চতুর্থা পর্ব শেষ

ছোটগল্পঃ
চতুর্থাঃ (শেষ খন্ড)
মোর্শেদা হোসেন রূবীঃ
~~~~~~~~~~~~~

-” আস্সালামুআলাইকুম, ভালো আছেন নাকি? ”
গমগমে কণ্ঠস্বরটা চিনতে পেরে খানিক চুপ রইলো পারুল। নম্বরটা ঐ দিনই সেভ করে রেখেছিলো সে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিলো,” জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি…?”
-” জ্বী, আমিও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ইয়ে আপনি কি ব্যস্ত? ”
-” জ্বী না। ব্যস্ত না। কেন?”
-” না, মানে। অসময়ে ফোন করে বিরক্ত করলাম কিনা…! একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা! ”
-” সমস্যা নেই, বলে ফেলুন..!”
-” সামনা সামনি বলতে পারলে ভালো হতো। ঈষিতাকে নিয়ে একটু আসবেন নাকি বাইরে..?”
-” খুব কি জরুরী…?”
-” একটু…!”
পারুল মুহূর্তকাল ভাবলো।
কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে বললো,” আসতে না চাইলে আমি জোর করবো না। তাহলে ফোনেই দশটা মিনিট সময় দেন, আমি বুঝায়া বলি!”
-” না, সমস্যা নেই। আমি আসবো..!”
-” আচ্ছা, আচ্ছা, অসংখ্য ধন্যবাদ। কবে কোথায় আসবেন, এটা ঈষিতার সাথে ফিক্সড করে নেন। আপনার যেখানে বসতে আরাম লাগে জানাবেন, আমি সেইখানেই বসবো!”
-” জ্বী…!” ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকালো পারুল। কি বলতে চায় আসলে আমজাদ। কোনো সিরিয়াস কথা না তো? পারুলের আগের বিয়ের ব্যপারে কিছু বলবে নাকি? নাকি তার সাথে আরেকবার দেখা করার বাহানা..! কথাটা মনে আসামাত্রই নিজেকে ধমকালো ,’ মানুষটা আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে বড় বাহাদুর বনে গেছিস!”
একটু পরেই ঈষিতা ফোন করে জানতে চাইলো পারুল কখন যেতে পারবে। পারুল সাত পাঁচ না ভেবেই বলে দিলো,” আজই…!”

দুপুরের রোদ মরে এলে পারুল বাড়ী থেকে বেরুলো। আজ ইচ্ছে করেই একটু পরিপাটি হয়ে নিয়েছে। কারনটা সে নিজেও জানে না। নিজেও একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “এতো সাজ কিসের তোর !” বলে নিজেই উত্তর খু্জে নিয়েছে,” এটা তো সাধারন ভদ্রতা,সেদিনের মতো ভুত বনে যাবো নাকি ব্যাটার সামনে…!!!”

আমজাদ আগে থেকেই বসে ছিলো কফি শপের দোতলায়। কার সাথে যেন জোরে জোরে ফোনে কথা বলছিলো সে। পারুল অতদুর থেকে তার সব কথা স্পষ্ট শুনতে পেয়ে মনে মনে ভাবলো,” লোকটা কি সবসময় এরকম চেঁচিয়েই কথা বলে?”
অবশ্য পারুলকে দেখেই কথা শর্টকাট করলো সে। তবে ঐটুকু সময়ের মধ্যেই পারুল লোকটাকে আপাদমস্তক জরিপ করে ফেললো। লোকটাকে আজ একেবারেই অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেদিনের সাথে মেলাতে পারছে না পারুল। হালকা একটা অফ হোয়াইট টি শার্ট পড়েছে, সাথে এ্যাশ কালারের প্যান্ট। লোমশ হাতগুলো লোকটার পুরুষালি অবয়বের স্বাক্ষর বহন করছে। পারুল মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো লোকটার হাতগুলো বেশ দর্শনীয়! পালোয়ান টাইপ। আড়চোখে পায়ের দিকেও একবার তাকালো পারুল, টাখনুর সামান্য ওপরে এসে প্যান্টের ঘের থেমে গেছে। এখান থেকেই লোমশ পা গুলো দেখা যাচ্ছে। পায়ের বেল্টের জুতাটাও বেশ রুচিশীল। ঢোলাঢালা শার্টের কারনে লোকটার আদুরে ভূড়িটাও আজ অনেকটা অদৃশ্য। বেশ ভালোই মাঞ্জা মেরেছে ভদ্রলোক। সবই কি ওকে ইমপ্রেস করার জন্যে..?” শেষ লাইনটা মনে আসাতে আপন মনেই অকারন পুলক বোধ করলো পারুল।
লোকটা সামান্য হেসে চেয়ার দেখিয়ে ওদের বসতে বলে ওয়েটারকে তুড়ি মেরে ডাকলো। তুড়ির শক্ত আওয়াজে কিছুটা চমকে উঠে হাসি চাপলো পারুল। সাথে সাথেই লোকটার নাম দিয়ে ফেললো পারুল, ‘বনমানুষ’! লোকটার অবয়বের সাথে নামটা বেশ যায়।
-” কেমন আছেন বলেন। এতো শুকাইসেন ক্যান? খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করেন না নাকি? ” আমজাদের কথায় পারুল কিছু না বলে সামান্য হাসলো।
সে সামান্য ঝুঁকে বললো,” আপনে কি সবসময়ই এইরকম কথা কম বলেন না খালি আমার সামনেই লাজুকলতা?”
পারুল বিব্রতমুখে লোকটার দিকে তাকিয়ে ঈষিতার দিকে তাকালো। ঈষিতা দুনিয়া ভুলে মোবাইলে চোখ রেখে বসে আছে। কানেও হেডফোন গুঁজে দিয়েছে পাজীটা। আমজাদ ঈষিতাকে একবার দেখে নিয়ে পারুলের দিকে তাকালো! গোঁফের আড়ালে হাসি লুকিয়ে বললো,” ঈষিতারে দরকার..?”
-” কি জন্যে ডেকেছেন সেটা বলুন!” পারুল নিজের অস্বস্তি ঢাকার জন্য নড়েচড়ে বসলো।
আমজাদ দুহাত বেড় দিয়ে বসে বললো,” হম, বলতেসি। তবে আজকে কিন্তু আপনারে দেইখা চিনতেই পারিনি। একদম অন্যরকম লাগতেসে। ছোটবেলায় একটা ছবি দেখসিলাম। নায়িকাটার নাম মনে নাই, কিন্তু আপনারে অনেকটা ওর মতো লাগতেসে। এটা বলায় আবার মাইন্ড করলেন নাকি..?”
পারুল হাসি চেপে মাথা নাড়লো,” নাহ্..!” আড়চোখে ঈষিতার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কষে একটা গালি দিলো ওকে। সে আজ ইচ্ছে করেই মোবাইলে ডুব মেরেছে।
এরই মধ্যে কমলার জুস চলে এলে নিজেই একটা গ্লাস পারুলের দিকে বাড়িয়ে ধরলো লোকটা। সাথে অন্থন আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।
পারুল ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর দিকে হাত বাড়াতেই লোকটা বললো,” আলুটা কম খাইলেই ভালো। অন্থনটা খান। কচি মুরগীর বুকের মাংসটা দিয়ে এটা বানায়। আপনারে আলু খাওয়ায়া নিজের চোখের আরামটা নষ্ট করতে চাইতেছিনা! ”
পারুল হাত গুটিয়ে নিলো। লোকটাকে যতোটা ভদ্র ভেবেছিলো আসলে সে মোটেও ভদ্র না। একটা মিচকা শয়তান। তলে তলে সবই দেখে। অথচ ভাব দেখায় তাকায়নি।
পারুলকে হাত গুটাতে দেখে বলে উঠলো লোকটা,” ও কি, হাত সরায়া ফেললেন কেন? আরে আমি তো এমনেই বলছি। নেন তো…! আই, তুই নেস না কেন?”
বলে নিজেই পারুলের হাতে একটা অন্থন ধরিয়ে দিয়ে নিজে শুধু জুস নিলো আমজাদ। পারুল ভদ্রতা করে তাকেও অন্থন ইশারা করতে হাত দেখিয়ে ইশারায় বারন করে জুসের গ্লাসে স্ট্র ডুবালো। ঐদিকে ঈষিতা ততক্ষণে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ডিসটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে টপাটপ মুখে পুরতে শুরু করেছে।

আমজাদ হঠাৎ কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো,” আমার আম্মা চাইতেসে বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক্। ওর আম্মাও তাই..!” ঈষিতাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে বললো। গতকালও আম্মা বলতেসে সামনের শুক্রবারে কাবিনটা করায়া রাখি। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না! ” বলে পারুলের দিকে তাকালো।
পারুল নিজেও বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। আমজাদ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” যেভাবেই হোক, বিয়ে তো জীবনে একটা হইসিলো আপনার আর সেটা থেকে পুরোপুরি মুক্ত না হয়ে নতুন জীবনে পা বাড়ানো তো সম্ভব না। আপনি বুঝতেসেন তো কি বলতে চাইতেসি? মানে আমি আপনার ডিভোর্স আর ইদ্দতের কথা বলতেসিলাম। আপনি যদি এরই মধ্যে ডিভোর্সটা সেরে ফেলেন তাহলে ইদ্দতের সময়টুকু আমি একটা কারন দেখায়া আমাদের বিয়েটা পিছায়া দিবো। পুরো ব্যপারটা আমি আমার উপর নিয়ে নিবো, আর ঐ ফাঁকে আপনে ক্লিয়ার হয়া গেলেন। কি, এটা ঠিক আছে না?”

পারুল খাওয়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। সত্যিই তো, এই ব্যপারটা তো সে ভেবেই দেখে নি। ডিভোর্সটা তো দরকার। তা না হলে নতুন বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। তারমানে ডিভোর্স আর ইদ্দত মিলিয়ে প্রায় তিন চার মাস সময় আরো লাগবে ওর। ততদিনে ইসতিয়াক যে কোথাকার পানি কোথায় নিয়ে ঢালবে কে জানে! আচ্ছা, আমজাদকে কি বলবে ইসতিয়াকের ওসব কথা? “নাহ্, সংকোচ হচ্ছে। সরাসরি না বলে ঈষিতাকে দিয়ে কথাটা ওর কানে পৌঁছে দিলেই বোধহয় ভালো হবে।
পারুল খেয়াল করলো আমজাদ উত্তরের আশায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে হালকা মাথা ঝাঁকালো। ছোট্ট করে বললো,” জ্বী..!”
আমজাদ নিজেও কিছুটা বিমর্ষচিত্তে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,” তাহলে আমাদের বাসা থেকে কাবিনের ডেট ঠিক করতে চাইলে আমি নিজের একটা ব্যক্তিগত কাজ দেখায়া কাবিনটা আপনার ইদ্দতের পরে ফেলি। আর আপনার বাসার দিকটা আপনি সামলে নিয়েন, ঠিক আছে?” পারুল সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লো। ওকে ইতস্তত করতে দেখে আমজাদ তাকালো,” কি, কিছু বলবেন?”
” হ্যাঁ, মানে। আমি একা এসব ডিভোর্সের কাগজ টাগজ কিভাবে কি করবো মানে…!” পারুল কথাটা শেষ করতে পারলো না।
আমজাদ সামান্য হেসে বললো,” আরে, এতো ভাবেন ক্যান? আমি আছি কি করতে…!” পারুল এবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস চাপলো। তবে ওর মাথায় এবার নতুন চিন্তা দেখা দিলো। ইসতিয়াককে ডিভোর্স লেটার দেয়া মানে ঘটনাটাকে জাগিয়ে তোলা। আর ইসতিয়াক এটার পূর্ণ সুযোগ গ্রহন করবে। ডিভোর্স লেটার নিয়ে জনে জনে দেখিয়ে যে কি কাহিনী রচনা করবে কে জানে। আর বাবা…! বাবা জানলে যে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে ভাবতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে পারুলের। আমজাদকে কিছু বলবে কিনা মনস্থির করতে পারছে না সে।
এদিকে আমজাদ ততক্ষনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঝটপট পকেট থেকে পার্স বের করে একটা এক হাজার টাকার নোট ডিসে রেখে আঙ্গুলের ইশারায় ওয়েটারকে ডেকে ঈষিতার মাথায় টোকা মেরে বললো,” আই বুড়ি, গেলাম। বাকি টাকা তর কাছে রাখিস! ” বলে স্মিত হেসে একনজর পারুলের দিকে তাকালো। পারুল ওনার দিকে তাকিয়েই ছিলো। আমজাদ তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যাওয়ায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো।
আমজাদ বললো,” আমি যাই। যে কোনো দরকারে হাবিজাবি চিন্তা না করে গ্রাহামবেলের যন্ত্রটারে কাজে লাগাবেন, মনে থাকবো তো ? গেলাম! ” বলেই আমজাদ অদৃশ্য হয়ে গেলো। পারুল তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো করুন চোখে।

ঈষিতার সাহায্য নিয়ে ডিভোর্সের কাজটা খুব সহজেই সম্পন্ন করে ফেললো পারুল। অবশ্য এর পুরো কৃতিত্ব ঈষিতার। সেই সাহস যুগিয়ে যুগিয়ে কাজটা সম্পন্ন করতে ত্বরান্বিত করলো। তবে বিষয়টা মায়ের জানা থাকায় ততটা বেগ পেতে হলো না। ঐদিকে আমজাদদের বাড়ী থেকে জানানো হলো, আমজাদের ব্যবসায়িক কিছু জটিলতার কারনে আগামী মাস দুয়েক বিয়েশাদীর ঝামেলায় তারা যেতে পারছে না। আমজাদের মা নিজেই ছেলের আচরনে বিরক্ত বলে বারবার পারুলের মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। পারুলের মা পুরো ব্যপারটা বুঝতে পেরে আমজাদের মা’কে এটা নিয়ে লজ্জিত না হবার জন্য অনুরোধ জানালেন। কারন তিনি তো জানেন যে আমজাদ তার মেয়ের লজ্জা ঢাকতেই দোষটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। নইলে বিয়ের তাড়া তারই বেশী ছিলো।

পারুলের একান্ত ইচ্ছায় ডিভোর্সের চিঠি ইসতিয়াকের বাসার ঠিকানায় না পাঠিয়ে ওর অফিসের ঠিকানায় পাঠানো হলো। পারুল দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলো ইসতিয়াকের রিএ্যাকশনের জন্য। কিন্তু ইসতিয়াককে নিরব দেখে সে যারপরনাই অবাক হলো। সে কি তাহলে চিঠি পায়নি? কারন পেলে তো অন্তত একটা ফোন করতো। নাকি সে বড়সড় কোনো ঝামেলা পাকাবার বন্দোবস্ত করছে? চিন্তায় পারুলের নাওয়া খাওয়া বন্ধ হবার পথে। পারুলের মা নিজেও কম চিন্তিত নন। প্রতিদিনই মনে হয়, আজই বুঝি সাহিনার ফোন এলো। গেটে বেল বাজলে বুকটা ধ্বক করে ওঠে, এই বুঝি সাহিনা এলো।

এদিকে প্রতিদিনের মতো অফিসের কাজ সেরে বেরোবার পথে পিয়ন হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিতেই কিছুটা অবাক হয়ে গেলো ইসতিয়াক। খামটা উল্টেপাল্টে দেখলো। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের চিঠি। চিন্তিত মুখে খামটা খুলতেই একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো সে। ধীরে ধীরে মুখটা শক্ত হয়ে উঠলো ওর। কি করবে ভাবতে লাগলো ইসতিয়াক। পারুলের মতো কমবুদ্ধির মেয়ে এতো গুছিয়ে কাজ করেছে ভাবতেই অবাক লাগছে। ওর একার পক্ষে যে এই কাজটা সম্ভব নয় এটা কারো না বলে দিলেও চলবে। তাহলে বুদ্ধিটা কার ! হঠাৎ মনে পড়লো মা নিজেই সেদিন পারুলের বিয়ে পেছানো নিয়ে কি যেন বলছিলেন। কথাটায় তখন অতো গা করেনি ইসতিয়াক। পারুলের হবু বরের ব্যবসায়িক জটিলতার কারনে নাকি বিয়েটা পিছিয়ে যাচ্ছে। শুনে ইসতিয়াক নিজেও কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলো এই ভেবে যে, যাক্, কিছুটা সময় পাওয়া গেলো। কিন্তু বিয়ে পেছানোর কারন যে এটা, তখনো ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি। এখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে পারছে ইসতিয়াক। কিন্তু প্রশ্ন হলো পারুলকে এই পাকা বুদ্ধির যোগানদাতাটা কে..? কারন এই বিয়ে বহাল থাকাবস্থায় পারুলের ঐ বিয়েটার বিরুদ্ধে ইসতিয়াক আইনগত একটা ফেভার পেতে পারতো কারন এক স্বামী থাকতে পারুল আরেক স্বামী গ্রহন করতে পারে না। আর সেটা করার জন্য বিগত পাঁচবছরের কাল্পনিক দাম্পত্য সবার সামনে পেশ করা ওর জন্যে কোনো ব্যপারই না। ইসতিয়াক সোজা বলে দিতো যে পারুলের সাথে আমার স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক এখনো বহাল আছে। লোকে তাই বিশ্বাস করতো। ফলে পারুলের বিয়েটা সহজেই বানচাল হয়ে যেতো।
রাগে ক্ষোভে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো ইসতিয়াকের। ওভার কনফিডেন্টই ওকে বোকা বানিয়েছে। সে ধরেই নিয়েছিলো পারুল ওদের বিয়ের কথা কাউকে বলতে পারবে না। অথচ পারুল কি সুন্দর স্টেপ বাই স্টেপ আগাচ্ছে। তাহলে কি ইসতিয়াক ধরে নেবে পারুল একাই বুদ্ধি করে কাজটা করেছে? উঁহু…ইমপসিবল। ওকে পেছন থেকে কেউ গাইড করছে। কিন্তু সেটা কে?
পারুলের হবু বর আমজাদ নয় তো? আর যদি আমজাদ না’ও হয়ে থাকে তবে এখন তাকে এটা জানানো ইসতিয়াকের জন্য ফরয হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতত পারুলের সঙ্গে আপাতত ক্যাচালে যেয়ে কোনো লাভ নেই। বরং ওর শক্তির উৎস খুঁজে বের করে সেটাকে আগে ধ্বংস করতে হবে তখন পারুল নিজেই নির্জিব হয়ে পড়বে। অযথা আগেভাগেই মামাকে জানিয়ে নিজের ট্রাম্পকার্ডটা নষ্ট করতে চায়না ইসতি। তাতে পারুলকে ওর ফিরে পাওয়া আরো কঠিন হয়ে যাবে। কারন এসব জেনে যদি মামার কিছু হয়ে যায় তখন পারুল আর ওকে বিয়ে করতে চাইবেনা এটাই স্বাভাবিক। তারমানে আগে আমজাদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করা দরকার।
ইসতিয়াক ঘড়ি দেখলো। তারপর চিঠিটা পকেটে পুরে সোজা বেরিয়ে গেলো। দোকানের ঠিকানা আগেই জেনেছে সে। কাজেই খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। লোকটা দোকানেই ছিলো। ইসতিয়াক প্রথমে ভদ্রভাবেই জানতে চাইলো, এখানে আমজাদ কে? ”

আমজাদ ক্যাশে ব্যস্ত ছিলো। উঠে এসে সালাম দিয়ে নিজেই হাত বাড়িয়ে দিলো,” আমিই আমজাদ হোসেন। জ্বী, বলেন! ”

ইসতিয়াক আমজাদের বাড়িয়ে ধরা হাতটা না দেখার ভান করে বরং পুরো মানুষটাকেই আপাদমস্তক দেখলো। ঠোঁটে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের হাসি। পারুল শেষ পর্যন্ত এই বুনো ভাল্লুককে বিয়ে করতে যাচ্ছে? নাহ্, প্রতিদ্বন্দী হিসেবে একেবারেই দুর্বল। ইসতিয়াকের সামনে এর সোজা হয়ে দাঁড়াবারও যোগ্যতা নেই! ইসতিয়াক সিনা টান করে দোকানটার চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মনে মনে প্রীতি অনুভব করলো। যাক্, অন্তত আমজাদের চেয়ে বহু গুণে টপে আছে সে। ইংরেজীতে প্রশ্ন করলো,” আচ্ছা, আপনিই তাহলে আমজাদ মিয়া…?”
আমজাদ মৃদু হেসে বললো,” বাংলায় বললে ভালো হয় ভাইজান। ইংরেজী বুঝি কম। তবে এটুকু বুঝতে পারতেসি যে আপনে আমারেই খুঁজতে আসছেন। হ্যাঁ, আমিই আমজাদ, তবে মিয়া না, হোসেন। খামাখা বাপের দেয়া নামটারে বদলাবো কেন! তখনকার সময়েই দশ হাজার টাকা দামের খাসি দিয়া আকীকা করসিলো আমার আব্বা…! এখন বলেন, কেনো খুঁজতেসেন। কোনো অর্ডার আছে নাকি? ”

-” জ্বী, না! আমি কোনো অর্ডার দিতে আসিনাই। আমি এসেছি পারুলের ব্যপারে দুটো কথা বলতে। পারুলকে চেনেন তো…?”

-“ওওও….আচ্ছা…আচ্ছা…! পারুল ?” আমজাদ এবার ভালোভাবে তাকালো ইসতিয়াকের দিকে। ” আরে আসেন। বসেন। ” আমজাদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
দোকানের কর্মচারীদের ডেকে চা ঠান্ডা দিতে বললে ইসতিয়াক হাত তুলে থামালো।

-” ওসবের দরকার নেই। আমি আপনার সাথে কয়েকটা বিষয়ে আলাপ করতে এসেছি। সেটা শেষ করেই চলে যাবো! ”

-” জ্বী, বলেন। তার আগে এই চেয়ারটায় বসেন। বসে কথা বলি। আপনি সাহেব মানুষ অনেকক্ষণ দাঁড়ায়া থাকলে পা ব্যথা করবে। ” আমজাদ একটা চেয়ার টেনে ইসতিয়াককে বসতে দিয়ে নিজেও বসলো। কর্মচারী দুটোকে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিলো সে।

ইসতিয়াক কিছুক্ষণ ভেবে বললো,” পারুলের সাথে আপনার পরিচয় কতদিনের? কিভাবে চেনেন ওকে?”

-“বলবো, তার আগে আপনি বলেন তো। আপনি কে? আপনি কি ওর বড় ভাই..?”

-” না, বড় ভাই হবো কেন। আমি কে সেই পরিচয় পরে বলবো। তার আগে আপনি…!”

-” একমিনিট ভাইজান, আপনি যদি ওর বড় ভাই না হন তাহলে বাইরের কারো সাথে আমি আমার হবু স্ত্রী’র ব্যপার নিয়া কথা বলা পছন্দ করবো না।কারন স্ত্রী হলো খুবই ব্যক্তিগত একটা ব্যপার! মোবাইল, পার্স কিংবা নিজের ফোন নম্বরের চেয়েও বেশী ব্যক্তিগত। এটা যাকে তাকে দেখানো যায়না।”

-” খুব ভালো কথা। বিয়ের আগেই এতো ব্যক্তিগত মাল বানিয়ে ফেললেন যাকে সে স্বাধীন না অন্য কারো ব্যক্তিগত জিনিস সেটা জানার প্রয়োজন মনে করলেন না? এটা তো পরের জিনিস চুরি করে পকেটে ঢোকানোর শামিল! ”

আমজাদ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কথাটা শুনলো। ওর মন বলছে এটা পারুলের সেই ফুপাতো ভাই। কিন্তু এখানে সে কি ইন্টেনশনে এসেছে সেটা আগে জানা দরকার। তাছাড়া এখনি সে নিজের সবকথা এই লোকটাকে জানতে দিতে রাজী নয়। আমজাদ কিছুটা কৌশলী হওয়া প্রয়োজন মনে করলো। সে একটু অবাক ভাব দেখিয়ে বললো,” তাই নাকি..? বলেন কি…? আপনি বলতে চান পারুলের সাথে কারো সম্পর্ক আছে? ”

-” বলতে চাই না, বলছি। কারন আমি পারুলের স্বামী, ইসতিয়াক। আমরা নিজেরাই একসময় বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু পরিবারে সেটা জানানো হয়নি। ভেবেছিলাম সব গুছিয়ে তারপর জানাবো। পরে নানান সমস্যার কারনে আর সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে আমরা স্বামী স্ত্রী’র মতোই একসাথে থেকেছি। কিন্তু কথাটা সবাইকে জানাতে পারিনি বলে পারুল আর আমার মধ্যে একটু মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। সে এখন রাগ করে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আপনাকে বিয়ে করতে চলেছে! “বলে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে আমজাদের দিকে তাকালো ইসতিয়াক কিন্তু আমজাদের চেহারায় ভাবান্তর বোঝা গেলো না।

সে একটু হেসে বললো,” কি বলেন না বলেন, পারুলের কেন বিয়ে হতে যাবে। সে তো খুবই সহজ সরল মেয়ে..! স্যরি, আমি আপনার কথা মানতে পারলাম না!”

আমজাদের কথা শেষ হবার আগেই ইসতিয়াক পকেট থেকে তালাকের নোটিশ বের করে আমজাদের সামনে মেলে ধরে বললো,” আমার সময়ের দাম আছে। ফালতু সময় নষ্ট করতে আসি নাই এখানে। এই যে দেখুন, সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী। এটা তার পাঠানো তালাকের নোটিশ।”

আমজাদ এক পলক নোটিশটা দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,” বুঝলাম। কিন্তু নোটিশ নিয়ে গিয়ে বউ রে না মানায়া আমার কাছে আসছেন কেন সেইটা বলেন। আপনাদের মাঝখানে আমি কি করতে পারি..?”

-” অদ্ভুত লোক তো আপনি ! জেনে শুনে বিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে করবেন নাকি যত্তসব। চোখে দেখেন না সে বিবাহিত! ”

-” আলহামদুলিল্লাহ চোখেও ঠিকমতো দেখি আর কানেও ভালোই শুনি। খালি কিছু জিনিস এখনো বুঝি না। নিজের বিয়ে করা বউরে ধরে রাখতে না পেরে আসছেন আমার কাছে। আপনার তো মিয়া বউয়ের কাছে থাকার কথা, আপনি এসব আমারে বলে লাভ কি। ধরেন আমি বলে দিলাম, আমি বিয়ে করবো না তাতেই কি পারুল আপনার কাছে ফিরে যাবে? সে আরেকজন পাত্র ঠিকই পেয়ে যাবে, মাঝখান থেকে আমি কেন অযথা পারুলকে বিয়ে করতে অস্বীকার করবো! ”

-” আজব মানুষ তো আপনি। হবু বউ দুই নাম্বারী করেছে জানার পরেও আপনি বিয়ে করতে এক পায়ে খাড়া? দুনিয়াতে কি আর মেয়ে পান নাই..?”

-” এখন যদি কিছু বলি তো বলবেন, হুজুরের মুখ খারাপ। একবার বলতেসেন আপনাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, আবার বলতেসেন মনোমালিন্য, এখন আবার বলতেসেন বউ নিজেই দুই নাম্বার। কোনটা ঠিক। আচ্ছা, এক মিনিট, আমার একটা উপকার করতে পারবেন? ”

ইসতিয়াক কোনো জবাব দিলো না। তবু আমজাদ বলে চললো,” আমারে কিছুদিন সময় দেন। এমনেও আমার বিয়ে আগামী দুই তিন মাসের আগে সম্ভব না। ততদিনে আমি পারুলের বিষয়টা আরেকটু ভালো কইরা জানার চেষ্টা করি। আপনি এখনি কাউরে কিছু বইলেন না। পারুল যদি সত্যিই আপনারে চায় তো আমার কোনো আপত্তি নাই, আমি সরে যাবো। তবে অন্যের মানসম্মান নিয়া ছিনিমিনি খেলার কত শখ যে কত ভয়ংকর। সেটা আমি তারে বুঝায়া দিতে চাই। এই যে, আমারে দেখতেসেন! খুব বেকুব মনে হইতাসে, না? আমি মানুষটা কিন্তু ঠিক এর উল্টা। যা হোক্, আমার উপকারের জন্য ধন্যবাদ। আপনি এবার আসতে পারেন! ”

ইসতিয়াক কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। লোকটাকে প্রথমে যতটা সহজ সরল গোবেচারা মনে হয়েছিলো আসলে সে ঐটা না। পারুলের বিয়ের কথা শুনে সে প্রথমে বিশ্বাসই করেনি আর এখন প্রমান দেখানোর পর ক্ষেপে গেছে। তারমানে পারুলকে বুদ্ধি দেবার মতো মানুষ হিসেবে তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে। হয়তো এটা পারুলের নিজেরই বুদ্ধি আর নয়তো ওর বন্ধু বান্ধবের কেউ ওকে সাপোর্ট করছে। আচ্ছা, ওর ভাইবোনরা কেউ সাপোর্ট করছে না তো? করুক, এখন মজা টের পাবে। আমজাদ মিয়া নিজেই টের পাওয়াবে। আর যদি এটা আমজাদের ভানও হয়ে থাকে তবু সমস্যা নাই। বাকি কাজ করার জন্য ইসতিয়াক নিজেই যথেষ্ট। আপাতত শুধু অপেক্ষা।

রাতে ঘুমাবার জন্য বিছানায় পিঠ ছোঁয়াতেই ফোনটা বেজে উঠলে পারুল একটা হার্টবিট মিস করলো। দ্রুত ফোন হাতে নিতেই দেখলো আমজাদ। পারুলকে বেশী কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে বললো ,”আমি কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। এই কয়েক দিন একটু সাবধানে থাকবেন।” বলে ওর দোকানে ইসতিয়াকের যাবার কথা জানিয়ে পারুলকে শান্ত থাকতে বলে দিলো আমজাদ। পারুল যেন কোনো ব্যপারেই উত্তেজিত না হয় কারন ইসতিয়াক এখন আমজাদের পরবর্তী কাজকর্মের আশাতেই বসে থাকবে। আমজাদ ঝামেলা লাগালেই সে এসে ধুঁয়ো দিয়ে পরিবেশ ঘোলা করবে আর তারপরে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নামবে। ”
সবশুনে পারুল বললো,” আমার একটু ভয় করছে। যদি কোনো ঝামেলা করে?”
-“না, আপাতত ভয়ের কিছু নাই। তবে একবার মনে হলো, সে হয়তো আপনাকে ভালোবাসে। ভালো কথা, আরেকটা সেকেন্ড থট দিবেন না কি ?”
পারুল ভীষন রেগে গিয়ে বললো,” আপনার মন না চাইলে আপনি স্বচ্ছন্দে সরে যান। আমাকে সাজেশান দেবার আপনি কে? আমি সারাজীবন একা থাকবো তবু ঐ লম্পটটার কাছে ফিরে যাবো না!”
-” আহ্, এটা শোনার জন্য জানটা বাইর হয়া যাইতেসিলো। নাহ্, আপনারে একা থাকতে দিলে তো।” আমজাদ ফোন রাখার পর পারুলের ঘুম একেবারে উড়ে গেলো।

====

তিনটা মাস কোনদিক দিয়ে কাটলো পারুল বলতে পারবে না। এর মধ্যে একমাস পরই একদিন ইসতিয়াকের ফোন এসেছিলো। সে কৌশলে আমজাদের ব্যপারটা জানতেই ফোন করেছিলো কিন্তু পারুল কিছুই বলেনি। ইসতিয়াকের সেই পুরোনো থ্রেড তবে এবার গলায় জোর কিছুটা কম ছিলো। হয়তো আমজাদের তোলপাড় দেখার অপেক্ষায় আছে। নয়তো আমজাদ কিছু না করে বিয়ে করতে এলেও ইসতিয়াক ঝামেলা পাকাবে। এজন্যেই সে শান্ত আছে ! কিন্তু আমজাদের কি হলো! না একটা ফোন না কোনো খবর। সে কি তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করবে না পারুলকে? নাকি ইসতিয়াক নিজেই আমজাদকে আজেবাজে কথা বলে সরিয়ে দিয়েছে। কয়েকবারই ইচ্ছে হয়েছে আমজাদকে ফোন দেয়। কিন্তু এক আত্মমর্যাদাবোধ থেকে সেটা করছে না পারুল। ঈষিতাও আজকাল ফোন করলে এটা সেটা বলে কিন্তু আমজাদ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলে না। এসব ভেবে এক অন্যরকম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে দিন যাচ্ছে পারুলেন।

বিকেলে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিলো পারুল। এমন সময় হঠাৎ ঈষিতার ফোন এলো। শুধু বললো, “তৈরী হও কন্যা। আমরা আসতেছি। রাখি..!”
-” এ্যাই দাঁড়া। আমরা আসতেসি মানে? কারা, মানে কে কে?”
-” নানু, আম্মু আর ছোটো খালামনি!” বলেই ফোন রেখে দিলো পারুল। প্রচন্ড অস্থির লাগছে ওর। মা’কে কথাটা জানাতেই তিনিও বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে পারুল আর থাকতে না পেরে আমজাদকেই সরাসরি ফোন দিলো। কয়েকবার রিং হবার পর আমজাদ নিজেই ফোন ধরলো। পারুলের কণ্ঠে চাপা অভিমান। বলেই বসলো,” ওহ্, বিরক্ত করলাম বুঝি..?”
-” আরে বিরক্ত করবেন কেন। আসলে আমি নিজেই প্রচন্ড চাপের মধ্যে ছিলাম এই কয়েকদিন। আপনার ফুপাত ভাইটাকে শায়েস্তা করতে এছাড়া কোনো বিকল্প আমার জানা ছিলো না। আশাকরছি সে আর আপনাকে বিরক্ত করবে না! ”
-” তাই…? কিভাবে কি হলো একটু বলুন না!”
-” সব বলবো, তবে তার আগে মুরুব্বীদের মধ্যে কথাবার্তা ফিক্সড হতে দেন। আমি এসেই আগে আম্মা আর আপাদের পাঠালাম। তারা গিয়ে বাকিসব ঠিক ঠাক করে আসুক। আপনার সাথে আমার কথা হবে একেবারে বৃহস্পতিবারে , বিয়ের আসরে। ”
-” আর ইসতিয়াক যদি….?”
-” সে আসবে না। তার অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি যে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী’র মাধ্যমে তার ইনফার্টিলিটির কাগজপত্র পেয়েছি আমি। প্রয়োজনে তার দ্বিতীয় স্ত্রী’ও সাক্ষ্য দেবে। আর ইসতিয়াককে আরো কিছু কথা বলেছি সেটা আপনার না শুনলেও চলবে। কারন তার নিজেরই বহুত কাহিনী আছে। সেগুলো প্রচার হলে ওর জন্যেই সমস্যা। আপাতত এতোটুকু জেনে রাখুন সে আর আসবে না।”

পরম নির্ভরতায় দুচোখ বুঁজলো পারুল। সেদিন সন্ধ্যায়ই আমজাদের মা পারুলকে দোয়া করে গেলেন। শুক্রবার রাতেই বিয়ে। আমজাদের ইচ্ছা, সেদিনই সে মেয়ে নিয়ে যাবে। অনুষ্ঠান কয়েকদিন পরে করলেও চলবে।
ফলে বৃহস্পতিবার রাতেই ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে পারুলের আকদ পড়ানো হয়ে গেলো। আকদ শেষে মিষ্টিমুখ করানোর সময় ঈষিতাই ওর মুখে মিষ্টি গুঁজে দিয়ে বললো,” অর্ধেকটা খাবেন মামী। বাকিটা কিন্তু মামা খাবে!”

ছোটোখাটো রেওয়াজ রুসুমের মধ্য দিয়ে মেয়ে বিদায় দিলেন পারুলের বাব-মা। নতুন বাড়ীতে এসেও পারুলের মনে হচ্ছিলো সে তার আপনজনদের মাঝেই আছে। আরো আধাঘন্টা পর আমজাদের মুখোমুখি হলো পারুল। আমজাদ ওকে দেখেই হেসে বললো, “নায়িকার নামটা মনে পড়সে, বলবো? ”
পারুল চোখের কপট শাসনে হেসে ফেলে বললো,” এতোসব কিভাবে কি হলো কিছুই তো বললেন না! ”
-” আজই শুনতে হবে? পড়ে শুনলে হয় না? আজকে কি এই বেরসিক গল্প করার সময়? আজ তো আমাদের নিজেদেরই কত কথা জমা হয়া রইসে। আপনি আসলেই বড় বেরসিক মেয়ে দেখা যায়!”
-” আমাকে আপনি বলে ডাকছেন আপনি, আর আমি হলাম বেরসিক? ”
-“ওহ্, তারমানে আমারে ইনডায়রেক্টলি রসিক হবার জন্য খোঁচানো হইতাসে, তাই না? আমি কিন্তু সব বুঝি! ”
পারুল মুখ টিপে হেসে মুখ নামালো।
আমজাদ হঠাৎ পারুলের কানের কাছে মেঘ গুরু গুরু কণ্ঠে বলে উঠলো,” আমার ধৈর্য সহ্য কিন্তু একদমই নাই। তার উপর সেদিন ঈষিতার মুখে শুনলাম আমারে নাকি বনমানুষ ডাকা হয়। সেদিনই ঠিক করলাম, তোমার সাথে বনমানুষের মতো আচরণ করলে কেমন হয়। তুমি কি জানো, বনমানুষেরা কেমন..? ”
-” ইস্, ঈষিতাটা বড় পাজীতো। আপনাকে এটাও বলে দিয়েছে! ওটাতো আমি এমনিই একদিন দুষ্টুমী করে বলেছিলাম…!” বাকী কথাগুলো অব্যক্তই রয়ে গেলো পারুলে। বনমানুষটা তার বন্য আচরনে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছে। অথচ ভয় পাবার বদলে তার বিশাল থাবার মাঝে পারুলের নিজেকে বড় নিরাপদ মনে হলো আজ। এ যেন একজোড়া সুখী কবুতর। একসময় নিজেকে বনমানবী ভাবতেও আজ আর কোনো বাধা রইলো না। মনের ভেতর থেকেই কেউ যেন বলে উঠলো, তুমি আজ যা হতে পেরেছো তা হবার জন্যেই তৃষিত অন্তরে অপেক্ষা করেছিলে এতোদিন। বরং তুমি ইসতিয়াকের কোনোদিনই ছিলেনা, না প্রথমা না চতুর্থা। সব ভালোবাসায় মোহ মিশে থাকলেও সব মোহে ভালোবাসা থাকেনা। মোহের ফাঁদেই পড়েছিলে তুমি। আজ এই বনমানুষটা জানিয়ে দিচ্ছে সত্যিকারের ভালোবাসার আগ্রাসী ভূমিকা কেমন।

~সমাপ্ত~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here