পথে হলো দেরি পর্ব ১৯

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১৯

,
,
শৌখিন গাড়ি ছুটিয়ে রিফাতের সাথে দেখা করতে চলেছে।
রিফাত একটু আগেই ফোন দিয়েছিলো।
তারা সবাই শৌখিনের কাছে ট্রিট চায়।কিসের ট্রিট সেটা তারা জানেনা।বিনা কারনেই একেকবার একেক বন্ধুকে ধরে বেধে তারা ট্রিট নেয়।
তো আজকে শৌখিনের পালা।
এমনিতেও কিছুবছর যোগাযোগ না থাকার কারনে শৌখিনের কাছ থেকে ফুটো পয়সাও তারা বের করতে পারেনি।
তাই আজ তারা সে আফসোস মেটাবে।শুধে আসলে তুলবে সব।
শৌখিনও বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে।
বন্ধুরা বন্ধুকে জালাবে না তো আর কে জালাবে?
সে গাড়ি চালিয়ে পথ চলে।
রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া প্রচুর।
শৌখিন গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে আশপাশটা চোখ বুলায়।
তার মন আজ ভালো।বেশ ভালো।ভেতরটা সুখী মানুষদের মতো চিন্তাহীন।যদিও মনের এককোনে মিতালির জন্য খারাপলাগা আছে,অপরাধবোধ আছে।
তবুও সে সুখি।
ইরাকে পেয়ে সে প্রচন্ড সুখী।
শৌখিন গাড়ি চালানোর ফাঁকে হঠাৎ হুট করে ব্রেক করে।
পেছনের কিছু গাড়িওয়ালা চিৎকার করে।হুট করে মাঝ রাস্তায় এভাবে গাড়ি থামানোর ফলে শৌখিনকে বকাবকি করে।তবে সে কথা শৌখিনের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।
সে সাইডে গাড়ি পার্ক করে নেমে পরে।
মিতালি তখন রাস্তার একপাশে রিকশার অপেক্ষা করছিলো।
শৌখিন অবাক হয়ে তার পাশে এসে দাড়ায়।
মিতালিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখে।
তাকে অন্যরকম লাগে।কালকের মিতালি আর আজকের মিতালির ভেতর পার্থক্য লাগে।
আজকের মিতালি শাড়ি পরিহিত,নাকে তার বড় নাকফুল।
বিবাহিত মেয়েদের মতো।
মিতালিও ততক্ষণে শৌখিনকে দেখেছে।সেই আগে বলে ওঠে,

—তুমি এখানে?

শৌখিন আন্দাজে ঢিল মারার মতো বলে,

—তুমি বিয়ে করেছো?

যদিও এখনকার যুগে শাড়ি, নাকফুল অবিবাহিতরাও পরে।তবুও শৌখিন প্রশ্নটা করে বসে।

মিতালি বলে,

—হ্যাঁ।

—কবে? কাকে?

–আছে একজন।

শৌখিন বেশ খুশি হয়।মিতালির জন্য ভালোলাগে তার।
মিতালিকে নিজের জিবনে এগিয়ে যেতে দেখে বুকটা শান্ত হয়।
সে খুশি মুখে বলে,

—কংগ্রাচুলেশন মিতালি!

—থ্যাংকস্।
তো এদিকে কোথাও যাচ্ছিলে?

–হ্যা,রিফাতের সাথে দেখা করতে।
তুমি এখানে দাড়িয়ে আছো যে?

—রিকশার খুঁজছি।

শৌখিন বলে ওঠে,

—কোথায় যাবে?চলো আমি পৌঁছে দিয়ে আসি?

মিতালি বলে,

—,না না আমি একাই যেতে পারবো।

আসলে সে শৌখিনের সাথে বেশিক্ষণ থাকতে চায়না।শৌখিনকে দেখলেই তার কান্না পায়।
বুক ভার হয়ে আসে।
এই যে শৌখিনের গলায় আচরের দাগ,সেটা দেখার পর থেকেই মিতালির কান্না পাচ্ছে। হাউমাউ করে কান্না পাচ্ছে।
যদিও সে বিবাহিত।
তার এখন স্বামী আছে,সংসার আছে।
তারপরও মিতালির কষ্ট হচ্ছে।
যাই হোক না কেনো,শৌখিন তার প্রথম ভালবাসা।
প্রথম ভালবাসাকে কি এতো সহজে ভোলা যায়?
শৌখিন কথা শোনেনা।সে জোর করে।
বলে,

—আমার উপর রেগে আছো মিতালি?আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি তুমি?প্লিজ চলো।
আমার খুব ভালো লাগবে এতে।
প্লিজ।

অগত্যা মিতালি রাজি হয়।
সে যাবে।
শৌখিন খুশি হয়ে গাড়ির ডোর খুলে দেয়।
মিতালি সামনে বসে।
চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দেয় শৌখিন।

ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামায়।মিতালি এখানেই নামবে।
মুগ্ধ ভার্সিটি এসেছে।
সে বলেছে আজ সে মিতালিকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে।
ভার্সিটির সামনে মিতালিকে অপেক্ষা করতে বলেছে।
মিতালি ধীরেসুস্থে গাড়ি থেকে নামে।
শৌখিনের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা সূচক হাসি দেয়।
শৌখিনও প্রতুত্তরে হাসে।
মিতালি সামনে এগোতে গিয়ে নিচে থাকা কাঁদা মাড়িয়ে ফেলে।
ফলস্বরূপ স্লিপ কাটে।
তবে পরার আগেই শৌখিন দৌড়ে এসে মিতালিকে ধরে ফেলে।
তবে টাল সামলাতে পারেনা।
দুজনেই মাটিতে পরে যায়।কাঁদায় মাখামাখি হয় দুজনে।
মিতালি শৌখিনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে।
শৌখিনও হাসে।

ইরা ভার্সিটি থেকে বের হয়।শাম্মি পেছন পেছন আসে।
ইরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—আগের চেয়ে তুই বেশি সুন্দরী হয়ে গেছিস রে ইরা,ব্যাপারটা কি বলতো?
ভাইয়ার সাথে তোর কি সব ঠিক হয়ে গেছে নাকি?

ইরা লজ্জায় মাথা নিচু করে।মুচকি হেসে বলে,

—কিসব কথা যে তুই বলিস!

–সত্যি বলছি,বলনা?

ইরা প্রসঙ্গ পাল্টায়।সে বলে,

—এসব কথা বাদ দে তো।আগে তোর কথা বল?

—আমার আবার কি কথা?

—তোর সংসারের কথা,স্বামীর কথা।

শাম্মিও মুচকি হাসে।
সে সুখি একটা মানুষ।তার স্বামী নিরবের মতো মানুষ হয়না।শাম্মিকে খুব ভালবাসে।মাথায়,করে রাখে।
তবে একথা সে ইরাকে বলতে পারেনা।
নিরবের কথা বলতে গেলেই সে লজ্জা পায়।
হঠাৎ কিছু মনে পরায় শাম্মি উত্তেজিত হয়ে বলে,

—একটা দারুন খবর আছে রে ইরা।

–কি খবর?

—মুগ্ধ না বিয়ে করেছে।কাল বউ নিয়ে বাসায় এসেছে জানিস?

ইরাও অবাক হয়।ভাবে মুগ্ধ তাহলে এই জন্য বদলে গেছে?বলে,

—সত্যি?মেয়েটা কে রে?চিনিস নাকি?

—হ্যাঁ চিনিতো।
তুই ও চিনিস।নাম জানলে পুরো অবাক হয়ে যাবি।

—কি নাম?

শাম্মি বলার আগেই ইরার চোখ পরে ভার্সিটির গেটের কাছে কাঁদার মাঝে বসে থাকা হাস্যরত যুবক যুবতীর উপর।
কাদা মাখা থাকলেও ইরা এক নিমিষে তাদের চিনতে পারে।
শৌখিন আর মিতালির এতো কাছাকাছি বসে হাস্যরত অবস্থা দেখে ইরার বুকটা ধক করে ওঠে।
ভেতরটা কষ্টের অনলে জ্বলে ওঠে,
ভাবে শৌখিনের সাথে মিতালির এখনো যোগাযোগ আছে?এখনো সম্পর্ক আছে দুজনার?
তবে শৌখিন যে বলেছিলো সে মিতালিকে সবটা জানাবে?তবে কি সে বলেনি?
নিশ্চয়ই বলেনি।
নয়তো এতোটা স্বাভাবিক থাকতো না মিতসলি।পরনে তার এতো গুছালো শাড়ি?
এটাও কি সে শৌখিনের জন্য পরেছে?
ইরার চোখ জলে ভরে উঠলো।
শৌখিন কি তবে ধোকা দিলো ইরাকে?সে কি আসলে মিতালিকেই চায়?তাকেই ভালবাসে?
আর ইরা?
সে কি কেবলই ছিলো মোহ?
শাম্মি পেছন থেকে ইরাকে ধাক্কায়।বলে,

—কিরে এভাবে থমকে দাড়ালি কেনো?

ইরা কাঁপা কাঁপা গলায় কেনমতে বলে,

—বাড়ি যাবো।মাথাটা খুব ঘুরছে।
সে আর দাড়ায় না।হনহন করে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যায়।
পেছন পেছন ছোটে শাম্মিও।
সে আশেপাশে খেয়াল করেনা।
খেয়াল করলে হয়তো শৌখিন মিতালিকে দেখতে পেতো।হয়তো ইরার সাথে মিতালিকে তার দেবরের বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতো।

💮💮💮

—কাঁদার মাঝে কি করো বউ?

কথাটা শুনতেই মিতালি ভ্রু কুঁচকে ফেললো।এমন কথা কে বলতে পারে সে জানে।খুব ভালো করেই জানে।
তবে শৌখিন অবাক হলো খুব।
উঠে দাড়িয়ে সে মুগ্ধর দিকে তাকালো।
মিতালি ততক্ষণে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে।বললো,

—উল্টো পাল্টা কথা না বলে হাত ধরে টেনে তুলুন আমায়।

মুগ্ধ হেসে এগিয়ে এলো।মিতালির হাত দুটো যত্ন করে ধরে বসা থেকে দাড় করালো।
বললো,

—কাঁদায় কিভাবে পরলে বলোতো?নাকি আটা ময়দা মেখে মন ভরেনি তাই কাদা মাখছিলে?

মিতালি উঠে দাড়িয়ে শাড়িতে লেগে থাকা কাদা হাত দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করছিলো।মুগ্ধর কথায় সে তেড়ে এলো।বললো,

—খবরদার আমায় রাগাবেননা বলে দিচ্ছি।

মুগ্ধ ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,

—যাহ বাবা!রাগালাম কোথায়?আমি তো সত্যি কথা বলছি।

মিতালি চোখ বড় করে তাকাতেই মুগ্ধ পিছিয়ে গেলো।শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বললো,

—ভয় দেখাও কেনো?এমনিতেই গরুর মতো চোখ তার উপর আরও বড় করলে ভয় লাগেনা বুঝি?

মিতালি এতক্ষণ যাবত নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়ে এবার ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলো।তেড়ে এসে মুগ্ধর চুল টেনে ধরলো।চেঁচাতে চেঁচাতে বললো,

—শয়তান ছেলে!আমার চোখ গরুর মতো?আমার চোখ?

শৌখিন এতক্ষণ পাশে দাড়িয়ে হাবার মতো মিতালি মুগ্ধর ঝগড়া দেখছিলো।
তবে এবার তাদের ঝগড়া মারামারিতে রুপ নেওয়ায় সে দৌড়ে এসে মিতালিকে ছাড়ালো।
বললো,

—কি হচ্ছে টা কি?

মিতালি চুপ হলো।তার এতক্ষণ আশেপাশের কথা মনে ছিলোনা।বাঁদর ছেলেটা তাকে এতো রাগিয়ে দেয় যে অন্যকোন কথা তার মাথায় থাকেনা।
সে চুপচাপ মুগ্ধর পাশে এসে দাড়িয়ে শৌখিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—এটাই আমার হাসবেন্ড শৌখিন।

শৌখিন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,

—মুগ্ধ? মুগ্ধ তোমার হাসবেন্ড?

—হ্যাঁ।

মুগ্ধ চুলটা হাত দিয়ে ঠিক করে শৌখিনের দিকে তাকালো।
মিতালিকে ইশারা করে শৌখিনকে বললো,

—আর এই হচ্ছে আমার ঝগড়াটে সিনিয়র বউ!

মিতালি চোখ গরম করে বললো,

—আবার?

মুগ্ধ হেসে ফেললো।শৌখিনও হাসলো।সে এগিয়ে এসে মুগ্ধ কে জরিয়ে ধরে বললো,

—খুব সুখি হও তোমরা।
খুব খুব খুব সুখি হও।

মুগ্ধ প্রতুত্তরে মিষ্টি হাসলো।
,

,

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here