#জলারণ্যের_ওপারে
——————————
১৫.
ছেলেটার ধমকে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না মোহনা। সে শান্ত দৃষ্টিতে পরখ করলো ছেলেটাকে। তারপর বন্ধুদের বললো, ‘কীরে? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন তোরা? বসবি তো!’
মোহনার এই কথাটায় সবার বুকের ভেতর ছোটখাটো টর্নেডো বয়ে গেল। তাহমিনা ঢোঁক গিললো। তার মামাতো ভাই এখানে পড়ে। সেই সুবাদে সে এখানকার সবাইকেই চেনে। মোহনা ছেলেটাকে এরকম পাত্তা দিচ্ছেনা দেখে খানিক ভয় পাচ্ছে সে।
‘তোমাকে না বলেছি দাঁড়াতে?’ হিসহিসিয়ে বললো ছেলেটা।
‘কেন দাঁড়াব?’ দায়সারাভাবে প্রশ্ন করল মোহনা।
‘দাঁড়াতে হবে। এই নির্জনে কী করছ?’
‘আপনার দেখার বিষয় না। আর নির্জন নির্জন করছেন কেন? ৫/৬ জন যে জায়গায় আছে সেটা নির্জন হয় কীভাবে?’
‘তোমার সাহস তো কম না!’
‘আমি জানি।’
‘তোমার নামে কমপ্লেন করতে হবে।’
‘কিন্তু আপনি কে কমপ্লেন করার?’ এবার উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল মোহনা। এই প্রশ্নটায় খানিক থমকালো ছেলেটা। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মানে? কী বলতে চাইছো?’
‘বলতে চাইছি…’
কিছু একটা বলতে নিচ্ছিলো মোহনা, কিন্তু মাঝপথে দিপু বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘মোহনা প্লিজ। এটা তোর গুন্ডামির জায়গা না।’
দিপুর কথায় পাত্তা না দিয়ে মোহনা ছেলেটার দিকে একটা ভয়ঙ্কর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘বলতে চাইছি আপনি এখানকার স্টুডেন্টই নন। তাহলে আপনি কে কমপ্লেন করার?’
‘অ্যাঁ!’ অবাক হয়ে বলে উঠলো সবাই, শুধুমাত্র তাহমিনা ছাড়া। সে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আই লাইক ইট! এন্ড… আই লাইক ইউ!’ বলে হাসতে হাসতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো ছেলেটা।
‘তুই বড্ড বেশি বেশি করিস মোহনা। কে বলেছে এখানে হিরো হতে?’ রেগেমেগে বললো তাহমিনা।
‘ওটা হিরোইন হবে।’ ফোঁড়ন কাটলো জান্নাত। তাহমিনা চোখ লাল করে তাকালো ওর দিকে। তাহমিনার এই রূপ দেখে চুপসে গেল জান্নাত।
‘তুই কীভাবে জানলি এটা এখানকার স্টুডেন্ট না?’ উৎসুক দৃষ্টিতে জানতে চাইলো নুরুল। দিপুও তালে তাল মেলালো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কেমনে জানলি?’
‘আরে এখানে আসার সময় দেখলাম, তাহমিনার মামাতো ভাই না কি’তো ভাই একটা আছেনা? ঐ ভাইটা এই ছেলেটাকে বলতেছে যে, “কীরে তোর ভার্সিটিতে আজ ক্লাস নাই? এখানে আজ আসলি যে”। তোরাই বল, যদি এখানকার হতো তাহলে ওভাবে বলতো ভাইটা?’ বিজ্ঞের মতো হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো মোহনা।
‘ঠিক, ঠিক।’ সহমত পোষণ করলো নুরুল, দিপু, জান্নাত।
‘ও ভাইয়াদের ক্লোজ ফ্রেন্ড।’ ক্যাটকেটে গলায় বললো তাহমিনা।
‘তো?’ কপাল কুঁচকায় মোহনা। এবার তাহমিনা মিষ্টি করে হাসলো। তারপর বললো, ‘ছেলেটা হচ্ছে এখানকার প্রিন্সিপালের একমাত্র পোলা। আর এখানে যে সিনিয়ররা পাওয়ার খাটায়, তাদের ক্লোজ ফ্রেন্ড। এবার কমপ্লেন করলে সবকটা বাঁশ খাবো।’
কথাটা শোনামাত্র সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। মোহনাও। প্রথমদিনই এভাবে কাণ্ড বাঁধালো সে! মনেমনে নিজেই নিজেকে বকতে লাগলো। দিপু নুরুলের কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘চল ভাই। আমরা রাজমহলে যাইয়া সিঙ্গাড়া সমুচা খাই। পেট ভইরা পানি খাই। চিকেন রোল খাই। তারপরে বাড়িতে যাই। এই মাইয়াটারে এইখানে ফালায় যাই।’
শেষের লাইনটা অনেকটা ধমকের স্বরে বললো দিপু। জান্নাত বললো, ‘এই নুরুল, আমার তো মনে হচ্ছে আমরা কোনো বাঁশ টাশ খাবনা।’
‘আমারও মনে হচ্ছে।’ বলে সবার দিকে তাকালো নুরুল। মোহনা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘মানে?’
‘মানে, ছেলেটা মেবি তোর হিরোইনগিরির উপর ক্রাশ খেয়েছে। আই থিংক।’ বললো জান্নাত।
‘হ্যাঁ। দেখলিনা? যাওয়ার সময় কেমনে লাইক ইউ লাইক ইউ বলে গেল?’ নুরুল বললো দিপুকে আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। নুরুলের চোখে দুষ্টুমি। হাসিতে দুষ্টুমি।
‘আমি বাড়ি যাবো।’ ধমকে উঠলো মোহনা। দিপুও বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘এই ছাড়তো। চল এখান থেকে। বাড়ি যাই।’ বলে হাঁটা ধরলো। সবাই নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করলো।
★
দুপুর ১টা। অনিন্দপুর বিশ্ববিদ্যালয় (ছদ্মনাম) প্রায় খালি হওয়ার পথে। সব টিচাররা চলে গেছেন ইতোমধ্যে। তখনই প্রবেশ করলো আরাফাত। সে এখানকার ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, রাতে ঘুমায়নি। ঘুম থেকে উঠেই এখানে এসেছে। এসে দেখলো, বন্ধুরা সবাই যার যার বাইকে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাকে দেখে মোহিত বললো, ‘কীরে? সারারাত কী করছিলি?’
আরাফাত উত্তর দিলো না। সে চারিদিকে তাকাচ্ছে। দ্বিধায় আছে বাইক থেকে নামবে কি না। সে বললো, ‘আজকে নবীন বরণ ছিলো না?’
‘ছিলো তো। তার আগে তুই বল এই অবস্থা কেন? রাতে ঘুমাস নাই?’ বললো শাহেদ।
‘ঘুমাইছি।’ বলে আবার চারিদিকে তাকাতে লাগলো সে। মোহিত বললো, ‘তাহলে গাঞ্জুড়িদের মতো চোখ এমন লাল কেন?’
সেই কথাকে পাত্তা না দিয়ে আরাফাত বললো, ‘ফার্স্ট ইয়ারের সবাই চলে গেছে?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’ মোহিত বললো চিন্তিত সুরে। আরাফাত একটা অস্ফুটে শব্দ করলো। সম্ভবত ‘শিট’ বলেছে। পরিস্থিতি হালকা করতে শাহেদ হাসতে হাসতে বললো, ‘মোহিতের কাহিনী শুনছস?’
‘কিসের কাহিনী?’
‘একটা মেয়ে নাকি ওরে সেইরাম দিছে।’ বলে হাসলো শাহেদ। আরাফাত মোহিতের দিকে তাকালো। মোহিত বললো, ‘আমি ক্রাশ খাইছি। আমার ওর নাম্বার লাগবে।’
‘তাই? তোর গার্লফ্রেন্ড তাহলে কারে দিবি?’ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো আরাফাত।
‘কারে দিব মানে? আমার গার্লফ্রেন্ড কাউরে দিবনা।’
‘তাইলে নাম্বার চাস কেন?
‘এটাতো ব্যাকাপ মামা! বুঝোনা?’ একটু ভাবের সাথে বললো মোহিত। তারপর শাহেদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোর কাজিনের ফ্রেন্ড না ওটা? ওর কাছ থেকে নাম্বার দে।’
‘আমি তো দিতে পারব, সমস্যা নেই। তুই আরাফাতের কাছ থেকে পারমিশন নে।’ বললো শাহেদ। আরাফাত একটু কৌতুহলী হলো। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার পারমিশন কেন?’
মোহিতও জিজ্ঞেস করলো, ‘তাই তো, আরাফাতের পারমিশন লাগবে কেন?’
‘কারণ তুই যে মেয়েটার উপর ক্রাশিত সে হচ্ছে মোহনা।’
শাহেদের কথায় মোহিত থমকালো। সে একবার আরাফাতের দিকে তাকালো। দেখলো আরাফাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। আবার শাহেদের দিকে তাকালো। বললো, ‘স-সেই মোহনা?’
‘হ্যাঁ ভাই, সেই মোহনা। শালা তোর ভার্সিটিতে আসাই আমি বন্ধ করব এবার।’ বললো আরাফাত হিসহিসিয়ে।
‘এই আমার বাবা কিন্তু প্রিন্সিপাল!’ আঙুল তুলে বললো মোহিত।
‘তুমি ক্রাশ খেয়েছো?’ আদুরে কণ্ঠে আবার বললো আরাফাত।
‘না। জীবনেও না। হেহে, ফান করেছি। আচ্ছা বাড়ি যাব না?’
মোহিতের অবস্থায় হেসে কুটিকুটি আরাফাত আর শাহেদ। হাসতে হাসতে আরাফাতের মনে হলো, ইশ! আজকেই দেরি হতে হলো!
★
রাতের খাবার খাওয়ার সময় সোহানার গলায় মাছের কাঁটা বিঁধেছে। সে অনবরত কাঁদছে। দেখে মনে হচ্ছে মাছের কাঁটা এতো বেশিই ক্ষতিকর। এরইমধ্যে সে বারকয়েক শুকনো ভাত গিলেছে। তারপরেও কাঁটা যাচ্ছেনা। কাঁদছে আর বিড়বিড় করে বলছে, ‘রুনু ভাইকে কল দাও। রুনু ভাইকে কল দাও।’ মঞ্জুরা বারবার উনার বোনের ছেলে রুনুকে কল দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু ছেলেটা রিসিভ করছেনা। তার মায়ের বংশে একটা কথা প্রচলিত আছে, কারো গলায় মাছের কাঁটা বিঁধলে রুনুকে কল করলে সেই কাঁটা ছুটে যায়। ফোনের ভেতরেই রুনু কিসব দোয়া পড়ে ফু দেয়, এতেই কাজ হয়ে যায়। রুনু এও বলে, কেউ যদি তার সাথে খেতে বসে আর সে যদি কাঁটা গিলেও খায় তাহলেও নাকি গলায় সেই কাঁটা বিধবে না। মোহনা যদিও এসব বিশ্বাস করেনা। তার কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। এখানে বসে থেকে এসব দেখতেও ভালো লাগছেনা তার। সে তার রুমে গিয়ে দরজা লাগালো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো নয়টা মিসডকল। সে মোবাইল অফ করে শুয়ে পড়লো। আজ আর অন করবেনা। সকালে করবে।
★
চলবে……
©ফারজানা আহমেদ