তাহারেই পড়ে মনে পর্ব ৮

#তাহারেই_পড়ে_মনে
পর্ব আট
‘এইবার তুমি পুরো একানব্বই দিন পরে এলে।’ একটু খুশি একটু রাগ মিষ্টির চোখে। ‘আচ্ছা, আর এইরকম নায়ক সেজে থাকা হচ্ছে আজকাল? হুম?’

‘কী করবো, তুই তো আমাকে সহ্যই করতে পারিস না। তোর আশেপাশে কত নতুন নতুন মানুষ, কত পড়াশোনা জানা, স্মার্ট ছেলেরা। এর ভেতর তুই তো শুধু আমাকে নাকানিচুবানিই খাওয়াস! আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তোর পাল্টা কথার জবাব দিতে পারিনা। কি বলতে কি বলি কে জানে! কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসি, বিবিজান!’

‘সাড়ে সেয়ানা তুমি, কিভাবে আমাকে ঘায়েল করতে হয় সেটা ভালো করেই জানো। এতো যদি ভালোবাসো তবে এতোদিন এলেনা কেন?’

‘কে বলেছে আসিনি?’

‘ইয়া আল্লাহ, সত্যি এসেছো? আমি কেন দেখলাম না?’

‘তোর তো চারচোখ, চারচোখে কি দেখা যায়? আগে ঠিক পারতি, তখন না দেখেই টের পেতি। এখন আমাকে তোর মানুষই মনে হয় না।’

মিষ্টি খিলখিল করে হেসে ওঠে। ‘তবে আজকে কেন এলে? আজও লুকিয়ে থাকতে চোরের মতো।’

‘থাকতামই তো! আমি তো বলেছিলাম আমি আর তোর সামনে আসবো না। কিন্তু তুই আজকে শাড়ি পরেছিস! সামনে থেকে দেখার ইচ্ছে আটকাতে পারলাম না। তোর হাতটা ধরি, মিষ্টি?’

‘শুধু আমার সামনে আসবে না এটা বলোনি তুমি প্রিন্সভাই। আরও কিছু বলেছিলে। আমার কিন্তু সব মুখস্থ থাকে, মনে করিয়ে দেবো?’ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে আনে মিষ্টি।

‘তুই ইচ্ছে করে এগুলো করিস, মিষ্টি। ইচ্ছে করে আমাকে রাগিয়ে দিস। আমাকে নিয়ে খেলতে তোর খুব ভালো লাগে না? সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।’ বেশ রুষ্ট দেখায় প্রিন্সকে।

‘জানোই যদি, তবে রাগ করো কেন? আর এই সবাইটা কে? এই সবাইকে তুমি কি কি বলে বেড়াও?’

প্রিন্স ওর কথার উত্তর দেয় না, অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে শংকা, মিষ্টিকে কি ও আসলেই পেয়েছে? এ কেমন পাওয়া?

মিষ্টি হাত দিয়ে প্রিন্সের মুখ টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। ‘আমার দিকে তাকাও, ভালো করে তাকিয়ে বলো, তোমার ওই সবাই আর কি কি বলে। তারা কি তোমাকে বলে, আমি তোমাকে কতখানি চাই? কতখানি ভালোবাসি? তাকাও ভালো করে, আমার চোখের দিকে তাকাও, বলো, কি দেখো?’

‘সিএফসি’

‘কি?’ মিষ্টি উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখে, সিএফসির অপজিটে বসে আছে ওরা। ওর চশমায় ওই ফাস্টফুড শপের সাইনবোর্ডের রিফ্লেকশন হচ্ছে। ও রেগে লাল হতে হতে হেসে ফেললো। প্রিন্সের কাঁধে মাথা দিয়ে আস্তে করে বললো ‘তুমি কখনো পাল্টে যেওনা প্রিন্সভাই, এইরকম উজবুকই থেকো সবসময়!’

মিষ্টি ওকে উজবুক বলছে, ওর খারাপ লাগার কথা ছিলো – তবুও ওর বুকজুড়ানো শান্তি যেন নেমে এলো।

একটু বাদে মিষ্টি বলে উঠলো ‘চলো, আজকে শপিং করবো। তুমি যেরকম হাইফাই সেজে থাকো, তোমার পাশে আমাকে কাজের বুয়ার মতো দেখাচ্ছে। আজকে ভালো ভালো জামা-গয়না কিনে দেবে চলো।’

প্রিন্স খুশি হয়ে উঠলো। মিষ্টি কি পছন্দ করে ও জানেই না। কখনো মিষ্টিকে কিছু দেওয়া হয়নি, দেওয়ার কথা ওর মনেও হয়নি। আজ মিষ্টি নিজের থেকে চাইছে। খুশিতে ও আটজন হয়ে লাফাতে থাকলো। কিন্তু সেই খুশি বেশিক্ষণ থাকলো না – মিষ্টি অনেক কেনাকাটা করলো ঠিকই কিন্তু প্রিন্সের পকেট থেকে একটা টাকাও বের করতে দিলো না। ও রেগে গেলো ‘তবে আমার সাথে এলি কেন? আমি কি কুলি হয়েছি যে, তোর ব্যাগ বইবো? সবকিছুর লিমিট থাকে কিন্তু। তোর মনে হয় না, তুই সবসময় বাড়াবাড়ি করিস? অতিরিক্ত কিছুই কিন্তু ভালো না, মিষ্টি। আমি তোর সব কথা শুনি বলেই যে সবসময়ই শুনবো এমন কিন্তু কোনো শর্ত নেই।’

‘আমি তোমার সাথে আসিনি প্রিন্সভাই, তোমাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি।’

‘এমন করিস না। আমাকে ছোট করতে, অপমান করতে তোর ভালো লাগে?’

জবাবে কিছু বলতে গিয়েই থেমে যায় মিষ্টি। আজকে কিছু কঠিন কথা বলতেই হবে প্রিন্সকে। ‘শপিং শেষ, চলো কিছু খাই। খুব খিদে লেগেছে।’

‘হুম’ মুখ পুড়িয়ে উত্তর দিলো প্রিন্স।

মিডনাইট সান রেস্টুরেন্টের দিকে ঢুকতে থাকলে মিষ্টি চোখ কপালে তুললো ‘ওদিকে কোথায় যাও, আমার এতো টাকা নেই।’

‘তোর নেই, আমার তো আছে।’

প্রিন্স মিষ্টির সব কথা শুনলেও মিষ্টি ওর কোনোকথাই শোনেনা। এবারেও শুনলো না। নিলক্ষেতের সস্তা বিরিয়ানির হোটেলে ঢুকলো ও। প্রিন্স নাক কুঁচকালো। কত নোংরা! মিষ্টি হেসে বললো ‘ খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে।’

‘আমি মরে গেলেও এখানে খাবো না।’

‘মরতে হবে না, তুমি বাপবাপ বলেই খাবে। তবে আমি খাওয়ার ব্যাপারে কাওকেই জোর করি না। তোমার খেতে হবে না, আমি খাই, তুমি বসে বসে দেখো।’

‘তুই বুঝি নিজের টাকা খরচ করিস? তোকে তোর বাবা টাকা দেয় না?’

‘উহু, ওই কথা বোলো না। আমি ক্লাস এইট থেকে টিউশন করাই। এখন দুটো ছাত্র পড়াই ঢাকাতে আমি। আমি যা খরচ করি নিজের টাকায় গো!’

‘আমার টাকায় খেলে কি ক্ষতি হতো?’

‘উঁহু, তোমার টাকাতো না, প্রিন্সভাই, যদি হতো আমি খুশিখুশি তোমার ঘাড় ভেঙে খেতাম। পিকপকেটও করতাম। কিন্তু সবতো খালুর টাকা। একদিন অন্য সবাই তো বলবেই, সাথে তুমিও বলবে, তোমার বাবা ধনী বলেই আমি তোমাকে ফাঁসিয়েছি। ওই অপমানটা আমি নিতে পারবো না, প্রিন্সভাই। আর আসলেই তো, কেউ যদি আমার কাছে জানতে চায় কেন আমি তোমাকে চাই, আমার কাছে তো সত্যিই কোনো উত্তর নেই। আমি তো জানিই না কেন আমার তোমাকে চাই। তোমাকে চাই আমি, এইটুকু ভাবতেই আমার ভালো লাগে, এটাই শুধু আমি জানি। সাবিহা খালা যদি জানতে পারে, সুপারি কাটার যাঁতি দিয়ে আমাকে টুকরো টুকরো করবে। বলবে তার সোজা সরল, লালুভুলু ছেলের মাথা আমি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছি।’

নিজের মাকে ভালোমতোই চেনে প্রিন্স। শুকনো একটা ঢোঁক গিলে নিলো। তারপর অকারণ জেদ করেই বললো ‘মা কিছুই বলবে না, মিষ্টি। এগুলো তুই শুধু আমাকে জ্বালাতন করার জন্যই বলিস। এমন না যে জাফরিন খালা আমাকে আদর করবে!’

‘দেখলে, মায়েরা কি করবে না করবে তা নিয়ে এখনই আমরা ঝগড়া করছি, তাহলে পারে কী হবে? ভাবতেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।’

‘কী হবে, তেমন হলে আমরা থাকব না ওদের সাথে।’

‘সেই দায়টাও আমার ঘাড়েই এসে পড়বে। মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে আলাদা করার বদনাম পড়বে। আর ধরো সেরকম হলোও, তোমার এই দামি লাইফস্টাইল, লাখ টাকার বাইক এইসব মেইনটেইন কিভাবে করবে? নিজের রোজগার তো এক টাকাও নেই। এরকম সস্তার খাবার খেতেও তো তোমার রুচিতে লাগবে।’

‘তুই সবসময়ই আমাকে খোঁটা দিস এইভাবে। আসলে লাল-নীল দুনিয়া দেখে তোর মাথা ঘুরে গেছে। এখন আমাকে তোর অনেক তুচ্ছ মনে হচ্ছে। এখন আপদ মনে হচ্ছে আমাকে, আমি না আসলে, তোর আশেপাশে না থাকলে তোর খুশি লাগে। আমাকে সবার সামনে প্রেজেন্ট করতে তোর লজ্জা লাগে, তাই ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে এতো কথা বলিস। আছে, আমার বাবার যথেষ্ট টাকা আছে, সেটা আমার দোষ? সেই টাকার উত্তরাধিকার আমি একা, সেটাও আমার দোষ? আমি কেন আমার সাতপুরুষ বসে খেলেও সেই টাকা ফুরোবে না, সেটাও আমার দোষ? তো, আমি এখন কি করবো – জবাই দিবি তুই আমাকে? সবাই ঠিক বলে, তুই অকারণ ঘোরাচ্ছিস আমাকে। আর আমি গাধা, তোর পেছনে হেঁদিয়ে মরে যাচ্ছি। কেন? তোর মতো মিষ্টি দিনে দশটা আমার জন্য পাগল হয়। আজকে বিয়ে করবো বললে সব মন্ত্রী-মিনিস্টারেরা মেয়ে দেবার জন্য রাজি হয়ে যাবে।’ গলা চড়ে যায় প্রিন্সের!

‘ভালো হবে না, বলো? পড়াশোনা শেষ করে যখন চাকরি পাবোনা তখন তোমার শ্বশুরকে গিয়ে ধরবো, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য।’ সোজা সরল মুখে বললো মিষ্টি।

এবারে প্রিন্স হেসে ফেললো ‘সহ্য করতে পারবি?’

‘পারবো না গো, সত্যি পারবো না। তোমাকে বকি, রাগিয়ে দেই, কষ্ট দেই – কিন্তু অন্য কেউ তোমার বউ হবে এ আমি কোনোদিন সহ্য করতে পারবো না। তুমি খুব ভালো করে জানো, তা। তাও এতো বকলে আমাকে? সবাই যখন আড্ডা দেয়, সিনেমায় যায়, সেজেগুজে কনসার্টে নাচে, আমি মুখ গুঁজে বই পড়ি – আমার তো ওইটুকু ছাড়া কিছু নেই, আর তো কিছু পারি না আমি। কেউ যেন আমার ব্যর্থতার দোষ তোমার ঘাড়ে চাপাতে না পারে তার জন্য আমি তটস্থ থাকি সারাক্ষণ। আমি তো কাউকে বাদ দিতে পারবো না, না তোমাকে না আমার পরিবারকে। আমি খুব লোভি প্রিন্সভাই, আমার যে সব চাই। তোমার হাতদুটোও ধরতে চাই, মিঠির হাতখানিও মুঠোয় রাখতে চাই। আমার সফলতার পুরষ্কার হয়ে যেন তোমাকে চাইতে পারি, আব্বু- আম্মু যেন হাসিখুশি মেনে নেয় তোমাকে এর জন্য যে আমি কত চেষ্টা করি, তোমাকে আমি বলে বুঝাতে পারবো না।’

মিষ্টির এতোখানি আবেগ প্রিন্সকেও ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে যায়। আনন্দের অতিসায্যে ও মিষ্টির হাত মুঠোয় চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে ‘এতো কষ্টের কী দরকার মিষ্টি! চল, বিয়ে করে ফেলি, বিবিজান।’

মিষ্টি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, একটু আগের উথলে ওঠা ইমোশন গিলে ফেলে। ও বোঝে পণ্ডশ্রমই হোলো, এই ছেলের মাথায় এতো সূক্ষচিন্তাভাবনা ঢোকার কোনো রাস্তাই নেই। ও শুধু এইটুকু বোঝে ভালোবাসি- বিয়ে করবো- ব্যস! বাবা মা না মানলে একটা হাউকাউ লাগবে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন! ও খুব কড়া চোখে প্রিন্সের চোখের দিকে তাকালো তারপর খুব কঠিন করে বললো ‘বিয়ে করবা যে, দেনমোহর দিতে পারবা?’

এই প্রশ্নটা প্রিন্সের জন্য কমন পড়েছে, ও হেসে দিয়ে বললো ‘কত টাকা চাই তোর, বল?’

মিষ্টি বিপদে পড়লো, বলার জন্যই বলা, এই হিসেব তো ও করেনি। ‘ধরো এক লাখ টাকা।’

প্রিন্স একটু ভাবলো, ভেবে বললো ‘এক মাস সময় দে।’

‘এক মাস কেন? এক মাসে কি করবা তুমি?’

‘এমনিতে দশ-বিশহাজার চাইলেই পাবো, কিন্তু একলাখ দিতেতো আব্বা ঝামেলা করবে। আজ দশ, কাল পাঁচ এইভাবে নিয়ে একমাসে তোর কাবিনের টাকা আর যা খরচ সব যোগাড় হয়ে যাবে।’ অনেক কনফিডেন্ট শোনালো প্রিন্সকে।

প্রিন্সের এতোখানি আনন্দে একগামলা পানি ঢেলে দিয়ে অনেকখানি তিক্ততা মিশিয়ে মিষ্টি বললো ‘তবে তো আমার তোমার আব্বাকেই বিয়ে করা উচিত।’

প্রিন্স মূহুর্তে ক্ষেপে গেলো। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বললো ‘তুই অতি শয়তান মেয়ে মিষ্টি। এরপরে যদি তোর কথা আমি মনে মনেও ভাবি তো আমার নামে কুত্তা পালিস। এতো অহংকার ভালো না, এতো পড়াশুনার অহংকার তোর – কি হবে এতো পড়াশুনা দিয়ে? তোদের পাশের বাড়ির লিপি পাগলির কথা মনে নেই – কি লাভ হলো অত লেখাপড়ার? তুইও বুঝবি একদিন! ওইরকম পাগল হবি তুইও আমার জন্য।’ বলেই দ্রুততম বেগে চলে গেলো প্রিন্স।

মিষ্টি আস্তেধীরে উঠে বাইরে বেরোতেই প্রিন্স এসে হাজির। রাগে ওর মুখ টকটক করছে। মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে বললো ‘তোর জন্য কিনেছিলাম, আমার বাপের টাকায়। কিন্তু তুই তো নিবি না।’
বলেই জোরে আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ফেললো মোবাইলটা। ‘একদিন আমার দেওয়া, আমার ছোঁয়া একটা জিনিসের জন্য তুই রাস্তাঘাটে কাঁদবি, মিষ্টি! যেভাবে আমাকে নিয়ে খেলছিস, এর সুদেআসলে তোকে ভুগতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি ভালো না, মিষ্টি!’

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মিষ্টি। ‘তোর কান্না কেবল শুরু, এরপর আমার জন্য তোকে অনেক কাঁদতে হবে।’

চোখের পানিতে ভাসতে থাকা মিষ্টিকে ফেলে চলে গেলো প্রিন্স।

চলবে…

(বাড্ডে ট্রিট এইটা ☺️। প্রতিদিন গল্প দিচ্ছি, ছোট কইলেই বাইড়ামু😑)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here