জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব শেষ

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————
১৭. (শেষ পর্ব)
(বর্তমান)
———-
মোহনা যখন দৌড়ে গিয়ে আরাফাতের সামনে দাঁড়িয়েছিল, মোহনার চোখে তখন ছিলো রাজ্য জয় করা খুশি। সে কান্নাভেজা কণ্ঠে হেসে হেসে বললো, ‘আরাফাত… আরাফাত তুমি… আমি…’

খুশির চোটে সে ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলোনা। হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসছিলো, আর চোখ দিয়ে ঝরছিলো পানি। ততোক্ষণে সৌমিক এসে মোহনার পেছনে দাঁড়িয়েছে। আরাফাতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুহি অবাক দৃষ্টিতে দেখছিলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে মেয়েটার। সে মোহনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ক-কে আপনি?’

‘আমি… আমি মোহনা… আরাফাত তুমি কথা বলছোনা কেন?’ জোর গলায় বললো মোহনা। তার কান্না কিছুটা থেমে এসেছে। আর তখনই, আকাশ চিরে আসা কড়া রোদ, সমুদ্রের শা শা গর্জন, আর চারিদিকের গমগমে ভাব, সবকিছু ভেদ করে মোহনার কর্ণকুহরে এসে ঢুকলো আরাফাতের কণ্ঠ। সেই কণ্ঠে বলা কথাটা থমকে দিলো মোহনাকে। খুবই সাবলীলভাবে বলেছিলো আরাফাত, ‘দুঃখিত, চিনতে পারলাম না। কে আপনি?’

মোহনার পৃথিবী যেন থমকে গেল। এই এতো সৌন্দর্য, সমুদ্র, সবকিছু যেন ফিঁকে লাগছে তার কাছে। চিনতে পারছেনা? আরাফাত তাকে চেনে না? শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মোহনা আরাফাতের দিকে। আরাফাত একটা হাসি দিয়ে রুহিকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো। পেছন ফিরে তাকালো না একবারও। মোহনা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আরাফাতের চলে যাওয়া দেখতে লাগলো। কতক্ষণ কাটলো জানা নেই। সৌমিক পেছন থেকে মোহনার দু’বাহু ধরে বললো, ‘চলো, মোহনা।’

মোহনা ফিরে তাকালো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘দ-দেখলে? ও নাকি আমায় চেনেনা। চেনেনা? আসলেই চেনেনা?’

‘চলো মোহনা।’ আস্তে করে বললো সৌমিক।

‘আরাফাত আমাকে চেনেনা বললো! ফিরেও তাকালো না… ও-ওটা ওর স্ত্রী? ভারি সুন্দর না?’ মোহনার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে। চারিদিকে বারবার মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। বিড়বিড় করছে, ‘চেনেনা? আমাকে চেনেনা? ও চেনেনা?’

সৌমিকের কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটা এমন কেন করল? একটু ভালো করে কথা বললে কী হতো? মোহনাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি সে এখানে বসে পড়বে। সৌমিক আর কোনো কিছু চিন্তা না করে মোহনাকে কোলে তুলে নিলো। তখনই সৌমিকের বুকে আছড়ে পড়ে নিঃশ্বব্দে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মোহনা। সেই কান্নার দমকে বারবার তার শরীর কাঁপতে থাকলো। সৌমিকের বুক ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় থমকালো মোহনা। আস্তে আস্তে তার মনে পড়তে লাগলো সেই স্বপ্নের কথা। যে স্বপ্নে আরাফাত তাকে বলেছিলো,
‘গগনতলে মিলিয়ে যাচ্ছে অংশুমালী,
মন সায়রের উষ্ণ কম্পন, সাথে ঊর্মিমালীর গর্জন।
উত্তাল ঢেউয়ের বাধা পেরিয়ে-
যাবে জলকন্যা? আমার সাথে?
ঐ জলারণ্যের ওপারে!’

জলারণ্যের ওপারে নিয়ে যাবে বলে সেই জলারণ্যের উত্তাল ঢেউয়ে যখন আরাফাত তাকে ফেলে চলে আসছিলো, তখন যে দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে উদ্ধার করেছিলো, তা ছিলো সৌমিকের। হ্যাঁ, ওটা সৌমিক ছিলো। তাকে নতুন জীবনে নিয়ে এসেছিলো। ঠিক আজকেরই মতো!

জাহাজ ছুটে চলেছে টেকনাফের উদ্দেশ্যে। রেলিঙের উপর দু’হাত রেখে আকাশপানে তাকিয়ে আছে আরফাত। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। নিশ্বাস থমকে যাচ্ছে বারংবার! অশান্তি করছে বুকের ভেতর। চোখটা জ্বালা করছে ভীষণ। রুহি পাশে দাঁড়িয়ে আরাফাতের দিকে তাকিয়েছিলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো, ‘ওটা মোহনা ছিলো, তাইনা?’

আরাফাত ঠোঁট কামড়ে তাকালো রুহির দিকে। উপর নিচে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। তার গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রুহি এক আঙুলে সেটা মুছে দিয়ে বললো, ‘পৃথিবীটা অনেক বড়। এখানে কারো সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ক্ষীণ। যেহেতু ওর সাথে আবার দেখা হয়েছে, খানিকটা সময় ভালো কাটানো যেতো।’

‘ও বিশ্বাসঘাতক, রুহি। বিশ্বাসঘাতক।’ বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আরাফাত। ভেতরে চলে গেল। রুহি কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর আস্তে আস্তে সেও ভেতরে গেল। তাকে তার স্বামীর মন ভালো করতে হবে যে!

বিছানায় বসে অঝোর ধারায় কাঁদছে মোহনা। কিছুক্ষণ পর পর হেঁচকি উঠছে। তারপরও কান্না বন্ধ হচ্ছেনা। সৌমিক বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান্নারত মোহনাকে দেখছিলো একদৃষ্টে। তার বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো মোহনাকে এভাবে কাঁদতে দেখে। তার প্রতিটা পশম কাঁদছিলো, প্রেয়সীর এই ক্রন্দনরত মুখ দেখে। সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। চোখ জ্বালা করছে। অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর সৌমিক ভেতরে গেল। মোহনার কান্না তখন বন্ধ হয়েছে। ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। সৌমিক পাশে গিয়ে বসলো।

‘মোহনা…’

‘আজকের পর থেকে কোনোদিন আমার অতীত নিয়ে কোনো কথা বলব না আমি। ভুলে যাবো, সব ভুলে যাব।’ শান্ত স্বরে বললো মোহনা। মোহনার এই কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। চমকে গিয়ে তাকালো সৌমিক তার দিকে। মোহনা আবার বললো, ‘আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ, সব এখনথেকে আমার স্বামী। আমার একটা বাজে অভিজ্ঞতার জন্য আমি তোমার ভালোবাসাকে অবহেলা করবনা।’

সৌমিক তখনও অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহনার দিকে। মোহনা খানিকটা এগিয়ে গেল সৌমিকের দিকে। তারপর সৌমিকের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘তুমি পারবেনা? পারবেনা তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমাকে নতুন করে গড়ে নিতে? একান্ত তোমার ব্যক্তিগত বানিয়ে নিতে? ভীষণ, ভীষণভাবে তোমার করে নিতে?’

‘পারব। পারব।’ আজলা করে মোহনার মুখটা ধরে বললো সৌমিক। মোহনা চোখ বন্ধ করলো। সাথেসাথে তার গাল বেয়ে নোনা জল গড়ালো। সেই জল সৌমিক তার দুই ঠোঁটের সাহায্যে মুছে দিলো। তারপর মোহনাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে বারকয়েক নিশ্বাস নিলো। সেই উত্তপ্ত নিশ্বাসের সংস্পর্শে কাঁপছিলো মোহনা। সৌমিক মোহনার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো, ‘তোমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগে সেই পানি আমি ওষ্ঠে তুলে নেব। মাটিতে পড়তে দেবনা।’

মোহনা এবার তাকালো সৌমিকের দিকে। সৌমিক ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। সৌমিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোহনা হুট করে সৌমিকের ঠোঁটজোড়া দখল করে নিলো। ধাতস্থ হতে সময় লাগলো সৌমিকের। তারপর সেও মেতে উঠলো নেশায়। কিছুক্ষণ পর হাঁপাতে হাঁপাতে সৌমিককে ছাড়লো মোহনা। সৌমিক উত্তপ্ত নিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকলো মোহনার দিকে। মোহনা নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি আমার সম্পূর্ণ অধিকার চাই।’

সৌমিক যেন এই কথাটিরই অপেক্ষায় ছিলো। মোহনার শাড়ি এক টানে খুলে তাকে শুইয়ে দিলো। মোহনার নেশায় আসক্ত সৌমিক পান করছিলো প্রেমের সুধা। একটু একটু করে মোহনার শরীরের প্রতিটি ভাজ আবিষ্কার করতে লাগলো সে। উত্তাল ঢেউ যেমন সবকিছু চুরমার করে দেয়, ঠিক তেমনি সেদিন সৌমিকের ছোঁয়ায় মোহনার খোলস চুরচুর করে ভাঙছিল, আর সৌমিকের ভালোবাসায় নতুন করে গড়ছিলো সব। অন্তরঙ্গতার ছোঁয়ায় মোহনাকে পুরোপুরিভাবে উন্মাদ করে দিয়ে সৌমিক ফিসফিস করে বলেছিলো, ‘তোমাকে আমি কখনও উন্মাদের মতো কাঁদতে দেবনা। উন্মাদের মতো কান্নার বদলে আজ থেকে তুমি এভাবে আমাকে উন্মাদের মতো ভালোবাসবে। আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে বাধ্য করব তোমায় আমাকে ভালোবাসতে। তুমি শুধুই আমার ব্যক্তিগত। একান্ত ব্যক্তিগত।’

সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সৌমিক৷ মুগ্ধ নয়নে দেখছে, মোহনার বাচ্চামি। বাচ্চাদের মতো পানি নিয়ে খেলছে মেয়েটা। পানিতে ভিজে তার পরনের কাপড় শরীরের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। মোহনার পূর্ণাঙ্গ নারীরূপ সৌমিকের ভেতরের সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে বারং বারংবার। সৌমিক মোহনাকে প্রথম দেখেছিলো একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানে মোহনা তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে ছিলো। সেই মোহনাকে প্রথমবারের মতো দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো সৌমিক। জীবনে এই প্রথমবারের মতো তার হৃদপিণ্ডে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলো একটা মেয়ে। পাগলের মতো সে তখন মোহনার ডিটেইলস খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে খবর পেলো, তারই এলাকার একটা ছেলের ব্যাচমেট মোহনা। ছেলেটার নাম মাহতিম। মাহতিমকে দিয়েই খবর নিয়ে জানতে পারলো, আরাফাত আর মোহনার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। সৌমিকের মাথায় জেদ চেপেছে। কিছুতেই সে মোহনাকে হারাতে চায়না। জল ঘোলা না হওয়া পর্যন্ত সে সেটা ঘাটতে থাকে। দিনের পর দিন সুযোগ খুঁজতে থাকে কীভাবে মোহনাকে নিজের করে পাওয়া যায়। এভাবেই একদিন সে জানতে পারে, আরাফাত নিজের বাবা মায়ের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে চায় মোহনাকে। এটা শোনার পর সৌমিকের মনে হলো, সে হাতে চাঁদ পেয়েছে। সে সুযোগটা কাজে লাগালো। মাহতিমকে দিয়ে মোহনার বাবার কানে একটা মিথ্যা বানোয়াট গল্প বানালো। মাহতিমকে দিয়ে মোহনার বাবাকে বলালো, আরাফাতের একটা স্ক্যান্ডাল আছে। ভার্সিটিতে তাকে একটা মেয়ের সাথে একটা বন্ধ ক্লাসে আপত্তিকর অবস্থায় হাতেনাতেই ধরা হয়েছে। ভার্সিটিতে পাওয়ারফুল থাকায় সেটা ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছিলো তারা। মোহনা বিষয়টা জানলেও বিশ্বাস করে নি। এই গল্পটা মাহতিম একা বলে নি, সাথে তিন চারজন স্বাক্ষীও নিয়ে এসে বলেছিলো। বিশ্বাস না করে উপায়ই নেই! শোনার পর আলতাফ চৌধুরী তাৎক্ষণিক আরাফাতের বাবাকে কল করে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। চরিত্রহীন ছেলের সাথে মেয়ে দিবেন না এও বললেন। আরাফাতের বাবাও কম নাকি? বিয়ে ভাঙার এই মোক্ষম হাতিয়ার উনি কীভাবে হাতছাড়া করবেন? উনিও সাথেসাথে বলে দিলেন, মোহনার মতো মেয়েকে তার ছেলের বউ করবেন না তিনি। যে মেয়ের বাবা সত্য মিথ্যা যাচাই না করে কথা শোনায়, সেই মেয়েকে তিনি বাড়ির বউ করবেন না। তিনি নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন। এইতো, আর কী? দুই পরিবার মিলে দু’জনকে নিজেদের মতো করে অনেককিছু বলে দু’জনের মধ্যেখানে একটা দেয়াল তৈরি করে দিলো। যে দেয়াল ইহকালে ভাঙার মতো নয়। আরাফাতের কাছে মোহনা বিশ্বাসঘাতক, কারণ মোহনা তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য এই নোংরা কাহিনী বানিয়েছে। আর মোহনার কাছে আরাফাত বিশ্বাসঘাতক, কারণ সে মোহনাকে কিছুই না জানিয়ে তাকে রেখে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে। হাহ! কী সুন্দর, তাইনা? কতো সহজেই জিতে গেল সৌমিক! এইজন্যই, ভালোবাসার মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। কারোর কথায় প্রভাবিত হয়ে মানুষটাকে অবিশ্বাস করতে হয়না। আমাদের চারপাশে যারা আছে, সবাই আমাদের ভালো চায় না। সবাই আমাদের মিত্র নয়।

নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো সৌমিক। মোহনার মিহি কণ্ঠ কানে এলো তার। মোহনা তাকে ডাকছে। একসাথে ভিজবে বলে। দু’হাত পকেটে রেখে হেসে হেসে এগিয়ে যাচ্ছে সৌমিক, মোহনার দিকে। মোহনা লাফাচ্ছে আর দু’হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। সৌমিক হেটে যাচ্ছে আর আপনমনে বিড়বিড় করে বলছে,

‘পাপ কিবা পূণ্য করি আমি,
হাসিল করেছি তোমারে,
তোমায় নিয়ে যাবো প্রেয়সী-
ঐ জলারণ্যের ওপারে!’

(সমাপ্ত)
@ফারজানা আহমেদ
শেষ হয়ে গেল ‘জলারণ্যের ওপারে’।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here