জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ১৪

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

১৪.
(অতীত)
———-
মোহনা বসে আছে তার বাবার সামনে। আজ তার ভার্সিটির প্রথম দিন। তাই আলতাফ চৌধুরী মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছেন কিছু কথা বলার জন্য। প্রায় সাত/আট মিনিট যাবৎ বসে আছে মোহনা। কিন্তু আলতাফ চৌধুরীর পত্রিকা পড়া এখনও শেষ হচ্ছেনা। এদিকে দশটা বাজতে চললো। সাড়ে এগারোটায় ভার্সিটিতে উপস্থিত থাকতে হবে। আলতাফ চৌধুরী এবার পত্রিকাটা নামিয়ে রাখলেন। মোহনা নড়েচড়ে বসলো। আলতাফ চৌধুরী বলতে শুরু করলেন, ‘তোমার চাচা, ফুফু, সবাই আমাকে বলছিলো, মেয়ে তো ইন্টার পাস করে ফেলেছে। এবার নাহয় বিয়েটা দিয়েই দাও। কতো ভালো ভালো পাত্রের সন্ধান আসছে।’

কথাটা এতোটুকু বলে থামলেন আলতাফ চৌধুরী। মেয়ের দিকে তাকালেন। মোহনা মাথানিচু করে আছে। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমি জানি, তোমার ইচ্ছা লেখাপড়া শেষ করার। আর আমার মেয়ের ইচ্ছা আমার কাছে পুরো দুনিয়ার কথা থেকে দামী। তাই এতো ভালো ভালো সম্বন্ধ আসার পরেও আমি এসবে পাত্তা দিচ্ছি না। আমি চাই, তুমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করো।’

এই পর্যায়ে এসে মোহনা তাকালো বাবার দিকে। দেখলো তার বাবা ঠিক তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মোহনার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। তার বাবা তার ইচ্ছাকে এতো দাম দিচ্ছেন! আলতাফ চৌধুরী বলছেন, ‘দেখো মা, নিজের ইজ্জত নিজেকে রাখতে হয়। মেয়েদের খারাপ পথে পা মাড়ানোর একটা সময় থাকে। যেমন ধরো, মেট্রিক অথবা ইন্টারে পড়া সময়গুলো। এই সময়টা মেয়েরা আবেগে ভাসে। কিন্তু এই সময়গুলো পার হওয়ার পর তারা পরিপূর্ণ হয়। ভুলের সংখ্যাটা কমে যায়। আবেগে না ভেসে তারা বিবেক দিয়ে চিন্তা করে। কোনো কাজ করার আগে সেটা নিয়ে প্রচুর ভাবে। আমার বিশ্বাস, তুমি এখন বিবেকবান হয়েছো। ভুল করার সময়গুলো পেছনে ফেলে এসেছো। আগেও আমার মান সম্মানে আঘাত হানে এমন কিছু তুমি করো নি, আমার বিশ্বাস এখনও এমন কিছুই করবেনা। তোমাকে কখনও দূরে কোথাও পড়তে পাঠাইনি। একা কোথাও পাঠাইনি। এখন তুমি একা ভার্সিটিতে যাবে বন্ধুদের সাথে। দূরে যাবে। তোমার চাচা আমাকে বলেছেন মেয়ের ঠ্যাং লম্বা করতেছিস। কিন্তু আমিতো আমার মেয়েকে চিনি। সে নিজেকে নিজে রক্ষা করতে জানে।৷ তোমাকে আমি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিচ্ছি। আশাকরি আমাকে তুমি নিরাশ করবেনা। এবার যাও। সাবধানে থেকো। মন দিয়ে লেখাপড়া করো।’

মোহনা একটা মুচকি হাসি দিলো। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা লাগছে তার। সে উঠে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘তোমার সব কথা আমি মনে রাখব বাবা। এমন কিছু করবনা যাতে তোমার মাথা নিচু হয়। দোয়া করো শুধু আমার জন্য।’

আলতাফ চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পরম মমতায়, পরম ভরসায়।

ভার্সিটির গেইটে ঢোকার সময় একটা আলাদা উত্তেজনা কাজ করছিলো মোহনার ভেতর। কেমন যেন খুশিখুশি লাগছিলো। কিন্তু ভার্সিটিতে ঢুকে অবাক হলো সে। পুরো ভার্সিটি খালি। দেখলো ক্লাসে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা বসে আছে স্কুলের মতো। গেইটে ঢুকেই খানিকটা হেঁটে লম্বা একটা সিঁড়ি। সিঁড়ি বাইতে বাইতে মোহনা তাহমিনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই আজকে আমাদের নবীন বরণ না?’

‘সেরকমই তো শুনলাম।’ এদিকওদিক তাকিয়ে বললো তাহমিনা।

‘তাহলে অনুষ্ঠানের কোনো ছিঁটেফোঁটা দেখিনা যে?’

‘তাইতো। নুরুল, দিপু, জান্নাত, কাউকেই তো দেখছিনা।’

‘একটা কল দে তো জান্নাতকে।’

‘ট্যাকা নাই ফোনে।’ মুখের ওপর জবাব দিলো তাহমিনা। মোহনা একটা বিরক্তিভরা শব্দ করল মুখ দিয়ে। তারপর জান্নাতের নাম্বারে কল দিলো। জান্নাত রিসিভ করলনা। দিপুর নাম্বারে কল দিলো। দিপু রিসিভ করেই বলল, ‘টাইমরাণী দেখি এইবার রেকর্ড করল! টাইমে টাইমে আসতে পারলোনা! কুড়ি মিনিট লেইট।’

‘এই প্যাঁচাল ছাড়তো। ক্লাস খুঁজে পাইনা।’

‘তুই ক্লাসে যাবি বইন? যাইসনা দোহাই লাগে। এইগুলা কী বালের নবীন বরণ বে? ছাত্রছাত্রীদের বসায়া রাইখা ওরা সবাই বক্তৃতা মারে। সারাজীবন শুনে আইলাম নাচ গান হয়। এইখানে দেখি উলটা। যাইসনা, পায়খানা ধরব তোর বসতে বসতে।’

মোহনা হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, ‘তুই আর মানুষ হইলি না।’

‘ভালা কথার দামতো নাই তোর কাছে। শোন, তাহমিনা আইছে?’

‘হ্যাঁ। আমার সাথেই।’

‘সিঁড়ি দিয়া সোজা উপরে উইঠা দেখবি অফিস-রুমের বামদিকে একটা চিপা গলি আছে। ওরে নিয়া এদিকে আইসা পড়। আমরা সবাই টিলাতে আছি।’

‘টিলা আছে এইখানে?’ অবাক হয়ে বললো মোহনা।

‘হয়, আছে। চিপা রাস্তায় আইসা ডাইনদিকে আইবি। আমরা এইখানে।’

‘আচ্ছা।’ বলে ফোন রাখলো মোহনা। ডানদিকে তাকিয়ে তাহমিনাকে কিছু বলতে গিয়ে ধাক্কা খেলো সে। তাহমিনা নেই! কোথায় গেল? ‘তাহমিনা…’ দু’একবার আস্তে আস্তে ডাকলো মোহনা। চারিদিকে তাকাতেই চোখে পড়লো, তিনটা ছেলের সাথে অফিস-রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কিসব কথা বলছে তাহমিনা।

‘আশ্চর্য! এরা কারা?’ বলতে বলতে এগিয়ে গেল মোহনা। গিয়ে দেখলো তাহমিনা খিলখিল করে হাসছে। মোহনা দেখেই বললো, ‘এই মোহনা। দেখ, আমার মামাতো ভাই। ফাইনাল ইয়ারে পড়েন উনি। এখানেই।’ তাহমিনা বললো একটা ছেলেকে দেখিয়ে।

‘ও। আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’ মৃদু হেসে বললো মোহনা।

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোন ডিপার্টমেন্ট?’

‘ম্যানেজমেন্ট।’

‘আমিও সেম। কোনো হেল্প লাগলে বলবে অবশ্যই।’ বলে হাসলো ছেলেটা। তারপর তার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করালো। কিছুক্ষণ কথা বলে ওরা বিদায় নিলো। মোহনা তাহমিনাকে বললো, ‘চল। পেছনদিকে টিলা আছে। ওখানে জান্নাতরা সবাই।’

‘আচ্ছা।’

প্রায় অনেকদিন পর বন্ধুরা একসাথে হয়েছে। এই ভার্সিটিতে সবাই চান্স পাবে বলেই এখানে এতো দূরে অ্যাপ্লাই করেছে সবাই। চান্সও পেয়েছে। অনেকদিন বাদে এক হওয়ায় আড্ডাটা জমেছে। তাহমিনা সাথে করে টিফিন নিয়ে এসেছে। অনেকগুলো পিঁয়াজু বানিয়ে এনেছে সবার জন্য। খেতে খেতে নুরুল বললো, ‘শুকনো মরিচ নিয়া আসলিনা?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, শালি জীবনে পুরা কাম করেনা। আধা আধা করে।’ বললো দিপু।

‘খাইতে দিছি শুকরিয়া কর।’ মুখ ঝামটা মারলো তাহমিনা। মোহনা আর জান্নাত হেসে উঠলো। জান্নাত বললো, ‘ভাই, আমি আজকে গেইটে ঢুকেই মারাত্মকভাবে ক্রাশ খাইছি।’

‘আমিও।’ বললো নুরুল।

মোহনা খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘জীবনে এটা ছাড়া কিছু আছে তোদের?’

‘আছে তো। তোর মতো সিরিয়াস বান্ধবী।’ বলে হাসলো তাহমিনা।

দিপু বললো, ‘আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন এবার।’

‘মানে?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো মোহনা।

‘মানে আমার আর তোর রোল একলগে। তার মানে আমাদের সিট পাশাপাশি পড়বে। তুই আমারে দেখাবি। নো চিন্তা ডু ফুর্তি।’ বলে খ্যাটখ্যাট করে হাসতে লাগলো দিপু। সবাই হাসলো।

‘এই তোমরা কোন ডিপার্টমেন্ট? কোন ইয়ার? এই নির্জন জায়গায় কী করছ ক্লাস রেখে?’

একটা গমগমে পুরুষকণ্ঠ ধমকে ধমকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলো মোহনাদের। ছেলেটাকে দেখে তাৎক্ষণিক সবাই দাঁড়িয়ে গেল, মোহনা ছাড়া। সবার মুখ ফ্যাঁকাসে। ছেলেটা মোহনার দিকে তাকালো। সাথেসাথে তাহমিনা মোহনাকে বললো, ‘দাঁড়া বে। দাঁড়া।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে বললো মোহনা।

ছেলেটা এবার মোহনাকে আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো, ‘হেয় ইউ, স্ট্যান্ড আপ!’

চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here