবে শান্তি হবি….
—আমি কখন মানা করলাম? তুমি গিয়েছিলে আমার ঘরে?
—ডাকতে গিয়েছিলাম দেখি তোর দরজায় লিখে রেখেছিস,
“অযথা ডাকাডাকি করবে না মা, খবরদার! নতুন বউয়ের জ্বালায় সারারাত একফোঁটা ঘুমোতে পারিনি”। বিয়ে করে তুই কি নির্লজ্জ হয়ে গেছিসরে বাবু!
আমি দৌঁড়ে আমার ঘরের সামনে গেলাম। ইরিন তাহলে এটাই সকালে দরজায় লাগিয়েছিলো!
সন্ধ্যায় আমার আড্ডাবাজি রুটিনমাফিক। বেরিয়ে যাবার সময় দেখলাম ইরিন ফিরছে। আমার মুখোমুখি এসে বললো,
—আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?
—তোমাকে বলতে হবে কেন?
—বাইরে গেলে কোথায় যাচ্ছেন সেটা একজন কাউকে বলে যাওয়া ভালো। কখন কোন বিপদ-আপদ হয়।
—এতদিন তো আমি কাউকে বলে যাইনি। তোমার জন্য রুটিন পাল্টাবো কেন?
—বারে, রুটিন পাল্টাতে হবে কেন? এটা রুটিনে এড করে নিলেই তো হয়…. এই যে, এখন থেকে কোথাও যাবার আগে আমি ইরিনকে বলে যাবো।
আমি চোখ রাঙানী দিয়ে তাঁকালাম। ইরিনও সাথে সাথে চোখ রাঙিয়ে তাঁকালো।
আমার হাসি পেয়ে গেলো। কারণ সে চোখ বড় দেখাতে গিয়ে মুখের হা’ও বড় করে ফেলেছে…..
—আপনি কি দু’মিনিট দেরী করে যাবেন? আমি কিছু শপিং করেছি সেগুলো দেখাতাম….
আমি অনিচ্ছুকভাবে ইরিনের পিছনে পিছনে আবার ঘরে এলাম।
ইরিন চোখ টিপে বললো,
—থ্যাংক ইয়ু।
—এই ভাঙা পায়ে শপিং করলে?
—পা তো এখন ভালো। এই যে দেখেন। ব্যথাও নেই। আমার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব ভালো। জ্বর, পেট খারাপ হলে এমনিতেই সেড়ে যায়, ঔষধ লাগে না।
আমি ভাবলাম ইরিন তাঁর নিজের জন্য কেনাকাটা করেছে, তা না। সে কেনাকাটা করেছে মায়ের জন্য এবং আমার জন্য।
—এত ঝামেলায় পড়ে বিয়ে করলেন।, বাবা কিছু দেন নি আপনাকে। ভাবলাম আমিই দিই… হাজার হোক বিয়ে তো, নাকি?
ইরিন আমার জন্য পাঞ্জাবি থেকে আন্ডারওয়্যার পর্যন্ত….. সব কিনে এনেছে এবং সবই একসাইজ করে ছোট…..
পাঞ্জাবী একদম শর্ট, হাতা শর্ট… জুতো পায়ে দিলাম সেটাও ছোটো। ইরিনের চোখমুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো পারলে সে আমাকে কেটে ছোট করে ফেলে….
মুখ কুঁচকে শুধু বললো,
—কঅঅঅত লম্বা বলুন তো আপনি…? দোকানী তো বললো, এটা সবথেকে বড় সাইজ….. কারো পা এত বড় হয়? এইটাই তো বাজারের সবথেকে লম্বা প্যান্ট….
বেচারী পারলে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে কেঁদে ফেলে।
আমার পাঞ্জাবি ধরে টানাটানি করলো বেশ কিছুক্ষণ। জুতোও টানলো…
আমি ইরিনের অবস্থা দেখে বললাম,
—ঠিক আছে, এতটুকু শর্ট পাঞ্জাবি পরা যায়.।. তাছাড়া প্যান্টও ঠিক আছে, টাখনুর উপরে প্যান্ট পরা তো সুন্নত।
ইরিন আমার কথায় তেমন আশ্বস্ত হলো বলে মনে হলো না। একবার অবশ্য অস্পষ্টভাবে বললো,
—আমি কি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরবো? মন খারাপ লাগছে খুব। এতগুলো শপিং… একটাও ঠিকঠাক হলো না আপনার। ইশ্….
আমি কথাটা শুনেও না শোনবার ভান করলাম।
ইরিনের দেওয়া শর্ট পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে আমার হুট করে মনে হলো, আমিও তো কিছু দিই নি ইরিনকে। আমার কি তাঁকে কিছু দেওয়া উচিত?
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা