#এক_জীবন_অনেক_জীবন(২২)
*********************************
কায়সার সাদাতের সাথে কথা শেষ করে জহির সাহেবকে ফোন দিয়ে তানভীরের মোবাইল নাম্বারটা দিলেন । সাথে রিকোয়েস্ট করলেন, ছেলেটাকে যেন কোনোভাবে কোনো ঝামেলায় জড়ানো না হয় । জহির সাহেব তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে তানভীরের কাছ থেকে তাঁরা ইনফরমেশন বের করার জন্য প্রয়োজনে জিজ্ঞেসাবাদ করতে পারেন তবে তাকে ঝামেলায় ফেলবেন না । কথা শেষ করে কায়সারের দুশ্চিন্তা এলো, তাবাসসুমকে তিনি এখন কী বলবেন ?
সাদাত বললো –
খালু আমার তো এখন কোনো কাজ নেই । আমি তাহলে বাসায় চলে যাই ।
না না তুমি বাসায় যেও না এখন । আমার খুব টেনশন হচ্ছে সাদাত, তোমার খালাকে আমি কী বলবো ? আমার মাথা তো কাজ করছে না । আমার মেয়ে কী করলো এটা ? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, জারা এটা করতে পারে না । জারা কেন এমন করবে ? লেখাপড়া শিখিয়ে এতো বড় করেছি কী এমন অবিবেচকের মতো কাজ করার জন্য ? আর ছেলেটা তো ভালো না । এ তো একটা ক্রিমিনাল । এই ছেলে তো জারা’র ক্ষতি করে ফেলবে যে কোনো সময় । তানভীরও আমাকে তাই বললো । ছেলেটাকে আমার কাছে ভালো মনে হলো সাদাত । ছেলেটা জারাকে বাঁচাতে চেয়েছিল কিন্তু রফিক যদি জারা’র কোনো ক্ষতি করে এই ভয়ে সে-ও চুপ করে গেছে ।
খালু রফিক অনেক উচ্চাভিলাষী আর মিথ্যুক একটা ছেলে । স্কুলে থাকতেই দেখেছি, সব সময় বড়সড় চাপাবাজী করতো । ওদের গাড়ি আছে, কয়েকটা বাড়ি আছে, প্রতিদিন এতো এতো টাকা হাতখরচ পায় আরো কতো যে গল্প শোনাতো কোচিং-এ এসে । একদিন তো ইউনুস স্যারের কাছে কঠিন ধমক খেয়েছিল এইসব মিথ্যা বলার জন্য । তবুও ওর লজ্জা হতো না কখনো । ওর একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে এখনো । ওকে নিয়ে আমাদের বন্ধুরা হাসাহাসি করলেই বলতো –
এই রফিকের কাছে একদিন আসবি চাকরির জন্য, লিখে রাখ তোরা । এই রফিকের অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়ার জন্য সাতদিন আগে সিরিয়াল নিতে হবে । আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না খালু , জারা’র সাথে ওর পরিচয় হলো কেমন করে ?
বললাম না ফেসবুকে পরিচয় । এখন বুঝতে পারছি ছেলেটা ফেক আইডি খুলে জারাকে ফাঁদে ফেলেছে । আমার মেয়েটা কী এতোটাই বোকা ! সে কী ছেলেটার কথাবার্তা , চালচলনে কিছুই বুঝতে পারেনি ? আমার এখন শুধু টেনশন হচ্ছে, জারা’র না আবার কোনো ক্ষতি হয়ে যায় । শোনো তুমি যেও না, শাফিনের রুমে যেয়ে চেঞ্জ করে রেস্ট নাও । রাতে তো তোমারও ঘুম হয়নি ঠিকমতো ।
কায়সার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে গেলেন আর সাদাত শাফিনের রুমে চলে আসলো । জারা’র বিয়ের কথা শুনে তার মনটা এতো খারাপ লাগছে কেন সে নিজেও বুঝতে পারছে না । জারাকে সে কখনোই পেতে চায়নি । জারা’র প্রতি তার যে অনুরাগ তৈরি হয়েছে নিজের অজান্তেই, সেই ভালোলাগা যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে তার জন্য সে সারাক্ষণ সচেষ্ট থেকেছে । মনের ওপর তো মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না । মন কখন কোথায় হারায় আগে থেকে বুঝতে পারলে সে কিছুতেই তার মনটাকে জারা’র মনের ঘাটে ভিড়তে দিতো না । তারপরও যখন ব্যাপারটা ঘটেই গেল, সে তার বিবেক দিয়ে ,বুদ্ধি দিয়ে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে । আজ যখন জারা’র এতো বড় একটা বিপদ হলো, তার কেন যেন নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে । সে তো কোনোভাবে রফিকের হাত থেকে জারাকে বাঁচাতে পারলো না । যদিও রফিকের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই বহু বছর । রফিকের মতো বিষাক্ত একটা জীবের ছোবল থেকে জারা নিজেকে কতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে পারবে সেটা ভেবেই মন খারাপ আরো বেড়ে যাচ্ছে তার ।
.
.
কায়সার যখন রুমে এলেন তাবাসসুম রুমে ছিলেন না । রোজা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিল । ঘুরে তাকিয়ে বললো –
আব্বু এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না ? অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল ।
খোঁজ পাওয়া গেছে ।
কোথায় জারা ! রোজা জোরে চিৎকার করে উঠলো ।
আস্তে বলো রোজা । তোমার মা কোথায়?
মা বড় খালার সাথে কথা বলছেন ।
তোমার মা’কে এখন জানানো যাবে না ।
আব্বু কী হয়েছে ? জারা’র খারাপ কিছু হয়েছে আব্বু? তাড়াতাড়ি বলো প্লিজ, আমার খুব টেনশন হচ্ছে ।
রফিকের বন্ধুর নাম্বার পেয়েছিলাম । ছেলেটার সাথে কথা হলো । ঐ ছেলেটাই খবরটা দিল তবে আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না । জারা না-কি রফিককে বিয়ে করে ফেলেছে ।
আর্তনাদ করে উঠলো রোজা –
আব্বু তুমি কী বলো এইসব ? জারা এই কাজ করবে কেন!
আমি জানি না । আমি এখনো বিশ্বাস করি না । জহিরকে ছেলেটার নাম্বার দিয়েছি । দেখা যাক ও কী খবর দেয় ।
আব্বু এটা যদি সত্যি হয়, মা তো একটা কিছু করে ফেলবে । হায় হায় জারা এটা কী করলো !
তোমার মা’কে কীভাবে জানাবো সেটাই বুঝতে পারছি না । সাদাত গিয়েছিল রফিকের বাসায় । শ্যামলী তে বাড়ি ছেলেটার । বাবা-মা মনেহয় জানে না ছেলেটা কোথায় আছে ।
এখন কী হবে আব্বু?
তোমার মা’কে কিছু বুঝতে দিও না । সে তো বিরাট হৈচৈ শুরু করে দেবে । আমি জহিরের ফোনের অপেক্ষায় আছি ।
আব্বু তুমি কিছু খেয়েছো ?
হুম খেয়েছি ।
তোমাকে দেখতে খুব টায়ার্ড লাগছে । তুমি এবার এসে শোও । কিছুক্ষণ ঘুমালে ভালো লাগবে ।
এখন ঘুমাবো না মা । মনটা খুব খারাপ লাগছে রে মা ।
না তুমি এখন ঘুমাবে । আসো আমার সাথে । আমরা সবাই ঘুমিয়েছি শুধু তুমি কাল থেকে একবারও বিছানায় আসোনি ।
রোজা কায়সারের হাত ধরে টেনে বিছানার সামনে নিয়ে বললো –
তোমার মোবাইলটা দাও তারপর শোও । জহির আংকেলের ফোন আসলে আমি তোমাকে ডেকে দেবো ।
এখন ঘুম আসবে না মা ।
আব্বু তোমার চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে । তুমি কিন্তু অসুস্থ হয়ে যাবে যদি এমন করতে থাকো । আচ্ছা ঘুমাতে হবে না, চুপচাপ শুয়ে থাকো । আমি বসছি তোমার পাশে ।
মেয়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে শুতে হলো কায়সারের । রোজা তাঁর পাশে বসে টুকটাক কথাবার্তা বলে যাচ্ছে, তিনি চুপ করে শুনছেন । এতো দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি বহন করছিল শরীরটা, শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলেন কায়সার ।
বাপ-মেয়ে এতক্ষণ যে কথাগুলো বলছিল, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আরো একজন মানুষ সেই কথাগুলো শুনছিলেন । ভেতরে থাকা মানুষ দু’জন বুঝতেও পারলো না বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দুনিয়াটা তখন টালমাটাল লাগছিল ।
.
.
শরীরটা বোধহয় বেশ ক্লান্ত ছিল, সে কারণেই একটানা কয়েক ঘন্টা ঘুমালেন কায়সার । ঘুম ভাঙতেই দেখতেন তাবাসসুম পাশে শুয়ে আছেন । স্ত্রীর হাতটা ধরলেন কায়সার । তাবাসসুম কায়সারের চোখে চোখ রাখলেন, মুখে কিছু বললেন না । সেই চাহুনিতে এতোটাই কষ্ট ছিল যে কায়সারেরে বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো । তাঁদের এমন সাজানো গোছানো নির্ঝঞ্ঝাট সংসারটা হঠাৎ এমন এলোমেলো হয়ে যাবে এমনটা তিনি চিন্তাও করেননি কখনো । বুকের ভেতর এমন এক ক্ষরণ হচ্ছে যা আগে কখনো হয়নি । এই কষ্টটা যেন অন্য রকম । অন্য কষ্টের সাথে ঠিক মেলে না । সব আছে তাঁর অথচ নিজেকে ভীষণ অসহায় আর নিঃস্ব মনে হচ্ছে হঠাৎ ।
বেশ কিছুটা সময় এভাবেই নিঃশব্দে কেটে গেল । তারপর তাবাসসুম বললেন –
কী ব্যাপার তুমি আমার কাছ থেকে এমন পালিয়ে বেড়াচ্ছো কেন বলো তো ? জারা’র খোঁজ দিয়েছে জহির ভাই ? এতোটা সময় পেরিয়ে গেল অথচ এইটুকু কাজ ওনাকে দিয়ে হলো না ?
বাধ্য হয়ে কায়সারকে বলতেই হলো জারা’র কথা –
জারা ভালো আছে । জহির ফোন করেছিল ।
জারা কোথায়, ও বাসায় আসছে না কেন ?
আসবে, চলে আসবে ।
তুমি ঘরে বসে আছো কেন ? যাও মেয়েটাকে নিয়ে আসো । কোথায় গিয়েছিল জারা ?
এখানেই ছিল, উত্তরায় ওর এক বন্ধুর বাসায় ।
মেয়ের সাহস কতো বেড়েছে তুমি খেয়াল করেছো ? সে কীভাবে আমাদের না জানিয়ে বন্ধুর বাসায় যেয়ে রাতে থাকলো ! কোন বন্ধু, ফোন করো তো । আমি কথা বলবো জারা’র সাথে । তাকে বেশি আদর দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো তুমি । এখন বোঝো মেয়ের অবস্থা ।
কায়সার এরপর কী বলবেন কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না ।
কী হলো ফোন করো । কার বাসায় গেছে তোমার মেয়ে ? আমি কথা বলবো এক্ষুণি । বন্ধুর বাসার ঠিকানা নাও, চলো আমরা যেয়ে নিয়ে আসি জারাকে ।
কায়সারের মনে হলো বন্ধুর বাসার কথা বলাটা ঠিক হয়নি। এটা বলে তো তিনি আরো বিপদে পড়ে গেলেন ৷ কথা ঘোরাতে বললেন –
তোমরা খেয়েছো ? বড় আপার কোনো খোঁজই তো নিলাম না আমি ।
হুম ওরা সবাই খেয়েছে । তুমি আমার কথার উত্তর দিলে না যে ?
শাফিন ফোন করেছিল ?
হুম । রোজার সাথে কথা হয়েছে ।
চা খাবে তাবাসসুম, চা দিতে বলবো ?
তাবাসসুম হঠাৎ রেগে গেলেন । উঠে বসে বললেন –
যে কথাটা আর সবাই জানলো, সেই কথাটা তুমি আমাকে বলোনি কেন?
কী কথা !
তুমি জানো না কী বলছি আমি ?
কায়সার যেন দমবন্ধ অবস্থায় পড়ে গেলেন । তাবাসসুম কী জেনে গেল সবকিছু কিন্তু রোজা বা সাদাত কারোরই তো তাকে বলার কথা না । তাহলে ?
তোমার মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেয়ে বিয়ে করেছে ঐ ফ্রডটাকে ?
কে বললো তোমাকে?
তুমি তো আমাকে বলোনি কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকেই শুনেছি ।
কায়সার খুব অবাক হলেন তাবাসসুমের কথায় । তাবাসসুম কথাটা জেনে গেছেন অথচ এতোটা নির্লিপ্ত আছেন কেমন করে !
শোনো তোমার মেয়ে যদি সত্যি এই কাজ করে থাকে, করেছে তো নিশ্চয়ই, এরপর কিন্তু তার সমস্ত দায়দায়িত্ব তার নিজের । আমি তাকে বারবার করে নিষেধ করেছি, বুঝিয়ে বলেছি কিন্তু সে আমার কথাকে পাত্তা দেয়নি । সে এতো ছোটোও না যে নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পারবে না । এই জীবন সে নিজে বেছে নিয়েছে । এর পুরো দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে ।
মানে কী ?
মানে হলো, সে তো ঘর ছেড়েছে আদিত্যের হাত ধরে তাই না? আদিত্য যখন রফিক হয়ে যাবে তখন তো সে এই ধাক্কা সামলানোর মতো মানসিক অবস্থায় থাকবে না । তখন যেন সে এখান থেকে কোনো সাহায্যের আশা না করে । সে হয়তো রফিকের কথা জানতেও পারে । আমাদেরকে বোকা বানানোর জন্য ওকে আদিত্য সাজিয়ে রেখেছিল আমাদের সামনে ।
তাবাসসুম তুমি কী বলো এইসব !
একটাও ভুল কথা বলছি না আমি । সে যখন বিষয়টা এতো সুন্দর করে আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে তখন রফিককে আদিত্য বানানো কোনো বিষয়ই না তার কাছে । তোমার মেয়ে সব জানতো, এই ছেলের কোনো দোষ নেই ।
তুমি একটু শান্ত হও, সব ঠিক হয়ে যাবে ।
কোনো কিছু ঠিক হবে না । বিয়ে কোনো ছোটোখাটো জিনিস না । ইচ্ছে হলো করলাম, ভালো লাগলো না ছেড়ে দিলাম, এটা তো তেমন কোনো কিছু না । আর সে যদি রফিককে বিয়ে করে থাকে তাহলে তো ছাড়ার প্রশ্নই আসে না । আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, জারা যেন আমাদের আর বিরক্ত না করে ।
তোমার মাথা ঠিক আছে তো ? মেয়েটার কী হয়েছে, কোন অবস্থায় আছে সেসব না জেনেই বলে দিলে সে যেন আর বিরক্ত না করে ! বিষয়টা আগে ঠিকমতো জানতে দাও তারপর সিদ্ধান্ত নাও ।
বিষয় আমার বুঝতে বাকি নেই । আমি চোখের সামনে তোমার মেয়ের ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি । সে যেহেতু এই জীবন বেছে নিয়েছে তাই এই বাড়িতে সে যেন আর না ফিরে আসে ।
তাবাসসুমের বলার ধরণটা এতোটাই কঠিন ছিল যে কায়সার আর কথা বাড়ালেন না । সময় আসুক, সময় নিজেই তার পথ ঠিক করে নেবে ।
.
.
ভয়ে জারা’র গলা শুকিয়ে আসছে । চোখের সামনে সব ঝাপসা লাগছে তার । সীমা খালার কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে কী হবে তার ? মা তো তাকে মেরেই ফেলবেন । মা তাকে বারবার করে নিষেধ করেছেন কিন্তু সে একবারও মা’র কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেনি । এতো বড় ভুল সে করলো কেমন করে ! আব্বু তাকে কতো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছেন অথচ সে কী সুন্দর করে তাঁদের সবাইকে বোকা বানিয়েছে এতোদিন ধরে অথচ আজকে বোকা তো সে হয়েছে । এই ছেলেটা তাকে এতোদিন ধরে এভাবে বোকা বানিয়ে আসছে আর সে ক্রমাগত বোকা হয়েই গেছে !
মাথা কিছুতেই কাজ করছে না । একসাথে নানা রকম ভাবনা আর দুশ্চিন্তা এসে অস্থির করে তুলছে তাকে । সীমা খালা পাশে বসে কী বলে যাচ্ছেন তার কিছুই বুঝতে পারছে না জারা । সে আবারো চেষ্টা করলো রোজার মোবাইল নাম্বারটা মনে করতে । নিজেরটা ছাড়া একমাত্র এই নাম্বাটাই তার মুখস্ত ছিল । মাঝের ছয়টা ডিজিট একই হওয়ায় নাম্বারটা সে খুব সহজেই মনে রাখতে পারতো কিন্তু শেষের দু’টো সংখ্যা কিছুতেই এখন আর মনে পড়ছে না । জারা নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলো । চোখ বন্ধ করে আবার ভাবতে চেষ্টা করলো নাম্বারটা । দু’টো সংখ্যা মনে পড়লো, চোখ খুলে সে কল করলো নাম্বার মিলিয়ে । মনে মনে প্রার্থনা করছে, এটাই যেন সেই নাম্বার হয় ।
কল রিসিভ করে ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই জারা বললো –
কে আপু ?
কে বলছেন ?
আপু আমি জারা ।
কিছুটা সময় দু’পাশেই কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না । তারপর হঠাৎ রোজা বলে উঠলো –
জারা তুমি এইটা কী করেছো ? সত্যি কী তুমি বিয়ে করে ফেলেছো ? হ্যালো জারা, হ্যালো, কথা বলছো না কেন হ্যালো……
আপু তুমি জানলে কেমন করে ? সরি আপু, আমি খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছি ।
তুমি বিয়ে করেছো জারা ? তুমি ঐ ছেলের সাথে আছো এখন, কোথায় আছো ?
জারা তাকিয়ে দেখলো সীমা খালা ওর দিকে তাকিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করছেন । সে উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললো –
খালা আর দুই মিনিট কথা বলবো প্লিজ । বলেই রুমের শেষ মাথায় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো । তারপর বললো –
আপু আদিত্য আসলে অন্য কেউ ।
জানি, সে হচ্ছে রফিক ।
আপু তুমি জানলে কী করে !
সবাই জানে । পুলিশ গিয়েছিল ঐ ছেলের বাসায় । সাদাতও গিয়েছিল । জারা তুমি এমন একটা কাজ কী করে করলে বল তো ?
আপু আমার খুব ভুল হয়ে গেছে । আপু আমি বাসায় আসবো ।
আমার এখন ইচ্ছে করছে থাপড়িয়ে তোমার দাঁতগুলো ফেলে দিতে । ফাজিল মেয়ে কোথাকার । সবকিছুতে এডভেঞ্চার খুঁজতে থাকো তাই না ? মা আর আব্বু তোমাকে এতোবার করে বুঝালেন তারপরও সেই ভুলটাই তুমি করে ফেললে জারা । মা তোমার ওপর অসম্ভব রেগে আছেন । জারা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না, আমাদের সবাইকে তুমি কী পরিমাণ কষ্ট দিয়েছো । সাদাতের মুখের দিকে পর্যন্ত তাকানো যাচ্ছে না আর আব্বুর কথা তো বললামই না । তুমি এটা কেন করলে জারা ?
খুব ভুল হয়ে গেছে আপু । আপু প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও । আমি আর এমন ভুল করবো না ।
এমন ভুল তো মানুষ বারবার করে না । একবার করলেই সারাজীবন তার রেশ টানতে হয় জারা । তোমাকে বলে লাভ কী ? তোমার যদি বোধ থাকতো তাহলে কী আর এমন কাজ করতে পারতে ?
আপু প্লিজ, আমার খুব ভয় লাগছে এখন ।
চুপ, একদম চুপ । একদম ন্যাকামি করবে না । ভয় লাগবে কেন, তোমার সেই আদিত্য ওরফে রফিক আছে না তোমার সাথে ?
জারা আর কোনো কথা বলতে পারলো না । নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করলো ।
সীমা খালা ডাক দিলেন –
জারা তোমার কথা শেষ হয়নি ?
কথাটা শুনতে পেয়ে রোজা বললো –
কে কথা বলছে, কে আছে তোমার পাশে ?
সীমা খালা, ওনার বাসায় এসেছি আমরা । উনি মোবাইল চাচ্ছেন ।
শোনো তুমি এখন কোথায় আছো ? তাড়াতাড়ি বলো ।
আমি বাসার এড্রেস জানি না । যেখানে এসেছি এই জায়গাটার নাম মির্জাপুর, টাঙ্গাইল আর যেখানে আছি এর পাশের রোডেই একটা হোটেল আছে আল – মদিনা নামে । যে বাসায় আছি এই বাসাটার একটা নাম আছে আপু, মায়ের দোয়া টাইপ কী যেন । আপু প্লিজ আমাকে বাঁচাও । আমি বাসায় আসতে চাই ।
মন দিয়ে শোনো যা বলছি । ফোন রেখেই আমার নাম্বারটা ডিলিট করে দেবে আর যেখানে আছো সেখানেই থাকার চেষ্টা করবে । আমি এখনই আব্বুকে দিচ্ছি ইনফরমেশনগুলো । জহির আংকেল নিশ্চয়ই কিছু একটা করবেন । সাবধানে থেকো জারা ।
সীমা খালা জারা’র পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন । জারা আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না । কোনোমতে নাম্বারটা ডিলিট করে মোবাইলটা ফেরত দিল ।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন –
কার সাথে কথা বলছিলে ?
ফ্রেন্ডের সাথে । জারা মোবাইলটা এগিয়ে দিলো সীমা খালার দিকে ।
সীমা খালার শাশুড়ি ডাকতেই উনি শাশুড়ির রুমে চলে গেলেন । জারা’র খুব বেশি ভয় করছে রুমে ঢুকতে । যাকে সে আদি হিসেবে জানতো সে যখন হঠাৎ রফিক হয়ে গেল, তার মুখোমুখি সে কী করে হবে ? একবার মনে হচ্ছে দরজা খুলে বেরিয়ে যাবে এখন থেকে আবার আপুর কথা মনে হতেই ইচ্ছেটা বাদ দিলো সে । এমনিতেই যা ভুল হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আপুর কথার বাইরে কোনো কাজ সে করবে না । অনেক ভেবেচিন্তে সে রুমে যেয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো ।
রুমে এসে দেখলো আদি মোবাইলে ব্যস্ত । তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো –
কোথায় ছিলে ?
খালার সাথে গল্প করছিলাম । তুমি কখন উঠলে ?
উঠেছি । সরি তখন রাগ করার জন্য । আমার কাছে এসে বসো তো জারা ।
জারা’র কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠলো । ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে এর গলাটা চেপে ধরতে । একবার মনে হলো এখনই জিজ্ঞেস করবে, কেন তার সাথে আদিত্য সেজে এতোদিন অভিনয় করেছে সে ? কথাটা জিজ্ঞেস করতে যেয়েও থেমে গেল জারা । আপু তাকে একদম নরমাল থাকতে বলেছে । সে যেন কোনোভাবেই বুঝতে না পারে যে জারা তার সবকিছু জেনে গেছে ।
কী হলো ডাকছি না তোমাকে? আমার কাছে আসো, একটু জড়িয়ে ধরি তোমাকে ।
জারা কী করবে বুঝতে পারছে না । এমন সময় খালা রফিক বলে ডাকতেই আদি রুম থেকে বের হয়ে গেল ।
সীমা খালা ডাইনিং টেবিলে বসে ছিলেন । রফিক কাছে আসতেই বললেন –
কী রে তুই এই মেয়েকে নিজের নাম, পরিচয় সব মিথ্যে বলেছিস কেন ?
কে বললো ?
কে বলবে আবার, ঐ মেয়ে ই বললো । ও তো তখন থেকে আদি আদি করে যাচ্ছিল । মিনাকে চেনে না, তোর বাড়ি কোথায় কিছুই তো জানে না ।
ও আর কিছু জিজ্ঞেস করেছে ?
না আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি । আমার মোবাইল নিয়ে ফোন করে কার সাথে যেন কথা বললো ।
কার সাথে ? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো রফিক ।
আমি কী জানি কার সাথে । আমাকে বললো বন্ধুর সাথে কথা বলেছে কিন্তু কল লিস্টে কোনো নাম্বার তো নেই । মুছে দিয়েছে মনে হয় । কথা বলতে বলতে কাঁদছিল জারা । দেখিস বাবা আমাকে কোনো ভেজালে ফেলিস না যেন । তোর খালু থাকে না দেশে , আমি একা থাকি এদের নিয়ে ।
টেনশন কোরো না খালা, তোমার কোনো বিপদ হবে না ।
রফিক রুমে এসে দেখলো জারা জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে । কাছে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো –
চলো জারা বাইরে থেকে বেড়িয়ে আসি ।
হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় জারা চমকে উঠলো । জোর করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো –
ছাড়ো আমাকে, ব্যাথা পাচ্ছি ।
ব্যাথা পাবে কেন, তুমি কী মোমের পুতুল?
ভালো লাগছে না, ছাড়ো প্লিজ ।
আচ্ছা ছেড়ে দিলাম । চলো ঘুরে আসি ।
না আমি কোথাও যাবো না ।
কেন যাবে না ? গেলে ভালো লাগবে চলো যাই ।
আপুর কথা মনে পড়লো জারা’র । কঠিন গলায় বললো –
বললাম তো যাবো না, শরীর ভালো লাগছে না । কথাটা বলে রফিকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানায় যেয়ে বসলো জারা ।
রফিক কতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো চুপচাপ তারপর পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো –
কাকে ফোন দিয়েছিলে জারা ?
জারা ঢোঁক গিলে বললো –
আমার এক ফ্রেন্ডকে । ওদের বাড়ি এদিকেই কোথায় যেন ।
নাম কী তোমার বন্ধুর?
তুমি চিনবে না ।
নাম্বারটা মুছে দিয়েছো কেন ?
জারা কোনো উত্তর দিতে পারলো না ।
আদিত্য ওরফে রফিক ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে । ওকে দেখতে ঠিক ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছে কেন হঠাৎ ! জারা’র শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল । আব্বু কী নাম্বারটা পৌঁছাতে পেরেছে জহির আংকেলের কাছে ।………………………