এক জীবনে অনেক জীবন পর্ব ২৯

#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(২৯)
**********************************

ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জারা’র মনে হচ্ছে ওর হার্টবিট যেন হঠাৎ করে খুব বেড়ে গেছে । দরজা খুললেই মা’র মুখোমুখি হতে হবে তাকে । প্রায় এক মাস পর মা’র সাথে দেখা হবে । কী বলবে, কীভাবে সরি বলবে মনে মনে অনেকবার আওড়ে নিয়েছে সে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । আব্বু’র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে জারা বললো –

খুব ভয় লাগছে আমার ।

কেন !

মা কী বলবে আমাকে ? যদি কথা না বলে, যদি অনেক বকা দেয় ?

তোমাকে তো বলেছি মা যেটা করবে একদম মুখ বুঁজে শুনবে । মা-ই তো বকা দেবে আবার মা-ই তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবে ।

বাপ-মেয়ের কথার মাঝখানে দারজা খোলার শব্দে জারা’র নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল । ভয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো সে ।

তোমার কুরিয়ার না পার্সেল কী জানি আনতে গেছিলা ঐটা আসতে এতক্ষণ লাগলো?

রুক্ষ গলার আওয়াজ শুনে জারা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো দরজায় শিল্পী আপু দাঁড়িয়ে আছে । ওর সাহস দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল কিন্তু এখন কিচ্ছু বলার নেই তার । হজম করে নিলো কথাটা । বললো –

কেমন আছো শিল্পী আপু ?

তুমি যেমন রাখছো আমাদের সবাইকে ।

জারা আর কোনো কথা না বলে কায়সারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো ।

কায়সার ভেতরে ঢুকে বললেন –

তোমার খালাম্মা কোথায় শিল্পী ?

খালাম্মা ওনার রুমে । বড় খালা আইছে একটু আগে ।

বড় খালার নাম শুনে জারা’র যেন জ্বর চলে আসলো । বড় খালা কেন এখানে ? ওনার কী মন ভরেনি তাকে চড় মেরে আর এত্ত এত্ত খারাপ কথা শুনিয়ে ?

কায়সার বললেন –

তুমি রুমে যেয়ে ফ্রেশ হও তারপর আমাদের রুমে চলে এসো ।

জি আব্বু ।

নিজের রুমের দরজার সামনে এসে জারা’র খুব কান্না পেলো, একই সাথে ভালোও লাগলো অনেক । কতদিন পরে সে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে । রুমটা ঠিক তেমনই আছে যেভাবে সে রেখে গিয়েছিল । প্রত্যেকটা জিনিস পরিপাটি করে গোছানো । বারান্দায় যেয়ে রকিং চেয়ারটায় বসলো জারা । অনেক দিন পর মনে হলো নিজেকে ফিরে পেল সে । হঠাৎ দখিনের ঠান্ডা বাতাস এসে নাকে মুখে ঝাপটা মারতেই চেনা গন্ধটা পেল সে । মাঝে মাঝে বৃষ্টি আসার ঠিক আগে এমন ঠান্ডা বাতাস আর মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে পড়ে তার বারান্দায় । মন ভরে বাতাসটা নেয়ার আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো । বৃষ্টির ছাঁট এসে জারা’র পা ভিজিয়ে দিচ্ছে আর দমকা বাতাসের তোড়ে শরীরে আঁকিবুঁকি কাটছে । জারা ঠিক সেভাবেই বসে রইলো । বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার নড়তে ইচ্ছে করছে না একটুও ।বৃষ্টির ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে চোখের জলটুকু ।

হঠাৎ পিঠে কারো স্পর্শ পেতেই ফিরে তাকালো জারা । আব্বু কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতে পারেনি সে । তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলো জারা ।

কায়সার বললেন –

বৃষ্টিতে ভিজে গেলে তো একদম । জামাকাপড় সব ভিজে শেষ ! ওঠো, এগুলো পাল্টে মা’র কাছে এসো । এতো মন খারাপ করে থাকলে চলবে ? তোমাকে সাহসের সাথে সবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে । চলে এসো, আমি আছি তো তোমার সাথে ।

জারা ভেজা কাপড় পাল্টে দুরুদুরু বুকে মা’র রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো । তাবাসসুম বড় বোনের সাথে কথা বলছিলেন, দু’জনের হাতে চায়ের কাপ । জারাকে দেখে সবার কথা বলা থেমে গেল । ইয়াসমিন বললেন –

ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? ভেতরে আয় ।

কায়সার সোফায় বসে ছিলেন, জারা তাঁর পাশে যেয়ে দাঁড়ালো ।

ইয়াসমিন বললেন –

বহু কান্ড ঘটিয়ে, নাটক করে শেষ পর্যন্ত ঘরে যখন ফিরেই এসেছো, এবার একটু মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো । সবাইকে যথেষ্ট নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে তোমার জন্য । আশা করি তোমার শিক্ষা হয়েছে । এরপর আর কোনো অ্যাডভেঞ্চারের চেষ্টা তুমি করবে না ।

বড় খালা যখন রাগ হয়ে যান তখন তুই, তুমি দু’টোই চালাতে থাকেন । বড় খালার কথা এখন একদম শুনতে ইচ্ছে করছে না । তাবাসসুম একটা কথাও বলেননি, মেয়ের দিকে তাকিয়েও দেখেননি একবারও । জারা খুব করে চাচ্ছে মা তাকে কিছু বলুক । যা খুশি বলুক, বকা দিক, রাগ করুক, চিৎকার করে উঠুক তার সাথে তবুও মা কিছু তো একটা বলুক ।

কায়সার পরিবেশটাকে সহজ করার জন্য বললেন –

আপার বাসায় থেকে জারা’র কিন্তু একটা লাভ হয়েছে । ও কিন্তু এখন খাবার নিয়ে কোনো বাছাবাছি, কোনো রকম বিরক্ত করে না । শাকসবজি, সব রকম মাছ সবই কিন্তু খাওয়া শিখে গেছে । নিজের সব কাজও নিজে করে ।

ইয়াসমিন বললেন –

ঠ্যালায় পড়লে সবাই শেখে । তোমরা মুখের সামনে চিকেন আর পাস্তা ধরে রাখবে, তো বাচ্চাদের কী দোষ ? আর এত্তো বড় মেয়ে নিজের ঘর নিজে গোছাতে পারবে না, এটা কেমন কথা ! আমি শিল্পীকে বলে যাচ্ছি, এখন থেকে শিল্পী ওর কোনো কাজ করে দেবে না ।

জারা’র খুবই বিরক্ত লাগছে এখন । বড় খালা আসেই শুধু ভেজাল লাগাতে । বিরক্ত লাগলেও কিচ্ছু করার নেই তাই চুপ করে রইলো সে ।

ইয়াসমিন বললেন –

আর থাকতে পারছি না । তোর দুলাভাইয়ের শরীরটা খারাপ । দু’বার ফোন করেছে এর মধ্যে ।

রাতে খেয়ে যাও আপা ।

না আজকে না, আরেকদিন ওদের নিয়ে এসে অনেকক্ষণ থাকবো ।

জারা’র দিকে তাকিয়ে বললেন –

লেখাপড়ার দিকে মন দে এবার পাকামো ছেড়ে । আমি জানি তুই মনে মনে আমাকে অনেক গালাগালি করছিস । আমি তোর শত্রু না রে মা । বাচ্চাদের খারাপ কিছু হলে বাপ-মার জানটা বেরিয়ে যেতে চায় । সেটা যদি তোরা বুঝতি তাহলে এইসব করতে পারতিস না । যা হয়েছে সব ভুল গিয়ে মন দিয়ে পড়ালেখা শেষ কর ।

ইয়াসমিনকে বিদায় দিতে কায়সার তাঁর সাথে নিচে চলে গেলে রুমটায় অদ্ভুত নিরবতা নেমে এলো । জারা’র কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন থেমে গেল হঠাৎ করে । তারা দু’জন ছাড়া কোথাও কেউ নেই । জারা কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না । এমন মুহূর্তগুলো কেন আসে জীবনে যখন নিজেকে বড় বেশি অসহায় মনে হয়, নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে ।

কেমন ছিলে ?

মা’র গলার আওয়াজে জারা’র ভেতরটা যেন কেঁপে উঠলো । কী বলবে সে, কী উত্তর দেবে এমন প্রশ্নের ? সে চাইছে ছুটে যেয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে সরি বলতে কিন্তু চেষ্টা করেও গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না । অনেক কষ্টে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে জারা ধীর পায়ে তাবাসসুমের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো । আড়ষ্টতার কারণে মা’র চোখে চোখ রাখতে পারছে না সে ।

তাবাসসুম বললেন –

হাতটা দেখি ।

বাম হাতটা বাড়িয়ে দিলো জারা ।

তাবাসসুম দু’হাতের ওপর আলতো করে জারা’র হাতটা ধরে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তারপর বললেন –

ভালোই কেটেছিল, দাগ রয়ে গেছে । এই দাগটা যেতে অনেক সময় লাগবে, হয়তো পুরোপুরি মুছবে না কোনোদিন ।

এই প্রথম জারা সরাসরি মা’র মুখের দিকে তাকালো । মা’র চেহারাটা ভীষণ মলিন লাগছে, চোখের নিচের ডার্ক সার্কেলের স্পষ্ট ছাপ ।

এই যে হাতের দাগ এটা চোখে দেখা যাচ্ছে কিন্তু মনের মধ্যেও এমন অনেকগুলো ক্ষত তৈরি হয়েছে । বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না বলে কষ্টের গভীরতাটুকু কেউ অনুভব করতে পারছে না ।

জারা ডুকরে কেঁদে উঠলো ।

আমি কখনো ভাবিনি, সত্যি ই আমি চিন্তাই করিনি এমন কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে । আমি তো ছেলেমেয়ে বড় করতে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছি । সে কারণে নিজের ওপর খুব রাগ হয় মাঝে মাঝে, নিজেকে ব্যর্থ মনে হয় । আমার এখন কারো ওপরে কোনো রাগ, কোনো অভিমান নেই ।

জারা দেখলো মা একবারও তার দিকে তাকাচ্ছেন না । কথাগুলো যেন নিজের সাথেই বলে যাচ্ছেন । মুখে রাগের কোনো ছাপ নেই , বিরক্তি ভাব নেই । মা’র এই নির্লিপ্ত চেহারাটাকে জারা খুব বেশি ভয় পায় । এরপর মা যে কী বলতে পারে সে ঠিক অনুমান করতে পারছে না ।

আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে কারো কোনো বিষয়ে নাক গলাবো না । সবাইকে তার নিজের মতো থাকতে দেবো আর আমিও আমার নিজের মতো থাকবো বাকিটা সময় । এই সংসারের পেছনে সারাটা জীবন দিয়েছি আমি এবার নিজের ইচ্ছে মতো একটু বাঁচবো । অন্যের জীবনে আর দখলদারি করতে চাই না ।

জারা’র খুব কষ্ট হচ্ছে মা’র এমন নির্লিপ্ত কথাবার্তায় । এরচেয়ে তাকে খুব করে বকা দিক, সে কিছু মনে করবে না কিন্তু এই আচরণটা তার সহ্য হচ্ছে না একদম । সে আর থাকতে না পেরে বললো –

মা প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও, আমার খুব ভুল হয়ে গেছে ।

তাবাসসুম এই প্রথম মেয়ের দিকে সরাসরি তাকালেন । চাহুনিতে এতোটাই কষ্ট ছিল, জারা চোখ নামিয়ে নিলো । অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সে, এবার মা’র পাশে বসে বললো –

মা তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বোলো না, আমি সহ্য করতে পারছি না, খুব কষ্ট হচ্ছে । তুমি আমাকে বকা দাও, যা খুশি বলো তবুও এভাবে কথা বোলো না মা ।

বকা দিয়ে কী হবে ? বকা দিলে তুমি বুঝবে ? অনেকবার তো বুঝিয়ে বলেছি, বকাও দিয়েছি কিন্তু কাজ হলো না তো । তোমার কাছে আমার কথা কোনো গুরুত্বই পায়নি । তুমি ভেবেছো মা আগের জেনারেশনের ব্যাক ডেটেড মানুষ , মা কী আর এতো কিছু বুঝবে ? যেটা তোমার কাছে ভালো মনে হয়েছে, তুমি সেটাই তো করেছো ।

মা প্লিজ মাফ করে দাও । আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি মা । এরকম ভুল আর কখনো হবে না ।

কিছু কিছু ভুল বারবার করতে হয় না, একবার করলেই আজীবন সেটার রেশ রয়ে যায় । কেউ না কেউ, কোনো না কোনো সময়ে সেই দুঃসহ স্মৃতিটা মনে করিয়ে দেয় । তুমি চিন্তা কোরো না , তোমার সাথে তোমার আব্বু আছেন । তোমার যে কোনো সমস্যায় তিনি তোমার পাশেই থাকবেন ।

মা আমি তোমাদের দু’জনকেই পাশে চাই সবসময় ।

তাবাসসুম হাসলেন, সেই হাসির অর্থ জারা ধরতে পারলো না ।

কায়সার কখন রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ খেয়াল করেনি । মা-মেয়ের কথোপকথন শুনে বুঝলেন, অভিমানের বরফ গলতে আরো কিছুটা সময় লাগবে । তিনি এসে জারা’র পাশে বসে বললেন –

জীবনে খুব একটা শিক্ষা হয়েছে তোমার । এটা হয়তো দরকার ছিল । দরকার ছিল এই কারণে যে তুমি আমাদের বিশ্বাস করোনি, উল্টো আমাদের বোকা বানিয়েছো । শেষ পর্যন্ত বোকা কিন্তু তুমিই হয়েছে । তুমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে যে কাজটা করেছো, এটা আসলে কতোটুকু প্রভাব ফেলবে তোমার জীবনে এটা বুঝার জন্যে হলেও এই শিক্ষাটা তোমার দরকার ছিল । এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি নিজেকে শুধরে নিতে পারো তাহলে হয়তো জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে । আমরা আশা করবো তুমি নিশ্চয়ই শুধরে নেবে নিজেকে ।

সরি আব্বু । আমি আর কখনো তোমাদের কাছ থেকে কোনো কিছু লুকাবো না । আব্বু মা আমার সাথে কথা বলছে না । মা’কে বলো আমাকে মাফ করে দিতে, আমার সাথে কথা বলতে ।

আমি তোমার মা’কে কিছুই বলবো না , তোমাকে যেমন কিছু বলিনি । তোমাকে আরো একবার সুযোগ দিয়েছি । এখন তুমি তোমার কাজ দিয়ে মা’র রাগ অভিমান ভাঙাও । এখানে আমার আর কোনো ভূমিকা নেই জারা ।

তাবাসসুম জারাকে বললেন –

তোমার রুমে যেয়ে রেস্ট নাও । শাফিনের সাথে কথা বোলো । তুমি ওর সাথে কথা বলোনি দেখে ও মন খারাপ করেছে ।

জারা রুমে চলে গেলে কায়সার এসে তাবাসসুমের পাশে বসে বললেন –

মেয়েটার সাথে আরেকটু ভালোভাবে কথা বললে পারতে । এমনিতেই খুব মন খারাপ করে আছে আর তোমার ভয়ে তো এই রুমে আসতেই চাচ্ছিল না ।

বলবো, আমারও একটু সময় লাগবে । তাকে আরো একটু অনুশোচনায় ভুগতে দাও । এখনই সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলে তার কোনো বোধোদয় হবে না ।

ঠিক আছে, তুমি ভালো বুঝবে ।

.
.

জারা এরমধ্যে বাড়ির বাইরে বের হয়নি একবারও । রোজা দু’দিন এসেছিল ওকে নিয়ে বাইরে ঘুরবে বলে কিন্তু অসুস্থতার কথা বলে এড়িয়ে গেছে জারা । তার শুধু একটা কথাই মনে হয়, বাইরে বের হলেই সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে ।

যেহেতু সেমিস্টার শুরু হয়েছে তাই জারাকে ভার্সিটিতে আসতেই হলো । শুরুতে সে খুব ভয় পাচ্ছিল কে কী প্রশ্ন করবে সেটা ভেবে । ক্লাসগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই শেষ করলো সে । প্রথম কয়েকদিন কেউ তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি । আজ ক্লাস শেষে ফেরার সময় তানিশা ছুটে এসে ওকে ধরলো । ছুটিতে কেমন কাটলো, তাবাসসুম যে একদিন তানিশাকে ফোন করেছিল এইসব টুকিটাকি কথার শেষে অর্থী আর রোমেল এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো । অর্থী জিজ্ঞেস করলো –

জারা তুই কই ছিলি রে এতোদিন?

কোথায় আবার থাকবো, বাসায় ছিলাম ।

না বাসায় তো ছিলি না । কোথায় ছিলি বল ?

তানিশা বললো –

বাসায় ছিল না তো কেথায় ছিল ?

আমি জানি । এমন ভান করছিস যেন তুই কিছুই জানিস না ? সেদিন আড্ডায় তো তুইও ছিলি । সামিন জারা’র পালানোর কথা বলেনি আমাদের ?

এইসব কথা না বললে হয় না অর্থী ?

জানতে হবে তো আসল ঘটনা আর কথা তো সত্যি তাই না ? আচ্ছা জারা একটা কথা বল তো, তুই পালাইলি ক্যান ? আবার গেলি ই যখন তখন আবার ঐটারে ছাড়লি কেন ? এই তানিশা এইটা কী ঐ ছেলেটা যেইটা মামুর চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়ানো থাকতো জারা’র জন্য ? ছেলেটা তো দেখতে খারাপ না । কী রে বললি না জারা ছাড়লি কেন ছেলেটাকে ? এই তোরা বিয়ে করেছিলি না-কি লিভ টুগেদার এ থাকলি এতোদিন?

জারা তানিশা’র দিকে তাকাতেই ও অর্থীকে বললো –

এই তুই কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলিস ?

উল্টাপাল্টা কথা বলবো কেন দোস্ত ? আমার তো খুবই মজা লাগলো শুনে । ইশ এমন একটা অ্যাডভেঞ্চার আমারও খুব করতে ইচ্ছা করে কিন্তু পালানোর মতো তো কাউকে পাই না। এই জারা বল না কেমন লাগলো তোর ? কোথায় কোথায় ঘুরলি, কী কী করলি বল না ।

তানিশা রোমেলকে বলল –

এই ওকে নিয়ে যা তো এখান থেকে । অর্থীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ওকে নিয়ে আইসক্রিম খাওয়া ।

আমার মোটেও মাথা খারাপ হয়নি । আমি সত্যি তোর কাহিনিটা শুনতে চাই জারা । আমি তোকে ফোনও করেছিলাম তিন দিন কিন্তু তোর নাম্বারটা অফ ছিল ।

এই রোমেল তুই কী ওকে নিয়ে যাবি এখান থেকে ?

তানিশা’র ধমকের পর রোমেল অর্থীকে নিয়ে চলে গেল ওদের কাছ থেকে । যেতে যেতে অর্থী চিৎকার করে বললো –

জারা তোর পালানোর কাহিনি শোনার অপেক্ষায় থাকলাম দোস্ত ।

আশপাশে যারা ছিল তারা জারা’র দিকে ফিরে তাকালো । লজ্জায় জারা’র ইচ্ছে করছিল মাটির সাথে মিশে যেতে । সে তানিশাকে জিজ্ঞেস করলো –

তুই জানতিস?

হুম ।

কিছু বললি না যে ?

কী বলবো ? অর্থীর মতো বললে তোর ভালো লাগতো ? আমি তো তোকে আগে বলেছিলাম তখন তুই আমার ওপর রাগ করেছিলি । তুই আসলে রঙিন চশমা পরে চারপাশটা দেখছিলি তাই যেটা আমরা সবাই দেখছিলাম সেটা তুই দেখতে পারিসনি । বাদ দে, তোর এই বিষয়টা নিয়ে আমি সত্যিই কিছু জানতে চাই না । তুই আমার যেমন বন্ধু ছিলি তেমনই থাকবি । এই ঘটনাটা আমাদের দু’জনার মাঝে না আনা ই ভালো ।

থ্যাংক ইউ তানিশা ।

কেন !

আমাকে বুঝতে পারার জন্য, আমাকে লজ্জায় না ফেলার জন্য ।

তুই তো আমার বন্ধু । বন্ধু কখনো লজ্জায় ফেলে না , লজ্জা থেকে বাঁচায় । চল যাই । ওদিকে তাকিয়ে দেখ অর্থী তুপা, নিধি’দের নিয়ে আমাদের দিকে আসছে । ও আবার প্যাচাল শুরু করবে বলে দিলাম ।

চল ।

গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই সিমরানের ডাকে পিছে ফিরে তাকালো জারা –

এই জারা তোমার না-কি কী ঘটনা হইছে , অর্থী বললো ইউটিউবে না-কি আসবে নাটকটা । কী ঘটনা রে ভাই ? একটু বলা যাবে ?

তানিশা বললো –

সিমরান একটু অপেক্ষা করো , ইউটিউবে আসলে আমি তোমাকে লিংক পাঠিয়ে দেবো ।

জারা’র দিকে তাকিয়ে বললো –

অর্থীর একটা ব্যবস্থা করতে হবে । মন খারাপ করিস না, চল চল ।

গাড়িতে বসে তবুও মন খারাপ করে থাকলো জারা । বন্ধুরা তাকে এভাবে খোঁচা দিয়ে মজা পাচ্ছে ! সামনে আরো কী শুনতে হবে কে জানে ? এই কষ্টটা সে কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছে না । এই কষ্টটা যে তার একার, এই অপমান তাকেই সহ্য করতে হবে ।

.
.

তাবাসসুমের খালাতো ভাইয়ের একমাত্র ছেলের বিয়ে । ভাই বারবার করে রিকোয়েস্ট করে গেছেন সবাই যেন অবশ্যই বিয়েতে আসে । গাজীপুরের রিসোর্টে চার দিনের প্রোগ্রাম । তাবাসসুম’রা তিন বোন পরিবারসহ যাবেন ঠিক করেছেন । জারা কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিল না । তাবাসসুম কায়সারকে বললেন –

অনেক দিন পর সবাই একসাথে দারুণ আনন্দ হতো । সব আত্মীয়স্বজন আসবে বিয়েতে ।

ঠিক আছে জারা যখন যাবে না তাহলে আমি ওর সাথে থাকি, তোমরা সবাই যাও ।

তুমি না গেলে আমি একা যেয়ে কী করবো ? প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে দেই তাহলে । আপা’রা যাক আর রোজা ওর শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে যাক ।

ঠিক আছে ।

শুধুমাত্র তার কারণে মা’র যাওয়া হচ্ছে না তাই বাধ্য হয়ে জারাকে রাজি হতেই হলো ।

.
.

রিসোর্টটা সত্যিই অনেক বেশি সুন্দর । সব বয়সীদের কথা মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে বিশাল বড় রিসোর্টটা । অনেক দিন পরে সবাই মিলে একসাথে হওয়ায় তাবাসসুমের মনটা ভালো লাগছে ভীষণ । সমবয়সী কাজিনদের সাথে আড্ডা জমে উঠলো তাঁদের তিন বোন আর স্বামীদের । চমৎকার সব রাইড দিয়ে একটা কর্ণার সাজানো আছে । ছোটোদের সাথে বড়রাও ভীড় করেছে সেখানে ।

রোজা অফিস ছুটি নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে চলে এসেছে । সিয়াম আসবে বিয়ের দিন । রোজার শাশুড়ি আড্ডায় সামিল হয়ে গেলেন আর শ্বশুর হেঁটে হেঁটে রিসোর্টটা দেখছেন । জারা সারাক্ষণ বোনের সাথে সাথে আছে । জাফরিন আর সানজিদাও আছে ওদের সাথে । দোলনা দেখেই সানজিদা আর জাফরিন বাচ্চাদের মতো দৌড়ে যেয়ে দোলনায় বসলো । জারা খুব মজা পেল দু’টোর কান্ড দেখে ।

রোজা জিজ্ঞেস করলো –

তোমার ক্লাস কেমন চলছে ?

ভালো আপু ।

যে ভার্সিটিগুলোতে অ্যাপ্লাই করেছিলে সেগুলোর একটাতেও হলো না ?

না হলো না তো ।

এখন কী করবে, শাফিনের সাথে কথা বলেছো ?

হুম, ভাইয়া বললো এখন আর অন্য কোথাও না যেয়ে এখানেই পড়া শেষ করতে । মাস্টার্সের জন্য আবার চেষ্টা করতে ।

তাহলে সেটাই করো । আমার মনে হয় এটাই ভালো হবে ।

আপু ভার্সিটিতে যেতে আমার আর ভালো লাগছে না ।

কেন কেউ কিছু বলেছে তোমাকে ?

জারা চুপ করে থাকলো, কোনো উত্তর দিলো না ।

কী হলো বলো ?

বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করা শুরু করেছে, খারাপ কথা বলছে ।

এটাকে আটকানো যাবে না জারা । তাও ভালো যে তুমি ঐ ছেলের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছো । সময়মতো তুমি যদি ওর বিষয়টা না জানতে অথবা ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে ফেলতো তাহলে সেটা আরো ভয়াবহ হতো । সাদাতের কাছে ওর ফ্যামিলির কথা শুনে আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছি । তুমি কেমন করে থাকতে ঐ পরিবেশে ? ছেলেটা তো ছোটোবেলা থেকেই খারাপ ।

ভাইয়া কী করে জানলো ওর ফ্যামিলির কথা ?

সাদাত তো ওর সাথে স্কুলে পড়তো, তোমাকে বলেনি ?

না তো !

তুমি এতোদিন খালার বাসায় ছিলে তবুও সাদাত তোমাকে বলেনি ? অবশ্য এইরকম মানুষদের দিয়ে আলোচনা না করাই ভালো । তুমি শুকরিয়া করো যে ভয়াবহ এক বিপদ থেকে আল্লাহ্ তোমাকে রক্ষা করেছেন । এগুলো নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না । বন্ধুরা কী বলছে সেটা নিয়ে মন খারাপ কোরো না । জাস্ট ইগনোর করে যাও । মানুষ কথা বলবেই, বলতে বলতে একসময় থেমে যাবে ।

সাদাত রফিকের পরিচিত এটা জানার পর থেকে জারা’র মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে ।…………….…………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here