এক ফাগুনের গল্প পর্ব ৭

#এক_ফাগুনের_গল্প
#পর্বঃ-০৭

স্যারের একটা বড় মেয়ে আছে সেটা জানা ছিল না আর সেই মেয়ের সাথে আমার রহস্যময় অবস্থায় দেখা হবে সেটাও ভাবিনি। মোহনার পিছনে পিছনে স্যার এর রুমে গেলাম, স্যার কার সাথে মনে হয় টেলিফোনে কথা বলছিলেন। আমরা প্রবেশ করার পরে কল কেটে দিয়ে আমাদের দিকে মনোনিবেশ করে বললেনঃ-

– কেমন আছো সজীব?

– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ স্যার।

– চট্টগ্রামের সব কাজ শেষ?

– হ্যাঁ গতকাল সকালে জাহাজ ইউরোপের উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছেড়ে গেছে।

– চট্টগ্রামের সবকিছু ফাইল রেডি করা হয়েছে?

– জ্বি।

– তুমি এক কাজ করো, সবগুলো ফাইল আরেকবার শুধু চোখের দেখা দিয়ে চেক করো। তারপর সেগুলো আমার চেম্বারে জমা দিয়ে বাসায় চলে যাও, তোমার ব্যবহৃত সবকিছু গুছিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আমার বাসায় চলে যাবে। ড্রাইভারকে বলা হয়েছে সে গাড়ি নিয়ে যাবে এবং তোমার সাথে মালামাল ধরতে সাহায্য করবে।

– ঠিক আছে স্যার।

– আমার মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে?

– জ্বি সামান্য।

– মোহনা খুব মেধাবী শিক্ষার্থী কিন্তু ওর ছোট ভাই ওর কাছে পড়তে চায় না তাই সমস্যা। নাহলে তো মোহনাই তাকে পড়াতে পারতো।

– জ্বি আঙ্কেল আসলে নিজের ছোট ভাইবোন গুলো কেমন যেন কথা শুনতে চায় না।

– হ্যাঁ সেটাই, আমার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে তাই আমি চাই ওরা দুজনেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক।

– আমি বললাম, মেডাম কোন ভার্সিটিতে পড়ে?

– কার কথা বলছো?

– পাশ থেকে মোহনা বললো, আপনার মেডাম ইডেন মহিলা কলেজে অনার্স ফাইনাল ইয়ার।

নিজের কেবিনে এসে কাজ করছিলাম, কাজের প্রতি মন বসাতে পারছি না। অর্পিতার কথা বারবার মনে পরছে, মোবাইল বের করে কয়েকবার কল দিয়ে চেষ্টাও করলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ। ভাবলাম আবারও একবার খুলনা শহরে গিয়ে ঘুরে আসবো, যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে তো একটু কথা হবে।

ঘন্টা খানিক পরে খবর নিয়ে জানলাম মোহনা চলে গেছে, অফিসের জন্য নতুন একটা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে গাজীপুরে তাই সেগুলোর কিছু পেপারে সাইন করার জন্য ওকে নিয়ে এসেছেন বড় স্যার। মনে হয় সেই ফ্যাক্টরি মোহনার নামে করবেন বা জমি তার নামে থাকবে। আমি অফিস থেকে বের হলাম বেলা সাড়ে বারোটার দিকে।

স্যারের বাসা ধানমন্ডির কলাবাগান এলাকায়, লেক থেকে সামান্য নিকটে। অফিসের গাড়ি করে নিজের ব্যবহৃত সবকিছু গুছিয়ে বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন মাগরিব পেরিয়ে গেছে। একজন বুড়ো মানুষ আমাকে একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন আর মালামাল অন্য লোক দিয়ে নামানোর ব্যবস্থা করতে লাগলেন। আমি ড্রইং রুমে বসে আছি, একটা মেয়ে এসে নাস্তা দিয়ে গেল তবে সেই নাস্তা অনায়াসে কুড়ি জনে খেতে পারবে।

স্যারের ছেলের নাম ফাহিম হাসান, ছেলেটা দেখতে ভদ্র প্রকৃতির মনে হচ্ছে কিন্তু বাকিটা পরে বোঝা যাবে। যেহেতু আজকে আসলাম তাই নাস্তা করে নিজের রুম গুছিয়ে নিচ্ছি। এমন সময় ফাহিম এসে বললোঃ-

– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, এসো ফাহিম।

– কি করছেন?

– সবকিছু গোছাচ্ছি, থাকতে হবে তো।

– আমি কিন্তু আপনাকে স্যার ডাকতে পারবো না, সবসময় ভাইয়া বলে ডাকবো।

– ঠিক আছে সমস্যা নেই।

– আজকে তো পড়াবেন না তাই না?

– সবকিছু ঠিক করে যদি সময় পাই তাহলে কিছু সময়ের জন্য নাহয় বসবো।

– আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

– দরকার নেই, তুমি বরং টেবিলে বসে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করো সেটাই ভালো হবে।

– একটা কথা ছিল ভাইয়া।

– বলো।

– আমার বড় আপু আছে, সে কিন্তু খুব সাংঘাতিক একটা মেয়ে তাই ওর সাথে মিশবেন না।

– কেমন সাংঘাতিক?

– সবসময় রেগে থাকে, কারণে অকারণে ঝামেলা তৈরী করে ফেলে, মা-বাবা দুজনই আপুকে ভয় পেয়ে চলে।

– তাই নাকি? তুমি ভয় পাও না?

– নাহহ।

– কেন?

– জানিনা।

ভেবেছিলাম মোহনার সাহায্য নিয়ে রুমটা সাজিয়ে নেবো কিন্তু বজ্জাত মেয়ে একবারও এদিকে আসে নাই। আমি সেই কখন আসলাম কিন্তু এখনো দেখা পর্যন্ত করে নাই, ধুর তাতে আমার কি?

রাতে খাবার টেবিলেও মোহনার সাথে দেখা হলো না, আমি আর স্যার দুজনেই অফিস আর ছাত্রজীবন নিয়ে আলোচনা করতে করতে খাবার শেষ করেছি।
ভেবেছিলাম একবার মোহনার কথা জিজ্ঞেস করবো কিন্তু পরে ভাবলাম সেটা বাড়াবাড়ি হবে। স্যার যদি তখন বলে যে ছাত্রের খবর না নিয়ে তার বড়বোনের খবর নিচ্ছি কেন? তখন কি জবাব দেবো? কি লজ্জা কি লজ্জা। পরক্ষণেই ভাবলাম মনে হয় সে হোস্টেলে থাকে তবে এ বিষয় সম্পুর্ন জানা যাবে ফাহিমের কাছে। রুমে বসে একবার ফাহিমকে ডাকার কথা চিন্তা করলাম। তারপর আবার সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম কারণ মোহনার কথা মাথার মধ্যে স্থান দেয়া যাবে না।

মোবাইলে কল এলো, তাকিয়ে দেখি চট্টগ্রামে থাকার সময় যে নাম্বার দিয়ে মোহনা কল দিয়েছিল সেই নাম্বার থেকে কল এসেছে। আমি রিসিভ করে বললামঃ-

– হ্যালো মোহনা?

– কি করছেন?

– বসে আছি তোমাদের বাসায়।

– আমি ফুপুর বাসায় গেছিলাম বিকেলে, সেখান থেকে মাত্র ফিরলাম। আপনি ডিনার করেছেন?

– হ্যাঁ।

– সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনি চায়ের নিমন্ত্রণ করেছিলেন আজ আমি যদি নিমন্ত্রণ করি তাহলে কি চা খাবেন?

– খাওয়া যেতে পারে।

– তাহলে সিঁড়ি দিয়ে ছাঁদে গিয়ে অপেক্ষা করুন আমি চা নিয়ে আসছি, সেখানে কথা হবে।

– এতরাতে ছাঁদে কেন?

– ভয় পাচ্ছেন? ভয় নেই আপনার স্যার কিছু বলবে না আপনাকে, অবশ্য তারা জানতেই পারবে না।

– তবুও কালকে দিনের বেলা দেখা হোক?

– বেশি কথা বলেন কেন?

– আমি খুব ক্লান্ত।

– আচ্ছা ঠিক আছে যেতে হবে না, আল্লাহ হাফেজ।

ভেবেছিলাম ঘটনা রাতের মতো সমাপ্ত হয়ে গেছে কিন্তু ভাবনা ভুল, কিছুক্ষণ পরে দরজা কড়া নাড়তে শুনতে পেলাম। দরজা খুলে দেখি মোহনা দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে দুটো চায়ের কাপ।

– আপনার চা।

– সরাসরি রুম সার্ভিস?

– রুমের ভেতরটা দেখতে পারি?

– তোমাদের বাসা যেহেতু তাই নতুন করে দেখার তো কিছু নেই।

– আচ্ছা বাদ দিলাম, কিন্তু প্রথম দিনের সাক্ষাৎকারে অনেক গুলো রহস্য ছিল সেগুলো জানবেন না?

– দিনের বেলা একসময় সেই আলোচনা করা হবে।

– আমি এখন বলবো।

– আমার মন-মানসিকতা বেশি ভালো না তাই আজ কিছু ভালো লাগছে না।

– কি হইছে জানতে পারি? কার জন্য মন খারাপ?

– অর্পিতার জন্য।

– অর্পিতা কে?

– আমি তাকে ভালবাসতাম।

– এখন বাসেন না?

– এখনো ভালবাসি।

– সে এখন কোথায় আছে? আপনাদের যোগাযোগ আছে? নাকি ব্রেকআপ হয়েছে?

– যোগাযোগ নেই, আমি মুসলিম আর অর্পিতা হিন্দু ধর্মের তাই আমরা আলাদা হয়ে গেছি। আমি কিন্তু তাকে ছেড়ে থাকতে চাই নাই কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। তিনমাসের বেশি হয়ে গেছে তার সাথে কথা বলতে পারি নাই, সে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।

– তার বাসার সামনে কিংবা চলার পথে কখনো দেখা করার চেষ্টা করেননি?

– আমি তার সন্ধান জানিনা।

– আমি কি সম্পুর্ন কাহিনীটা জানতে পারি?

– ঠিক আছে ভিতরে আসুন।

ঘটনা সবকিছু শুনে মোহনা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি রুবিকস কিউবটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেলাতে লাগলাম।

– আচ্ছা ধরুন অর্পিতা যদি আর ফিরে না আসে তাহলে আপনার কি করবেন? যে মানুষ নিজে থেকে হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজে বের করবেন?

– সেটা হয়তো সম্ভব না তবে আমি চেষ্টা করছি নিজেকে বাস্তবমুখী করে তৈরী করতে।

– সেটাই ভালো হবে।

– এবার আমার প্রশ্ন গুলো করি?

– হ্যাঁ করুন।

– স্যার বা আন্টি তারা কি করে?

– রাতের ডিনার শেষে মা-বাবা দু’জনেই ছাঁদে গিয়ে খানিকটা সময় পার করে। আমিও প্রায় সময় তাদের সঙ্গে থাকি তবে আজকে আপনার জন্য যাওয়া হলো না।

– স্যার মনে হয় খুব রোমান্টিক তাই না?

– হ্যাঁ খুব রোমান্টিক, বাবাও আপনার মতো কোন একজনকে ভালবাসতেন। তার সাথে বিয়ে হয়নি বলে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে, ভার্সিটিতে থাকতে মা অনেক পছন্দ করতেন বাবাকে। বাবা যখন ভেঙ্গে পরে তখন মা সেই ভেঙ্গে পরা মানুষটাকে জোড়া লাগিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখান। বিয়ের সময় বাবা মা’কে কথা দিয়েছেন যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে ছাঁদে বসে গল্প করার চেষ্টা করবেন। তাই বাবা অনেক ব্যস্ততার মাঝেও মা’র সাথে রাতের ডিনার শেষে ছাঁদে যায়। বাবা যখন দেশের বাইরে যায় তখন শুধু তাদের একসাথে ছাঁদে যাওয়া হয়না।

– এবার বলো, তুমি বড়লোক বাবার সন্তান হয়ে তবুও কেন বাসের মধ্যে চকলেট বিক্রি করতে?

– আমার একটা বান্ধবী আছে ওর বাসা কল্যাণপুরে আর ওর অনেক অসুস্থ। বান্ধবীর নাম সালমা, ও তার মা’কে নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। একদিন আমরা ক্যাম্পাসে কয়েক বান্ধবী এ বিষয় আলোচনা করছিলাম। তখন আমি বললাম যে আমিও আমার মা-বাবাকে ভালবাসি, কিন্তু ওরা বললো আমি বড়লোক বাবার সন্তান তাই আমি নাকি সালমার মতো লোকাল বাসে চকলেট বিক্রি করতে পারবো না। ওদের সাথে বাজি ধরে আমি সেই চিরকুট আর চকলেট নিয়ে রাস্তায় নেমে বিক্রি করেছি। বোরকা পরে মুখ এমন ভাবে বেঁধে নিয়েছিলাম যাতে করে পরিচিত কেউ দেখলেও আমাকে চিনতে না পারে। আর সেদিনই আপনার সাথে দেখা হয়েছে, আপনার কি মনে আছে আমি বলেছিলাম যে চকলেট বিক্রি নিয়ে কিছু সত্যি মিথ্যা লুক্কায়িত আছে।

– হ্যাঁ।

– এটাই সেই লুক্কায়িত সত্যি মিথ্যা, আর বাবার ল্যাপটপে অফিসের অনেকের ছবি থাকে। বাবার যখন মিটিং কনফারেন্স থাকে তখন তোলা হয়, আমি বাবার কাছে দেখেছি আপনাকে। তাও আবার আপনার সাথে বাসের মধ্যে দেখা হবার আগেই, সেই জন্য বাসের মধ্যে উঠে আপনাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো সত্যি জবাব দিবেন?

– চেষ্টা করবো।

– আমি যখন বাসে উঠে আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন আপনি নিজেকে হিরো মনে করেছেন তাই না? ভেবেছেন নিজেকে বলিউডের নায়কের মতো দেখা যাচ্ছে তাই মেয়েটা তাকিয়ে আছে। তাই মিঃ হাইব্রিড?

– মোটেই তা নয় বরং কৌতূহল হচ্ছিল।

– আর কোন প্রশ্ন আছে?

– তোমার সেই বান্ধবীর মা এখন কেমন আছে?

– অনেকটা সুস্থ, আপনি যাবেন একদিন দেখা করে আসবো?

– চেষ্টা করবো তবে ছুটির দিনে।

– ওকে।

হঠাৎ করে দুজনেই চমকে গেলাম কারণ মোহনার বাবা মানে স্যার মোহনাকে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছেন। ক্রমশ তার কণ্ঠের আওয়াজ আমার রুমের দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে ভয়ে মোহনার দিকে তাকিয়ে দেখি সেও শুকনা গলায় আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

চলবে…..?

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here