#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ২৫/শেষ
,
,
–আম্মু এতা কি?
ইরা বিরক্তিকর মুখে তাকায়।মেয়েটা বড্ড জ্বালাচ্ছে।সেই সকাল থেকে কিচেনে রান্না করতে করতে ইরা গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার।এমনিতেই মেজাজটা তার গরম হয়ে আছে তারউপর মেয়েটা কানের কাছে প্যানপ্যান করতে করতে কানের পোকা বের করে ফেলছে।
কিছুদিন হলো কথা বলতে শিখেছে সে।নতুন নতুন জিনিস দেখে জানার কৌতুহল হয় খুব তাই সারাক্ষণ একেওকে ধরে জিজ্ঞেস করে,এতা কি? ওতা কি?
ইরা বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে আবার ঠিক করে।
তাকে ছাড়া আর কাকেই বা জিজ্ঞেস করবে সে?
রেহেনা বেগম অসুস্থ মানুষ।
শরীর তার একেবারেই খারাপ।খাট থেকে উঠতেও পারেননা ইদানীং। বয়স বেড়েছে সাথে বেড়েছে অসুখ বিসুখ ও।
আর শৌখিন?সেতো সারাদিন রাত অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।মেয়ের সাথে কথা বলার সময় কোথায় তার?
সেই যে সাত সকালে বেরিয়ে যায় আর ফেরে রাতে।
ততক্ষণে স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে পরে।
বাবাকে সে শুক্রবার ছাড়া ঠিকমতো পায়ই না।
ইরা স্নিগ্ধার দিকে তাকায়।ইরা বিরক্ত হয়েছে সে হয়তো বুঝতে পেরেছে।তাই মুখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে আছে এককোনে।
ইরা মুচকি হাসে।
মেয়েটা তার মুখ ফুলানো অভ্যাসটাই শুধু পেয়েছে।আর সব স্বভাব চরিত্র তার বাবার মতো।দেখতেও বাবারই মতো।
ইরা গ্যাসের চুলার আচ কমিয়ে স্নিগ্ধার পাশে হাটু মুড়ে বসে।
বলে,
—রাগ করেছো?
স্নিগ্ধা তার মাথাটা এদিক ওদিক নাড়ায়।
ইরা আবার বলে,
–ওহ রাগ করেছো?তাহলে কি আর করার।আমি তো ভেবেছিলাম তোমায় একটা জিনিস দেবো।কিন্তু কেউ রাগ করে থাকলে তাকে কি কিছু দেওয়া যায়?
স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে আগ্রহের সাথে বলে,
—কি জিনিছ?
হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
—আমাল দাও আম্মু!
ইরা সাথে সাথ স্নিগ্ধার ছোটছোট হাতজোড়া আকড়ে ধরে।মুখে হাসি ফুটিয়ে কোলে তুলে নেয় তাকে।
রুমে গিয়ে একটা চকলেট তুলে দেয় হাতে।
স্নিগ্ধা খুশিতে ছোট ছোট গাল ভরিয়ে হাসে।হাসলে তাকে কি যে স্নিগ্ধ দেখায়!তার নামটার স্বার্থকতা বোধহয় হাসলেই ফুটে ওঠে।
ইরা মেয়েকে নামিয়ে আবার তাড়াহুড়ো করে কিচেনে এগোয়।আজ এখনো অনেক কাজ পরে আছে তার।
একা হাতে সব দিক সামলে উঠতে পারছেনা।
রহিমা খালার এক আত্মীয় মারা যাওয়ায় সে গ্রামে গেছে তাই আরও বেশি কাজের চাপ পরেছে ইরার ওপর।
🌸🌸
দুপুর পেরিয়ে রাত হয়।ইরা স্নিগ্ধাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরার অভ্যাস তার।যদিও বাবার সাথে দেখা হওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রাত জাগতে চায়।কিন্তু পারেনা।ঘুম এসে কাবু করে নেয় তাকে।
ইরা ট্রেতে খাবার সাজিয়ে রেহেনা বেগমের রুমে এগোয়।
কাছে বসে কপালে হাত রাখে।
রেহেনা বেগম চোখতুলে তাকান।
মেয়েটা তার পুরো সংসার কেমন নিজ হাতে সামলায়,তার খেয়াল রাখে,বাচ্চাটাকে সামলায়,শৌখিনের খেয়াল রাখে।
একহাতে কতো দায়িত্ব ঘারে তুলে নিয়েছে।
তিনি বলেন,
—স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে পরেছে?
ইরা প্লেট নিয়ে রেহেনা বেগমের সামনে রাখে।
খাওয়ার জন্য ইশারা করে।বলে,
—হুমম।
—খেয়ে ঘুমিয়েছে?
—হ্যাঁ।তুমি এখন ঝটপট খেয়ে নাও তো!
—খেতে ইচ্ছে করছেনা আজ।
ইরা শাসনের সুরে বলে,
—উহু তা বললে তো হবেনা।
না খেলে অসুস্থ হয়ে পরবে তুমি।তাছাড়া রাতের ঔষধ খেতে হবে।
রেহেনা বেগম বাচ্চাদের মতো করে বলেন,
—একদমই ইচ্ছে করছেনা।
ইরা হাত ধুয়ে প্লেটে হাত রাখে।খাবার নিয়ে রেহেনা বেগমের মুখের সামনে ধরে বলে,
—আমি খাইয়ে দিচ্ছি। একটু খাও!
রেহেনা বেগম খাবার গালে তুলে নেয়।তার কেনো যেনো চোখ জলে ভরে ওঠে।কেনো হয় এমন সে জানেনা।
মাঝে মাঝে অকারনেও তো কারো কান্না পায়?সুখের কান্না!
💮💮
শৌখিন ফেরে অনেক রাতে।তার আজ দেরি হয়ে গেছে।
অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছিলো।তারা ছাড়ছিলোই না তাকে।
তাছাড়া কতোদিন পর একসাথে হয়েছে তারা।
সবাই তো এখন যারযার কাজ,অফিস নিয়ে ব্যস্ত।
দেখাসাক্ষাৎ ই তো হয়না ঠিকমতো।
আজ এতোদিন পর জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে তারা।
শৌখিন বাড়ি ফিরে দরজায় কড়া নারে।
ইরা এসে দরজা খুলে আবার হনহন করে চলে যায়।
শৌখিন একটু অবাকই হয় ইরার কার্যকালাপে।
সে ভ্রু কুঁচকে নিজের রুমে এগোয়।
ঘর্মাক্ত ব্লেজার সোফার পাশে রেখে টিশার্ট ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।
ফ্রেশ হয় বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
বাইরে বেরিয়ে ইরাকে খোজে।
রুমে না পেয়ে বাইরে যায়।
কিচেনে খোঁজে।
ড্রায়নিং রুমে এসে টেবিলে নানা পদের খাবার ঢাকা দেখে শৌখিন আবার কপাল কুঁচকায়।
খাবারগুলো সব তার পছন্দের।কিন্তু আজ হঠাৎ তার পছন্দের এতো খাবার রান্না করার কারনটা কি?
শৌখিন চিন্তা করে।আজ কি বিশেষ দিন?কতো তারিখ আজ?
পরক্ষনেই চকিত হয়।
আরে আজ তো তাদের বিবাহ বার্ষিকী!শৌখিন কিনা এই দিনটা ভুলে গেলো?কিকরে?
সে চটজলদি নিজের রুমে দৌড়ে গেলো।
সারারুম খুঁজেও ইরাকে পেলোনা।
বেলকনিতে শব্দ শুনে সেদিকে এগোলো।
ইরা বেলকনিতে অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে।তার দৃষ্টি আকাশপানে।
আকাশে যেনো আজ তারার মেলা।
মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।আজ কি পূর্নিমা?
শৌখিনের মনে পরলো না।
সে ইদানীং কাজের মাঝে এতো ব্যস্ত থাকে যে কোনদিকেই তার হুশ থাকেনা।
অথচ ইরার ঠিক মনে থাকে।সেও তো কম ব্যস্ত থাকেনা!
শৌখিন এগিয়ে গিয়ে ইরাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো।
খোলা চুলে মুখ ডোবালো।
ইরা তবু কোন প্রতিক্রিয়া করলো না।সে আগের মতোই চুপচাপ আকাশ দেখায় মত্ত রইলো।
শৌখিন বুঝলো ইরা রেগে আছে।প্রচন্ড রেগে আছে।
সে আরও গভীর করে কাধে ঠোঁট ছোয়ালো।
ইরা কেপে উঠলো খানিকটা।
নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দুরে সরে দাড়ালো সে।বললো,
—কি সমস্যা? টেবিলে খাবার আছে খেয়ে যাও ঘুমাও গিয়ে।সকালে আবার অফিস আছে না?
শৌখিন বললো,
—রাগ করো কেনো এতো?ভুলে গেছিলাম তো?
ইরা তেড়ে এলে।বললো,
—ভুলবাই তো।ভুলবা না?সারাদিন অফিসে সুন্দরী সুন্দরী কলিগদের সাথে থাকো।বাড়ির বউয়ের কথা তো ভুলবাই।
শৌখিন হেসে ফেললো।বললো,
—একথা কিন্তু একদম ঠিক বলেছো।এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে কি যে বলবো?দেখলে শুধু তাকিয়েই থাকতে মন চায়।
ইরা আবার মুখ ফুলায়।কন্ঠে তার তীব্র অভিমান ঝরে পরে।বলে,
—তো যাও না,তাদের কাছেই যাও।
শৌখিন দুষ্ট হেসে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
—ঠিক আছে,যাচ্ছি।
ইরা অবাক হয়ে পেছন ঘোরে।শৌখিনকে বাইরে যেতে দেখে সে হুড়মুড় করে রুমে ঢোকে।
আনাচে-কানাচেতে চোখ বুলায়।
ভাবে শৌখিনকি সত্যি চলে গেলো?এককথায় এমন করলে সে?বুঝলো না,যে ইরা কথাটা রাগ করে বলেছে?রাগ ভাঙালোও না?
রাগে দুঃখে কান্না পেলো ইরার।
হঠাৎ পেছন থেকে শীতল হাত হেসে শাড়ি ভেদ করে ইরার কোমড়ে হাত রাখলো।নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—স্যরি বউ!এমন ভুল আর কক্ষনো হবেনা!
ইরা অভিমানী গলায় বললো,
—আর ঐ সুন্দর সুন্দর কলিগগুলো?
শৌখিন মুচকি হেসে বললো,
—আমার বউয়ের চেয়ে বেশি কোন সুন্দর মেয়ে আছে নাকি?আমার চোখে তো নেই।
—সত্যি?
শৌখিন ইরাকে সোজা করে দাড় করালো।চোখে চোখ রেখে বললো,
—হুমমম।
ইরাও চোখ রাখলো সে চোখে।যে চোখে চোখ রেখে সে সারাটাজিবন কাটিয়ে দিতে চায়।
এতোবছরের দুঃখের পর এতো সুখ যে তার কপালে ছিলো সে কখনো ভাবতেই পারেনি।কখনো কল্পনাও করেনি।
অতিরিক্ত আনন্দে তার চোখ ভরে আসে জলে।
শৌখিন ততক্ষণাৎ তা বুঝে ফেলে।
হাত দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলে,
—উহু,এ চোখে অশ্রু যেনো না আসে কখনো।
মুখে হাসি লেপ্টানো থাকবে সবসময়।
শৌখিনের কথা শুনে ইরা মুচকি হাসে।
শৌখিনও হাসে।দেরিতে হলেও সে তাদের জিবনে খুশি ফিরিয়ে আনতে পেরেছে যে!
,
,
সমাপ্ত।