আধঘণ্টা মার খেয়ে মুখে ফেনা উঠতে শুরু করেছে রজনীর। শরীর থরথর করে কাঁপছে মাটিতে উপুড় হয়ে। ঠোঁট,নাক কেটে রক্তাক্ত। ভ্রু’র কোনাটাও আংশিক কেটে গেছে।
পাশে দাঁড়ানো বিশালদেহী রজনীর মাসি হাফাচ্ছে অগ্নিদৃষ্টিতে রজনীর কাঁপা দেহটার দিকে চেয়ে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে ফের তিনি রজনীর এলোমেলো চুলগুলো টেনে ধরে বাজখাঁই গলায় বললেন,
” বল বিয়ে করবি?” কথাটা শেষ না হতেই চড় বসিয়ে দিলেন গায়ের শক্তি দিয়ে। গত দু’দিন না খেয়ে বেচারী রজনী এমনিতেও দূর্বল ছিল। আর এখন তো আধঘন্টার মারে মুমূর্ষু অবস্থা ওর। বাঁচার তাগিদে তাই অস্পষ্ট স্বরে কাঁপা গলায় বলেই ফেললো,
” আমি রাজি মাসি। আমি রাজি৷”
রজনীর মাসি বিমলা রাণীর মুখখানা সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টেনে ধরা চুলের মুঠিটা আলগোছে ছেড়ে মৃদু হেঁসে উঠে দাঁড়াল রজনীকে ছেড়ে। অসাড় হয়ে আসা দেহটা নিয়ে পড়ে গেল রজনী। চোখের জল আর ক্ষতের রক্ত মিলেমিশে একাকার। একবার ঝাপসা চোখে মাসিকে দেখল। বিমলা বন্ধ দরজা খুলতেই বাইরের আলো চোখে লাগল রজনীর। ঝাপসা চোখ দু’টো ধীরে ধীরে বন্ধ হলো ওর।
যখন চোখ খুললো বিয়ের সাজে সজ্জিত সে। ফোলা ফোলা মুখটা দেখে তার হবু শ্বাশুড়ি মা হাপিত্যেশ করতে লাগল। তার কথায় রজনী বুঝতে পারল তার মাসি তাদের মিথ্যা বলেছে। বলেছে পা পিছলে কলপাড়ে পড়েই নাকি এই অবস্থা রজনীর। রজনী বাকরুদ্ধ গত দু’তিনদিনের অত্যাচারে। এতিম রজনীর এই মাসিই ছিল মা -বাপ। অথচ সামান্য না না! সামান্য কেন হবে? অনেক কিছু পাবে তো রজনীকে বেঁচে তিনি। দুই ছেলের সরকারী চাকুরি, মেয়েটার বিয়ের পণ। এতোদিন খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করার জন্য এতোটুকু তো তাদের পাওনাই ছিল রজনীর কাছে। তারই ভুল হয়েছে। গত তিনদিনে কেন সে বুঝল না এ’কথা৷ রজনীর দু’চোখ গড়িয়ে টপটপ করে জল পড়ে। হাত পা ব্যথায় নাড়াতে পারছে না। পাছে চোখের জল হবু শ্বশুরবাড়ির কেউ দেখে ফেলে, এই ভয়ে বড়ো কষ্টে হাত উঠিয়ে জলটুকু মুছে ফেলল।
” এই তোরা বাইরে যা তো একটু।” একপ্রকার জোর করেই রজনীর পাশে বসা মেয়ে দুটোকে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে বাধ্য করল মিনু। মিনু ভালো নাম মিনতি বসাক। বিমলা রাণীর বড় পুত্রবধূ। সদা হাস্যোজ্জ্বল মিনু দরজা চাপিয়ে বসল রজনীর পাশে। এই একজনই আছে এ বাড়িতে যাকে রজনী মন খুলে সব বলে। রজনীর অনুক্ত কথাও যে বোঝে। মিনু হাত বাড়িয়ে রজনীর হাতটা তুলে মুঠোবন্দি করে বললো,
” কিছু খাবি?”
অবগুন্ঠনে ঢাকা মাথাটা মৃদু নাড়িয়ে না বলে রজনী। মিনু বললো,
” অল্প করে খা। ওষুধ ও তো খেতে হবে”
রজনী মুখ তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। শুকনো গলায় বললো,
” সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা বউদি?”
মিনুর হাসি মুখ মেঘে ঢাকল। হঠাৎ করে দু’হাতে রজনীকে জাপটে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল মিনু। মিনুর জাপটে ধরায় রজনীর ব্যথায় কাতর শরীরে আরও এক ঝলক ব্যথা অনুভব হলো। তবুও নির্বাক, অনুভূতিশূন্য হয়ে বসে আছে সে। কিছুক্ষণ বাদে ওকে ছেড়ে খাবারের থালা নিয়ে আসে মিনু। মিনুর অনুনয় বিনয়ে অল্প খাবার মুখে দিল রজনী। ব্যথানাশক ওষুধও তাকে খেতে হলো মিনুর কথা রাখতে।
” সব ঠিক যাবে দেখিস। ভগবান তোর মতো লক্ষিমন্ত মেয়ের সাথে অন্যায় করবে না।” মিনু আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললো।
” করবে না বলছ। এই তো হচ্ছে। দুঃখ কপালে সুখ নেই গো বউদি।” বিরবির করে বললো রজনী। সে’কথা মিনুর কানে গেল না৷ মিনু রজনীর হাতটা ধরে বললো,
” শোন, বরকে খুব ভালোবাসিস। স্বর্বস্ব দিয়ে তাকে ভালোবাসিস৷ তার চরণেই যে তোর ঠাঁই এখন। বিয়ের আগে ওমন অনেক কথায় বলে। আস্তে আস্তে তোকে ঠিক মেনে নেবে দেখিস।”
” স্বর্বস্ব! স্বর্বস্ব মানে কী গো বউদি? নিজের আত্মসম্মান বেঁচে দেওয়া নাকি মাতৃত্ব! তার সন্তানের মা হব অথচ তার স্ত্রী নয়। আমার কোল জুড়ে মাণিক আসবে কিন্তু তার মা হতে পারব না আমি। এরপর আর কী থাকে যা তার চরণে সঁপে দেব আমি?”
রজনীর বুক ফেটে কান্না আসছে। আজ তার বিয়ে নয় চিতা জ্বলবে। ঐ পবিত্র অগ্নিকুন্ডকে সাক্ষী রেখে সে চিতায় উঠবে। তারপর লাল সিঁদুর কপালে করে জ্বলতে থাকবে তার মগজ,দেহমন। মিনু অনেক কথায় বললো কিন্তু রজনী তার একটা কথাও শুনতে পেল না। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো মনে হচ্ছে। এভাবে কতোক্ষন কাটল রজনীর খেয়াল নেই। হুশ ফিরল ছোট বউদি রত্নার হাতের ঝাকুনিতে। সবাই মিলে ধরে নিয়ে চলল মন্ডপের দিকে। রজনী স্থির চোখের তারায়, কাঠের পুতুলের মতো হাঁটছে। এখনই ছেড়ে দিলে পড়ে যাবে যেন৷
রাত ঠিক তিনটে বাজতেই রজনীর সিঁথিতে সিঁদুর উঠল। সিঁথি থেকে কিছুটা পড়ল নাকের উপর। ছোটদার বিয়ের সময় রজনী কত স্বপ্ন বুনেছিল মনে মনে। ছোট বউদিকে দেখেই তার সেদিন প্রথম বউ হওয়ার ইচ্ছা জাগে৷ সিঁথিতে লাল টকটকে সিঁদুরে ভারী মিষ্টি লাগছিল ছোটবউদিকে তখন৷ আচ্ছা ওকেও কী মিষ্টি লাগছে ছোট বউদির মতো? না! বিবর্ণ সিঁদুরে কাউকে মিষ্টি লাগতে পারে? ওর এই সিঁদুর যে আর সবার মতো না। এর রঙ যে আর সবার মতো লাল টকটকে না। বিবর্ণ সিঁদুর কপালে পড়েছে ও। ধীরে ধীরে মুছে যাবে কপাল থেকে সিঁদুরের রঙ। সাথে তার জীবনের সকল রঙও। রজনীর চোখের কোনা জলে থই থই। দু’ফোটা টুপ করে পড়ল হাতের শাখা পলার উপর।
বিদায় ক্ষণ বেজে উঠল। সবাই কাঁদল রজনীকে ধরে কেবল ওর মাসি এলো না। রজনী এই শেষ সময়ে মাসিকে এক নজর দেখবে বলে এদিক ওদিক তাকায়। কোথাও দেখল না মাসিকে।
নিঃশব্দে কাঁদছিল গাড়িতে বসে রজনী। গাড়ি চলছে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সম্মুখে। রজনীর পাশে বসা তার স্বামী। রজনী তাকে ভালো করে দেখেনি আগে। এই যে পাশে বসে আছে এখনও সাহস কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই হচ্ছে না তাকে দেখার। মিনু বউদির কাছে শুনেছে তারা নাকি খুব বড়লোক। রজনীর স্বামীর নাম সৌমিত্র ব্যানার্জি। আমেরিকা প্রবাসী। বিয়ে উপলক্ষ্যেই নাকি এসেছেন তিনি। নিজের চেয়ে সতেরো বছরের ছোট গরিব রজনীকে বউ করবে শুধুমাত্র সন্তানের জন্য। সন্তান হওয়ার ছয়মাস পরেই রজনীকে ডিভোর্স দেওয়া হবে। হ্যাঁ এমনই চুক্তি তার মাসির সাথে হয়েছে এদের। রজনী এমন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল না বলেই দিনরাত মার খেয়ে মরতে বসেছিল। বাঁচার জন্য শেষমেশ তাকে রাজিই হতে হলো। শুধুই কী বাঁচবে বলে? না! তার মাসির ঋণ শোধ করবে বলেও সে রাজি হয়েছে।
রজনীর ভাবনায় ছেদ পড়ে পেটের যন্ত্রণায়। হঠাৎ পেটটা মুচরে ওঠে। গলা অব্দি উঠে আসে বমি। কী করবে এখন সে? সিট খামচে বসে রইল চোখ খিঁচে।
” কোনো সমস্যা?”
গাম্ভীর্য্য গলায় বললো সৌমিত্র। রজনী জবাব দিল না। এই মানুষটার সাথে কথা বলতেও তার ঘেন্না হচ্ছে। সৌমিত্র ভ্রুকুটি করে একবার রজনীকে দেখে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো। ঝুঁকে বসল রজনীর দিকে। রজনী সোজা হয়ে সিটের সাথে মিশে গেল বন্ধ চোখে। সৌমিত্র গাড়ির জানালা খুলে সরে এলো নিজের সিটে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
” বমি আসলে করতে পারো।”
সৌমিত্রের হুকুমের অপেক্ষায় ছিল কিনা কে জানে! বলা মাত্রই গরগর করে বমি করে দিল জানালা বাইরে মুখ রেখে রজনী। বমিভাব কিছুটা কমতেই সিটে মুখ নামিয়ে বসল। পানির বোতল এগিয়ে দিল সৌমিত্র। রজনী প্রথমে নিল না। শেষে সৌমিত্রের প্রচন্ড জোরে দেওয়া ধমকে ভড়কে গিয়ে পানির বোতল হাতে তুলে নিল। রজনীর বুক দুরুদুরু কাঁপছে সৌমিত্রের ধমক খেয়ে। কাঁপা হাতেই পানি পান করে সে। বাকি পথে আর কথা বলে নি সৌমিত্র তার সাথে। রজনীর কেন যেন মনে হলো সৌমিত্র তার উপর চটেছে। চটুক! যা ইচ্ছা মনে হয় করুক সে। রজনী তো তার কেনা দাসী। রজনী চুপচাপ মেনে নেবে, সয়ে যাবে। কোনোদিন মুখ ফুটে বিরোধ করবে না। কোনোদিন না। একবুক কষ্ট আর অভিমান পুষে নিঃশব্দে কাঁদছে রজনী। বাইরের অন্ধকার যেন তার জীবনেও ঢেকে গেছে।
বিবর্ণ সিঁদুর
পর্ব -০১
Writer Taniya Sheikh