#জলারণ্যের_ওপারে
——————————
১২.
‘মা, খবর শুনেছো?’ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো সোহানা। মঞ্জুরা তখন রান্না করছিলেন। সোহানার প্রশ্ন শুনে হেসে বললেন, ‘তোর আগেই শুনেছি।’
‘মানে কী! সবাই জানে আর আমি সবার শেষে জানলাম?’ কোমরে দু’হাত রেখে বললো সোহানা। মঞ্জুরা হাসলেন। বললেন, ‘তোর বাবা ঔষধ খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আজ বলে দেয়া লাগেনি। খুশিতে তো বাকবাকুম।’
‘বুকের ভেতরটা শান্তিতে ভরে গেছে রে। মেয়েটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে।’ শান্তির নিশ্বাস নিয়ে বললেন মঞ্জুরা।
‘কথা হচ্ছে, মাগো আপু সেন্ট মার্টিন যাচ্ছে! দুলাভাই কত্তো ভালো! আমার কতো ইচ্ছা ওখানে যাওয়ার। আপু আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলনা কেন? একা একা গেল।’ বিমর্ষতা নিয়ে বললো সোহানা।
‘হ্যাঁরে তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে? ওরা হানিমুনে গেছে। তোকে সাথে নিয়ে যাবে?’
‘তো আমি কি ওদের রুমে বসে থাকব নাকি? আমিতো দ্বীপের ধারে মনের সুখে ঘুরে বেড়াবো!’ বলে হেসে নড়াচড়া করতে লাগলো সোহানা। মঞ্জুরা ওর পিঠে চাপড় মেরে বললেন, ‘হয়েছে হয়েছে। যা ছাদে গিয়ে বরইগুলা বিছিয়ে দে। আজ ভালো রোদ আছে।’
সোহানা কঁকিয়ে ওঠে বললো, ‘পাত্তা দিলেনা। কখনোই পাত্তা দাওনা আমার কোনো কথা।’ বলে বরইর থালা নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল সোহানা। মঞ্জুরা হাসতে লাগলেন।
★
কক্সবাজারের একটা হোটেলে সৌমিক আর মোহনার জন্য একটা রুম বুক করা হয়েছে। রাতটা তারা এখানেই কাটাবে। পরদিন সকাল ৯ টায় টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার জাহাজ রওয়ানা হবে। হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর ২ টা বেজে গেল। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে গেল ওরা। টেবিলে বসে সৌমিক বললো, ‘এই তুমি গোসল করলেনা?’
মোহনা সৌমিকের দিকে তাকালো। কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সৌমিক আবার বললো, ‘কথা বলো।’
‘বীচে নামবো না?’
‘বীচে গোসল করবা? এই পানি তো লবণাক্ত। আর বালিতেও ভরে যাবা।’
‘আপনি সত্যিই একটা ঢেঁড়স!’ বিরক্তি নিয়ে বললো মোহনা।
‘আমি আবার কী করলাম!’ মিনমিন করে বললো সৌমিক।
‘বীচে ভিজলে তো পরে আবার গোসল করতে হবে। তাই একসাথেই করব।’
‘ওহো, তাই বলো। আচ্ছা, কী খাবে?’
‘ভাত খাবো।’
‘কাঁকড়া দিয়ে?’
‘আজ্ঞে না। আমার ওসব ভাল্লাগেনা। নরমাল কিছু।’
‘এক বউ পাইছিরে ভাই।’ বিড়বিড় করে বললো সৌমিক।
‘কী বললেন?’ সরু চোখে তাকালো মোহনা।
‘কিছুনা।’ বলে খাবার অর্ডার দিলো সৌমিক। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে এলো। খাওয়াদাওয়া সেরে তারা আবার হোটেলে ফিরলো। হোটেলে ফিরে বিছানায় গা এলাতেই সৌমিকের দু’চোখ লেগে এলো। তখনই মোহনা চেঁচাতে লাগলো, ‘এই, এই ঘুমোচ্ছেন কী? উঠুন!’
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সৌমিক। দেখলো মোহনা রণচণ্ডী রূপে কোমরে হাত রেখে তাকাচ্ছে তার দিকে। সৌমিক ফু দিয়ে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘এভাবে চেঁচায়?
‘তা কীভাবে চেঁচাবো একটু বলবেন?’
‘চেঁচানোরই কী দরকার?’
‘বীচে যাবো। আপনি ঘুমোচ্ছেন কেন?’
‘এখন? সন্ধ্যার পরে যাই? হাঁটবো।’
‘এখন পানিতে নামবো আমি। সন্ধ্যার পরে আবার হাঁটতে যাব।’
সৌমিকের কী যেন মনে হলো, সে হেসে দিলো ঠোঁট কামড়ে। মোহনা বললো, ‘হাসছেন কেন?’
সৌমিক হেসে হেসে বললো, ‘তুমি কি কোনো গন্ধ পাচ্ছো?’
‘কীসের?’ বলে নাক টানলো মোহনা, ‘কোনো গন্ধ তো নেই।’
সৌমিক বিছানা থেকে নেমে মোহনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ‘উহুম। আমিতো পাচ্ছি।’
‘কী?’
‘একটা মিষ্টি বউ বউ গন্ধ। এই তুমিতো পুরোদস্তুর বউ হয়ে গেছো।’
মোহনা কয়েক মুহূর্ত হা করে রইলো। তারপর দারুণ লজ্জা পেলো। মাথানিচু করে ফেললো। আসলেই তো, সে কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে। পুরো বউদের মতো। মোহনা সেখান থেকে বেলকনিতে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সৌমিক হাত ধরে আটকে দিল। মোহনা হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগলো। সে সৌমিকের দিকে তাকাতে পারছেনা আর। সৌমিক হো হো করে হেসে দিলো। বললো, ‘হয়েছে আমার লজ্জাবতী বউ। লজ্জা পেতে হবেনা। আমি বাইরে যাচ্ছি, তৈরি হয়ে এসো।’ বলে সে বেরিয়ে গেল।
★
বিকেল ৪ টা। পূব আকাশের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়তে শুরু করেছে। পড়ন্ত বিকেল বলেই হয়তো খুব একটা মানুষের আনাগোনা নেই এদিকে। সমুদ্র থেকে একটু দূরে সৌমিক দাঁড়িয়ে আছে। তার মুগ্ধ দুই নয়ন তখন দেখছে, নীল রঙের শাড়ি পরা মোহনা কিশোরীর মতো লাফাচ্ছে সমুদ্রের পাড়ে। আর প্রতি মুহূর্তে খিলখিল করে হাসছে। একটু পরপর বালির মধ্যে পা দিয়ে বৃত্তের মতো কিছু একটা বানাচ্ছে আর বড় বড় ঢেউ এসে সেগুলো মুছে দিচ্ছে। এই দৃশ্য সৌমিকের বুকেও উত্তাল ভালোবাসার ঢেউ তুলছে। মোহনা চিৎকার করে ডাকলো, ‘এইযে ঢেঁড়স, আসুন না!’
সৌমিক হেসে দিলো। বিড়বিড় করে বললো, ‘ঢেঁড়স!’ তারপর হেঁটে হেঁটে মোহনার কাছে গেল। গিয়ে বললো, ‘নামবে না?’
‘আরে এত্তো বড় বড় ঢেউ। আমাকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে কোথায় নিয়ে যাবে খুঁজেও পাবেন না।’
‘কিছু হবেনা। চলো।’
‘এই না না।’
‘আরে চলো তো।’ বলে মোহনার উত্তরের অপেক্ষা না করে সৌমিক দু’হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। তারপর মোহনাকে উঁচু করে ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে কোমর পানি অবধি গেল। তারপর সেখানে মোহনাকে দাঁড় করালো। চোখে চোখ রাখলো। মোহনা কিচ্ছুটি বললোনা। তার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে যেন। হুট করে এতো গভীর স্পর্শ যেন তার অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিলো। তাৎক্ষণিক একটা বড় ঢেউ এসে তাকে ভিজিয়ে দিলো মাথা অবধি। সৌমিক তাকিয়ে আছে তখনও তার চোখের দিকে। মোহনা কেশে উঠলো। নাকেমুখে পানি গিয়েছে। সৌমিকের ঘোর কাটে। ব্যস্ত হয়ে মোহনাকে নিয়ে পাড়ে আসে সে। কাশি বন্ধ করে মোহনা ক্যাটকেটে গলায় বললো, ‘বলেছিলাম না যাবনা? মেরে ফেলতে চাইছিলেন? যাতে আরেকটা বিয়ে করেন?’
সৌমিক থতমত খেলো। সে আমতাআমতা করে বললো, ‘আ-আমিতো…’
‘হয়েছে হয়েছে। চলুন। শরীর বালুতে ভরে গেছে।’ বলে হাঁটা ধরলো মোহনা। সৌমিক অবাক হলো। নিজেই চাইলো পানিতে নামতে, আবার নিজেই রাগ দেখাচ্ছে। সৌমিক বিড়বিড় করে বললো, ‘অদ্ভুত!’
হোটেলে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় মোহনা দেখলো একটা ছেলে একটা মেয়েকে কোলে করে নিয়ে উপরে উঠছে। সৌমিকও দেখলো, পাত্তা দিলোনা। মোহনা দাঁড়িয়ে পড়লো সিঁড়িতে। সৌমিক বললো, ‘কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে পড়লে যে?’
‘পা ব্যথা করছে।’
‘আর একটুই তো। দু’তিন সিঁড়ি। কষ্ট করে চল।’
‘বললাম তো পা ব্যথা করছে।’ ধমকে উঠলো মোহনা। ‘কোলে তুলে নিন।’
‘হ্যাঁ?’ সৌমিকের মনে হলো সে ভুল শুনেছে। ‘আবার বলো, কী বললে?’
‘ব-বলেছি… কোলে করে নিন।’ মাথানিচু করে নিজের এক হাতে আরেক হাত শক্ত করে ধরে বললো মোহনা। সৌমিক অবাক হলো, খুব অবাক হলো। সে ঢোঁক গিললো। হুট করে মোহনার এমন ব্যবহার বিভ্রান্ত করছে তাকে। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে মোহনাকে কোলে তুলে নিলো। এবার সৌমিকের স্পর্শ পেয়ে কাঁপলো না মোহনা। নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলো সৌমিকের দিকে। রুমে এসে মোহনাকে নামাতে যাবে আর তখনই মোহনা বললো, ‘এখানে না। সোজা ওয়াশরুমে নিয়ে নামিয়ে দিন।’
সৌমিক আবারও থমকালো। এক মুহূর্ত মোহনার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হয়ে এক পায়ে দরজা ঠেলে লাগালো। তারপর মোহনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই মোহনা দু’হাতে তার কলার চেপে ধরলো। সৌমিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মোহনা বললো, ‘একটু কষ্ট করে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে যান।’
অজস্র কৌতূহল চেপে রেখে শাওয়ার ছাড়লো সৌমিক। সরে আসতে গিয়ে চোখ পড়লো মোহনার ভেজা ঘাড়ের ওপর। বৃষ্টির ফোঁটার মতো শাওয়ারের পানিগুলো চুয়ে চুয়ে পড়ছে মোহনার ফর্সা ঘাড় বেয়ে। নেশা লেগে গেল সৌমিকের। সে নিজেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হলো। আস্তে আস্তে মোহনার সেই ভেজা ঘাড়ের ওপর নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিলো, পানি শুষে নিলো। মোহনা থরথর করে কেঁপে সৌমিকের কলার আরো জোরে চেপে ধরলো। ভারী নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সৌমিকের হাত এবার মোহনার শাড়ির ভেতর উন্মুক্ত পেটে নেমে আসলো। ওষ্ঠদ্বয় এসে ছুঁয়ে দিলো মোহনার পেলব ওষ্ঠ। আর তখনই মোহনার চোখে ভেসে উঠলো এক চিরচেনা মুখ। অদ্ভুত কাণ্ডটা তখন ঘটালো মোহনা। হঠাৎ ধাক্কা দিলো সৌমিককে। একটুর জন্য পড়ে যায়নি সৌমিক। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো সে মোহনার দিকে। মোহনা তখন বাকহারা। কী করলো এটা সে? সবকিছু ঠিক করার প্রয়াসে ছিলো। জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চেয়েছিলো। কিন্তু এটা কী হয়ে গেল? মোহনা আস্তে করে বললো, ‘আমি… আমি…’
‘তাড়াতাড়ি বেরোও। আমি ফ্রেশ হবো।’ বলেই সৌমিক বেরিয়ে গেল। সোজা বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। কপালের ডানপাশের রগ দপদপ করছে। পরনের শার্টটা খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো সৌমিক। চোখ জ্বালা করছে। অপমানের আভাস সারা শরীরে। ভালো লাগছেনা কিছু। এই সমুদ্র, শো শো বাতাস, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ… সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। এক্ষুণি, এক্ষুণি বাড়ি ফিরে যেতে চায় সে। রুমে এসে মোবাইলটা নিয়ে আবার বেলকনিতে ফিরে গেল সৌমিক। কল করলো ফিরতি টিকিটের জন্য।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সবকিছু ভেঙেচুরে কাঁদছে মোহনা। মাথার চুল খামচে ধরে কাঁদছে। কেন সে নিজের জীবন সুন্দর করতে পারছেনা? কেন সে ঐ মিথ্যাবাদীকে ভুলতে পারছেনা? কেন এসবের ভীড়ে সৌমিককে কষ্ট দিচ্ছে সে। ইশ, সবকিছু যদি এক পলকেই ভুলে যাওয়া যেতো!
★
চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ