#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব: ১২
ইরিনের পরীক্ষার ডেট দিয়েছে টাকা দেওয়া লাগবে কোথায় পাবে ভেবে পাচ্ছে না । কাছে স্বর্ণের আংটি চেইন আর দুল আছে বিক্রি করে সবটা ম্যানেজ করতে হবে কিছুদিনের জন্য । এভাবে আর হবে না একটা চাকরী ম্যানেজ করতেই হবে । এসব ভাবতে ভাবতেই ইরিন রেডি হয়ে স্বর্ণের দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ।
– কি ব্যাপার ইরিন আপু সৌমিক ভাই কি একেবারেই ছেড়ে দিল আপনাকে ?
– আরে রিমা কি যে বলিস ছেড়ে দেবে কেন ভাইয়া তো ভয়েই পালিয়ে গেছে ।
বলেই হেসে উঠলো দু’জনে ।
ইরিনের চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো মুছে নিয়ে বললো রাগন্বীত হয়ে বললো-
“আমি সৌমিকের বিবাহিতা স্ত্রী এটা ভুলে যেও না তোমরা , আর আমাকে এভাবে হ্যারাস করলে ভালো এর ফল ভালো হবে না বলে দিচ্ছি” বলেই ইরিন পাশ কাটিয়ে চলে গেল ।
পেছন থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে তা যেন ইরিন কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে , চোখের পানি মুছতে মুছতে টান পায়ে এগিয়ে গেল ইরিন ।
– ইরিন ওর শখের আংটি টা বিক্রি করে দিয়ে ফ্রমফিলাপের টাকা জমা দিয়ে এলো সাথে কিছু খাবারের জন্য ফল কিনে ক্যাম্পাসে ফেরত এলো ।
তপ্ত রোদে গলাটা একদম শুকিয়ে এলো ইরিনের তবুও দ্রুত হলে ফিরছে শরীর টা আর নিতে পারছে না ।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার সবাই ইরিনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ।
ইরিন বিষয়টা কিছুতেই বুঝতে পারলো না সবাই ওকে দেখে বাজে ইয়ার্কি করে কিন্তু এভাবে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মতো তো কিছু হয় নি ।
দ্রুত পায়ে হলে ঢুকে গেল ইরিন ।
আশা ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো “ইরিন বিপদ ঘটেছে” !
– “কি বলছো আপু সৌমিকের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে” ?
– না বোন তা নয় ।
– তবে কি ?
– তুই তানিয়া আর রিমা কে কিছু বলেছিস ?
– হ্যাঁ কিন্তু কেন ?
– ওরা তোর নামে কমপ্লেইন করেছে বাজে ভাবে , হল সুপার তোকে খুঁজছিলো ।
ইরিনের ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো “এই একটা মাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল তাও হারিয়ে যাবে না তো” !
– ভয় পাস না আমরা বুঝিয়ে বলছি কিন্তু তবুও তোকে ডাকছে ।
– আচ্ছা আপু আমি যাচ্ছি ।
ইরিন ফ্রেশ না হয়েই হল সুপারের কাছে ছুটলো
– আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল আসবো ?
– আসো ।
– আঙ্কেল আমাকে ডেকেছেন ?
– হুম বসো ।
– তোমার নামে কমপ্লেইন এসেছে তা কি তুমি জানো ?
– জ্বি আঙ্কেল এসে শুনলাম ।
– হুম , আচ্ছা শোনো তবে আমরা আমাদের মেয়েদের ক্ষতি হোক এমন কিছু চাইবো না , আমাদের হলের পরিবেশ তোমার জন্য নষ্ট হোক সেটাও চাইবো না তোমার নামে অভিযোগ এসেছে তুমি অন্তঃসত্ত্বা কিন্তু অবিবাহিত ।
– না আঙ্কেল আমি বিবাহিত ।
– এমনটাই যদি হয়ে থাকে তবে আমরা প্রুফ দেখতে চাই যদি প্রুফ না দেখাতে পারো তবে আমরা তোমার বিষয়ে স্টেপ নিতে বাধ্য হবো , একজনের জন্য আমাদের হলের পরিবেশ নষ্ট করবো না ।
– আচ্ছা আঙ্কেল আমি প্রুফ দিতে পারবো ।
– খুব ভালো তবে প্রুফটা কালকের মধ্যেই দেখাতে হবে নয়তো কালকের মধ্যেই হল ছেড়ে চলে যেতে হবে ।
– ইরিন বিরস মুখে বললো “আচ্ছা আঙ্কেল” ।
– এখন তবে এসো ।
ইরিন রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবলো কাবিননামা এখানে এনে দেখাতে হবে তবেই সমস্যার সমাধান হবে ।
ইরিন রুমের কাছাকাছি আসতেই শুনতে পেলো
– ইরিনের এসব ঝামেলা আর ভালো লাগছে না ।
– এভাবে বলছিস কেন মিথি ?
– যেটা সত্যি সেটাই বলছি রে ওর জন্য অযাথা অযাথা বকুনি খেলাম আমরা হল সুপারের কাছে ।
– তো কি হয়েছে আমরা না হয় একটু বকা খেয়েছি আর ঐ মেয়েটার কথা একবারও ভেবেছিস ওর ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে ।
– না রে আপাতত আমার এসব ভাবতে ইচ্ছে করছে না ।
– তুই অতীত ভুলে গেছিস মিথি, ইরিন সব সময় আমাদের পাশে কিভাবে দাঁড়িয়েছে ।
ইরিনের ভেতর থেকে কেন জানি কান্না চলে এলো কাছের বন্ধুরা আজ এই কথা বলছে , নিজেকে সামলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো ইরিন ।
– ইরিন হল সুপার কি বললো ??
– আমি বিবাহিত তার প্রুফ দেখাতে হবে রে তবেই আমি এখানে থাকতে পারবো নয়তো না ।
– চিন্তা করিস না তোর বিয়ের কাবিন এর পেপার টা দেখালেই তো হয়ে যাবে ।
– আমিও তাই ভেবেছি ।
– ইরিন তুই তোর এই কাবিন নামা সৌমিক ভাইয়ার বাবা মা কে তো দেখাতে পারতিস ।
– কি দরকার আলো আজ যখন কাছের মানুষ গুলো আয়নার ওপিঠ দেখাচ্ছে সেখানে ওরা তো অনেক দূরের ।
-জানিস তো মিথি “খারাপ সময় গুলো একটা সময় কেটে যায় কিন্তু আঁচড়ে যাওয়া দাগ গুলো একদম কালো রেখা ফেলে যায়” ।
– মিথি একটু হকচকিয়ে যায় ইরিন কি তবে শুনে ফেললো সব ” তুই টেনশন করিস না ইরিন সব ঠিক হয়ে যাবে ” ।
ইরিন জবাব দিলো না শুধু একটু হাসলো ।
“মাঝে মাঝে কথা বলার থেকে সামান্য হাসি ভিষণ মারাত্মক ভাবে আঘাত করে” মিথিকেও এই সামান্য হাসি বেশ খানিকটা বিক্ষত করে দিল ।
ইরিন ফোন টা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল ,
রাহাত কে ফোন দিয়ে কাবিন এর পেপার টা ম্যানেজ করে দিতে বললো ।
– ইরিন !
– চিরচেনা কন্ঠস্বরে পরিচিত নাম ইরিনের বুকের ভেতর থাকা হৃদযন্ত্রের শব্দটা যেন একটু বেশিই বেড়ে গেল ।
অস্ফুট স্বরে বলল – “সৌমিক” কথা আটকে গেল ইরিনের মুখে , চোখ দিয়ে টপটপ করে শুধুই জল গড়িয়ে পড়ছে ।
সৌমিক কাছে এসে হাত দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে দিচ্ছে ।
ইরিন কে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো সৌমিক , কিছুক্ষণ পর মুখ উঠিয়ে ইরিন জিজ্ঞেস করলো
– কোথায় ছিলে তুমি ? জানো কতো খুঁজেছি তোমাকে !
– চলে এসেছি তো পাগলীটা আর রাগ করে না ।
– তুমি কিভাবে পারলে বলো তো আমাদের ছেড়ে থাকতে ? আমাকে তোমার পুচকু সোনাকে মনে পড়লো না একবার ও ?
“অভিমানীনি এভাবে অভিমান করো না এই কান ধরছি আমি আর এমন ভুল হবে না” -বলেই সৌমিক কান ধরলো ।
– হবে না তাতেও তোমার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই ।
– বউ ভুল হয়ে গেছে আর হবে না , ইরিনের পেটে হাত দিয়ে বললো দেখ না পুচকু সোনা তোর মাম্মাই আমার উপর কতো রাগ করে আছে ।
– হয়েছে হয়েছে খবরদার ওকে যদি তোমার দলে টানার চেষ্টা করেছো না তবে বাবা আর ছেলে কে একসাথে শাস্তি দেয়া হবে ।
– না না বাবা আর রাজকন্যা ।
– না আমার ছেলে চাই ।
– আমার ছোট্ট, দুষ্টু একটা ইরিন চাই ।
– যদি ছোট্ট ইরিন কে সামলানোর জন্য কোনো সৌমিক কে না পায় !
– বউ এই পৃথিবী যতোদিন আছে , আমাদের রক্তের প্রজন্মে একটা করে ইরিন আর সৌমিক জন্মাবে পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড কর্ণারে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে “ভালোবাসার কাটা পাখি ইরিন-সৌমিক” ।
– আমি তো গ্ৰামবাংলার প্রেমিক পাখি ডাহুক হতে চাই , যে কিনা তার সঙ্গী হারিয়ে গেলে তাকে সুর করে ডেকে ডেকে শেষ পর্যন্ত আত্মাহুতি দেয় ।
– সৌমিক ইরিনের মুখে হাত দিয়ে বলে না ইরিন আমি নিজের অস্তিত্ব নেই ভাবতে পারি কিন্তু তুমি আর পুচকু থাকবে না এটা ভাবতে পারি না।
– তুমি ফিরে না এলে এছাড়া আমার কোনো পথ থাকতো না সৌমিক , তুমি ছাড়া আমার অস্তিত্ব একদম বিলীন ।
– না আমি আমার সাহসী ইরিন কে দেখতে চাই যে কিনা আমি না থাকলেও শক্ত হাতে রাজকন্যার হাত ধরবে , এগিয়ে যাবে আমাদের কল্পনার সাজানো লক্ষ্যে ।
– তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ সৌমিক , তোমার রাজকন্যা ও বাবা ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে তোমাকে ছাড়া সব লক্ষ্য আমার কাছে তীর হারা নৌকার মতো ! আর কোথাও যেতে দেব না ।
বলেই সৌমিককে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো ।
সৌমিক ইরিনের কপালে আদরের ছোঁয়া এঁকে দিয়ে বললো “ইরিন এখন আমি আসছি ” !
– না সৌমিক প্লিজ যেও না কোথাও ফিরে এসো।
সৌমিক পেছন ফিরে না তাকিয়ে হেটে চলে গেল ।
ইরিন হুড়মুড় করে উঠে পড়লো , দেখলো ঘেমে গেছে একদম সবাই ঘুমোচ্ছে । এতোক্ষণে স্বপ্ন দেখছিলো সে সৌমিক আসে নি ।
ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলো রাত তিনটা বাজে ।
ইরিনের চোখ টা আবার জলে ভিজে গেল কতোদিন পরে সে সৌমিককে দেখেছে স্পর্শ করেছে । ওযু করে এসে তাহাজ্জুদের নামায পড়তে বসে গেল ইরিন । আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে তার স্বামীকে ভিক্ষা চাইলো ।
চলবে…