ছোটগল্পঃ
চতুর্থাঃ (২য় খন্ড)
মোর্শেদা হোসেন রুবীঃ
~~~~~~~~~~~~~
-“কেন ফোন করেছো? বারবার এভাবে ফোন করে বিরক্ত করার মানে কি..?” পারুল থমথমে স্বরে বললো।
-” পারুল, আমি তোমার পায়ে পড়ছি। একবার, মাত্র একটাবার আমার সাথে দেখা করো জান। প্লিজ ! ” কাতর কণ্ঠে জবাব এলো ইসতির।
-” কেন, হঠাৎ দেখা করবো কেন? দেখা করার মতো কি হয়েছে? আর তোমার সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? তুমি তো মা ভক্ত ছেলে। আমাকে যে ফোন করেছো তোমার মায়ের অনুমতি নিয়েছো ?”
-” এভাবে লজ্জা দিওনা পারুল ! সবকিছুর জন্য আমি সত্যিই খুব লজ্জিত। ”
-“লজ্জিত ? লজ্জা বলে কিছু আছে নাকি তোমার? ”
-“এভাবে বলো না পারুল সোনা। আমার দিকটা একটু বুঝতে চেষ্টা করো ! কখন কোন পরিস্থিতিতে আমি বিয়েটা করতে রাজী হয়েছিলাম তুমি তো জানো না। জানলে আর রাগ করবে না! ”
-“এখন এসব জেনে লাভ কি..? গত পাঁচ বছরে তো জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি ! তাহলে এখন বলতে এসেছো কেন? নাকি নৌকা চড়ায়ে ঠেকেছে?”
-” বলো, যা খুশি বলো। তবু আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে। আচ্ছা, তুমি কি ভুলে গেছো সেসব দিনের কথা? যেদিন তুমি আর আমি নৌকায়…!”
-” আমার কিছু মনে পড়ে না ইসতিয়াক। আমার শুধু এতটুকু মনে আছে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছো তুমি। একটা বাচ্চা মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তার সর্বস্ব লুটে নিয়েছো । তোমার চরিত্রের আর কোনো কিছু অপ্রকাশিত নেই আমার কাছে। তবে, ঐ বয়সে সেটা বুঝিনি। আজ পারছি। তাই যত ভাবি তত ঘেন্না হয় নিজের উপর। কিভাবে পারলাম নিজেকে সেধে দিতে তোমার হাতে!”
-” এভাবে ভাবছো কেন? তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী। দস্তরমতো বিয়ে হয়েছে আমাদের। কোনোকিছুই অবৈধ ছিলো না! ”
-” ইসতিয়াক, আমাকে সেই ক্লাস টেন পড়ুয়া ষোলো বছরের পারুল পাওনি যে গাঁজাখুরি বুঝিয়ে শান্ত করবে। ঐভাবে বিয়ে হয়না। আমাদেরটাও হয়নি। কোনো মেয়ে নিজে নিজেকে বিয়ে দিতে পারেনা। বিয়ের কোনো শর্তই আমরা পূরন করিনি। না আমার কোনো ওয়ালি ছিলো, না ছিলো কোনো উপযুক্ত সাক্ষী, না তুমি আমাকে বিয়ে করে সমাজে ঘোষণা স্বরূপ কোনো ওয়ালিমা করেছো। এর প্রত্যেকটা বিয়ের শর্ত আর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। যারা এসব না মেনে কেবল সই করাকেই বিয়ে হয়ে গেছে মনে করে তারা রাসুলের সুন্নাহ থেকে বহু দুরে। আর আমি সেই পোড়াকপালিদের দলে পড়ে গেছি! ঐ কাগুজে বিয়ের জালে আটকে গেছি। “বলেই পারুল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো!
-” আমাকে ক্ষমা করো জান। আমি নিজের ভুলগুলো শোধরাতে চাই। বিয়ে করে তোমাকে সমাজে আমার স্ত্রী’র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাই!”
-” ইসতিয়াক, তোমাকে দেবার মতো কোনো গালি আমার জানা নেই বলে তোমার বদান্যতার ভাষা শুনে কেবল হাসলাম। কতটা হাঁদারাম ভাবলে তুমি আমাকে এভাবে প্রবোধ দিতে পারো। এটা বলছো না কেন যে, আমাকে বিয়ে করে নিজের গতি করতে চাইছো তুমি। অযথা ভালোবাসার ভন্ডামী করে নিজেকে কমেডিয়ান চরিত্রে উপস্থাপন না করলে কি হয় না তোমার…?”
-” এসব কি বলছো তুমি? আমার নিজেকে গতি করার কি হলো এখানে। এখনো আমি বিয়ে করতে চাইলে একশোটা মেয়ে পাবো । কিন্তু আমার প্রয়োজন তো তোমাকে। কারন আমি একই ভুল আর করতে চাইনা !”
-” আমিও…! আমিও আর ভুল করতে চাইনা। তাই প্লিজ, এভাবে আমার পিছু লাগা বন্ধ করো তুমি। আর ফোন করবেনা এখানে। রাখি!”
-” এক মিনিট…! এটাই কি তোমার শেষ সিদ্ধান্ত! ”
-” কেন, এখনও সন্দেহ হচ্ছে নাকি..? ”
-” ওয়েল, তাহলে কাজের কথায় আসি। শোনো, তোমার সাথে যে আমার বিয়ে হয়েছে এটা প্রচারের এখন সময় এসেছে। ভাবছি, মামা-মামীকে এসব জানিয়ে তোমার সাথে আমার গোপন অভিসারের খবরটিও চাউর করবো। সবাইকে জানাবো, আমার দুটো সংসারই তোমার কারনে ভেঙ্গেছে। তুমি ককান ভাঙ্গানী দিয়েছো ! ফলে তোমার আলটিমেট ক্ষতি হবে তিনটা। এক, তোমার অন্যত্র সুবোধ পাত্র পাবার আশা বাদ দিতে হবে, দুই, মামা স্ট্রোক বা এই জাতীয় কিছু করবে প্লাস আত্মীয় মহল থু থু করবে আর তিন, বিয়ে তখন তোমার আমার সাথেই হবে কিন্তু আজ যে সম্মানের সাথে হতে যাচ্ছিলো সেটা আর হবেনা বরং আম্মার চোখে তো বটেই পুরো আত্মীয় মহলে তুমি একদম ধূলায় মিশে যাবে। আর তোমার এহেন অবস্থা থেকে তোমাকে উদ্ধার করে ত্রাণকর্তা ভূমিকায় অবতীর্ণ হবো আমি..! তুমি সম্ভবত এটাই চাও। আজ তাহলে রাখি, কেমন !”
-“দাঁড়াও…! এসব করার পেছনে তোমার কারনটা কি জানতে পারি? তুমি নিজেই তো বললে যে তোমার জন্য একশোটা পাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমার পেছনে এভাবে হাত ধুয়ে লাগার কারনটা কি বলবে…?”
-” কারন একটাই সোনা জানু। তুমি আমার স্ত্রী…! আমার প্রথম প্রেম, আমার প্রথমা! আমি তোমাকে একদম ভুলতে পারছি না! ”
-“হাসালে। আমি প্রথমা নাকি চতুর্থা…?”
-” লোকচক্ষুর আড়ালের আমার এক জনমের প্রথমাই এবার লোকালয়ে চতুর্থা হয়ে যাবে। রাজী হয়ে যেও বাবু, প্লিজ হ্যাঁ..?”
ইসতি ফোন রেখে দিয়েছে মিনিটখানেক হলো কিন্তু তারপরেও রিসিভার কানে ঠেকিয়ে স্তব্ধ বসে আছে পারুল। তাকে বিয়ে করার জন্য ইসতি যে ভালোবেসে পাগল হয়নি এটা তারচে ভালো আর কেউ জানে না।
একটা ক্ষীণ ধারনা মনে ভাসছিলো গত কয়েক দিন ধরে। সেটাকে এতোদিন পাত্তা দেয়নি। ইসতির দুটো বউ যাবার পর বাতাসে কিছু উড়ো কথার সাথে নিজের ভাসা ভাসা ধারনা মিলিয়ে আজ পারুল স্পষ্ট বুঝতে পারছে কেন ইসতি ওকে বিয়ে করার জন্য এতো চাপ দিচ্ছে। তার কারন আজ পারুলের কাছে স্পষ্ট। আর সেটা হলো ইসতি একজন বাঁজা পুরুষ। সে পারুল থেকে শুরু করে মাঈষা ও তৃতীয় বৌকেও আবাদ করতে পারেনি। প্রথমদিকে এটা নিয়ে একটু ভয়ে ছিলো কিন্তু পরে গর্ভে সন্তান না আসাটাকে নিজের সৌভাগ্য ভেবে এসেছে। আজ বিষয়টা খোলাসা মনে হচ্ছে। কিন্তু লোকসমাজে একথা কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে দেবেনা ইসতি বা তার মা অর্থাৎ মেজফুপী। এজন্যই কৌশলে পারুলকে বিয়ের নামে প্রহসন খেলতে চাইছে তারা। আর এটার মানে হলো, পারুলকে বাকি জীবন ইসতির বাঁজা স্ত্রী’র ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে হবে। আর তাতে ইসতি রক্ষা পাবে বাঁজা হবার বদনাম থেকে, পাবে ফ্রি সার্ভিস দায়িনী বউ এবং সমাজেও পাবে মহান এক পরোপকারী স্বামী হিসেবে সুনাম । বাহ্, অঙ্কের টিচার তাহলে অঙ্কটা ভালোই কষেছে। কিন্তু পারুলই বা কি করবে এখন। ওকে ডিভোর্স দিয়ে নিজে অন্যত্র বিয়ে করতে গেলে লোক জানাজানি হবে। তারচে বড় কথা, ওর সব কিছু জেনে ওকে বিয়ে করবে এমন পাত্র কোথায়। কারন পারুল তো নিজের অতীত গোপন করে বিয়ে করতে চায়না আগেও করেনি। অন্তত আর কেউ না জানুক পারুল তার স্বামীর কাছে সৎ থাকতে চায় ।
ফোনটা রাখার পর থেকেই মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে পারুলের। দুশ্চিন্তায় পাগল হবার দশা হয়েছে ওর। ইসতি যে ভেতরে ভেতরে এতোটা অমানুষ, আজকের পরিস্থিতি তৈরী না হলে এটাও জানতো না। চাইলে পারুল মুখ বুঁজে সব মেনে নিয়ে ইসতির সাথে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যেতে পারে। ওর স্ত্রী সেজে এক অপমানের জীবন বেছে নিতে পারে। অন্যথায়…! আসলে এর অন্যথা কি ? পারুল নিজেও জানে না। আর কোনো উপায়ই যে সামনে দেখতে পাচ্ছে না সে। মা ওকে ইসতির সাথে বিয়ে দেবার জন্য এক পায়ে খাড়া। ঐ দিকে ফুপীও ইনিয়ে বিনিয়ে বাবাকে প্রস্তাব করেছে। মা’ও সব শুনে এই সুযোগে বড় দাও মেরেছে। ফুপীকে বলেছে, “আমার অবস্থা তো জানোই সাহিনা। মেয়ের জামাই হিসেবে ইসতিরে আমি ক্যাশ এক লাখের বেশী দিতে পারবো না। আর যদি ফার্ণিচার না নাও তো ফার্ণিচারের টাকাটা দিয়ে দেবো। এর বেশী আমি আর পারবো না। ফুপীও নাকি বলেছে, তোমাদের যা সামর্থ হবে তাই তো দেবে ভাবী । আমার কোনো ডিমান্ড নেই। তাছাড়া পারুল তো আমার নিজেরই মেয়ে ! না নিলেই বা কি। শুধু তুমি মন খারাপ করবে বলে নিচ্ছি। তোমার নিজেরও তো একটা শখ আছে! ”
মেয়েরে লাখ লাখ টাকা সেধে দেয়া যে মেয়ের বাপের শখ এটা পারুল জীবনে এই প্রথম শুনলো। কিন্তু সব শুনেও মুখ বুঁজে সহ্য করা ছাড়া ওর আর কোনো উপায় নেই। গতরাতেও তাহাজ্জুদে আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছে এই বলে, আল্লাহ আমার একটা উপায় করে দাও। ইসতি মানুষ ভালো হলে আমি সব ভুলে গিয়ে ওকে মাফ করে দিতাম। নতুন জীবন শুরু করতাম কিন্তু ওর যে চেহারা আজ আমি দেখেছি তাতে ওর সাথে বিয়ে সংসার তো দুর, কথা বলতেও ঘেন্না হয় মা’বুদ। আমি কি করি..! ফুপীর হাবভাবে মনে হচ্ছে এই মাসের মধ্যেই বিয়ের পাঁয়তারা করছেন তিনি। পারুলের মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেলো। শেষে কিনা প্রেমিক রূপী লম্পটকেই স্বামীর মর্যাদা দিতে হবে।
====
দুপুরে ভাতটাও ঠিকমতো খায়নি পারুল। কোনোমতে দুটো মুখে দিয়েই শুয়ে পড়েছে। চোখ দুটো বুঁজে পড়েছিলো। এমন সময় ঈষিতার ফোন বাজলে সেটা কানে ধরে বিমর্ষ কণ্ঠেই জবাব দিলো,” হম, বল্..!”
-” ম্যাডামের মুড কি বেশী খারাপ..?”
-” আর আমার মুড! আমার মতো মেয়েদের মুড থাকতে নাই। আমার কথা বাদ দে। কেন ফোন করছিস সেটা বল্..! ”
-” একটা ফেভার চাইতে ফোন করেছি রে..। প্লিজ, না করিস না দোস্ত। তোর লেজে পড়ি! ”
-” ফাজলামী না করে কি ফেভার লাগবে সেটাই বল্..!”
-” একজনের সাথে দেখা করতে যাবো। মানে এক হবু বরের সাথে। উনার সাথে আগে কথা বলেছি। তো উনি আমাকে মানে পাত্রী সরাসরি দেখতে চান। এখন একা যাই কি করে বলতো ! হঠাৎ তোর কথা মনে পড়লো। যাবি আমার সাথে। একা ভীষণ নার্ভাস লাগছে রে..!”
-” আমি যাবো? আমি গিয়ে কি করবো? অবশ্য যদিও এমন সম্ভাবনা একেবারেই নেই যে তোর হবু বর তোকে বাদ দিয়ে আমাকে পছন্দ করবে কারন তুই সেই রকম সুন্দরী আর তোর পাশে আমি….!”
-” একটু বেশী হয়া গেলো না ? নিজের গায়ের রং নিয়ে এতো আপসেট থাকিস ক্যান তুই সবসময়? নিজেকে এতো আন্ডার এস্টিমেট করা ভালো না। যা বানাইসে আল্লাহয় বানাইসে। প্যাচাল রেখে তুই আধাঘন্টার মধ্যে নিউমার্কেটে আয়। ”
-” ওকে..!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারুল ফোন কেটে দিয়ে উঠে বসলো।
হাত মুখ ধুয়ে জামা বদলালো। সদ্য কেনা আবায়াটা গায়ে চড়িয়ে মাথায় হিজাব বাঁধলো। হিজাব অনেকদিন ধরেই করছে কিন্তু নিকাবটা করতো না। ইসতিদের খবরটা পাবার পর থেকে করা ধরেছে। এটা একটা দুর্বল চেষ্টা ইসতি আর মেজফুপীকে নিরস্ত করার। কারন তারা বোরকাওয়ালী একদম পছন্দ করেন না। বিশেষ করে বোরকা তো ইসতির দুচোখের বিষ। আগেও ওকে রঙীণ স্কার্ফগুলো পড়তে দেখলে খেপে গিয়ে বলতো, আমার সামনে এসব যন্ত্রনা পড়ে আসবানা তো। যতসব ভন্ডামী। শোনো, মনের পর্দা হইলো আসল পর্দা। মন ঠিক তো সব ঠিক। মাথার মধ্যে এসব আলগা তেনা প্যাঁচানের মানে কি! পারুল তর্ক করতো না, কেবল ইসতির সাথে ডেটিং এ যাবার দিনগুলো তে স্কার্ফ পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলো।
আর এখন তো নিকাব সহ ধরেছে। মা’কে ও বলে দিয়েছে, “আমার বোরকা পড়ায় বাধা দিতে পারবেনা ওরা, আগেই বলে দিলাম।”
যদিও পারুলের ক্ষীণ সন্দেহ আছে ইসতিদের নিয়ে। এরা মুখে বলবে, ‘আচ্ছা সমস্যা নেই,বোরকা পড়তে চায় পড়বে।’ কিন্তু দেখা যাবে বিয়ের পর ওর বোরকা বা হিজাব পড়া টোটালি বন্ধ করে দেবে এরা। ইসতির মতো বাটপারের পক্ষে সব সম্ভব।
নানান এলোপাতাড়ী ভাবনার মধ্য দিয়ে নিউমার্কেট পৌঁছালো পারুল। ঈষিতা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে। ওকে দেখেই হাত নাড়লো। পারুল এগিয়ে গেলে ওর হাত ধরে দুজনে রওনা দিলো ভেতরে।
ঈষিতা হালকা হেসে বললো,” শোন্, পারু। লোকটার সাথে তুই কথা বলবি। তার সম্পর্কে সব জেনে নিবি। কারন আমি তো লজ্জায় ভালো করে তাকাতেই পারবো না!”
-” নখরামি বাদ দে। বিয়ে করবি তুই আর কথা বলবো আমি, তাই না? ”
-” কি আশ্চর্য! তবে তোকে কষ্ট দিয়ে আনালাম কেন। তুই অনেক গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে পারিস বলেই না…! ”
-“তাই বলে…!”
-” চুপ, এসে গেছি।” বলে পারুলকে নিয়ে একটা বেকারীতে প্রবেশ করলো ঈষিতা। কাকে যেন সালাম দিলো।
পারুল কানে কানে বললো,” কাকে সালাম দিলি? এখানে তো ঐ দাড়ীওয়ালা মটুটা ছাড়া আর কেউ নেই। ”
ঈষিতা উত্তর দেবার আগেই ক্যাশবক্স থেকে নেমে এলো লোকটা। ঈষিতাকে ইঙ্গিতে কোনের একটা টেবিল দেখিয়ে দিলে সে পারুলকে নিয়ে ওখানে গিয়ে বসলো। পারুল ফিসফিসিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওদের টেবিলে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে জয়েন করলো ঐ ক্যাশবক্সের দাঁড়ীওয়ালা লোকটাই।
সশব্দে সালাম দিয়ে চেয়ার টেনে বসেই বললো ,” এতো দেরী কেন? অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতেসি। যা হোক্, কথা শুরু করার আগে একটু গলাটা ভিজায়া নেয়া যাক। কি বলেন ? ” শেষ কথাটা পারুলকে উদ্দেশ্য করে। কারন লোকটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু পারুল মুখ নামিয়ে বসে আছে।
আচমকা ঈষিতা ওকে গুঁতো মারলে সে চমকে গিয়ে বললো,” জ্বী, সমস্যা নেই। ”
লোকটা হাত উঁচিয়ে তুড়ি বাজালে তিনটা সফট ড্রিংকস চলে এলো। লোকটা নিজেই গ্লাসে ঢেলে পরিবেশন করলো সেগুলো। ঢালার সময় আড়চোখে তাকাতে গিয়ে লোকটার সুগঠিত আঙ্গুল গুলো চোখে পড়লো পারুলের। মোল্লার রুচি তো ভালোই । নখগুলাে কি সুন্দর করে কেটেছে। কিন্তু ঈষিতার পাত্র কই? এই দাঁড়িওয়ালা মোটুটা নিশ্চয়ই ঈষিতার মতো মেয়ের পাত্র নয়। নাকি এটা পাত্রের অভিভাবক। লোকটার গলা খাকারি তে চিন্তা ভঙ্গ হলো পারুলের।
-” আচ্ছা, কথা শুরু করা যাক, কেমন? আমার নাম হলো আমজাদ। আমজাদ হোসেন। এই যে বেকারীটা দেখতেসেন, এইটা আমার। পৈত্রিক ব্যবসা আরকি। খুবই চালু দোকান আমাদের। আগে আব্বা বসতো। তিনি মারা যাবার পর থেকে আমিই এটা চালাই। আরেক ভাই আছে, সে এসবে নাই। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মানুষ তো। তার নাকি প্রেস্টিজে লাগে। তাই…! ওহ্, আগেই বইলা নেই। আমি কিন্তু ভাই মেট্রিক পাস মানে আই. এ পরীক্ষা দেই নাই। বহু কষ্টে আই. এ ফার্ষ্ট পার্ট পাশ করছিলাম কিন্তু ফাইনালটা আর দিতে ইচ্ছা করে নাই। তাছাড়া কি হবে লেখাপড়া করে বলেন। বইতে যেসব লেখা আছে এসব তো জানিই। হুদাই সময় নষ্ট…! ওহ্…. স্যরি। মেয়েদের সাথে কথা বলে অভ্যাস নাই তো। এর জন্য…! আচ্ছা, এবার আপনার কথা বলেন শুনি। ” বলে পূর্ণ দৃষ্টিতে পারুলের দিকে তাকালো লোকটা।
পারুল পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,” জ্বী, আ…আমি মানে আমাকে বলছেন..?”
-” হম, আপনাকে না তো কাকে বলতেসি। আপনি পারুল না? ”
-” কিন্তু আমি মানে ঐ টা তো ঈষিতা। মানে পাত্রী…!” লজ্জায় মুখ দিয়ে কথা বেরোতে চাচ্ছে না ওর। হায় কপাল, এ কোন গাড়লের পাল্লায় পড়লো পারুল। আর ঈষিতা কোন আক্কেলে নিজের জন্য এমন আধাপাগল পাত্র জুটিয়েছে। দেখতে শুনতে মন্দ না হলেও ব্যাটা কথাতো বলে প্রচুর । আবার লেখাপড়াও কম। ঈষিতার মতো এম.এ পাশ মেয়েকে এর পাশে মোটেই মানায় না! ঈষিতা কি দেখে রাজী হলো! ”
পারুল ভুলেই গেলো ঈষিতা ওকে কী কী জিজ্ঞেস করতে বলেছে। পুরো পুরি খেই হারিয়ে ঈষিতার দিকে তাকালো পারুল। কোনোমতে বললো,” ঈষু, তুই কথা বল্ না ওনার সাথে! ”
ঈষিতা কিছু বলার আগেই আমজাদ নামের লোকটা বলে উঠলো,” আরে ও কি বলবো। কথা তো হবে আপনার সাথে আমার। তার আগে বলেন আমাকে অপছন্দ হয়নি তো..!”
পারুলের এবার জ্ঞান হারাবার দশা হলো। ঘেমে ভিজে উঠেছে ওর নেকাব। মুখের সাথে বিশ্রীভাবে লেগে যাচ্ছে সেটা। কথা বলতে গেলে ভেজা কাপড় মুখের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
পারুল হাত দিয়ে বারবার সেটা ঠিক করতে করতে বললো,” আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হয়েছে। ইয়ে মানে, ঈষিতা হলো…!”
-” ঈষিতারে আমারে পরিচয় করানো লাগবে না। ওরে আমি ভালো করেই চিনি। ছোটো থেকেই আমার চোখের সামনেই তো বড় হইলো সে। আমি আসলে আপনার সব কথা শুনেছি। আপনারা মেয়েরা অল্প বয়সে এতো বেশী পাকনামি করেন যে তার খেসারত দিতে গিয়ে জীবন নষ্ট করে ফেলেন। বিয়েতে ইসলামের শর্তগুলো কি জানেন ? এটা কি পুতুল খেলা? কবুল কবুল কবুল বললেই হয়ে গেলো, তাই না? এসব হিন্দী সিনেমা দেখে শিখছেন মনে হয়। ঐ যে, কেয়ামত সে কেয়ামত তাক একটা ছবি আছে না ? মানে, পোলাপান নষ্ট করার ধান্ধা আরকি। এক্কেবারে জান দিয়া ফালায়। যতসব ফাইজলামি। শোনেন, একটা মেয়ের কখনো ওয়ালী ছাড়া বিয়ে হয়না। তাছাড়া ছেলের উপর ওয়ালিমা ওয়াজিব। ছেলেটা সমাজকে জানাবে যে, সে এই মেয়েটার স্বামী। অনেকের এতে দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু এইটাই বিশুদ্ধ মত। আপনি কি মনে করে…?”
-” ঈষিতা এসব কি হচ্ছে…?” বাধ্য হয়ে পারুল ঈষিতার দিকে তাকিয়ে বলে বসলো এবার। ঈষিতা কাচুমাচু হয়ে বললো,” ছোটমামা, তুমি কাজের কথা না বলে এসব কথা বলা ধরলা কেন। আমার বান্ধবী তো নার্ভাস হয়ে ঘেমেটেমে একাকার!”
-” ওহ্, আচ্ছা..স্যরি স্যরি। আমি আসলে মানুষটাই এমন। রাখঢাক রেখে কথা বলতে পারিনা। আপনি বরং নিকাবটা আলগা করে বসেন। পাত্রের সামনে জায়েয অঙ্গ দেখানোর অনুমতি আছে। অবশ্য আমি আপনার ছবি আগেই দেখেছি ঈষিতার কাছে। মানে আমার ভালো লাগসে আপনারে আরকি..!” লোকটার কণ্ঠে এবার সামান্য লাজুকতা ফুটলো। কিন্তু পারুল ততক্ষণে পুরাই স্তম্ভিত।
কেবল ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বললো,” ছোটোমামা? আপনি ওর ছোটোমামা?”
-” জ্বী, আমি ওর একমাত্র ছোটোমামা। ওর মুখে আপনার সব শুনে আপনাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে ভাগনি আমাকে বললো, আপনি নাকি প্রায়ই এদিকে আসেন। আপনাকে একদিন আমার দোকানে নিয়ে আসবে। আপনি আসবেন শুনে আমি আজ কোথাও যাই নাই। বাইরে একটা কাজ ছিলো। বাদ দিসি। যাক্, ভালো কথা, আপনে রান্না জানেন তো? আমি কিন্তু খেতে ভালোবাসি ? ভুড়ি দেখেই আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চয়ই! হা হা হা…! আচ্ছা, আপনার চোখে চশমা কেন? চোখে সমস্যা? পাওয়ার কত এটার ? ”
মাথাটা ঝিমঝিম করছে পারুলের। লোকটা এখনো হাসিমুখে কিসব যেন বলে চলছে। পারুল ঈশিতার দিকে তাকাতেই ও আলতো করে নিজের কান ছুঁয়ে কি যেন বলছে। সম্ভবত ক্ষমা চাচ্ছে। পারুল লজ্জায় লোকটার দিকে তাকাতে পারছে না। মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। ঈষিতা যে কায়দা করে ওকেই দেখাতে নিয়ে আসছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পেলে আরেকটু ফিটফাট হয়ে আসতো। এই বোরকার কালারটা একদম ভালো না। নরমালি এদিক সেদিক পড়ে যায় এটা। তাছাড়া আজ এটা ইচ্ছে করেই পড়েছে যদিও জানে পাত্র ওকে রেখে পারুলকে দেখে আকর্ষিত হবে না তবু নিজের দিক থেকে সতর্ক থেকেছে কারন বলা তো যায়না। তাছাড়া ঈষিতা নিজেই বলে, পারুল তোর চোখ গুলা খুব সুন্দর রে। একদম ক্লিওপেট্রার মতো। ভালো করে দেখলে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করেনা। এসব সাত পাঁচ ভেবেই পারুল নিজেকে যথাসম্ভব ঢেকে ঢুকে এসেছে। একটা চশমাও জুটিয়েছে। অার এসব কি হচ্ছে…!”