#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব: ১৫
ছোট্ট মেয়েটাকে ঘিরে চলছে ইরিনের জীবন তরী ।
এই একটা বছরে ইরিনের বাবা মা ইরিন কে অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায় নি ,সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ইরিন নিজের পৃথিবী নিজে গড়ে তুলেছে স্নিগ্ধা কে ঘিরে ।
জীবনের রাস্তাগুলো বড্ড কঠিন সহজ পথে হাঁটতে গেলেও হোঁচট তোমাকে খেতেই হবে । আর একজন সিঙ্গেল মাদারের জন্য তার পৃথিবী টা বড্ড পাহাড় সম বন্ধুর পথ ।
ইরিন স্কুল আর বাচ্চা নিয়ে বড্ড ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। ইরিন চাকরি তে জয়েন করার পর নিজের মেয়ের জন্য সময়ই বের করতে পারছে না তাই রহিমা খালাকে ইরিন আর স্কুলে যেতে দেয় না নিজেই বেতন দিয়ে রেখে দেয় বাচ্চার জন্য ।
এই স্বার্থপর পৃথিবীতে রহিমা খালা এখন ইরিনের কাছের একটা মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
সময় আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগলো দিন গুলো ও চলছে নিজের মতো করে ।
একে একে চলে গেল আরো ছয়টি বছর ইরিন স্কুল ছেড়ে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে । স্নিগ্ধা ও বেশ বড় হয়ে গেছে ।
একদিন সকাল বেলা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল হাতে পেপার দেখছিল হঠাৎ একটা নিউজে চোখ আটকে যায় , চিরচেনা ভার্সিটির ছবির সাথে বিজ্ঞপ্তি , ভালো করে পড়ে দেখে ওর ডিপার্টমেন্টেই লেকচারার নেবে ।
ডিপার্টমেন্ট থেকে তাকে সুযোগটা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সবকিছুর থেকে দূরে থাকতে তখন আবেদন টা করা হয় নি ।
সারাটা দিন অফিসে ইরিন মন দিতে পারলো না তার বারবার আবেদনটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু বাঁধা কাজ করছে তাই করতে পারছে না ।
দুইদিন সিদ্ধান্তহীনতায় কাটিয়ে দিল তারপর
মনে মনে ঠিক করলো ইরিন ছয় বছর পর আবার যখন বিজ্ঞপ্তি টা চোখে পড়লো তখন সে নিজের ভার্সিটিতেই ফিরবে । অবশেষে আবেদন টা করেই দিল ।
মাস দুয়েক পর হঠাৎ করে একদিন সকালে পিওন এসে একটা খাম দিয়ে গেল , খাম খুলেই দেখতে পেল জয়েনিং লেটার ।
রুমে গিয়ে খুশিতে স্নিগ্ধাকে একদম জড়িয়ে ধরলো ইরিন ।
– মামনি হঠাৎ কি হলো ??
– মাম্মাই আজ আমি অনেক খুশি ।
– কেন মামানি ?
– আমরা চট্টগ্রাম ফিরবো ।
– মামনি হঠাৎ আমরা চট্টগ্রাম কেন শিফট করছি ?
– মাম্মাই আমি ওখানে লেকচারারে জয়েন করেছি ওখানে নতুন চাকরি পেয়েছি তাই আমরা শিফট করছি ।
– মামনি এখানে আমার সব ফ্রেন্ডসরা আছে আমার ছেড়ে যেতে ভালো লাগছে না !
– মাম্মাই জীবন টা অনেক কঠিন “জীবনের প্রান্তিক দুঃসময়ে কোনো বন্ধু বা আপনজন কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না নিজের পৃথিবী একদম নিজেকে সামলাতে হয় “। তাই এই বন্ধুদের জন্য কখনো মন খারাপ করবে না ওখানে অনেক নতুন ফ্রেন্ডস পাবে ।
– মামনি আমার নানু বাসায় যেতে মন চায় ।
– স্নিগ্ধা সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ হতে নেই মা
– কেন মামনি ?
– বড় হও মাম্মাই তখন বুঝবে , তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নাও তোমার আমরা কাল চট্টগ্রাম ফিরবো হাতে বেশী সময় নেই । বলেই চলে গেল ইরিন রহিমা খালার কাছে ।
এদিকে স্নিগ্ধার মন খারাপ হয়ে গেল সে যতোবার নানু বাড়ি, দাদু বাড়ি যেতে চেয়েছে ততোবারই মা মানা করে দিয়েছে ।
রহিমা খালার রুমে যেতেই ইরিন দেখতে পেল খালা ঘুমোচ্ছে , শরীর টা ভালো না জ্বর এসেছে ।
বিপদে আপদে এই রহিমা খালা তার পাশে ছিল তাই ইরিন তার দায়িত্ব টা আর ফেলতে পারে নি , নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে তাকে অতি যত্নে ।
আস্তে আস্তে ইরিন রহিমা খালার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক দিল
– খালা এখন কেমন লাগছে তোমার ?
– ইরিন মা ভালো লাগছে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম চোখটা লেগে এসেছিল ।
– খালা তুমি ওঠো তোমাকে আমি খাইয়ে দিই ।
– আমি পারবো তো খেয়ে নিতে ।
– তুমি ওঠো না !
ইরিন খাইয়ে দিতে দিতে বললো তার চাকরির খবর টা , কিন্তু রহিমা খালার ভয় হলো ইরিনের অতীত নিয়ে বুঝতে দিল না কারণ ইরিন চাকরি টা পেয়ে অনেক খুশি ওর খুশি নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না ।
আজ ইরিন তার ক্যাম্পাসে ফিরছে স্নিগ্ধাকে নিয়ে , আজ সে স্টুডেন্ট হয়ে না লেকচারার ইরিন জামান হয়ে ফিরছে ।
সবকিছু পাল্টে গেছে চেনা জায়গাগুলো অনেক বদলে গেছে অথচ স্মৃতির গন্ধ গুলো আজো লেগে আছে প্রতিটা কোনায় কোনায়। চোখ মেললেই ভেসে উঠছে সৌমিকের সাথে কাটানো খুনশুটিময় মুহূর্তগুলো ।
পুকুর পাড়ের পাশ দিয়ে যেতেই আস্তে আস্তে থেমে গেল চলার গতি দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো ইরিন প্রথম রাগ করার কথা , প্রথম ভালোবাসার কথা ।
অজান্তেই চোখ ভরে এলো ইরিনের ।
চশমার ভারি গ্লাসের আড়ালের চোখ গুলো আজ হঠাৎ করেই অনেক বছর পর কান্না করে দিল ।
সব ফর্মালিটিজ পূরন করে কোয়ার্টারে যেতে বেশ সময় লেগে গেল , ছয় বছরে পুরোনো লেকচারারদের মুখ গুলো আর দেখা যাচ্ছে না নেই কোনো পরিচিত মুখ । চেনা ক্যাম্পাস বড্ড অচেনা হয়ে গেছে ।
সারাটা দিন রুম গোছাতেই কেটে গেল নাজেহাল অবস্থা সবার ,বাসা বাড়ি পাল্টানোর এই এক সমস্যা । সারা দিনের ক্লান্তিতে খুব তাড়াতাড়ি সবাই ঘুমিয়ে পড়লো । অনেক দিন বাদে ইরিনের স্বপ্ন জুড়ে সৌমিক এলো খুব অদ্ভুতুড়ে এক স্বপ্ন দেখলো ইরিন সৌমিক ওকে খুঁজে বের করতে বলছে । হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখে ঘাবড়ে গেল ইরিন ছয় বছর পর আজ এমন একটা স্বপ্ন দেখলো ।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাজার করতে গেল , ফিরে এসে ইরিন গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিল ।
আজ তার ভার্সিটি তে প্রথম ক্লাস নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিল , কার্বাড থেকে একটা হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি বের করে নিলো সাথে সাদা রঙের ম্যাচিং হিজাব পরে নিল , চোখ হালকা করে কাজলের প্রলেপ দিয়ে নিল সবশেষে চশমাটা দিয়ে এসে স্নিগ্ধা আর রহিমা খালার সামনে দাঁড়ালো ।
দু’জনেই অবাক হয়ে দেখছে ইরিন কে ভুত দেখার মত করে ।
– স্নিগ্ধ দিদিভাই এটা কি তোমার মামনি ??
স্নিগ্ধ বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বললো
– না দিদা এইটা আমার মামনি না ।
ইরিন এবার কপট রাগ দেখিয়ে বললো- “তোমারা কি শুরু করলে বলোতো” ??
– অনেক বলেও কখনো তোকে শাড়ি পড়াতে পারিনি ইরিন তাই অবাক হয়ে গেছি ।
– দিদা শুধু কি তাই আজ মামনি চোখে কাজল পড়েছে দেখেছো ?
– মামনি তোমাকে আমার মা মনে হচ্ছে না ।
– মাম্মাই এটা কেমন মজা ?
– সত্যি বলছি মামনি তোমাকে আমার বড় আপু মনে হচ্ছে ।
– পাকনি মেয়ে তবে রে ! ওর দিকে ইরিন এগিয়ে গেলে স্নিগ্ধা এক দৌড়ে বেলকুনি তে চলে গেল । ওর কান্ড দেখে ইরিন হেসেই যাচ্ছে
– ইরিন জানিস মা তোকে আজ কতো ভালো লাগছে দেখতে , কেন এমন থাকিস না সবসময় বলতো ?
– প্রতিটা মেয়ের বড় অলঙ্কার তার স্বামী , আমার তো স্বামী নেই আমি কিভাবে সেজে থাকতে পারি বলো খালা ।
– ইরিন মা সব ভুলে কি তুই তোর জীবন শুরু করতে পারিস না নতুন করে ?
– খালা বিয়ে তো আমি করতেই পারতাম, চাইলেই সবটা শুরু থেকে আবার সাজাতে পারতাম আমার নিউরোলজিস্ট বাবুর সাথে কারণ তিনি যে আমাকে বড্ড ভালোবাসতেন , উনি ভেবেছিলেন আমি কখনো বুঝতেই পারবো না তার লুকোনো ভালোবাসা মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিল আমাকে কিন্তু আমি চাইনি তার গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগুক আমার বন্ধুত্বের উপর এই সমাজ আঙ্গুল উঠাক আমি তো শুধু সৌমিককে ভালোবেসেছি খালা ।
– এমন একটা মানুষ কে হারিয়ে ফেললি ইরিন মা সত্যিকারের ভালবাসা বার বার আসে না , তোর ভাগ্য তোর দরজায় কড়া নেড়েছিল আবার কিন্তু তা অবহেলায় ছুড়ে দিয়েছিস আর পরে আছিস এক রাশ শূন্যতাকে ঘিরে বদ্ধ ঘরে ।
ইরিন মুগ্ধ হয়ে রহিমা খালার কথা শুনছে মাঝে মাঝে রহিমা খালা খুব চমৎকার কিছু কথা বলে ।
-ইরিন মজা করে বলে উঠলো “কে বলেছে খালা দেখোনা কেমন সেজেগুজে ম্যাডাম সেজে ক্লাসে যাচ্ছি” ।
ভয়ে ভয়ে রহিমা বললো
– আমি তোর জন্য সমন্ধ দেখবো মানা করিস না মা !
– “সম্ভব নয় খালা এটা কখনো বলো না , আমি বিয়ে করলে একটা স্বামী পাবো , ছেলে মেয়ে পাবো একটা সুন্দর সংসার পাবো আমার মাম্মাই তো একটা বাবা পাবে না” ।
আমার ভাগ টাও কম পাবে সেটা আমি সহ্য করি কি করে বলোতো ও যে আমার সৌমিকের দেওয়া শেষ সম্বল ওকে আমি আগলে রাখবো আমার সবটা দিয়ে “আমি যে ওর মা” !
রহিমা বেগম আর কিছুই বলতে পারে না ।
– আচ্ছা খালা আমি তবে আসছি দোয়া করো ।
– আচ্ছা মা সাবধানে যাস ।
প্রথম দিনে সবার সাথেই কম বেশি আলাপ হলো তিনটা ক্লাস নিল ইরিন , দিনটা বেশ ব্যাস্ততায় কেটে গেল ।
এর ই মাঝে মনে পড়লো মাঝ রাতে দেখা স্বপ্নের কথা কিন্তু সেটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো, যা গেছে তা আর খুঁজতে চায় না সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় ইরিন ।
স্নিগ্ধাকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে নিয়মের রুটিনে সবটাই এগিয়ে যাচ্ছে ।
একদিন ক্লাস নিয়ে কোয়ার্টারে ফিরছে ইরিন হঠাৎ মনে হলো কেউ ইরিন কে ডাকছে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই , পরে খেয়াল করে আর কিছু শুনতে পেল না আবার হাঁটছে পেছন থেকে ডাকটা দৃঢ় কন্ঠে ভেসে এলো
– ইরিন আপু !
ইরিন চিনতে পারছে না কাছে আসতে দেখতে পেল ক্যাম্পাসের সেই জুনিয়র ছেলেটা অনিক ।
– ইরিন আপু আমাকে চিনতে পারছেন আমি অনিক ।
– ইরিন হাসি মুখে বললো চিনেছি রাহাত ভাইয়ার বাধ্যগত ভাইটা , কেমন আছো ?
– আপু আমি ঠিকঠাক আছি, আপনি এখানে , কিভাবে ? আমরা কতো খুঁজেছি আপনাকে জানেন ?
– রিল্যাক্স অনিক শান্ত হও একটা একটা করে জিজ্ঞেস করো ।
– আপু আপনি কোথায় হারিয়ে গেছিলেন ??
– “যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় তাকে হারিয়ে যাওয়া বলে না” আমি ইচ্ছে করেই এই শহর ছেড়েছিলাম আমার বাচ্চাকে একটা সুস্থ পরিবেশ দেওয়ার জন্য ।
ইতস্তত করে আনিক জানতে চাইলো “কি বাচ্চা হয়েছে” ?
ইরিন মিষ্টি করে হেসে বললো “মেয়ে হয়েছে এখন সে ছয় বছরের” ।
– আলহামদুলিল্লাহ আপু আপনি হঠাৎ এখানে কেন ?
– আমি এখানে চারুকলা বিভাগে জয়েন করেছি ।
– শেষমেশ আসলেন তবে আপু কিন্তু অনেকটা দেরি করে ফেললেন আসলেই বন্ধুরাই সব থেকে বেশি ধোঁকা টা দেয় ।
কথার মাঝে হঠাৎ অনিকের ফোন এলো তাই অনিক আর দাঁড়াতে পারলো না খুব তাড়াতাড়ি বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো কথাটা শেষ করার সুযোগ টা পেল না আর ইরিন ওর বলা শেষ কথাটাই ভাবতে লাগলো ।
অনিক কি বলতে চাইলো কেন বন্ধুদের কথা বললো তবে কি অতীত টা কে একবার খুঁটিয়ে দেখবে, ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেল কোয়ার্টারের দিকে ।
চলবে ….
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই আর কেমন হয়েছে জানাবেন)