শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ১৬
রাতের ২ টা বাজে ইহান রুমে ঢুকল। রুমাইসা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে। খাবার টা এখনো পড়ে আছে সেভাবেই ঢাকা। ইহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কারো মনে জায়গা করে নেওয়া এত সহজ না। অনেক কিছুর বিসর্জন এর পরে মনে নিজের জায়গা পাওয়া যায়। ততদিনে আত্মসম্মান নামক জিনিস টা সামনের মানুষ টার কাছে হারিয়ে ফেলতে হয়। রুহির বেলায় ও একি কাজ করেছিল। কিন্তু বারংবার সে নিজের সম্মান টা কে নষ্ট করতে চায় না। থাকুক রুমাইসা ওর মত। বরং ওদের মাঝে দুরত্ব টা বজায় থাকলেই দুজনের জন্য ভালো। যে আগে মায়ায় পরে তার কষ্ট টাই বেশি হয়।
ইহান ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। খাটের আওয়াজে রুমাইসার ঘুম ভেঙে গেল। ইহান ওই পাশ হয়ে আছে। ঘুমাচ্ছে নাকি জেগে আছে বুঝতে পারছে না একদম। রুমাইসা এবার ঠিক মত এবার শুয়ে পড়ল। ওর মনে হল নাকে তীব্র সিগারেটের গন্ধ লাগছে। তবে কি ইহান সিগারেট খেয়ে এসেছে বাহির থেকে! কই এতদিন তো একবারো এমন স্মেল আসে নি। তবে আজ সিগারেট কেন খেল!!
দুজনে দুই পাশে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে।কারো চোখেই ঘুম নেই। রুমাইসা নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছে। ইহান কি কাল থেকে ওর সাথে খারাপ আচরন করবে আবার? – এটাই বড্ড ভাবাচ্ছে ও কে। ওই দিকে ইহান ডুবে আছে অতীতের স্মৃতি তে। যেখানে আছে ওর ভালোবাসা , ওর আবেগ,অনুভূতি আর কিছু আশা।
সকাল বেলা রুমাইসা ঘুম ভাঙার পর ও বিছানা ছাড়তে পারল না। গায়ে প্রচন্ড ব্যথা আর জ্বর। কালকের সারাদিন এর খাটুনি বোধ হয় শরীর একদম ই নিতে পারে নি। ইহান আর ইহিতা যে বাইরে সেটা বিছানায় তাকিয়েই বুঝল। শ্বাশুড়ির বড় গলা এখান থেকে ই শুনা যাচ্ছে। দেয়ালে তাকিয়ে দেখল বেলা ৯ টা বাজে। আজকে শনিবার, ইহান হয়তো সারাদিন বের হবে না। কিন্তু নাশতা টা বানাতে পারল না এখনো । না জানি বাইরে গেলে শ্বাশুড়ি কি বলে বসে। কিন্তু জ্বরে গা কাপছে রীতিমতো ওর। তবুও কাঁপতে কাঁপতে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গেল। মুখ ধুয়ে বের হয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল রুম থেকে । মাথা ব্যথায় অবস্থা খারাপ ওর। চোখ তো জ্বলছেই সাথে।
বাইরে আসতেই দেখল ঘরের সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। কিছু আলোচনা করছিল বোধ হয়। ও কে দেখেই থেমে গেল। শ্বাশুড়ি নিজের জায়গা থেকে ই বলল “বাহ,বাহ মহারানী আপনার ঘুম ভাঙল বুঝি? ”
রুমাইসা মাথা নিচু করে বলল “ক্ষমা করবেন মা, একটু দেরী হয়ে গেল। ”
“হ্যা বউ তো ঘরে এনেছি বসিয়ে খাওয়ার জন্য। একজন তো পোয়াতি। নড়তে চড়তে ই পারে না । আরেকজন বাচ্চা জন্মায় যেন কত কিছু করে ফেলছে। ঘরের কাজ কাম বাদ। এই বুড়া বয়সে এসে আমাকেই সব করতে হবে এখন। চিন্তা করিস না মরার আগ পর্যন্ত আমি ই করে খাওয়াব। তোদের বউদের তোরা আরামে রাখিস। ”
ইহান আর সাহিল দুজনের গায়েই কথাটা কাটার মত বিধল। আর ঘরের বউ দুইজন তো চুপসে রইল। তৃষার মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্ট না থাকতেও কথা শুনেছে, এখন প্রেগন্যান্ট হয়েও কথা শুনতে হচ্ছে। আর রুমাইসার মনে হচ্ছে ওর আসলেই লেট করে উঠায় অনেক বড় পাপ হয়ে গেছে।
ইহান বলার আগেই সাহিল বলল “মা,তুমি জানো তৃষা কে ডক্টর সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দিয়েছে। ওর আর বেবির কিছু হলে তখন তুমি কি বলবে? ”
নাসিমা বেগম এর আগে থেকে ই ঝাঝ ছিল গলায়। এসব শুনে ঝাঝ বেড়ে গেল। আবার বলা শুরু করল “হ্যা হ্যা, বউয়ের গোলাম হয়েছিস না। পা চাটা গোলাম হয়েছিস তো। বউ যা করবে সব ঠিক। আর মা যে ১০মাস পেটে ধরল, বড় করল, মা কে কেন মনে রাখবি। যা না বউয়ের চুড়ি আর শাড়ি পড়ে বসে থাক।”
ইহান এতক্ষন ধৈর্য্য সহকারে সহ্য করছিল সব। এবার রাগ উঠে গেল। “মা, ভাই খারাপ কি বলল শুনি একটু। ভাবীর অবস্থা কি তুমি জানো না। প্রেগন্যান্ট এর আগে তো কম কাজ করাও নি। তোমার এই সব কাজের চাপেই তো ভাবীর বাচ্চা যেতে যেতে বেচে গেছে। তবুও তোমার একটু বুদ্ধি হয় না, দয়া হয় না।মিলি আছে, সাইয়ারা আছে তোমার তো হাত পা ভাঙে নি। কই সাইয়ারা যে পড়ে পড়ে বেলা ১২ টা পর্যন্ত ঘুমায়, একদিন তো মেয়েকে আগে উঠাও নি। মেয়ে কি তোমার শ্বশুর বাড়ি যাবে না? আর কাল রুমাইসা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একা একা রান্না করল, কয়বার জিজ্ঞেস করেছ খেয়েছে কিনা? তুমি আর তোমার মেয়ে তো একবারো উকি দেও নি কি করছে মেয়েটা একা একা। এত এত টাকা থাকার পর ও, ৬০ জন মানুষের দুইবেলার খাবার ও কে দিয়ে রান্না করালে। কিছু বলেছি একবারো না ও একবার কিছু বলেছে?? ”
রুমাইসা লজ্জায় মাটির নিচে চলে যায় পারলে। ওর শ্বাশুড়ি কেমন সেটা ওর অজানা নেই। এখন যে ওর গুষ্টি উদ্ধার করবে সেটা ও জানে। তাই ভয়ে ভয়ে আড়চোখে শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকাল। তালুকদার সাহেব নাসিমা বেগম কে বলল “কাল এতগুলো মানুষের রান্না ও কে দিয়ে রান্না করিয়েছ তুমি? অথচ আমাকে বললে মানুষ এনেছ ঘরেই রান্না করবে। সেজন্য টাকাও নিলে তুমি! ”
নাসিমা বেগম এবার চুপসে গেল। চুরি ধরা পড়ার পর চোর যেমন কাচুমাচু করতে থাকে ওনার অবস্থা ও তেমন হল। মুখ দিয়ে কথা বের হল না কোন। তালুকদার সাহেব চেচিয়ে মিলি কে ডাক দিল।
মিলি আড়ালেই দাড়িয়ে ছিল। ডাক পেয়ে দৌড়ে আসল। “জ্বি খালু? ”
“সাইয়ারা কে এখনি ডাক দেও। বল আমি ডেকেছি।”
মিলি এক দৌড়ে গেল সাইয়ারার রুমে।তৃষা জানে পরিণতি এখন যা ই হবে কিন্তু ঝড় ওর আর রুমাইসার উপর দিয়ে যাবে ই। বারবার সাহিলের হাত চেপে ধরছে ভয়ে। সাহিল ও কে ভরসা দিচ্ছে। রুমাইসা সব ই দেখছে কিন্তু এখন ওর গায়ে কেন যেন এসব জিনিস লাগছে না।ও ভয় পাচ্ছে ঝামেলা না বেশিদূর গড়ায়। এদিকে জ্বর এ ভালো লাগছে না দাড়িয়ে থাকতে। আবার এত মানুষের সামনে বসতেও পারছে না।
সাইয়ারা চোখ মুখ কচলাতে কচলাতে সবার সামনে আসল। ও কে দেখেই তালুকদার সাহেব চেচিয়ে উঠল এক রকম জোরে।
“বেলা বাজে ১০ টা এখন ঘুম থেকে উঠানোর জন্য তোমাকে ডাকতে কেন হবে? ”
সাইয়ার হামি দিতে দিতে বলল “বাবা মাত্র ই তো ১০ টা। আজ তো ক্লাস নেই। একটু ঘুমাবো না? ”
তালুকদার সাহেব একটা ধমক দিল সাইয়ারা কে। ধমকের কারনে সাইয়ারার ঘুম পালিয়ে গেল।
“নবাবের বেটি না তুমি। যখন ইচ্ছা তখন কেন ঘুম থেকে উঠবা? সকালে ফজরের নামাজ পড়েছ তুমি? এক বেলা নামাজ পড়তে তো দেখি না তোমাকে। ঘরের কোন কাজ টা তুমি কর? কাল যে ছোট বউ এত রান্না একা রান্না করল, একটু হেল্প করেছ তুমি? ”
সাইয়ারা আমতা আমতা করে বলল “কত মেহমান ছিল। তাদের সাথে গল্প করছিলাম। আর সকালে তো ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে গিয়ে দেরী হয়ে গিয়েছিল।”
“চুপ থাক বেয়াদব মেয়ে। কেন তোমার কি বিয়ে হবে না? নাকি সারাজীবন এভাবে ঘাড়ের উপর বসে বসে খাবে? ঘরের কোন কাজ টা পারো তুমি শুনি? মায়ের আদরের মেয়ে তুমি। দেখি না তো এখান কার খুটি ওইখানে নড়াতে। তুমি মেহমানদের সাথে গল্প করেছ, তোমার ভাবীর কি গল্প করার অধিকার ছিল না ? যার জন্য এসেছে তারা, তার দেখাই তো পায় নি এক মিনিট। সব ই দেখেছি কাল আমি। শুধু সৌজন্যের খাতিরে চুপ ছিলাম।কাজী তালুকদার এর বয়স হয়েছে বলে তোমারা যা খুশি তা করবা সেটা তো হবে না এ বাড়িতে। আমি যতদিন আছি সব আমার তত্ত্বাবধানে চলবে। ”
এবার নাসিমা বেগম মরা কান্নার মত চেচিয়ে উঠল।
“হ্যা হ্যা আমি আর আমার মেয়ে ই তো দোষী সবকিছুর। আমার একটা মেয়েই, কয়দিন পর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। ও কে দিয়েও এখন কাজ করাও তোমরা। সব দোষ এই অলুক্ষনে মেয়ের। আমার ঘরে আসার পর থেকেই এমন শুরু হয়েছে। সব শান্তি নষ্ট করে দিল আমার। নিজে এক নষ্টা আবার সাথে পাপ নিয়ে এসেছে।”
রুমাইসা লজ্জায় কাঠ হয়ে গেল। শক্ত করে কামিজের কাপড় টা করে ধরে রাখল। ঘর ভর্তি মানুষের সামনে কান্না করতে পারছিল না। তৃষার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কারন ও জানে কথা গড়িয়ে কই যাবে।
নাসিমা বেগম আবার বলল “যেমন শিক্ষা তেমন কাজ। একে তো বাপ মা নাই। তাই শিক্ষাও নাই কোন। শিক্ষা পেলে হয়ত এসব নোংরা কাজ করতে চারবার ভাবতো। ”
সাহিল এর মাথা নিচু হয়ে গেল। ওর একটা ভুল বুঝি সারাজীবন এর জন্য দাগ কেটে গেছে। ইহান এর পাশেই তৃষা বসে ছিল । ইহান ইহিতা কে তৃষার কোলে দিয়ে উঠে দাড়াল। সামনে রাখা টেবিল টা তুলে খুব জোরে আছাড় মারল ইহান। টেবিলের কাচ ভেঙে গুড়াগুড়া হয়ে গেল। রুমাইসা আর সাইয়ারা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল।
তৃষার চোখ বিষ্ফরিত হয়ে গেল। নাসিমা বেগম ও চুপ করে গেল। ইহান রাগে এক রকম ফুসতে লাগল। তৃষা সাহিল কে বলল আমাকে তাড়াতাড়ি রুমে নিয়ে যাও। আমার খুব খারাপ লাগছে। তৃষা সাহিল কে ধরে কোমরে হাত দিয়ে উঠল। ইহিতা তখনও তৃষার কোলে।রুমাইসা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে ইহিতা কে কোলে নিল।সাহিল আর তৃষা একদম ওর কাছাকাছি ছিল। কিন্তু রুমাইসা একবারো কারো দিকে তাকায় নি।
নাসিমা বেগম এক চিৎকার দিল। সবাই ওনার দিকে তাকাল। “আল্লাহ তুমি আমাকে নিয়ে যাও দয়া কইরা। আর বাচতে ইচ্ছা করে না। সব ঝামেলা আমার কপালে কেন আনসো। এক বাঞ্জা আরেক বেশ্যা রে আমার ঘরে আনসো তুমি। আমি মইরা যামু। আমি মইরা যামু। ”
এক রকম কপাল চাপড়াতে লাগল নাসিমা বেগম।সবাই ভয় পেতে লাগল। না জানি কি করে বসে। তালুকদার সাহেব, সাহিল আর সাইয়ারা ক্রমাগত ওনাকে থামতে বলছে। রুমাইসা আর তৃষাও বলে উঠল “মা এমন করবেন না। আমাদের ক্ষমা করেন দয়া করে।”
ইহান চেচিয়ে উঠল। “ওনার ঢং ছাড়তে বল। ওনার এসব মরাকান্না বন্ধ করতে। ”
নাসিমা বেগম রেগে ইহানের সামনে এসে বলল “কি জাদু করসে এই বেশ্যা মেয়ে তোকে হ্যা? ”
এবার সাহিল চেচিয়ে বলল “মা তুমি কিন্তু যা তা বলছ অনেকক্ষন ধরে। ইহান ভুল কিছু বলছে না।”
রুমাইসা আর তৃষা নাসিমা বেগম কে মানাতে ওনার হাত ধরল। নাসিমা বেগম দুজনকে দেখেই রেগে গেল।কোন ভাবনা চিন্তা ছাড়াই উনি দুইজন কে ধাক্কা মেরে বসল।
রুমাইসা আর ইহিতা যেয়ে পড়ল কাচের উপর। ইহিতার হাতে আর কানে কাচ ঢুকে গেল। আর তৃষা মাটিতে পড়ে গেল। ব্যথায় তৃষা আর ইহিতা দুজনেই চিৎকার করে উঠল।
(বেশি বেশি কমেন্ট করবেন সবাই।)